ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নজরুলের ‘দারিদ্র্য’র পুনর্পাঠ

খালেদ হামিদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩৮ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১১
নজরুলের ‘দারিদ্র্য’র পুনর্পাঠ

দারিদ্র্য মানবসভ্যতার একটি অমোঘ বাস্তবতা। কৃষিভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার শুরুতে ভূমি এবং উৎপাদনের উপকরণের ওপর শক্তিমান সংখ্যালঘুর নিয়ন্ত্রণ লাভের পর থেকেই দারিদ্র্যের সূত্রপাত কিনা তা হলফ করে বলা যায় না।

তবে এ-কথার উচ্চারণ বাহুল্য, অভাবগ্রস্ততা শ্রেণীবিভক্ত সমাজব্যবস্থারই সৃষ্টি। সার্বিক বিচারে, জিন-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট, ই-মেইল নামের অত্যাশ্চর্য যোগাযোগ-ব্যবস্থা আর ব্যক্তি-মালিকানার স্থলে ক্রমান্বয়ে যৌথ মালিকানার প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে খ্যাত পৃথিবীর বিশাল এলাকায় বিদ্যমান দারিদ্র্যের মাত্রা সভ্যতার কথিত উৎকর্ষকে লজ্জিত করে রেখেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সময়ে এ খ-িত সভ্যতার রহস্য উন্মোচনে পূর্ণাঙ্গরূপে সক্ষম না হলেও নিজের ধরনে সেই বাস্তবতার অনুসন্ধানে কতদূর অগ্রসর হন তা যাচাইয়ের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ-পর্যায়ে নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটির স্তবকভিত্তিক ক্রমান্বয়িক আলোচনার পরিবর্তে প্রথমেই দেখা যাক তিনি কেন শুরুতেই বলেন, দারিদ্র্য তাঁকে খ্রিস্টের মতো মহান করেছে এবং তাঁরই মস্তকে পরিয়ে দিয়েছে ‘কণ্টক-মুকুট শোভা’। এই শিরস্ত্রাণ আবার মহত্ত্বের সৌন্দর্যে দীপ্যমান। যদিও বলা হয়, জিসাস ক্রাইস্ট চরিত্রটি কাল্পনিক তথা ইতিহাসেই জিসাসের অস্তিত্ব অবাস্তব বা অনুপস্থিত। কেননা, রোম সাম্রাজ্যের অন্তত ষাটজন ঐতিহাসিকের প্রথম শতকে লেখা ইতিহাসে জিসাসের উল্লেখই নেই। জিসাস ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলে তাঁদের কেউ না কেউ তাঁর কথা উল্লেখ করতেন; কিন্তু কেউ করেননি। তথাপি, খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এটা সুবিদিত যে, ইহুদি জীবন-ব্যবস্থার অসঙ্গতিসমূহ চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের পথ নির্দেশ করেন বিধায় জিসাস ওই ইহুদিদের হাতে নির্মমভাবে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে আত্মোৎসর্গ করেন। এভাবে সকলের পাপের ভার নিজে বহন করে তাঁর পিতা ভুবনেশ্বরের স্বর্গরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন। তিরোধানের তিন দিন পর এবং ফের চল্লিশ দিন পরেও জগতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।

বাইবেলের শিক্ষা অনুযায়ী খ্রিস্টানদের কাছে জিসাসের অসাধারণত্ব এখানে যে, তিনি সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিলেন। তাঁর মতো আর কোনো অবতার জীবনোৎসর্গ করেননি এবং তিনি ছাড়া আর কেউই পৃথিবীর শেষ সময়ে ইহধামে পদার্পণ করবেন না। এত শীর্ষে যাঁর সম্মান তাঁর সমীপবর্তী অবস্থানে, নজরুল বলেন, দারিদ্র্য তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে। এ-প্রতীতী ঘোষণার মানে কি এ নয় যে, উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তি ব্যতিরেকেই আপন শ্রম বিক্রয়ের মধ্য দিয়ে অগণিত দরিদ্র মানুষ আত্মোৎসর্গে নিয়ত নিয়োজিত? এবং, এ-ত্যাগের মাধ্যমে স্থিতাবস্থা বজায় থাকলেও মানুষের শোষিত হবার বেদনায়, দরিদ্র জনম-লীর জীবন-সংগ্রামের মহত্ত্বের উপলব্ধিতে নজরুল কি উদ্বেলিত হননি? দ্বিতীয়ত লক্ষণীয়, তাঁর অন্য কিছু কবিতার মতো মন্ত্রতুল্য প্রথম দু পঙক্তির কোনো পুনরাবৃত্তি নেই আলোচ্য কবিতায়। তাহলে কি এ-পঙক্তিযুগলকে শিরোধার্য করে কবিতার বাকি অংশে তিনি এর বিস্তার ঘটিয়েছেন অথবা বিস্তৃত করেছেন প্রথম উচ্চারণটির পশ্চাৎপট? বিস্তার ঘটাবার চেয়ে ওই পটভূমি উল্লেখে ব্যস্ত হয়ে তিনি দারিদ্র্যকে একবার ‘তাপস’, আরেকবার ‘রুদ্র’ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু দারিদ্র্যকে অভিযুক্ত করতে গিয়ে নিজের হৃতাবস্থাহেতু ক্ষোভও সঞ্চারিত করেন তিনি এই কবিতায়। এখানে তাই সচেতন পাঠকের চৈতন্যে ঝলসে ওঠে এই জ্ঞান, ক্রিস্টোফার কডওয়েলের যেমনটা উপলব্ধ হয়, জগতের দুঃখ-কষ্ট অর্থনৈতিক।

