ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রাণীদের দ্বিতীয় আবাসস্থল

জর্জ বুশ যেখানে তার মনের কথাটি বলেছেন

মূল : অরুন্ধতী রায় অনুবাদ : অদ্বয় দত্ত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩১ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১১
জর্জ বুশ যেখানে তার মনের কথাটি বলেছেন

২০০৬-এর মার্চে জর্জ বুশ রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন। সে সময় তিনি ব্যাপকভাবে জনরোষের সম্মুখীন হন।

তার সফরের মাত্র কয়েক দিন আগে একটি ভাষণের পরিবর্তে ‘অ্যানিমেল ফার্ম টু’ (প্রাণীদের দ্বিতীয় আবাসস্থল) শীর্ষক এই ব্যঙ্গাত্মক নাটিকাটি লেখা হয় এবং ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভার খোলা মঞ্চে গভীর রাতে এটি মঞ্চস্থ হয়।

ঘটনার দিন। পুরনো কেল্লা। দিল্লির চিড়িয়াখানা।

এখন বসন্তকাল। নিমগাছে গাছে নুতন পাতা ভরে উঠেছে। রেশমি সুতো এবং তুঁতগাছ পত্রপল্লবে পুরোপুরি বিকশিত হয়ে উঠেছে। গাড়ির রাখার স্থান মার্সিডিস গাড়িতে পূর্ণ হয়ে আছে, যাদের ইঞ্জিনগুলো সচল, ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও। উর্দিপরা শোফার (ব্যক্তিগত গাড়ির বেতনভুক্ত চালক) অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে উচ্চগ্রামে গাড়ির স্টেরিও থেকে হিন্দি ছবির গান শুনছে।

চিড়িয়াখানার ভেতরে পশুদের খাঁচা কয়েকদিন আগে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে, এবং সেখান থেকে ফিনাইলের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। খাঁচার শিকের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া ছোট ছোট আমেরিকান ও ভারতীয় পতাকাগুলো নানা জায়গায় পতপত করে উড়ছে। এবং প্রতিটি খাঁচার ওপরেই ভারি অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত যুক্তরাষ্ট্রের সুঠাম পেশির নিরাপত্তাকর্মীরা সানগ্লাস পরে অবস্থান নিয়েছে। তারা খাঁচা এবং ভিড়ের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে যাতে বিন্দুমাত্র কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়। দেখে মনে হচ্ছে তারা নির্দিষ্টভাবে প্যাঙ্গোলিন নিয়ে তাদের একটু অস্বস্তি রয়েছে।

জর্জ বুশ নিজেও একটি বুলেটপ্রুফ খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। ধনী শিল্পপতি, সাংসদ এবং কিছু চলচ্চিত্র তারকাদের সামনে তিনি ভাষণ দিচ্ছেন। তাদের সকলেই অসংখ্য আংটি পরে আছেন এবং তাদের অনেকেরই কব্জিতে জড়ানো রয়েছে বিবর্ণ-লাল সুতো।

জর্জ বুশ : হ্যালো, সমবেত সৌভাগ্যবান অতিথিবৃন্দ! যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনতে ব্যস্ত কর্মসূচির ভেতর থেকে কিছুটা সময় বের করে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তোমাদের  ধন্যবাদ।

(হুলক গিবন কথাটা শুনে একটি হুটোপুটি খেল। ওরাংওটাং তার মক্ষিকা-তাড়ানোর কাজ ছেড়ে এদিকে একটু ফিরেও তাকাল না। আর, এক জায়গায় গুচ্ছবদ্ধ কতগুলো চিতাবাঘ মৃদুমন্দভাবে হেঁটে  বেড়ালো। এবং ধীরস্থির লরিস যেন একটু বিস্মিতই হয়েছে। )

