ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

অভিধানের আপন ও পর | সোহেল হাসান গালিব

বিশেষ রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬
অভিধানের আপন ও পর | সোহেল হাসান গালিব

‘সবুজ পত্র’ পত্রিকায় গত শতকের দ্বিতীয় দশকে যে ভাষা-আন্দোলনের সূচনা প্রমথ চৌধুরীর হাতে, নিজের রচনায় ষোল আনা এস্তেমাল করার আগেই তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন ‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধটি।

সেখানে তিনি বলছেন :

“যখন বঙ্গবিভাগের বিভীষিকায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়াছিল তখন আমাদের ভয়ের একটা প্রধান কারণ ছিল এই যে এটা রাজনৈতিক ভূগোলের ভাগ নয়, ভাষার ভাগকে আশ্রয় করিয়া বাংলার পূর্ব-পশ্চিমে একটা চিত্তের ভাগ হইবে। সমস্ত বাংলাদেশের একমাত্র রাজধানী থাকাতে সেইখানে সমস্ত বাংলাদেশের একটি সাধারণ ভাষা আপনি জাগিয়া উঠিতেছিল। তাহা ফরমাশে গড়া কৃত্রিম ভাষা নহে, তাহা জীবনের সংঘাতে প্রাণলাভ করিয়া সেই প্রাণের নিয়মেই বাড়িতেছে। আমাদের পাকযন্ত্রে নানা খাদ্য আসিয়া রক্ত তৈরি হয়, তাহাকে বিশেষ করিয়া পাকযন্ত্রের রক্ত বলিয়া নিন্দা করা চলে না, তাহা সমস্ত দেহের রক্ত। রাজধানী জিনিসটা স্বভাবতই দেশের পাকযন্ত্র। এইখানে নানা ভাব, নানা বাণী এবং নানা শক্তির পরিপাক ঘটিতে থাকে এবং এই উপায়ে সমস্ত দেশ প্রাণ পায় ও ঐক্য পায়। রাগ করিয়া এবং ঈর্ষা করিয়া যদি বলি প্রত্যেক প্রদেশ আপন স্বতন্ত্র পাকযন্ত্র বহন করুক তবে আমাদের হাত-পা বুক-পিঠ বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া বলিতে পারে আমাদের নিজের নিজের একটা করিয়া পাকযন্ত্র চাই। কিন্তু যতই রাগ করি আর তর্ক করি, সত্যের কাছে হার মানিতেই হয় এবং সেইজন্যই সংস্কৃত বাংলা আপনার খোলস ভাঙিয়া যে-ছাঁদে ক্রমশ প্রাকৃত বাংলার রূপ ধরিয়া উঠিতেছে সে-ছাঁদ ঢাকা বা বীরভূমের নয়। তার কারণ নানা প্রদেশের বাঙালি শিখিতে, আয় করিতে, ব্যয় করিতে, আমোদ করিতে, কাজ করিতে অনেক কাল হইতে কলিকাতায় আসিয়া জমা হইতেছে। তাহাদের সকলের সম্মিলনে যে এক-ভাষা গড়িয়া উঠিল তাহা ধীরে ধীরে বাংলার সমস্ত প্রদেশে ছড়াইয়া পড়িতেছে। এই উপায়ে, অন্য দেশে যেমন ঘটিয়াছে, তেমনি এখানেও একটি বিশেষ ভাষা বাংলাদেশের সমস্ত ভদ্রঘরের ভাষা হইয়া উঠিতেছে। ইহা কল্যাণের লক্ষণ। অবশ্য স্বভাবতই এই ভাষার ভূমিকা দক্ষিণ বাংলার ভাষায়। এইটুকু নম্রভাবে স্বীকার করিয়া না লওয়া সদ্-বিবেচনার কাজ নহে। ঢাকাতেই যদি সমস্ত বাংলার রাজধানী হইত তবে এতদিনে নিশ্চয়ই ঢাকার লোকভাষার উপর আমাদের সাধারণ ভাষার পত্তন হইত এবং তা লইয়া দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা যদি মুখ বাঁকা করিত তবে সে বক্রতা আপনিই সিধা হইয়া যাইত, মানভঞ্জনের জন্য অধিক সাধাসাধি করিতে হইত না। ”



