ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তূর্ণার নীল ছিল ভীষণ প্রিয় | মাহতাব হোসেন

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
তূর্ণার নীল ছিল ভীষণ প্রিয় | মাহতাব হোসেন

মি জানি তূর্ণার নীল ছিল ভীষণ প্রিয়। প্রিয় অনেক কিছুই ছিল—যেমন হাত ভরতি সবুজ রিনিঝিনি চুড়ি।

সেই যে বৃষ্টির দিনে প্রথম দেখা। একটা ছোট্ট দোলনা অথবা কাঠ পাতানো বসার জায়গায় ভিজে ভিজে কানের কাছে ঠোঁট। কানে লেগে থাকা সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত, আর পাতায় মিলিয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানির সাথে ঘুঁচে গিয়েছিল একাকিত্ব।

সেদিন বৃষ্টি হবার কোনো কারণ ছিল না। সেই বৃষ্টিই হয়ত মেয়েটাকে দীপ্ত’র কাছে অনিন্দ্য রূপবতী করে তুলেছিল। হৃদয়ে এক অদম্য ইচ্ছে জাগে নিজেকে সমতায় নিয়ে আসার। নিজে এগিয়ে যাওয়ার কিংবা যুগান্তর আগলে রাখার কর্মযজ্ঞ। কেননা তূর্ণার নীল ছিল ভীষণ প্রিয়, আর হাতভর্তি সবুজ চুড়ি। এসবেই দীপ্ত নিজেকে হারায়। তখন দীপ্ত’র জীবনের সদ্য শুরু। চাকরিজীবন। নিজেকে একটা অবস্থানে দাঁড় করানোর সময়। দীপ্ত তূর্নার যে বিষয়টাতে অতিমুগ্ধ—এই মেয়ে এত অল্পতেই সন্তুষ্ট! তারপর... তারপর একযুগ। জাগতিক নিয়মে একযুগ না হলেও দীপ্ত’র মনের দিনপঞ্জিতে একযুগ। এক যুগ পরে দেখা হওয়া মাত্রই—



এই মেয়ের জন্য দীপ্ত আয়োজন করতে থাকে সুবিশাল ‘নীলের’। নীলচে আলোর বিচিত্র এক পৃথিবীর। নীলে নীলে মুগ্ধ হবে তূর্ণা। প্রচণ্ড বাতাসে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে সবুজ চুড়িগুলো দীপ্ত’র হাতে লাগিয়ে রিনিঝিনি শব্দ করবে। কানের কাছে ঠোঁট। দূরের আকাশ কাছে নেমে আসবে, সমুদ্রের নীল ও আকাশের নীলের কম্বিনেশনে মুগ্ধ হবে। এরপর?



‘এবার বৈশাখিতে আমায় কী কিনে দেবে?’
‘একটা টাঙ্গাইলের শাড়ি। আমি তো বুঝি না। আমি থাকব তুমি কিনে নেবে?’
‘উঁহু’
‘তাহলে?’
‘একটা নীলচে পৃথীবী’
‘ওয়াও, ঠিক আছে তাহলে। তোমার জন্য তৈরি হবে নীলচে পৃথিবী’

এই মেয়ের জন্য দীপ্ত আয়োজন করতে থাকে সুবিশাল ‘নীলের’। নীলচে আলোর বিচিত্র এক পৃথিবীর। নীলে নীলে মুগ্ধ হবে তূর্ণা। প্রচণ্ড বাতাসে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে সবুজ চুড়িগুলো দীপ্ত’র হাতে লাগিয়ে রিনিঝিনি শব্দ করবে। কানের কাছে ঠোঁট। দূরের আকাশ কাছে নেমে আসবে, সমুদ্রের নীল ও আকাশের নীলের কম্বিনেশনে মুগ্ধ হবে। এরপর? এরপর আরো কত বাকি। পথ ভুলে যাওয়ার বিকেল শেষে ডাকবাংলোর ছাদে রাত নেমে আসবে। চাঁদ ডুবে যাওয়া রাতে নক্ষত্ররা নেমে আসবে কাছে, নক্ষত্রের নীলে নিজের মুখ অন্ধকারে হারিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়বে বনে জঙ্গলে, কলকলে বয়ে যাওয়া পাথুরে নদীতে।
‘বৈশাখ চলে আসছে তো’
‘হুম জানি তূর্ণা’
‘কোথায় তোমার নীলচে পৃথিবী’
‘একটু কি সময় দেবে না?’
‘হুম, ডান। কিন্তু আমার নীল চাই’