আমি আজকে এখানে এশিয়ার দুটি মহান গণতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে কথা বলার জন্য এসেছি। এই দুই দেশকে আমি আমার হারেমে আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইন্নিয়া (‘ইন্ডিয়া’র উচ্চারণগত অপভ্রংশ) ... এবং আফগানিস্তান- সরি- পাকিস্তান। ধ্যাৎ! আমি জানতাম এটা কোথাও না কোথাও খালি খোঁচায়- তবে আফগানিস্তান ইতিমধ্যেই আমার হারেমে জায়গা পেয়েছে। তাই, ও-দেশকে আর আমার কব্জার ভেতরে আনবার দরকার নেই। হে! হে! ইন্নিয়ার (ভারতের) গণতন্ত্রটা মহান, কারণ, এখানে জনগণ এমন একটি সরকারের জন্য ভোট প্রদান করে- যে সরকার নাকি আমাকে মান্য করে চলে। আর আমি পাকিস্তানের গণতন্ত্রও পছন্দ করি, কেননা- ওখানে আছেন জেনারেল মোশাররফ, যাকে আমিই ভোট দিতে পারি। এবং একই কারণে আমি পছন্দ করি মধ্যপ্রাচ্য এবং সৌদি আরবের উন্নাসিক নেতাদেরও। ফিলিস্তিন কোনো ভালো গণতান্ত্রিক দেশ না, কারণ সেখানকার জনগণ এমন একটা লোককে ভোট দেয় যাকে আমি পছন্দ করি না। তবে যাই হোক, ইন্নিয়ার (ভারতের) গণতন্ত্রটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের।

পাঁচ শতাব্দীরও আগে, আমাদের অত্যন্ত নামকরা গণহত্যাকারী এবং আমাদের জাতির প্রতিষ্ঠাতা ‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’ ইন্নিয়া আবিষ্কার করতে বের হয়েছিলেন এবং প্রমাণ করেছিলেন যে, পৃথিবীটা গোলাকার। আর এখন আমার বন্ধু টম ফ্রিডম্যান বলেন, এটা নাকি সমতল। সত্যি বলতে কী, যতক্ষণ পর্যন্ত এটা আমার নিয়ন্ত্রণে আছে আর আমি এটা নিয়ে খেলাধুলা করতে পারি ততক্ষণ এই ‘আকার’ নিয়ে আমার আসলে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। তবে তোমরা তো জানোই, ‘ক্রিস্টোফার কলম্বাস’ ইন্নিয়ার পরিবর্তে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসেছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে ওখানেই অসংখ্য ‘ইন্নিয়ান’ (রেড ইন্ডিয়ান) ছিল। ঈশ্বরের সমর্থন পেয়ে আমরা তাদের সবাইকেই মেরে ফেলেছি- প্রায় চার থেকে ছয় কোটির মতো। আমি একদম সঠিক সংখ্যাটা মনে করতে পারছি না। আমার অফিস থেকে পরে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি পাঠিয়ে দেব। তবে এ বিষয়ে আমরা আটকে না থাকি। বন্ধুদের মধ্যে একটা ছোটখাট গণহত্যা করলে কিই-বা হয়? মূল কথা হলো, আমরা এখন নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র পেয়ে গেছি। এটা এমন একটা ভূমি যেটা মুক্তমানুষদের জন্য এবং সাহসী লোকদের এটি একটি সুতিকাগার। আমাদের এখন অনেক বেশি নিউকুলার (নিউক্লিয়ার-এর উচ্চারণগত অপভ্রংশ ‘নিউকুলার’, অর্থাৎ বিশ্বকে আতঙ্কে হিমশীতল করে দেওয়ার মতো পারমাণবিক অস্ত্র) অস্ত্র আছে- যা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আমি চাইলে, যদি আমার মন খারাপ থাকে তবে পুরো বিশ্বটাকেই এক মিনিটের ভেতরে ধ্বংস করে দিতে পারি। হে! হে! দুষ্টুমি করলাম। আমি আসলে অতো বেশি খামখেয়ালি লোক নই। তাছাড়া... আমি তো এখনকার মতো তোমাদের পক্ষে। ওহ্, মানে হলো- আমি এখন তোমাদের পক্ষে। আমি তো তোমাদের শত্রু নই, তাই না? আমাকে দেখে কি সে রকম লোক বলে মনে হয়? তোমরা কি ‘স্লিপিং উইথ দ্য এনিমি’ (শত্রুর সঙ্গে সহবাস) সিনেমাটা দেখেছো? আমি দেখেছি এবং আমার স্ত্রী লরাকে বলেছি, সিনেমাটা ঠিকই আছে, শুধু প্রশ্ন হলো- কে কাকে ... ? হা! হা!