..মজহাব, মুসল্লি, মস্তাহাব, মাগরেব, মিলাদ, মোনাজাত, মোনাফেক, মোহাদ্দেস, রাহেলিল্লা, রুকু, রোকন, লানৎ, লিল্লা, শবে কদর, শাফায়াত, শিরক, সালাত, সুবহানাল্লা, সেহেরি, সোয়াব, হাশর, হেদায়েত, হেফ্জ : এগুলো ধর্মীয় পরিভাষা। এসব আমাদের গল্পে-গানে-কথায় এমনভাবে উঠে এসেছে, এদের সাহিত্যিক মূল্যও তৈরি হয়ে গেছে এতদিনে। সাহিত্যের কথা বাদ দিলাম, কোনো মুসলমানের পক্ষে তার প্রাত্যহিকতায় শব্দগুলি এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। এরা ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ঠাঁই পেলেও সংসদ বাংলা অভিধানে আজও অপাঙক্তেয়



নিজের মুখে যাতে বেশি কথা বলতে না হয়, সেজন্যে বড় একটা উদ্ধৃতি-অংশই গ্রহণ করলাম। এখন আর আমার মুখ ফুটে বলার দরকার নেই যে, ঢাকা যেহেতু স্বাধীন বঙ্গদেশের রাজধানী, সেহেতু নতুন একটি ‘মানভাষা’ গড়ে উঠবার পাঁয়তারা ইতিহাসের নিজস্ব নিয়মেই এখানে চলবে, চলতে থাকবে। অন্তত রবীন্দ্রভাষ্য তাই বলে। সেক্ষেত্রে বাধাটা কোথায়? একশ’ বছর আগে চলিত/প্রাকৃত ভাষা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা ছিল সংস্কৃত। আর আজকের দিনে, আমাদের বাংলাদেশে, বাই ডিফল্ট, নতুন একটি ভাষা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা ঐ একশ’ বছরের চলিত ভাষাটাই। মানে প্রমথ—ও রবীন্দ্র-লালিত ভাষা। বাধা কিন্তু প্রমথ বা রবীন্দ্র স্বয়ং নন, বরং তাদের রচনা আমাদের মধ্যে ইমানি তাকত যোগায় মানুষের মুখের ভাষার দিকে কেবলা ঠিক করে নিতে।

কিন্তু কেন? কেন নতুন একটি ভাষার আদল গড়ে ওঠা জরুরি বলে মনে হয়? কিংবা আশলেই কি জরুরি? ক্রিয়াপদ আর সর্বনামের ক্ষেত্র ছাড়া ডমিন্যান্ট ঢাকাই বুলি চলিত বাংলার সঙ্গে কতটুকু ফারাক করে? নাকি দুই বাংলার ইতিহাস-ঐহিত্য এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে যে, তার আছর পড়ে বদলে যাচ্ছে ভাষার খোলনলচে? আমরা এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে যাব না। বঙ্গবিচ্ছেদের বেদনায় কোনো সাম্প্রদায়িকতার হদিসও নেব না। তবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেশ বড় একটা ব্যবধান যে তৈরি হয়েছে দুই ভূগোলের মানুষের মনে অর্থাৎ বাংলার পূর্ব-পশ্চিমে প্রকৃতঅর্থেই ‘চিত্তের ভাগ’ যে ঘটেছে এবং একশ’ বছরেও তাতে মেলাবার প্রয়াস যে দেখা যায় নি, সেই দুঃখের দলিল অস্বীকার করি কেমন করে? এই দলিল ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসবে কার দায় কতটুকু এবং কোনখানে।

খুব ছোট এবং পরিচিত পরিসরেই একটি জরিপ আমরা চালাব। দুই বাংলার প্রতিনিধিত্বশীল দুটি অভিধানের মধ্যেই আমরা চেষ্টা করব দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে।

