মকবুল ফিদা হুসেন ভারতের একজন কালজয়ী চিত্রকর। তার শিল্পকর্ম কালকে জয় করলেও কালের অমোঘ নিয়মেই ৯ জুন লন্ডনে তার নশ্বর জীবনের যতি পড়েছে ৯৫ বছর বয়সে এসে।
তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পীই নন; তিনি কখনো কবি, কখনো ভাস্কর, কখনো বিখ্যাত বা বড়লোকদের বাড়ির নকশাকার আর কখনো একজন চিত্রনির্মাতা। তার সমকালীন শিল্পীদের থেকে তিনি আলাদা, কারণ তিনি রঙ-তুলি-ক্যানভাসের ভেতর নিজেকে আটকে রাখেননি। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে উপাদান নিয়ে লিখেছেন বাংলানিউজের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রবাব রসাঁ।
ভারতের পিকাসো
বিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্প-আন্দোলনে বিশিষ্ট শিল্পশৈলী ‘কিউবিজম’কে সমৃদ্ধ করেছিলেন স্পেনের শিল্পী পাবলো পিকাসো। এই শৈলীর পেছনে প্রেরণা ছিল আফ্রিকা, প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট-ছোট দ্বীপ ও আমেরিকার আদিবাসীদের শিল্পঐতিহ্য।
শুধু শৈলীতেই নয়, বিষয়বস্তুতেও পিকাসো তুলে ধরেছিলেন বিপ্লবের বাণী। এই বিপ্লব যুদ্ধ-ধ্বংস ও অনাচারের বিরুদ্ধে।
একইভাবে, মকবুল ফিদা হুসেন চিত্রকলায় বৈচিত্র্য এনেছিলেন আবহমান ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্য ও ইউরোপীয় শিল্পশৈলী ‘কিউবিজম’-এর মিলন ঘটিয়ে। এর ফলে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলা ও মকবুল ফিদা হুসেন সমার্থক হয়ে দাঁড়ান।
শিল্প-সমালোচক দিপালি নন্দবানিকে এক সাক্ষাৎকারে মকবুল বলেছিলেন, ‘ভারতের আধুনিক শিল্পকলার বয়স অন্তত ৫০০ বছর। আমাদের শিল্পে দুটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে, যা ইউরোপের চিত্রকলায় নেই। তারা উদ্বিগ্ন বাস্তবতা নিয়ে। তারা শুধু ‘স্পেস’ দেখে। আর আমরা সেই ‘স্পেস’ দেখি এবং তাকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। ’
২০০৬ সালে যখন ফোর্বস ম্যাগাজিন মকবুলকে ‘ভারতের পিকাসো’ অভিধায় অভিহিত করেছিল তখন কি ভেবেছিল, এই শিল্পীকেও শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে মাতৃভূমির বাইরে?
খ্যাতি-অখ্যাতির সঙ্গে বসবাস
১৯১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশশাসিত ভারতে তৎকালীন বোম্বে প্রেসিডেন্সি এলাকার পান্ধারপুরে জন্ম নেওয়া শিশুটি হয়েছিলেন ভারতের আধুনিক শিল্পকলার সেরা শিল্পী। হয়েছিলেন ভারতের সবচে দামি শিল্পী। এই স্বশিক্ষিত শিল্পী তার যৌবনের শুরুতে জীবনের চাহিদা মিটিয়ে ছিলেন বোম্বের সিনেমার পোস্টার এঁকে।
চল্লিশের দশকের শেষের দিকে এসে তিনি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন একজন চিত্রশিল্পী হিসেবে। পরবর্তীকালে তিনি ভারতের চিত্রকলাকে আঞ্চলিক রূপ থেকে তুলে এনে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিকতা।
শিল্পী হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন বড় বড় পুরস্কার। ১৯৫৫ সালেই পেয়ে যান ‘পদ্মশ্রী’। সরকারি স্বীকৃতির সিঁড়ি বেয়ে তিনি আরেক ধাপ উঠে আসেন ১৯৭৩ সালে। লাভ করেন ‘পদ্মভূষণ’। ১৯৯১ সালে তিনি উঠে আসেন আরো এক ধাপ। এবার তাকে সম্মানিত করা হয় ‘পদ্মবিভূষণ’ দিয়ে।
এরপর ভারতের শ্রেষ্ঠ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারত রতœ’ দেওয়ারও জোরালো দাবি উঠেছিল। কিন্তু ততদিনে তার কপালে লেগে গিয়েছিল বিতর্কের বিচ্ছিরি রঙ।
আবহমান ভারতীয় চিত্রকলার একজন ভক্ত হিসেবে মকবুল এঁকেছিলে পুরাণের দেবতাদের রূপ। দিয়েছিলেন নতুন অর্থ। কিন্তু তার শিল্পভাবনায় খুশি হতে পারেনি ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদি গোষ্ঠী। তাদের মতে, মকবুল ফিদা দেব-দেবীদের নগ্ন শরীর এঁকে ধর্মের অবমাননা করেছেন।
ধর্ম অবমাননার মামলা হয়েছিল তার নামে। বাড়িতে হামলাও হয়েছিল। এসেছিল জীবনের প্রতি হুমকি। ২০০৬ সালে জন্মভূমি ভারত ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। এ-দেশ ও-দেশ ঘুরে অবশেষে ২০১০ সালে নেন কাতারের নাগরিকত্ব।
এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ২০০৮ সালে তেহেলকা ম্যাগাজিনকে তিনি জানিয়ে ছিলেন তার উপলব্ধির কথা। বলেছিলেন, ‘হিন্দু সংস্কৃতিতে নগ্নতা হচ্ছে শুদ্ধতার রূপক’।
তিনি শিল্পকর্মকে যেমন কম ভালোবাসেন না, তেমনি মানবতাকেও কম গুরুত্ব দেন না। তাই ম্যাগাজিনটিকে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি আমার ক্যানভাসে আঁকি। যা কিছু আঁকি তা গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ নিয়েই আঁকি। আর তা আঁকতে গিয়ে যদি কারো অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে আমি দুঃখিত। ’
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম
মকবুল ফিদা হুসেনের অসংখ্য চিত্রকলার ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো ‘বিটুইন দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প’, ‘বীণা প্লেয়ার’, ‘গনেশ’, ‘মাদার তেরেসা’, ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ‘দ্য ওরামা’ ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে ১৯৫৬ সালে আঁকা ‘বিটুইন দ্য স্পাইডার অ্যান্ড দ্য ল্যাম্প’ চিত্রকর্মটি মকবুলের বেশি প্রিয়। তিনি বলেন, ‘এই ছবিটিতে পাঁচজন নারী কথা বলছে। একটা রহস্য আছে এতে, কী বলছে তারা। ভয় আছে তাদের চোখে। সব মিলিয়ে ছবিটি আমাকে খুব মুগ্ধ করে। ’
‘আমি ভারতীয় সংস্কৃতির নির্যাসটাকেই ক্যানভাসে তুলে ধরি,’ এমন মন্তব্য করেছিলেন যে শিল্পী, ভারতের মাটিই তার শেষ আশ্রয় হবে কি?
বাংলাদেশ সময় ২২০০ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১১