এরপর তিনি তার আশপাশে উন্নাসিক, বিজয়োন্মত্ত চাহনি দিলেন, যাতে সবাই জানতে পারে সে কে এবং তাকে ভালোবেসে সমীহ করতে পারে।

আমি দুঃখিত যে, আজ এখানে লরা আসতে পারেনি। মাদার ত্রেজা (তেরেসা)-র একটি এতিমখানায় সে এতিমদের নিয়ে ফটো-সেশন করতে গেছে। আমি সত্যিকার অর্থেই তোমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গ উপভোগ করেছি। তিনি এমন একটা লোক যার মাথায় একটি পাগড়ি রয়েছে এবং হাস্যকর উচ্চৈস্বরে যিনি কথা বলেন। তোমাদের বাড়ির কাপবোর্ডের ভেতরে যেসব ছোট ছোট কিছু নিউকুলার বোমা রয়েছে, আমি চেষ্টা করেছি  তিনি সেগুলো যেন আমার হাতে তুলে দেন, যাতে তোমাদের  হয়ে আমি নিজেই এগুলো দেখাশোনা করে রাখতে পারি। তোমাদের  প্রধানমন্ত্রী একজন ভালো মানুষ- সে তো অক্সফোর্ড ফেরত, তাই না? কিন্তু তারপরও সে কীরকম একটি হাস্যকর পাগড়ি পরে থাকে। আর যখন আমি আশপাশে তাকাচ্ছিলাম, দেখতে পাচ্ছিলাম হাস্যকর রকমের পোশাক পরিহিতি সব লোকজন। কারো কারোর এমন কি দাড়ি পর্যন্ত আছে, দেখলে কেমন মুসলিম মুসলিম লাগে। এই গরমের দেশে যেসব লোকজন থাকে তাদের গায়ে কীরকম একটা গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু তারা কোনো সুগন্ধী ব্যবহার করে না। আমার প্রিয় সুগন্ধীর নাম হলো ‘ফ্রিডম’। এর ভেতরে চমৎকার লেবুর সুঘ্রাণ আছে। আমি মনে করি না যে, এরকম হাস্যকর রকমের পোশাক পরা লোকজনের হাতে এরকম ‘নিউকুলার’ অস্ত্র থাকা উচিত। সুতরাং তোমাদের কাপবোর্ডের ভেতরে যেসব ছোট বোমা রয়েছে, সেগুলো আমার কাছে দিয়ে দাও।
 
যুক্তরাষ্ট্রে আমরা কিন্তু বোমাগুলো কাপবোর্ডে রাখি না। আমরা সেখানে শুধু খোলসটাই রাখি। আমাদের সেসব খোলসের বেশ ভালো ভালো ডাকনাম আছে। তাদের আমরা ডাকি ‘পিস’ (বিশ্বশান্তি) , ‘ডেমোক্রেসি’ (গণতন্ত্র) ও ‘ফ্রি মার্কেট’ (মুক্তবাজার) নামে। অবশ্য তাদের আসল নাম হলো ‘ক্রুস মিসাইল’, ‘ডেইসি কাটার’ ও ‘বাঙ্কার বাস্টার’। আমরা গুচ্ছবোমাও পছন্দ করি। ওটাকে আমরা ‘ক্লেয়ার’ বলে ডাকি। এবং এটা আসলেই খুব সুন্দর। বাচ্চারা সেগুলোকে নিয়ে খেলতেও পছন্দ করে এবং সেটা তাদের মুখে অথবা ঘাড়ের ওপর বিস্ফোরিত হয়। এতে তাদের অনেকে মারাও যায়। এটা সত্যিই একটা হুটোপুটির জিনিস। কিন্তু আমার মাকে আবার এই কথা বলে দিও না। তা হলে সে আমার জিহ্বা সাবান দিয়ে ধুতে বাধ্য করতে পারে।