২.
অভিধান বা শব্দকোষ অনেক রকম হতে পারে। আমরা মূলত শব্দার্থ ও শব্দোৎস অনুসন্ধানের জন্য বেছে নিয়েছি দুটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধান। গুরুত্বপূর্ণ বলছি এ কারণে যে, এ দুটি বই-ই বেশি পাঠকের হাতে পড়ে ধন্য। এর একটি ঢাকাই, অন্যটি কোলকাত্তাই। ঢাকার অভিধানের নাম ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’, আর কোলকাতারটি ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ (পূর্বনাম ‘সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধান’)।

নামেই চরিত্রের কিছু আভাস আছে। কোলকাতার ওই কিতাবটির নাম ছিল বেশ রাশভারি—প্রথম দুটি শব্দই, কি বলায় কি লেখায়, আজ আর দেখা যায় না। প্রথমত, ‘সংসদ’ বানানে হসন্ত উৎখাত হয়েছে অনেক আগেই। দ্বিতীয়ত ‘বাঙ্গালা’ শব্দটি ‘বাংলা’ হয়েছে সেই কবে, যেদিন প্রমত্তা পদ্মাকে দেখে মানিক বন্দ্যোপাধায় লিখেছিলেন—‘পদ্মা তো কখনো শুকায় না। ...গতিশীল জলতলে পদ্মার মাটির বুক কেহ কোনোদিন দেখে নাই, চিরকাল গোপন হইয়া আছে’—তারও কিছুকাল আগে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, সেই যখন তিস্তার জলে বাঙাল ও বাঙালির রিশতা অটুট ছিল, তার প্রায় অর্ধশত বছর আগে। যা হোক, অভিধানটি আজ নিজের বাহ্যিক রূপটা অন্তত পাল্টে নিয়েছে।

তবু অনুমান তো করাই যায়, কোলকাতার অভিধানটির মর্মে আছে প্রাচীনতা, অপ্রচলতা এবং প্রাকৃত বাংলার প্রতি উপেক্ষা। এবং আরো একটি গুরুতর সমস্যা। সেটি হলো, বাঙালির প্রধান একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক চিহ্ন উদ্ধারে উদাসীনতা। বলছি মুসলমানি সংস্কৃতির কথা।

যেমন কিছু শব্দ:

আজরাইল, আজাজিল, আসর, আস্তাগফিরুল্লা, ইনশাল্লা, ইন্নালিল্লা, ইবলিশ, ইয়ানাফসি, এতেকাফ, এবাদত, এশা, ওয়াজ, গিবত, গোমরাহি, জাকাত, জোহর, তাহাজ্জুদ, দাফন, নফল, নসিহত, নাউজুবিল্লা, নাজায়েজ, নাফরমানি, ফেতরা, ফেরকা, বেদাতি, মকরুহ, মজহাব, মুসল্লি, মস্তাহাব, মাগরেব, মিলাদ, মোনাজাত, মোনাফেক, মোহাদ্দেস, রাহেলিল্লা, রুকু, রোকন, লানৎ, লিল্লা, শবে কদর, শাফায়াত, শিরক, সালাত, সুবহানাল্লা, সেহেরি, সোয়াব, হাশর, হেদায়েত, হেফ্জ।

এগুলো ধর্মীয় পরিভাষা। এসব আমাদের গল্পে-গানে-কথায় এমনভাবে উঠে এসেছে, এদের সাহিত্যিক মূল্যও তৈরি হয়ে গেছে এতদিনে। সাহিত্যের কথা বাদ দিলাম, কোনো মুসলমানের পক্ষে তার প্রাত্যহিকতায় শব্দগুলি এড়িয়ে যাওয়ার জো নেই। এরা ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ঠাঁই পেলেও সংসদ বাংলা অভিধানে আজও অপাঙক্তেয়।

