ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একাত্তরের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১১
একাত্তরের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা, অস্ত্র সংরক্ষণ ও বহন করা, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাদান, ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো, গুপ্তচর বৃত্তির মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার মতো অনেক কাজ করেছিলেন বাংলাদেশের নারীরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও কর্মরত ছিলেন অনেক নারী।

তারা সবাই-ই ছিলেন আসলে মুক্তিযোদ্ধা।

আর এমন ৩৭ জন বীর নারী মুক্তিযোদ্ধার অবদান ও অভিজ্ঞতা নিয়ে বই ‘একাত্তরের বিজয়িনী’। এ বছরের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে এই বিশেষ বইটি। এখানকার লেখাগুলি ২০১০-এর  ডিসেম্বর মাসজুড়ে ছাপা হয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠে। বইটি সম্পাদনা করেছেন মুস্তাফিজ শফি ও তৌহিদুর রহমান।

বইটি পাঠ করলে কিছু প্রশ্ন পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই জাগবে, স্বাধীনতার ৪০ বছরের সীমানায় দাঁড়িয়ে একাত্তরের নারী মুক্তিযোদ্ধারা আসলে কতটুকু মূল্যায়িত হচ্ছেন?  ইতিহাসে তাদের কতটুকু উল্লেখ করা হয়েছে?  রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের স্থান কতটুকু সে বিষয়ে আমাদের ধারণা রয়েছে  কী পরিমাণে?

ঢাকায় হানাদারদের আক্রমণের সূচনাপর্বেই প্রতিরোধের প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যে নারী তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী  ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। এ রাতে রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন একটি পাকিস্তানি ট্যাংকের সামনে। এতে ট্যাংকটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং রওশন আরা শহীদ হন। কিন্তু সরকারিভাবে প্রকাশিত দলিলপত্রে রওশন আরার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নেই। তাঁকে শহীদও বলা হয়নি। বলা হয়েছে ‘বীর’।

কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙা ও যশোর অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা মেজর ওসমানের স্ত্রী। স্বামীর সঙ্গে তিনি যুদ্ধে যান। দলিলপত্রে তাঁর আলাদা কোনো নাম নেই। পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ‘মিসেস ওসমান’ বলে। তাঁকে শহীদ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘নিহত’।

‘একাত্তরের বিজয়িনী’তে যেসব  নারী মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা স্থান পেয়েছে তারা হলেন আয়শা বেগম, আয়েশা খানম, ড. এস এম আনোয়ারা বেগম, আমিনা বেগম মিনা, আলমতাজ বেগম ছবি, উর্মিলা রানী রায়, কাকন বিবি, কাঞ্চনমালা, কৃষ্ণা রহমান, ছায়ারুন নেছা, জয়নাব বেগম, তারমন বিবি (বীরপ্রতীক), নাজমা বেগম, নিবেদিতা দাশপুরকায়স্থ, নীলিমা আহমেদ, পদ্মা রহমান, ফৌজিয়া মোসলেম, ফরিদা খানম সাকী, ফাতেমা খাতুন, ফোরকান বেগম, অধ্যাপক মমতাজ বেগম, মমতাজ বেগম বেলী, মধুমিতা বৈদ্য, মনোয়ারা বেগম, অধ্যাপক মাহফুজা খানম, মোমেলা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, রোকেয়া কবির, লক্ষ্মী রানী চৌধুরী, শওকত আরা খাতুন, শামছুন নাহার, শিরিনি বানু মিতিল, ডা. সিতারা বেগম (বীরপ্রতীক), সুষমা নার্গিস খুকু, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার এবং হাজেরা নজরুল।

এই নারী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বাগেরহাট, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, পিরোজপুর, সুনামগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। তাদের লেখাগুলোতে উঠে এসেছে তাদের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপট, উঠে এসেছে পাকিস্তানিদের সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার বহু নির্মম চিত্র। রয়েছে যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে তাদের বর্তমান অবস্থাই বা কী রকমের সেসব কথাও।

এছাড়া বইটির শুরুতে রয়েছে মুস্তাফিজ শফি ও তৌহিদুর রহমানের দীর্ঘ ভূমিকাসহ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে একটি পর্যালোচনা। এই দুটি রচনা মুক্তিযুদ্ধ ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে বহু মূল্যবান এবং জরুরি তথ্য ও বিশ্লেষণে পূর্ণ।  

দুঃখজনক হলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্রে আজও স্থান পায়নি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত অবদান। ইতিহাসে, দলিলে তাদের ভূমিকা চিত্রিত হয়েছে নির্যাতিতা হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীর অবদান যেন তাতে খুবই নগণ্য। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা কোনো তালিকা করার উদ্যোগ নেয়নি এখন পর্যন্ত কোনো সরকার। সামাজিক মর্যাদাও তেমন জোটেনি তাদের কপালে।

‘একাত্তরের বিজয়িনী’কে বলা যায় বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা ও অর্জনকে পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা।
 
‘একাত্তরের বিজয়িনী’ বইটি প্রকাশ করেছে শুদ্ধস্বর। প্রচ্ছদ করেছেন মাহবুবুল হক। মূল্য ৪০০ টাকা।

বাংলাদেশ সময় ১৮৪৫, মে ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।