আমি আজকে এখানে, কারণ এশিয়ায় খুব দ্রুতই পরিবর্তন আসছে। এবং আমি এসব ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অংশ হতে চাই। এবং আমি ওই জিনিসগুলো বেশ পছন্দও করি, কিয়োটোর যেসব হাবা উন্মাদ আছে, যেটা নিয়ে নিঃসন্দেহে ওরা তোমাদের ওপর দোষারোপ করছে। আমি বিশ্বাস করি, ইন্নিয়াতে একটা নদীও খালি নেই যেখানে পরিষ্কার জল পাওয়া যায়। এবং পানীয় জলের স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু তার পরিবর্তে তোমরা কোকাকোলা খেতে পারো। এটা ঠাণ্ডা আবার স্বাদও বেশি। আর তোমাদের তো বিশাল বিশাল শপিং মল আছে। তোমাদের হাতে যদি টাকা থাকে তবে সেখানে তোমরা যা খুশি তাই কিনতে পারো। এটা ভেবে আমি বেশ রোমাঞ্চিত হই যে, এখানকার ধনী ভারতীয়দের জীবনযাপন খুব দ্রুতই উন্নতি লাভ করছে। এবং ভারতীয় সিইও (কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান কর্মকর্তা) খুব দ্রুতই আমাদের পশ্চিমাদের সমতুল্য হয়ে আসছে। এটা আসলেই চমৎকার। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের সিইওদের আমরা ভতুর্কি দিই। আমরা তাদের ভালোবাসি বলে পচে গলে (দুর্নীতিগ্রস্ত) যেতে দিই। আমরা আমাদের কর্পোরেট কৃষদেরও ভালোবাসি। তাদের আমরা কোটি কোটি ডলার ভতুর্কি দিই, কারণ তারা প্রকৃতই ভালো মানুষ। তারা তোমাদের কৃষকদের মতো শীর্ণদেহ, গরিব, আর আত্মহত্যাপ্রবণ নয়। তোমাদের কৃষক তো ভতুর্কি পাবার যোগ্যই নয়। কারণ তারা তো মানুষ ভালো না। তাদের বরং প্রোজাকে (মাদক আস্তানায়) রাখা উচিত। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ কোম্পানিগুলোর আরেকটু বেশি আয় বাড়তো।

গত সপ্তাহে ‘এশিয়া সোসাইটি’র ভাষণে আমি বলেছিলাম যে, এটা শুনে ভালো লাগল ভারতীয় ধনীরা যুক্তরাষ্ট্রের ‘জেনারেল ইলেকট্রনিক’, ‘হোয়ার্লপুল’ ও ‘ওয়েস্টিংহাউস’ জাতীয় নানা কোম্পানির ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র’, রান্নাঘরের বিশেষ যন্ত্রপাতি ও ওয়াশিং মেশিন কিনছে। তরুণ ভারতীয়দের খাদ্যরুচির উন্নতি লাভ করছে। তারা এখন ডমিনাস পিজা এবং হ্যামবার্গারই পছন্দ করে বেশি। এটা একটি জবর খবর, কেননা আমেরিকানরা এই পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র স্থূলকায় জাতির উপাধি পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। এই রান্নার পদ্ধতিও সত্যিকার অর্থে অতি বিরক্তিকর।

কিন্তু সব মন্দেরই একটি ভালো ‘অ্যাপসিস’ থাকে।   বেশ ভালো ‘অ্যাপসিস’ থাকে। (তার একজন সহায়ক-কর্মী ছুটে এসে ফিসফিস করে বলল, মি. প্রেসিডেন্ট, ‘অ্যাপসিস’ নয়, ‘অ্যাসপেক্ট’। ) আমি ‘অ্যাসপেক্ট’ই বলেছি হেনরি। - এই বিরক্তিকর খাবারের ভালো ‘অ্যাসপেক্ট’ (দিকটা) হচ্ছে, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞাকে আরো দৃঢ় করে, এবং মুজলিমদের (মুসলিম) বিরুদ্ধে আমাদের যে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা সেটাকে আরো জোরদার করে- ওহ্ ভুল বলেছি, আমাকে মাফ করবেন- মুজলিম নয়, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে। আমি মুজলিমদের ভালোবাসি। ভালোগুলোকে অবশ্য, ওই তাদেরকে, যারা সন্ত্রাসী না, যারা কলসেন্টারগুলোতে কাজ করে। আমার বন্ধু টম ফ্রিডম্যান আমাকে বলেছেন- ইন্নিয়ার মুজলিম (ভারতীয় মুসলিম) নাকি সত্যিকারের ভালো মানুষ। সন্ত্রাসীদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী তোমাদের সবার ওপরেই সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি রেখেছে। তোমাদের কোনো ধারণাই নেই তোমাদের সম্পর্কে আমরা কতোটা জানি। আমাদের আছে পর্যবেক্ষণের জন্য গোপন অনুসন্ধান ক্যামেরা। আছে তারবিহীন বিভিন্ন নজরদারি যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার- যেগুলো আমরা তোমাদের কম্পিউটারগুলোর সঙ্গে লাগিয়ে দিয়েছি- যাতে আমরা সবসময়ের জন্য তোমাদের ওপর নজর রাখতে পারি। আমরা জানি তোমরা কোথায় যাচ্ছ, কী কিনছ এবং কার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ। আমি সন্ত্রাসীদের ঘৃণা করি, কারণ তারা মনে করে যে, একমাত্র তাদেরই মানুষ হত্যা করার অধিকার আছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা এবং গ্রান্ডমাদার- তোমরা হিন্দিতে যাকে নানি বলে থাকো, ঠিক?- বলতো, একমাত্র যে লোকটা মানুষকে হত্যা করার অধিকার রাখে এবং বিভিন্ন দেশকে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার অধিকার রাখে, অথবা সামরিক, রাসায়নিক কিংবা নিউকুলার (নিউক্লিয়ার) অস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার রাখে- সেই অমোঘ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তোমরা বলো তো দেখি সেই ব্যক্তিটা কে!