ধর্মীয় পরিভাষা শুধু নয়, মুসলমানদের পারিবারিক সম্পর্কবাচক শব্দগুলিতেও গরবর আছে মনে হয়। উদাহরণত বলতে পারি, পূর্বের সংসদ্ ‘খালা’ (মাসি) শব্দের স্ত্রীরূপ লিখেছিল খালী। বর্তমানে এটি সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু জুড়ে দেয়া হয়েছে গোত্র পরিচয়। বলা হয়েছে ‘মুসলমানি’ শব্দ। কিন্তু ‘মাসি’ শব্দের পাশে লেখা হয় নি ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ। ‘ননাস’ (স্বামীর বড় বোন) শব্দটি তো খুঁজেই পেলাম না। খুঁজে পেলাম ‘মামদো ভূত’ মানে মুসলমান ভূত (!)। আছে ‘যবন’ ও ‘ম্লেচ্ছ’। অথচ ‘মালাউন’ নাই। যবন ও মালাউন শব্দের প্রায়োগিক অর্থ একই—বিধর্মী। মুসলমানরা হিন্দুদের মালাউন এবং হিন্দুরা মুসলমানদের যবন ঠাউরে থাকে। ব্যুৎপত্তি যাই হোক না, ব্যবহারের দিক থেকে শব্দদুটি গালিবিশেষ।

এখানে আমরা অসংস্কৃত (আরবি, ফারসি, ইংরেজি ও দেশি) শব্দের একটা ফর্দ তুলে দিচ্ছি, যাতে আশা করি সংসদ বাংলা অভিধানের ঊনতা ধরা পড়বে চট করে, তার মর্জিসমেত। জানিয়ে রাখা ভালো, বাছাইকৃত শব্দগুলি খুব সুপরিকল্পিত নয়, বলা চলে র‌্যান্ডম সিলেকশন বা চকিত চয়ন। যথা :

আকিক [আরবি] = মূল্যবান পাথর। (কালো আকিকের মতো নিকষ দরিয়ার বুক : ফররুখ আহমদ)
আকিকা [আরবি] = নবজাত শিশুর নামকরণ, চুল কামানো এবং সেই উপলক্ষে ছাগল প্রভৃতি জবাই করে উৎসব অনুষ্ঠান। (আসিল আকিকা উৎসবে প্রিয় বন্ধু স্বজন যত : কাজী নজরুল ইসলাম)
আজাব [আরবি] = শাস্তি, সাজা। (দোজখের আজাব হতে রেহাই কি চাও? : জসীম উদ্‌দীন)
আজিজি [আরবি, বাংলা প্রত্যয়ান্ত] = অনুনয়। (আজিজি করিনু তব না রাখিলা বাত : সৈয়দ হামজা)
আসর/আছর [আরবি] = প্রভাব, চিহ্ন।

ইজাফা [আরবি] = বেশি/অধিক। (তিন সন ইজাফা দিয়াছি রাজকরে : ঘনরাম চক্রবর্তী)
ইত্তেহাদ [আরবি] = ঐক্য/বন্ধুত্ব। (সব দরিয়াকে বাঁধবে তোমার ইত্তেহাদ : ফররুখ)
ইমতেহান/এমতেহান [আরবি] = পরীক্ষা। (এমতেহান লওয়ার সুযোগ কারো হয় নাই : মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন)
উফর-ফাঁফর [দেশি/তদ্ভব] = অস্থির। (উফর ফাঁফর চিত্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে: দৌলত উজির বাহরাম খান)
উম্মত [আরবি] = শিষ্য, অনুচর, জাতি। (নিখিল ব্যথিত উম্মত লাগি এখনো তোমার অশ্রু ঝরে : ইসমাইল হোসেন শিরাজী)
উম্মি [আরবি] = নিরক্ষর, অজ্ঞ। (আমরা উম্মি মানুষ; লেখাপড়াও জানি না : মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন)
উয়ারি, উয়ারী [দেশি] = বহির্বাটি (ঢেকা মারি কৈল নিয়া বাহির উয়ারী : শেখ ফয়জুল্লাহ), বৈঠকখানা (শীতল যে সিংহাসন শীতল উয়ারী : দৌলত উজির বাহরাম খান)।

