ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মুন্নীর সাথে ২৭ বছর | সরকার আমিন

সবিশেষ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৬
মুন্নীর সাথে ২৭ বছর | সরকার আমিন

জ শাহনাজ মুন্নীর জন্ম‘দিন’।   শুভ জন্মদিন মুন্নী।

  মুন্নী সম্পর্কে কিছু কথা লিখতে ইচ্ছা করছে।

গত ২৭ বছর ধরে আমি শাহনাজ মুন্নীর সাথে আছি। এক ছাদের তলে ১৯৯৪ থেকে; ২২ বছর; আজিমপুরের কবরস্থানের দেয়াল লাগোয়া একটা একরুমের স্টুডিও টাইপের বাসায় শুরু হয়েছিল দাম্পত্য। জানালা দিয়ে গোরখননের শব্দ পাওয়া যেত। সবজি কিনতে নিচে নামলে লাশের দেখা মিলত। কিন্ত আমরা জীবন্ত ছিলাম; সর্বক্ষণ!

১৯৮৯ এর এক বিষণ্ন বিকালে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে সহপাঠী বন্ধুদের সাথে আড্ডারত ছিলাম।

পাশে বসা ছিল প্রিয় সহপাঠী মিহির মুসাকী, লিয়াকত জুয়েলসহ আরো অনেকে।

মুন্নী আসলো আমাদের কাছে।

পরিচয় দিল। বলল, সে পড়ে সোসিওলজিতে। আমাদের কথা এক বন্ধুর কাছে শুনেছে। আমরা কবিতা করি। সেও আমাদের দলে যোগ দিতে চায়, পরিচিত হতে চায়।

আমি তখন থায়রয়েডজনিত কারণে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছি।

কঠিনতম ডিপ্রেশন।

সবার সাথে আড্ডা দিই, আড্ডায় আছি আবার নাই-ও।

আত্মহত্যা তাড়াতে কবিতা লিখি —‘আত্মহত্যার বদলে এক কাপ চা খাও’।

মুন্নীকে দেখে চমকে উঠলাম।

সহজ এক নারী । সহজ চাহনি। সহজ জামা কাপড়। সহজ অভিব্যক্তি। মন বলল—আরে একেই তো আমার প্রয়োজন।

আমি চিনির মতো মনে মনে গলে গেলাম।

হৃদয় সাবানের মতো গলে যেতে লাগল।

আমি ওকে বললাম, ‘নাইস। আসো একদিন বাংলা বিভাগে।

আমরা দেয়াল পত্রিকা করি। লেখা দিয়ো। ’

মুন্নী সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে একদিন আসলো বাংলা বিভাগে। কিন্ত আমি নাকি ওকে দেখতে পাই নি। মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে গেল সে। আমাদের সম্পর্কের শুরুতে ‘একটু বাংলা সিনেমা’ হয়ে গেল। পরে মুন্নীর এক বান্ধবী নীলু; যে আমার সহপাঠী; এসে আমাকে বকা দিল—‘আমিন এটা একটা কাজ করলা!’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম।

মনে মনে যার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে আছি তাকে কি না দেখিনি আমি! অভিমানী মাইন্ডকরা মুন্নী আরেক দিন আসলো দয়া করে; দেখা করতে। বললাম, বিশ্বাস করো, দেখিনি তোমায়। সরলা মুন্নী কথাটা বিশ্বাস করল। আর বিশ্বাসের সূত্র ধরে আমাদের বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো।

আমার বিষণ্ণতা তবু যায় না।

মুন্নী আমাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, সাথের মেয়েটা কী হয়? বলি—বন্ধু। ডাক্তার বলেন, এমন একজন বন্ধু যার আছে তার বিষণ্নতা হয়?

থায়রয়েড সমস্যা তখনো ধরা পড়ে নি। কিন্ত ডিপ্রেশনে আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না। ডুবন্ত মানুষ যেমন আকড়ে ধরে কলার ভেলা; তেমন করেই আকড়ে ধরলাম কবিতা; গান আর মুন্নীকে। সারাক্ষণ অপেক্ষা কবিতা, গান আর মুন্নীর জন্য। আমার ক্যাম্পাস কবিতা আর মুন্নীময়। হাঁটি একসাথে, খাই একসাথে; ঘাসের ওপর ঘুমিয়ে পড়ি নজরুলের সমাধির পাশে। পাহারায় থাকে মুন্নী। এন্টিডিপ্রেশন ওষুধের প্রভাব। একদিন অঝোরে ঘুমাচ্ছি ঘাসে। মুন্নী বোধ করি খাবার আনতে গেছে। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি অসংখ্য লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে যেমনটা মাছ বাজারে ঘটে। লোকজন সন্দেহ করছিল আমি আদৌ বেঁচে আছি কি না। হঠাৎ চোখ মেলে দেখি কয়েকডজন মুখ উঁকি দিয়ে রয়েছে ঘুমন্ত আমার দিকে। আমার জেগে ওঠায় স্বস্তি পেল সবাই।