চিড়িয়াখানার সব প্রাণী আকস্মিক বিস্ময়ে ভয়ে বা চিৎকারে হুটোপুটি শুরু করলো। চিড়িয়াখানার পাগলাঘণ্টি বিকটভাবে বাজতে আরম্ভ করলো।

আমি আজ এখানে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত, কারণ আমি পশুপাখি ভালোবাসি। আমি তাদের শিকার করতে ভালোবাসি; বিশেষ করে তখন, যখন তারা খাঁচায় বন্দি অবস্থায় থাকে, এবং এ কারণে তারা আমাকে আর কামড়াতে পারে না। একবার একটা ছোট্ট মৌমাছি আমাকে কামড়ে দিয়েছিল। এবং যন্ত্রণায় খুব কান্নাকাটি করেছিলাম। আমি সেসব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও ভালোবাসি যারা ইতিমধ্যেই অনাহারে ডুবে আছে এবং যাদের আগেই বলপ্রয়োগে নিরস্ত্র করে দেওয়া হয়েছে। তোমরা তো জানোই যে, আই-রাকের (ইরাক) ব্যাপারে আমরা কতোটা ধূর্ত ছিলাম। আমি তো বোমা খুবই ভালোবাসি। কারণ তোমার তাতে দেখতে হবে না যে তুমি কাকে মারলে। এ কারণে আমার মতো একটা ভিতুর ডিম মানুষের জন্য এটা খুবই উপযোগী। তবে তোমাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। আমি এখানে তোমাদের ওপর বোমা ফেলার জন্য আসিনি, অথবা তোমাদেরকে না-খাইয়ে রাখার জন্যও আসিনি। কারণ, তোমরা- ইন্নিয়ারা (ভারতীয়রা) তো এমনিতেই অনাহারে আছো। হা! হা!

এরপর তিনি তার সেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ চাহনি দিয়ে আশপাশে তাকালেন এবং দেখে মনে হলো তিনি একটু সঙ্কুচিত হয়ে গেছেন, যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে তার আশপাশের মানুষ ভয়ে বেশ খানিকটা কুকড়ে গেছে।