এরেম [আরবি] = স্বর্গোদ্যান। (এরেম উদ্যানে যথা আনন্দে মাতিয়া : ইসমাইল হোসেন)

কহর [আরবি] = অভিশাপ, বিপদ, অত্যাচার। (শহরে কহর এত আপনি করিলা : ভারতচন্দ্র)

খানকা [আরবি] = পিরের আস্তানা, বৈঠকখানা। (পুরানো সেই খানকা এখন মলিন মুখে কাটায় দিন : গোলাম মোস্তফা)
খাসলত/খাসলতি [আরবি] = স্বভাব। (খাসলতি কিসে ধুবা : লালন)

গোমতল্লাশ [ফারসি+আরবি] = গুপ্ত জিনিশ খোঁজা। (আমরা এখানে গোমতল্লাস করিব : প্যারীচাঁদ)
গোরবত [আরবি] = দারিদ্র্য। (আমি গরিব কথায় দুনিয়াবী গোরবৎ বুঝাই নাই : আবুল মনসুর আহমদ)

চাশনাই [ফারসি] = লবণ, মরিচ, তেল, পেঁয়াজ দিয়ে চটকানো সিদ্ধ মাছের সঙ্গে ডাল, আলু, বেগুন বা অন্যান্য সবজির ভর্তা; চাটনি।

জারেজার/জারজার [ফারসি] = দরবিগলিত ধারায়। (কান্দে জারেজার)

তখল্লুস [আরবি] = কবিসাহিত্যিকের ছদ্মনাম। (কায়কোবাদ তাঁর তখল্লুস : সৈয়দ মুজতবা আলী)
তজদিগ, তযদিগ [আরবি] = সাক্ষ্য, প্রমাণ, যাচাই। (এ ব্যাপারে আমি আপনের নিজের তযদিগ চাই : আবুল মনসুর আহমদ।
তজল্লি, তাজাল্লি [আরবি] = আলো, জ্যোতি। (নূরের তাজাল্লি যেথা : ফররুখ আহমদ)
তফরা [আরবি] = তড়পানো, আছাড়-পিছাড়। (প্রলয়তুফানে জেলেডিঙ্গির তফরা খাওয়ার মতো : কালীপ্রসন্ন সিংহ]
তসল্লি [আরবি] = সান্ত্বনা, প্রবোধ। (কত সে ক্লান্ত বেদনা-দগ্ধ মুসাফির এরই মূলে বসিয়া পেয়েছে মা’র তসল্লি : নজরুল)
তহ [ফারসি] = খরচ, খাজনা। (আমি ত বাজারীদের তিন বৎসরের তহ মাফ করিয়া দিতেছি : গোপাল হালদার)
তাহজিব [আরবি] = ভব্যতা, ভদ্রতা।
তাহজিল/ তাহশিল [আরবি] = লাঞ্ছনা, শাস্তি, অসম্মান, অপমান। (না দিলে জওয়াব করিবে তাহশিল : সৈয়দ হামজা)
তৌফিক [আরবি] = সামর্থ্য, সম্পদ। (তৌফিক থাকলে রাজি হতেই হবে : মুফাখখারুল ইসলাম)
নওরাতি [মিশ্র] = উৎসবরাত্রি। (শোহরত দাও নওরাতি আজ : নজরুল)
নওশা [ফারসি] = বর, নতুন বাদশাহ। (নওশার বেশে সাজাও বন্ধু মোদের পুনর্বার : নজরুল)
নগিনা/নগীনা [ফারসি] = আংটির পাথর, মণি। (হেন সুন্দর বহুমূল্য নগীনা : মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)
নজদিক(গ) [ফারসি] = নিকট, সম্মুখ। (আন্দাজ হয় মৌত নজদিগ : প্যারীচাঁদ)
নন্নরে [দেশি] = নড়বড়ে।
নাজাই [ফারসি] = যে খরচের উল্লেখ নেই, যার কৈফিয়ত নেই। (দুজনে সংগীত-রসিকদের গান-বাজনা শুনিয়ে নাজাই টাকা রোজগার করবেন : প্রমথ চৌধুরী)
নাজাত [ফারসি] = মুক্তি। (নাজাত পথের আজাদ মান নেই কিরে কেউ বাঁচা : নজরুল)
নাজিল [আরবি] = অবতরণ, উপস্থিত, আবির্ভাব। (আয়াত নাজিল হওয়া)
নাদান [ফারসি] = বোকা, নির্বোধ। (কাপড়চোপড় দেখে বড়ই নাদান বলে মনে হয় : আসকার ইবনে শাইখ)
নানখাতাই [ফারসি] = মিষ্টান্ন বিশেষ। (নানখাতাই, মিঠা, নেমকি, পরটা এ সকল সুখাদ্য স্বহস্তে প্রস্তুত করিয়াছেন : মীর মশাররফ)
নাফানী [তদ্ভব/দেশি] = যৌবনগর্বিতা। (সে বলে নাফানী আলা না জান আপনা। চাঁদে দেখি দেখিয়াছি তোর সতীপনা : ভারতচন্দ্র)