এই আয়োজনে দীপ্ত’র সময় লাগে। সময় লাগে নিজের চাকরির ভিত শক্ত করতে। সময় লাগে থিতু হতে। আরো কত কাজ, সময় তো লাগবেই। সারাদিন কাজ আর ব্যস্ততায় তূর্ণা আশাহত হয়। কাজ শেষে বাসায় টেনে নিয়ে আসা একজনের ক্লান্ত শরীর, আর একজনের সারাদিনের অপেক্ষা। তূর্ণার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়। হতাশা বাড়ে... দীপ্ত’র আয়োজন শতকাজের মাঝেও মাথায় থাকে। বুকে জমে থাকা জলাবদ্ধতার মতো ভালোবাসা অপ্রকাশ্যই থাকে। কী দরকার? সময় তো চলে যায় নি। কাজের চাপ-ক্লান্তি-তিঁতকুটে মন বিপরীত দিকে কষ্ট বাড়ায়। হতাশা বাড়ায়।

তূর্ণাদের জন্য সমবেদনার হাতের অভাব কখনো থাকে না। সরি সমবেদনা কেন হবে? তূর্ণাদের পেছনে সিরিয়াল দিয়ে থাকে পাড়ার ছেলেরা। আমাকে বলতে হবে তূর্ণার পাণিপ্রার্থীদের কখনো অভাব হয় না। সময় চলে যায়। দুঃশ্চিন্তা জমা হয়। কতশত ভাবনা আসে। পাড়ার, এলাকার এইসব নির্ভরতার অজস্র হাত যখন আশেপাশে কিলবিল করে, তখন তূর্ণার চোখের সামনে ভাসে দীপ্ত’র নেতিবাচক বিষয়গুলো। আর কত স্যাক্রিফাইস? সুদীর্ঘকালের মমত্ববোধ, ভালোবাসা মাখা সময়গুলো গোধূলিতে হারায়। দীপ্ত’র অজান্তেই এইরকম একটা নির্ভরতার হাতে হাত রাখে তূর্ণা। দীপ্ত কিছুই জানে না। জানতে পারে না। এই অমানবিক শহরে পা রাখার জায়গাটা শক্ত করাই দীপ্ত’র মৌলিক কাজ। সেই ভাবনাই কি সত্য হয়ে যায়।

বৈশাখের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে তূর্ণার সাথে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আঙুলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কথা হয়। আঙুলগুলোতেও কি আজ ছন্দ নেই? আমি ভাবছি এলোমেলো কত কথা। কত দুঃষহ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে সামনের বাড়িটাতে। একটি দেশের জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যার সাক্ষী এই বাড়ি। সত্তর-একাত্তরের একখণ্ড বাংলাদেশ। কত কত বিশাল মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়ির সাথে।
‘তুমি আমাকে সময় দিতে পারছো না, বুঝতে পারছো?’
‘হয়ত, তবে ইচ্ছে করে নয়, একটু সময় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে’
‘আমি তো অপেক্ষা করতে পারি না দীপ্ত’
‘একটু অপেক্ষা করো তূর্ণা, তোমার জন্য নীলচে পৃথিবী’
‘শোনো, একটু বাস্তবতায় ফেরা দরকার। আমি সামনের মাসেই ব্রুকলিন চলে যাচ্ছি’
‘মানে?’
‘জানোই তো, বড় আপু থাকে ওখানে, ওর সাথেই আপাতত থাকব। তারপরে ভার্সিটির ভর্তির বিষয়’

দীপ্ত’র হাতের তালু থেকে তূর্ণার আঙুল সরে যায়। ধানমন্ডির এই সন্ধ্যা এক অদ্ভুত সন্ধ্যা। চারিদিকে হইচই। এত মানুষ। কানের কাছে হকারের হাকডাক। পার্কে আসা বাচ্চাদের ঘ্যানর ঘ্যানর। এসবই অদ্ভুত করে তোলে পরিবেশকে। তারপরেও খারাপ লাগে না।

দীপ্ত একদিন মানিক মিয়া এভিনিউয়ের মতো বড় রাস্তায় সন্ধ্যায় হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরতে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল এভিনিউ নীল শূন্য, সবুজ বৃক্ষ কিংবা হাত ভরতি সবুজ চুড়িও ধূসর হয়ে গেছে। মাথার উপর দিয়ে একটা ধূসর কাক কর্কশ শব্দে উড়ে যায়।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০১৬
টিকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।