আহা! ... নানি আমাকে বলতো এই স্টুপিডের মতো ভুল বকাই আমার একটা সমস্যা। দুঃখিত। আসলে আমি যে কারণে এখানে, আমি ধনী ভারতীয়দের খুব পছন্দ করি। এ কারণে পছন্দ করি যে, তারা আসলে অনেক অনুগত হয়। তারা অনেক বুদ্ধিদীপ্তও হয়। যেটা নাকি সত্যিকার অর্থেই খুব বিরল একটা মণিকাঞ্চনযোগ। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা তো এদের আদর্শ অভিবাসী মনে করি। আমি এ ধরনের অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত ধনী ইন্নিয়াদের বেশ পছন্দ করি। কেননা, তারা আমাদের নানা সমস্যা সমাধানে অতিরিক্ত চিন্তাশক্তির জোগান দেয়, এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোতে আমাদের যেসব ভোক্তা ও ক্রেতা আছে তাদের প্রয়োজনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জোগান দিয়ে আমাদের ব্যবসায়িক সিইও (নির্বাহী প্রধান)দের বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোগ্যপণ্যের জন্য ইন্নিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার এবং সেটা খুব ভালোভাবে কাজে লাগানোর জন্য এখানে প্রায় একশ কোটির ওপরে লোক আছে। ইন্নিয়া সরকারের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, ইন্নিয়ার নিজের সম্পদগুলো আমাদের নিয়ে যেতে দেয়। এই  যেমন কয়লা, বক্সাইট, বিভিন্ন খনিজ, এমন কি পানি ও বিদ্যুৎ। আমরা পরে সেগুলো বিপুল মুনাফায় তোমাদের কাছেই আবার বিক্রি করে দিই। সেটা আসলেই বেশ চমৎকার একটি ব্যাপার। এই জন্যই আমি ইন্নিয়ার সরকারকে ভালোবসি।

দুঃখজনকভাবে এই একশ কোটি লোকের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই খুব গরিব। আমি আবার গরিব লোকদের ঘৃণা করি, কারণ ওদের কোনো কিছু কেনার মতো টাকাপয়সাই নেই। আমার ইচ্ছে হয়, ওরা যদি হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। আমি তাহলে খুব খুশি হতাম। আমি শুনে বেশ আনন্দ পেয়েছি যে, হাজারে হাজারে ইন্নিয়ার কৃষকরা আত্মহত্যা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এদেরকে বলে থাকি দায়িত্বজ্ঞানহীন আত্মবিধ্বংসী আচরণ হিসেবে। তবে এখানে এই আচরণ আরেকটু বাড়িয়ে দিতে পারতাম এবং এটাকে যদি খুব দ্রুতগতিশীল করা সম্ভব হতো, তাহলে কৃষকদের আত্মহত্যার সংখ্যা আরো বাড়াতে পারতাম। তবে এই গরিবদের নিয়ে একটা সুবিধাও আছে। এরা বেশ ভালো গৃহপরিচারক-পরিচারিকা হয়। এবং কায়িক শ্রমে এরা বেশ পারঙ্গম। এসব কাজে আমাদের কিছু লোক দরকার আছে অবশ্য।
 
আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো ইন্নিয়ার বীজ, গাছগাছালি, জীববৈচিত্র্য, গুরুত্বপূর্ণ ভৌত অবকাঠামো, এমনকি তাদের নতুন নতুন আইডিয়ারও মালিক হয়ে যাবে। যেমনটা আমি বলেছিলাম, ইন্নিয়ানরা তো যথেষ্ট পরিমাণেই মেধাসম্পন্ন, আর কখনো কখনো তাদের মাথায় ভালো ভালো আইডিয়াও আসে। সুতরাং এসব নতুন আইডিয়া আমরা ইন্নিয়ার অধীনে রেখে দিতে পারি না। আমরা এসব কৃষককে নিজেদের শস্যবীজের মালিক হিসেবে রেখে দিতে পারি না। প্রত্যেকেরই তাদের প্রয়োজনে যেকোনো কিছু আমাদের কাছে চাওয়া উচিত। সবাই যখন আমার অনুমতি চাইতে আসে তখন এই আধিপত্য আমি বেশ পছন্দ করি। ডিক তো বলেই যে, জগতে আসল ব্যাপারটা হলো ‘নিয়ন্ত্রণ’।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি কর্পোরেশনের ব্যাপারে গর্ব বোধ করি যেটা বিল গেটস-এর মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল। সে তো প্রায়ই ইন্নিয়া সফরে আসে। সে তো খুবই চমৎকার এবং খুব উদার প্রকৃতির একজন লোক। সে তো এইচআইভি-এইডসের মোকাবিলা করতে ইন্নিয়া সরকারকে কয়েক কোটি ডলার দান করেছে। কিন্তু আমার ওইসব লোক পছন্দ না যারা এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত। কারণ তাদের বেশির ভাগই কৃষ্ণাঙ্গ ও সমকামী। আমি ওইসব কোম্পানিকে পছন্দ করি যারা এমন উচ্চমূল্যে এইচআইভি-এইডসের ওষুধ তৈরি করে, যা কেনার সাধ্য গরিবদের নেই। আমি ওই সব কুৎসিত বা নিম্ন রুচির চাঁছাছোলা কৌতুক পছন্দ করি। ওহ্! আমি তো বিলকে নিয়ে কথা বলছিলাম। বিল গেটসের কয়েক কোটি ডলার সাহায্যের বিনিময়ে ইন্নিয়ান সরকার কোটি কোটি ডলার কম্পিউটার টেকনোলোজি কিনে থাকে। সে এত ধনী যে আমার মাঝে মধ্যে ভয় হয়, কোন সময় আবার ফেটে না যায়। তার আশপাশে থাকলে আমি সবসময় একটি অ্যাপ্রোন পরে থাকি।