পায়রবি [ফারসি] = অনুসরণ/শিষ্যত্ব। [মিথ্যারে যদি মিথ্যা জেনেও করো তার পায়রবি : তালিম হোসেন]

ফাতেহা [আরবি] = কোরআনের প্রথম সুরা, মৃতব্যক্তির আত্মার জন্য সুরাফাতিহা ইত্যাদি পড়ে দোয়া ও ফকির খাওয়ানো অনুষ্ঠান। (করিব ফাতেহা আদি কান্দিব বিস্তর : হেয়াত মাহমুদ)

বদস্তুর [ফারসি] = যথারীতি/ নিয়মানুসারে। (কাননগো দপ্তর সাবেক বদস্তুর আমাদের খুড়া মহাশয়ের : রামরাম বসু)
বনোসা [ফারসি] = নীল রঙের ফুল বিশেষ। (নার্গিস আর গুলবনোসার দেখবে যেথায় সুনীল দল : নজরুল)
বাওয়ালি [তদ্ভব/দেশি] = যিনি বাঘকে বশ করার মন্ত্র জানেন। (আমাদের পবন বড় জবরদস্ত বাওয়ালী : শেখ হবিবুর রহমান সাহিত্যরত্ন)
বেওফা [ফারসি] =অকৃতজ্ঞ, নিমকহারাম। (বেওফা বদজাত এরা খারাবি করিল তেরা : সৈয়দ হামজা)
বেচইন [ফা+হি] = অস্থির।
বেতাব [ফারসি] = অশান্ত, ব্যাকুল। (বেতাব আমি বিমারির হালে : ফররুখ)
বেদাতি/বদিয়তী [আরবি] = মন্দ কাজ। (একে দুঃস্বপ্ন তায় দেবতার এই বদিয়তী : কেদারনাথ মজুমদার)
বেরন [ফারসি বিরিয়ান] = ভাজি/ভাজা। (বেগুন বেরন)
বেরন [ফারসি বেরুন] = ধান কাটার মজুরি হিশেবে মজুরকে প্রদেয় ধানের ভাগ।
বেশরা [ফা+আ] = শয়িরত বা বিধান মানে না এমন। (বেশরা ফকির)