মুন্নী একজন দয়ালু নার্সের মতো আমাকে ঘিরে রাখতে শুরু করল। মুন্নী সন্ধ্যার আগে গুলশানের দিকে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে চলে যায়, আমি ওকে বাসে উঠিয়ে ভাবতে থাকি কোথায় যাব আমি? জহুরুল হক হলের দিকে পা বাড়াই। পরের দিন খুব সকালের বাসে চলে আসে মুন্নী। ভিসির বাড়ির সড়ক ধরে ঘনকুয়াশায় হাঁটি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের দিকে এগুই। এক অনন্ত কুহকময় ভোর। আমরা হাঁটি। কখনো নিশ্চুপ, কখনো প্রগলভ।

একদিন মুন্নীকে বললাম, ‘তোমার সাথে আমার খুব জরুরি কথা আছে। ওঠো রিকশায়। ’

মুন্নী অবাক জরুরি কখা বলার জন্য রিকশা কেন?

বললাম—‘কথা বলো না। ওঠো রিকশায়। ’

রিকশা চলতে শুরু করলো পুরাতন ঢাকার দিকে।

লালবাগের কেল্লায় প্রবেশ করলাম টিকেট কেটে।

দাঁড়ালাম পুকুরের পাড়ে।

জলে ভরা পুকুরটায় কিছু শাপলা, কিছুটা অস্পষ্ট ঢেউ।

মুন্নী হতবাক। রিকশায় উঠে একটা কথাও বলিনি।

এবার মুন্নীর চোখের দিকে তাকিয়ে সহজভাবে বললাম, আমার একটা কথা জানার আছে। এই; তুমি কি আমার সাথে একটা জীবন কাটাবা?

টেনশনাস মুন্নী খুব সহজ করে উচ্চারণ করল “হা”।

আমি বললাম, ‘ওকে। কথা শেষ। চলো ক্যাম্পাসে ফিরে যাই। ’

সেই থেকে একসাথে আছি। প্রায় ২৭ বছর। এই ২৭ বছরে আমাদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ হয়েছে। অধিকাংশ সময় আমি চেঁচামেচি করি। মুন্নী থাকে শান্ত। যেন অপেক্ষা করে কখন আমার চেঁচামেচি থামবে; আর আমি নিরন্তর ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকব অযথা চেঁচামেচির জন্য। তারপর মিষ্টি হেসে মাফ করে দেবে আমাকে। আমি ক্ষতিপূরণ করতে ওকে নিয়ে বের হব কোনো অলৌকিক নভোযানে। ভাসাব অপার্থিব নৌযান।

আমাদের কোনো ঝগড়ায় বয়স তিনঘণ্টার বেশি পার হয় না কখনো। খুব সিলি বিষয় নিয়ে রাগ করি আমি। মুন্নী সাধারণত রাগে না, খালি মৌনব্রত পালন করে। ওর মৌনতা আমার কাছে রিম্যান্ডের মতোই ভয়াবহ। না, কোনো ‘তৃতীয় নারী বা পুরুষ’কে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোনো সমস্যা হয় নি। মুন্নী কোনো সন্দেহ করে নি কোনোদিন। করে না। এটা আমাদের দাম্পত্যের অন্যতম প্রধান ‘বিউটি’ বলে আমি মনে করি। আর আমি গোপনীয়তা রক্ষা করি, কোনো গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা না করে। ফেইসবুকে অনেক সদয় নারী আমাকে স্নেহশীল মেসেজ পাঠান। বেশি বিপদে পড়লে মুন্নীর পরামর্শ চাই। মুন্নী হাসে। বলে তোমার ভক্ত থাকতে পারে না আমিন? সহজ থাকো। আমিই মাঝে মাঝে হৃদয়হীন কাঠিন্য করে বসি অতিআগ্রহিনী কারো সাথে।

প্রতিদিন ছাদে আমরা রাতে ঘণ্টাখানেক হাঁটি। সারা দিনের সব জমানো কথা বলা হতে থাকে। মুন্নীকে যারা মিতভাষী হিসাবে জানেন তারা জেনে বিস্মিত হবেন যে সেই সময়টায় কত কথা যে বলে মুন্নী! মাঝে মাঝে অপরের ডায়লগ নকল করে। আমি হাসতে হাসতে মরি। প্রতিবেশিরা জানে পাশের ছাদে মধ্যরাতে হাঁটে দুটি উদ্ভট মানুষ। মানুষটার একজন হঠাৎ চিৎকার করে গেয়ে ওঠে তাৎক্ষণিক স্বরচিত কোনো গান।

মুন্নীকে বিয়ে করার সময় শর্ত তৈরি করেছিলাম, বিয়ে করেই বিয়েটা ভুলে যাব। নো ম্যারেজ ডে; টে। আমরা থেকে যাব অবিবাহের দম্পতি।

যৌথ ও যুক্তকে নিয়ে আমাদের দাম্পত্য বাগান।

 কোনো ছেলে নাই বলে দুঃখ নাই।
 

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।