আমি নিজেও যথেষ্ট ধনী। এবং আমার বন্ধুরাও ধনী, বন্ধুর বন্ধুরাও ধনী, এবং আমার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুরাও ধনী। বিশেষ করে ডিক চেনি। আমরা আমাদের ন্যাক্কারজনক চুক্তিগুলো একসঙ্গেই করে থাকি। তেল, অস্ত্র- এই সব আর কি। তবে এনরনে যেটা হচ্ছিল সেটা খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। কিন্তু যতক্ষণ এটা টিকে ছিল ততক্ষণ বেশ ভালো ছিল। ডিককে আমি এই কারণে বিশেষ পছন্দ করি যে, সংবাদ সম্মেলনে কী বলতে হবে সেটা সে-ই আমাকে সবচেয়ে ভালো বলে দিতে পারে। আমি তাকে সত্যিই খুব মিস করি। তবে আমি কখনই তার সঙ্গে মৃগয়াতে যাবো না। কারণ সে তার বেআইনি অস্ত্রটা দিয়ে যেকোনো সময় আমাকে গুলি করে বসতে পারে। এবং আমি ঠিক জানি না, আমি মারা গেলে তখন ঠিক কী করবো।

আমি এখন আই-রানের (ইরান) ওপর বোমাবর্ষণের জন্য মুখিয়ে আছি। আমাদের নতুন কিছু অস্ত্রপাতি আছে যেগুলো একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। আশা করি এটাও বেশ মজারই হবে। আমি আশা করি ইন্নিয়াও তাদের কিছু সৈন্য আমাদের এ কাজে সাহায্যের জন্য পাঠাবে। এখানে তো তোমরা কতো লোক, এদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেলে এমন কিছু হবে না। তা ছাড়া, তোমরা তো দলে দলে এমনিতেই বেআইনিভাবে আত্মহত্যা করো। তাহলে তোমরা কেন আইনসম্মতভাবে আই-রান অথবা আই-রাকে গিয়ে নিহত হবে না? আমরা তোমাদের জন্য একটি মরণোত্তর গ্রিনকার্ডের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সেটা আমরা লেমিনেট করে দেব। তবে তার খরচ তোমাদের অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হবে। ব্যাপারটা তোমরা একটু ভেবে দেখতে পারো।

সময় দেওয়ার জন্য তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। এখনকার মতো বিদায়। জয় হিন্দ। আবার দেখা হবে।

দায়মুক্তি : কপিরাইট, মেধাস্বত্ব আইন, জালিয়াতি, চৌর্যবৃত্তি, অনুলিপিকরণ সংক্রান্ত আইনকানুনের এই যুগে আমি এখানে স্বীকৃতি প্রদান করতে চাই যে, এই নাটিকা সম্পূর্ণভাবেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে রচিত। এখানে যে সব ধারণা প্রকাশ পেয়েছে- তা আমাদের অত্যন্ত নামকরা কবি, শান্তিকর্মী, নির্দোষ শিশু, মুক্তমনা ব্যক্তি এবং সমাজকর্মী জর্জ ডব্লিউ বুশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং তার জনসম্মুখে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ থেকে গৃহীত হয়েছে। এই নাটিকার একটি বড় অংশ ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘এশিয়া সোসাইটি’তে প্রদত্ত তার সাম্প্রতিক ভাষণ থেকে নেওয়া হয়েছে। সে কারণে নাটিকাটির প্রদর্শন থেকে টিকিট বিক্রির যাবতীয় অর্থ রয়্যালটি বাবদ তার নিকট সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।  

বাংলাদেশ সময় ২১১৫, মে ০৩, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।