ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ইরানের হাফিজ, ব্যাটা ছিল মহা কিপ্টে!

আহ্সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৬ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১১
ইরানের হাফিজ, ব্যাটা ছিল মহা কিপ্টে!

‘খরতাপে পুড়েছি বৃষ্টিতে ভিজেছি, তোমাকে দেখার আশায়, তোমাকে দেখার..’ বাংলা একটি গানের কথা এগুলো। পুরো গান জুড়ে গীতিকার প্রিয়াদর্শনে পাগল প্রেমিকের নানান কসরৎ আর পাগলামির ফিরিস্তি দিয়েছেন।

সাধারণ দৃষ্টিতে এর অধিকাংশই উম্মাদনার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের তো ভুলে গেলে চলবে না লালনের সেই অমোঘ বাণী ‘প্রেম যে করে সে জানে...’

আর লাইলী প্রেমে অন্ধ মজনুর (আসল নাম কায়েস) কাহিনী তো সবাই জানি। সেই যে, দীর্ঘদিনের অদেখায় প্রিয়া বিরহে কাতর কয়েস ‘লাইলী লাইলী’ বলে বনে বাদারে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ফিরছিল। এ অবস্থায় একদিন লাইলীর পোষা কুকুরের দেখা পায় মজনু। আর যায় কোথা, তাকেই জড়িয়ে ধরলো প্রেমিক শ্রেষ্ঠ কায়েস। এখানেই শেষ নয়, এক পর্যায়ে প্রেমান্ধ কয়েস পরম যত্ন আর ভালোবাসায় ওই সারমেয়র পদ চুম্বন করতে লাগলো।

আশপাশের সবাই হায় হায় করে উঠলো। আরে, আরে, পাগল করে কি!

কিন্তু মজনুর ব্যাখ্যা সহজ ---এই কুকুর লাইলীর। স্বাভাবিকভাবেই তার হাতের ছোঁয়া পেয়েছে সে। সুতরাং তাকে চুমু খাওয়া আর লাইলীর স্পর্শকে বা লাইলীকে চুমু খাওয়া একই কথা!

কারো প্রেমে জগত ভুলে যাওয়া পাগলে পরিণত হওয়ার পরেও কেউ এ ধরনের ব্যাখ্যা দিতে পারে- ভেবে অবাক মানতে হয়।

যাহোক গল্প কথা, সত্য হতে পারে আবার নাও পারে। কথা হচ্ছিল প্রেমিকার সন্দর্শন লাভে প্রেমিকের নানান ফন্দি ফিকির নিয়ে। এক্ষেত্রে এক উর্দু কবির কাণ্ড দেখুন, তিনি তার এই শেরে বলছেন

‘খুদা কারে হাসিনুকা বাপ মার যায়ে
বাহানা মউত হাম উসকি ঘার যায়ে। ’

অর্থাৎ
খোদা করুক ওই সুন্দরীর বাপ
যেন মারা যায় আজকেই,
লাশ দেখতে যাওয়ার উসিলায়,
আমি দেখে আসবো তাকেই।

বুঝুন অবস্থা, প্রিয়াকে এক নজর দেখার বিনিময়ে, প্রয়োজনে কবি তার হবু শ্বশুরের মৃত্যু কামনাতেও পিছ পা হননি। এ কাব্যকণিকা শোনার পর অনেক বাবাই তাদের হবু জামাইদের (কন্যার প্রেমিকদের) বিষয়ে আতংকিত হয়ে পড়তে পারেন।

hafez-smঅপরদিকে, ফার্সী কবি হাফিজ তো প্রিয়ার গালের তিলের জন্য বোখারা সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এ নিয়েও আছে আরেক গল্প। কাহিনী মোতাবেক, হাফিজের এই কবিতার কথা জনৈক মোসাহেব তৈমুর লংকে (কারো কারো মতে হালাকু খানকে) জানিয়ে অভিযোগের ছলে যা বলেন তা ছিল এরকম, ‘বাদশাহ নামদার! এত শৌর্য-বীর্য-বাহাদুরি, বেশুমার লোকবল আর অর্থ ব্যয়ে অভিযান চালিয়ে আপনি একের পর এক দেশ জয় করেন, আর হাফিজ কী না সেসব কোথাকার কোন নারীর গণ্ডদেশের তুচ্ছাতিতুচ্ছ এক তিলের বিনিময়ে অকাতরে বিলিয়ে দিতে চাচ্ছেন!

মধ্যযুগের নরপতি বলে কথা! বুশ-সাদ্দাম আর নেতানিয়াহুর চেয়ে তাদের মেজাজ শতগুণে বারুদভরা ছিল। হাফিজের ‘পরের ধনে পোদ্দারি ধরতে পেরে’ সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলেন বাদশাহ।

দরবারে তলব পড়লো যুগশ্রেষ্ঠ কবির। হাফিজ তখন বয়োবৃদ্ধ প্রায়। বাদশার উদ্ধত কণ্ঠে সওয়াল, মাননীয় কবি, এসব কী শুনছি! আপনি নাকি কোন নারীর গালের স্রেফ একটি তিলের বিনিময়ে আমার সাম্রাজ্যের অহংকার বোখারা-সমরখন্দ বিলিয়ে...

এ ধরনের উটকো আর বেরসিক জেরার মুখে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বিনয়াবনত হাফিজ বললেন, আপনি ঠিকই শুনেছেন, ধর্মাবতার। আমি আজকাল কিছুটা বেহিসেবি’ই হয়ে পড়েছি। আত্মমগ্ন কবির অসংকোচ আর বুদ্ধিদীপ্ত জবাবে বাদশাহ লা-জওবাব। এতক্ষণে অবশ্য তার হঠাৎ চড়ে যাওয়া মেজাজটাও পড়ে এসেছে, স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করতে শুরু করেছে। এমন হিসেবী অথচ নির্ভীক জবাবে মুগ্ধ বাদশাহ সহসাই জড়িয়ে ধরলেন হাফিজকে।

উপরের ঘটনাটার অথেনটিসিটি সম্পর্কে এ মুহূর্তে কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। তাই এটিও শোনা কথা বলে চালিয়ে দিতে হচ্ছে। কি? রেগে গেলেন! আপনাদের রাগ ভাঙাতে এখানে হাফিজের ‘প্রিয়ার গালের তিল’কে ধারণ করে আমার লেখা একটি নাচিজ শের পেশ করছি। আপনার প্রিয়ার পদতলে এটি নিবেদন করে দেখুন, সাফল্য আসতেও পারে।

তোমার ওই কালো তিলের কৃষ্ণগহ্বরে
বোখারা-সমরখন্দ তুচ্ছ নিশ্চয়!
ইরানের হাফিজ, ব্যাটা ছিল মহা কিপ্টে!
আমি হলে দিতাম, ‘বিশ্বের পুরোটাই। ’

বাংলাদেশ সময় ১২৫১, জুলাই ০৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।