মউজ, মৌজ [আরবি] = ঢেউ (দরিয়ার বড় মৌজ হইয়াছে : প্যারীচাঁদ), বিভোরতা (মৌজ করে শারাব পিউ : নজরুল), আনন্দ, ফুর্তি।
মউত, মৌত [আরবি] = মৃত্যু। (তবে বুঝি মউত হতো খুব সুখের : মুফাখখারুল ইসলাম)
মকসেদ [আরবি] = উদ্দেশ্য, গন্তব্যস্থান।
মনসুখ [আরবি] = বাতিল।
মরতবা/মর্তবা [আরবি] = গুণ, মর্যাদা। (বাদশাহ বাইচ্যা থাকতে হারি বাবার মাজারের মরতবা নষ্ট করে কোন ব্যাডা : আবু ইসহাক)
মসরুফ [আরবি] = নিয়োজিত, ব্যতিব্যস্ত। (দুনিয়ার ফেকেরে মসরুফ আছি : আবুল মনসুর আহমদ)
মসলত [আরবি] = উপদেশ, পরামর্শ। (এনার মসলতে কাম করলে মোদের দফা রফা হইত : প্যারীচাঁদ)
মসিবত/ মুসিবত [আরবি] = বিপদ, যন্ত্রণা।
মসিহ/ মসীহ [আরবি] = হজরত ঈসা বা যিশু। (আসিল কি ফিরে এতদিনে সেই মসীহ মহামানব : নজরুল)
মসিন/মসীন [অজ্ঞাত] = উৎপীড়ন। (মসীন করিবে রাজা : মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)
মাইয়াত [আরবি] = মৃত ব্যক্তি। (কেউ মাইয়াতের গোছলের ব্যবস্থা করে : ইব্রাহিম খাঁ)
মাসায়েল [আরবি] = প্রশ্ন, সমস্যা, বিধান।
মিসমার [আরবি] = সর্বনাশ, চূর্ণবিচূর্ণ, সম্পূর্ণ ধ্বংস। (নাসারা চায় আমাদের সব আস্তানা মিসমার করে দিতে : আবু জাফর শামসুদ্দীন)
মুরশিদ/ মুর্শিদ [আরবি] = গুরু, পথপ্রদর্শক। (যে মুর্শিদ, সেই তো রাসুল : লালন)
মুসাফা [আরবি] = সাক্ষাৎকালে করমর্দন।
মুহাজের [আরবি] = দেশত্যাগকারী, উদ্বাস্তু।

রইঘর [তদ্ভব] = নৌকার ছই (রইঘর চাপিয়া বসিয়া সদাগর : মুকুন্দরাম চক্রবর্তী), পুকুরের মধ্যস্থ গভীরতম গর্ত।
রওজা [আরবি] = সমাধি, কবর।
রাহাবর/রাহবর [ফারসি] = পথপ্রদর্শক।
রেজালা [ফারসি] = জায়ফল, যইত্রি ও শাহি জিরাসহ অন্যান্য মশলা দিয়ে রান্না তরকারি।
রেহেল [আরবি] = (কাঠনির্মিত) বইধারক—যাতে রেখে সাধারণত কোরআন পড়া হয় ।
রোখসত/রুখসত [আরবি] = কাজ শেষে লেনদেন মিটিয়ে বিদায়। (এক্ষুণি বলে রোখসত হই : আবু জাফর শামসুদ্দীন)
রোজানা [ফারসি] = পারিশ্রমিক। (অবশ্য সেইজন্য রোজানা দিতে হইবে : গোপাল হালদার)
রোনাজারি [হিন্দি+ফারসি] = কান্না। (ও কি রোনাজারি ক্ষুধিতের : ফররুখ)
রোসেমাৎ [আরবি] = মুসলিম প্রথা অনুযায়ী বিয়ের পর বর-কনের পরস্পর প্রথম দর্শন ও আচারাদি।

লেহাজ [আরবি] = লজ্জা-শরম, শিষ্টাচার। [বিপরীত—বেলেহাজ]
লোকমা [আরবি] = গ্রাস। (দুই চার লোকমা খেয়েছি : ইব্রাহিম খাঁ)