আলোচ্য কবিতাটির এক পর্যায়ে কবি আনন্দপূর্ণ নিসর্গেও প্রাণচাঞ্চল্য প্রত্যক্ষ করেন। একটি বৃক্ষও আনন্দের মধ্যে বাঁচে মর্মে রাবীন্দ্রিক উপলব্ধির অধিকতর মানবিকীকরণ ঘটান কি নজরুল এ-অংশে এই মূল্যবোধ থেকে যে, প্রত্যেক মানুষেরও আনন্দের মধ্যে বাঁচবার অধিকার আছে, চলমান আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যার অধিকাংশই অপহৃত?

কবিতাটি এগোতে থাকে এবং অন্তিম পর্যায়ে উৎকলিত হয় কবির সমকালীন সামাজিক বিষমাবস্থা। হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে, বলা যায়, তিনি একাত্মতা বোধ করেন যারা তাঁর দরোজায় শব্দ তুলে তাঁকে আহ্বান জানায়। এ কি সহমর্মিতা নাকি সম্মিলিত উত্থানের ইঙ্গিত, যে-জাগৃতির পরিচয়ে বাঙালির চেতনায় নজরুল এতটা বিশাল? যাই হোক, প্রাগুল্লিখিত পশ্চাৎপটের ক্রমবিস্তৃতি কবিতাটিতে শেষ অব্দি চলমান ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ভবিষ্যৎকে কিছুটা হলেও সম্ভাব্য করে তোলে।

নজরুল আক্ষরিক অর্থে সমাজতন্ত্রী ছিলেন না এবং আস্তিক কবি হিসেবে দারিদ্র্যর দরুন অভিমানও প্রকাশ করেন এই কবিতায়। কিন্তু উপর্যুক্ত অভিজ্ঞতাজনিত দ্রোহচৈতন্যের কারণে যেমন, তেমনি তীব্র মানবতাবাদিতার সুবাদেও, কবিতাটিতে পরিচিত সভ্যতার রহস্য উন্মোচনে দৃশ্যত তিনি সক্ষম না হলেও এর স্বরূপ শনাক্তকরণে ব্যর্থ হন নি।  

নজরুলের সাধারণ ছন্দ মাত্রাবৃত্ত হেঁটে হেঁটে থামলেও, তিনি তাতে দান করেন অনেকটা মার্চপাস্টের গতি। কিন্তু দারিদ্র্যের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার দীর্ঘকালীনতা এবং মানবেতিহাসে এর দুঃখজনক ব্যাপ্তির কারণেই কি এই কবিতাটি রচিত হয় পয়ার ছন্দে? হয়তো এটি মুক্তক অক্ষরবৃত্তে অথবা টানা গদ্যে লেখা হতো যদি নজরুলের কালের পাঠক-রুচিও ছন্দের স্পন্দনে বাঁধা না থাকতো।

নজরুলের সময়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বর্তমান রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে তিনি নিজেও ধার্মিক ছিলেন না। কিন্তু মূলত মার্কিনপন্থী ধর্মব্যবসায়ীদের আঘাত করলেও মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করেননি। তাছাড়া, আলোচিত কবিতার প্রথম দুই চরণে গুঞ্জরিত বেদনার আনন্দ এবং অভাবগ্রস্ততা সত্ত্বেও পরাস্ত না হবার পরিতৃপ্তি সজাগ পাঠকের আবেগ-আকাক্সক্ষা-অনুভূতি-চেতনা, এমনকি চিন্তাকেও পরিশ্রুত মহিমায় সমৃদ্ধ করে। অনেক পাঠকের স্মৃতিতেও উৎকীর্ণ এ-পঙক্তিযুগলের তুলনা বাংলা কবিতায় নেই। পুরো কবিতাটিই তাই আজো অদ্বিতীয়।

এ জন্যেই রুটির দোকানে চাকরি থেকে শুরু করে আরো অন্য যেসব অভিজ্ঞতা নজরুলকে ন্যুব্জ করতে পারেনি, সেসব বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যদি তাঁদেরকে যেতে হতো, তাহলে, নজরুলের বিরূপ সমালোচকদের পক্ষে কর্তৃত্বমূলক প্রতিষ্ঠার শিখরে আরোহণ সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ হয়। তাই বলতে পারি, কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আমাদের অনেক অনুসন্ধানই এখনো বাকি রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময় ১৯৪২ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।