শমসের [ফারসি] = তলোয়ার। (তুমি এস বীর হাতে নিয়ে শমসের : নজরুল)
শাদিয়ান/শাদিয়ানা [ফারসি] = আনন্দোৎসব, বিয়ের বাদ্য। (হঠাৎ সাদিয়ানা বাদ্য বাজিয়া উঠিল)
শান [আরবি] = মাহাত্ম্য, মর্যাদা। (আল্লাহর শান)
শাফা [আরবি] = আরোগ্য। (খোদা যাকে শাফা না দেয় তাকে কে ভালো করিতে পারে : আবুল মনসুর আহমদ)
সখাওত/ সাখাওত, সাখাওতি [আরবি] = দান, দাতা, দান-দাক্ষিণ্য। (হাতেম পাইয়া দান করে সাখাওতি কাম : সৈয়দ হামজা)
সয়ানি [তদ্ভব] = কিশোরী, চতুরা। (ইহ কো কহে সয়ানি : বিদ্যাপতি)
সরাফত/শরাফত [আরবি] = ভদ্রতা, আভিজাত্য।
সরপেচ [ফারসি] = রেশমি বা জরির ফিতাবিশেষ। (সরপেচ মোরছা কলসী নিরমল : ভারতচন্দ্র)
সরাবত [আরবি] = হাঙ্গামা। (হয়ত কোন বেশ্যার বাটিতে গিয়া সোরসরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বা মশারি পোড়ান : প্যারীচাঁদ)
সরেওয়ার [আ+ফা] = সাজিয়ে গুছিয়ে। (সে ব্যক্তি সরেওয়ার কিছু বলিতে পারিল না : প্যারীচাঁদ)
সরো [ফারসি] = সাইপ্রেস গাছ। (সরোর মতন সরল তনু টাটকা তোলা গোলাপ ফুল : নজরুল)
সরোকার [ফারসি] = সম্বন্ধ, দাবি, অধিকার। (তাদের কি সরোকার আছে আমায় যা তা বলবার : নজরুল)
সলুপা, সুলফা [দেশি] = শাকবিশেষ।
সহিসালামত [আরবি] = শান্তি, নিরাপত্তা।
সহুর [আরবি] = বোধবুদ্ধি। (জেলেখা বলেন মোর হইল সহুর : ফকির গরীবুল্লাহ)
সাদিক [আরবি] = সত্যবাদী, বিশ্বস্ত।
সানি [আরবি] = দ্বিতীয় বার। (এই মোকদ্দমায় সানি তজবীজ আবশ্যক : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর)
সায়েল [আরবি] = ফকির, মিসকিন। (লক্ষ দিরহাম তুমি দেবে লক্ষ সায়েলের হাতে : ফররুখ)
সারানি (নী) [দেশি+হিন্দি] = ভাটার সময়ে পানির হ্রস্বতা। (ভাটার সারানি পড়ল : প্যারীচাঁদ)
সালেক/সালিক [আরবি] = সুফি সাধক।
সাহাবি [আরবি] = হজরত মুহম্মদের জীবৎকালের বন্ধু।
সিদ্দত/সেদ্দত [আরবি] = দুঃখকষ্ট, দুঃখ দেওয়া (যতেক সেদ্দত মোরা করিয়াছি তারে : গরীবুল্লাহ)
সুবহে সাদেক [আরবি] = ভোর, ব্রাহ্মমুহূর্ত (আলঙ্কারিক)।
সেনি/ছেনি [ফারসি] = ডেকচির ঢাকনা।
সেমিতি [আরবি] = হজরত নুহের পুত্র সাম-এর বংশধর প্রাচীন জাতি, তাদের ধর্ম। (তুলনীয় ইং semitic)
সেলাপচি [অজ্ঞাত] = চিলমচি, হাত ধোয়ার পাত্র।
সেহেরা/সিহারা [ফারসি] = ফুল বা জরির তৈরি টোপর। (খুনের সেহেরা পরাইয়া দাও হাতে বাঁধি হাতিয়ার : নজরুল)
সোবে/শোবা [আরবি] = সন্দেহ, সংশয়। (সেই মুখই বটে, তবু সোবে হয় যায় নাকো ঠিক চেনা : মোহিতলাল)
সোয়াতি [তদ্ভব] = স্বস্তি, শান্তি। (জনম অবধি না পাই সোয়াতি : চণ্ডীদাস)

হরকিসিম/হরকিসম [ফা+আ] = নানা রকম।
হাজাম [আরবি] = ক্ষৌরকার, যে খতনা করে। (সুন্নত করিয়া নাম বোলাল্য হাজাম : মুকুন্দরাম)
হায়াত = জীবন, পরমায়ু। (রহিবেন জেন্দা জাহানে হায়াতে : অবনীন্দ্রনাথ)

শেষ পর্বের লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৮০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১৬

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad