ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

বাবার হাত | মণীশ রায়

গল্প/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৪
বাবার হাত | মণীশ রায়

অনেক্ষণ থেকে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়া মরা মাছের ফ্যাকাশে চোখের মতো জ্যোৎস্না খণ্ডগুলো সরলার মুখের উপর আছড়ে পড়ছে। চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অবিরল নিঃশব্দ ধারা।


মাত্র দুমাস হলো বিয়ে হয়েছে ওর; স্বামী হারাধনকে এখনো চেনা হয়নি পুরো। এরই ভেতর খবর এলো বাবা নেই। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলো বাপের বাড়ি; ছোটো ছোটো ভাই-বোনগুলোকে ফেলে এতো তাড়াতাড়ি কেন বাবা চলে গেলেন কিশোরী সরলা তা জানে না।
সে কখনো মায়ের গলা ধরে, কখনো ভাইবোন আর কাকা-জেঠাকে জড়িয়ে ধরে যখন বিলাপ করছিলো তখনো ওর মাথায় বাবার এই অকালমৃত্যু নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

সদ্য বিয়ে হয়েছে ওর; স্বামীর বাহুডোরের মোহ ওকে এমনি আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, ওর ইচ্ছেও নেই খুঁড়ে খুঁড়ে জমা কষ্টগুলো বের করে আনবার। সংসারের অজস্র আর্থিক অনটন কিংবা অভাব ক্লিষ্ট সংসারের কোন জটিলতা নিঃশব্দে বাবাকে হত্যা করেছে তা নিয়ে সরলার এখন আর কোনো মাথাব্যথা নেই।
ওর বিয়ে হয়ে গেছে; এটাই পরম সত্য কথা। সে এখন অন্য গোত্রে চেলে এসেছে; সে যে-সন্তান ধারণ করবে তার উপর ওর বাবার বাড়ির নয়, স্বামীর পরিবারের পুরো অধিকার;  স্বামী ও তার পরিবারের কষ্টই এখন ওর কাছে সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয়; এদের লাভ-লোকসান একান্তই ওর।
বাবার বাড়ি সরলার জন্যে এখন বেড়ানোর জায়গা; এর সাথে কোনো লেন-দেন কিংবা কোনো স্বার্থের যোগ নেই আর। তবু চোখ ফুঁড়ে ঝর্নাধারার মতো বেরিয়ে আসছে জল। কোনো স্বার্থ নেই, তবু বাবার মরা মুখের উপর চোখ পড়ে গেলেই কেন যে হু-হু করে উঠছে বুকের ভেতরটা!
স্মৃতির দুয়ার দিয়ে উড়ে উড়ে আসছে ওর শৈশব-কৈশোর আর যৌবনের পরাগরেণু; বাবা ওদের ছেড়ে গেছেন কথাটা ভাবতেই সরলা কঁকিয়ে উঠছে, বাবা, বাবাগো।

বাবাকে শ্মশানঘাটে নেয়া হলো। সন্তানের পর আগুন রঙের গাদাফুলের মালা দিয়ে মরদেহ সাজানো হলো। সবশেষে ছোটো ভাই আগুন দিলো বাবার মুখে।
বাবার চিতা দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে সরলার চোখের সামনে।
অজস্র নিঃস্বতায় ভরা আগুন মাখা বাবার ছোটোখাটো অন্তিম দেহখানি যখন জ্বলছে তখন সরলা মাঝে মাঝে ও বাবাগো বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে।
ওর চুল আলুথালু; শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে;  সদ্য নেয়া এঁয়োতির সিঁদুর মুখে চোখে ছড়ানো।
তবু একটু পরপর সরলার কেন যেন মনে হচ্ছে ও এখানকার কেউ নয়। কিছুক্ষণ বাদে স্বামী হারাধন ওর কানের কাছে মুখ এনে ঠিকই বলে উঠবে, ‘চল। দেরি অইয়া যাইতাছে। কাম ফালাইয়া আইছি। ’
পাড়া-প্রতিবেশী-আত্মীয়-পরিজন, এমনকি, মা-ও একটুখানি সুস্থির হবার পর ঠিক বলে উঠবে,‘ মা,  নিজের বাড়ি যাও। অশৌচে পড়ছ, শুদ্ধ অওন লাগবো। যাও গা। ’

শ্মশান থেকে ফেরার পর ছোটোভাইটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি সেরে সে ফিরে এলো নিজের বাড়ি মানে স্বামীর ডেরায়।
বিদায় নেবার সময় হারাধন ওর শাশুড়ির হাতে দুই হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বললো, ‘বাবার শেষ কামডা সাইরা নিয়েন। আমার পক্ষে আর আওন সম্ভব না। নতুন মুদিদোকান। খুব ব্যস্ত থাকন লাগে। ’
‘সরলারে পাডাইও। ’ মায়ের আব্দার।
‘চেষ্টা করুম। ’ হারাধন তেরছা করে নতুন বউর মুখখানার উপর চোখ রাখলো।
সরলা এক পা এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আমি কেমনে আমু কও? আমি আইলে হের কতো অসুবিধা। আমি ছাড়া সংসার অচল। ’
সরলার মায়ের চোখে ফ্যালফ্যাল করা অসহায় দৃষ্টি। তিনি ভাবেন, যিনি গেছেন তিনি তো সংসারের মায়াজাল থেকে মুক্ত হলেন। সেজন্য তাকে ঘিরে কেন অযথা মেয়ের সংসারে অশান্তি ডেকে আনা। বিয়ে হয়েছে সবে; নিজের সংসারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সময় এখন। মরা বাপের জন্যে কেন সে সেখানে অস্থিরতা তৈরি করবে। যা কর্তব্য তা তো জামাই বাবা জীবন ঠিকই সম্পাদন করছে, এই দুঃসময়ে দুইহাজার টাকা কি কম?
মেয়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়ার আবদার সরলার মা অতি সহজেই মেনে নেন এবং হাত বাড়িয়ে মেয়ে-জামাইর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে আঁচলের গিঁটে বেধে রাখে নাক দিয়ে নির্ভাবনার নিশ্চিন্ত লম্বা শ্বাস টেনে নেন ভেতরে।
বিদায় নেবার সময় মেয়েকে উপদেশ দেন, ‘ শাশুড়িরে জিগাইয়া সব করবা। অহন কিন্তুক মাথার উপরে বাপ নাই। কতাডা খেয়াল রাখবা। ’
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে তাতে সায় জানায় সরলা। যেন এটুকু বলাই মায়ের কর্তব্য। তাছাড়া, সরলাও জানে বিয়ের পর কে আপন আর কেই বা পর।
মাত্র দুইটা গ্রাম পেরোলেই সরলার শ্বশুরবাড়ি।

সন্ধ্যা হবার সামান্য আগে অটোরিকশায় করে স্বামীর সঙ্গে রওয়ানা দেয় সে। গ্রামের এবড়ো-থেবড়ো সেমিপাকা রাস্তা জুড়ে ক্রমাগত ঝাঁকুনি সহ্য করতে করতে সরলা একসময় টের পায় পাতলা চাদরের মতো হিমেল অন্ধকার ধীরে ধীরে চারপাশের গ্রাম্য বনবাদাড়গুলো মুড়ে ফেলছে।
বাঁশঝাড়ের মাথায় কুয়াশা কেমন দলা পাকিয়ে রয়েছে। দূর থেকে মনে হয় কোনো মানুষের মাথা।
পথ চলতে চলতে সহসা ওর শরীরে অজানা এক শিহরণ খেলে যায়। মনে হল অটোরিকশায় ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনার মাঝখানে আরো একজন বসে রয়েছে।
স্বামীর উপর সরু দৃষ্টি ফেলে সে বারবার করে পরখ করে নেয় ব্যাপারটা।
শ্বশুরবাড়ি পৌঁছার পরও ওর এই সন্দেহবাতিক ঘোচে না। কলাপাতায় সব্জি দিয়ে ফেনভাত খাওয়ার সময়ও কেন যেন মনে হতে থাকে ওর হাতের সঙ্গে আরো একটি হাত সেখান থেকে খাওয়া নিয়ে মুখে দিচ্ছে।

রাতে স্বামীর পাশে শোয়ার পর আরো একজনের চিরচেনা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় সে। সরলার বাবা মুকুন্দ পোদ্দারের সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস ছিলো। সরলা স্পষ্ট দেখতে পায় চিকন ধোঁয়ার একটি রেখা এঁকেবেঁকে উঠে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে ঘরের চালের দিকে।
ওর শ্বশুরবাড়িতে তিনদিন পর পুরুতঠাকুর এনে শ্রাদ্ধশান্তি করতে হয় মেয়েদের। যজ্ঞ হয় ; বাবার নামে পুরুতঠাকুরকে দানখয়রাত করতে হয়। সেইসব দানসামগ্রী পুরুতঠাকুর এক-একটি মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজের কাছে টেনে নেন। যাদের দান করবার মতো আর্থিক সংস্থান নেই তারা সামান্য অর্থ দিয়ে পিতৃমৃত্যুর দায়  বা অশৌচ থেকে নিজেকে শুদ্ধ বা মুক্ত করবার বৈধ অনুমতি চেয়ে নেন তার কাছ থেকে।
অশৌচমুক্ত হবার পর বাবার যা কিছু প্রিয় খাবার তা রান্না করে পশুপাখিদের উদ্দেশে খোলা আকাশের নিচে বেড়ে দিতে হয়। অদৃশ্য আত্মা যদি তৃপ্ত হন তো পশুপাখির বেশ ধরে সেই আহার গ্রহণ করে নেয়। নয়তো ছুঁয়েও দেখে না। এরকম হলে সমাজে কুৎসা রটে যায়। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ চোখনাক কুঁচকে সরলার দিকে তাকাবে; প্রশ্ন একটাই, ‘কী অমন করছ যে মরা বাপেও খাওন নিবার চায় না তুমার হাতে? ’
একথা ভাবতেই ওর শরীর হিম হয়ে যায় এক অজানা ভয় ও শঙ্কায়। জীবিত অবস্থায় অভাবী ও ভাঙাচোরা দোকানদার বাবা ওর কাছে যাই থাকুক,   নতুন শ্বশুরবাড়িতে এসে এই লোকলজ্জা সে সইতে পারবে না।   সত্যি সত্যি এরকম হলে মেয়ে হিসাবে ওর মরে যাওয়াই ভালো।  
গভীর রাতে সরলা স্পষ্ট শুনতে পায় চেনা কণ্ঠের ডাক।
রাতের বেলায় দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পর যেভাবে মেয়েকে ডেকে উঠতেন মুকুন্দ পোদ্দার, অবিকল সেইরকম গলা। মা সরলা, দরজা খোলো। দরজা খোলো মা।  
পাশে শোয়া হারাধন, ওর স্বামী। একটুও টের পাচ্ছে না ওর অবস্থা।
লোকটা ঘুমানোর সময় বললো, ‘কাইল তুমার বাপের ছরাদ্দ। সকালে বাবনা আইলে সাইরা ফেলাইও। আমার কাম আছে। ’
বলার পর মানুষটা রেলগাড়িতে চেপে বসল। ঘর ঘর ঘর ফুস। ঘর ঘর ঘর ফুস।
পুরনো আমলের রংচটা খাটটি কেঁপে কেঁপে উঠছে এই শব্দে। পর পর দুবার সে তার হাতটি স্বামীর বুকের উপর রাখার পরও কোনো শব্দের হের-ফের না হওয়ায় সরলা একটি বালিশ চেপে ধরে কানে। নাক ডাকার এমন বিকট শব্দ যে সে আর কিছু টের পাচ্ছে না। চোখ বুঁজে চুপচাপ পড়ে থাকে কতোক্ষণ।
সরলা যে ঘরটায় শোয় এর পাশেই একটা বড় তেঁতুলগাছ; গাছটার পর থেকে রমজান ব্যাপারির বাড়ির সীমানা শুরু। কিছু বিষকচু আর বুনো গাছের আড়া; একটা ছোটো ময়লা ফেলার গর্ত আর এর পাশে রমজান ব্যাপারির গোয়াল ঘর।  
রাত বাড়লেই গোয়ালঘরের উৎকট গন্ধ নাকে আসে। ঘুমানো দায়। মাঝে মাঝে গরুছাগলের হাম্বা আর ম্যা ম্যা ডাক ওদের সোহাগ রাতের মাতাল ঘুম কেড়ে নেয় যখন তখন।
এই নিয়ে অনুযোগ-অভিযোগ এবং সালিশ-দরবার। হারাধনের বাবা অমিয় দাস গোয়ার টাইপ স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক; কিছু পেলে সহজে ছাড়েন না। লেগে পড়ে এর শেষ দেখে তারপর ঘরে ফেরার স্বভাব তার।
সীমানা ঘেঁষা গোয়ালঘর সরানো নিয়ে বহু দেন-দরবার করবার পর রমজান অনেকটা চাপের মুখে ওর  শিক্ষক অমিয়বাবুকে বলে ওঠে, ‘এই কতাডা সুজাসুজি আমারে কইলেই অয় স্যর। মানুষ ডাইক্যা দরবার বওয়ানের কি দরকার আছিল স্যর? আপনের কতা কি আমরার শিরোধার্য না স্যর?’
এরপর তেঁতুলগাছটি ঘেঁষে ঢেউটিনের বেড়া তুলে দেয় রমজান আর ওদের গোয়ালঘরটি নিয়ে যায় সামনের দিকে।
এখন ওদের শোয়ার ঘরে পশুর মলমূত্রের দুর্গন্ধ যেমন আসে না তেমনি গভীর রাতে গরু, ছাগল আর ষাঁড়ের ডাকে কারো ঘুমও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
এতো সহজে এরকম একটি ফ্যাসাদ মিটে যাওয়ায় অমিয় দাস কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েন। তিনি দেন-দরবার করনেওলা জটিল টাইপ মানুষ হওয়ায় সহজেই ভেবেছিলেন এই নিয়ে অনেকদূর যেতে হবে। থানা-পুলিশ আর সাংবাদিকদের ডাকাডাকি করে এবং সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সমস্যার দোহাই দিয়ে অনেককিছু করবার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু অমিয়র একদা ছাত্র শুরুতেই সবকিছু অতিসহজে মেনে নেয়ায় মানুষটি দমে যায়; পুরো ব্যাপারটিকে দড়ি-প্যাচানোর মতো অতি সাধারণ ও লঘু এক কাজ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি তার।
এখন নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব সময় কাটছে ওদের; টিনের সীমানা-দেয়াল তুলে দেবার পর দুই পরিবারের ভেতর কথাবার্তা একেবারে বন্ধ। আগে ঈদের সেমাই আর লক্ষ্মী পুজোর নাড়– বিনিময় হত দুই পরিবারের ভেতর। সীমানা-দেয়াল তুলে দেবার পর সরলা দেখছে কেউ কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছে না। সরলার শাশুড়ির ছোটোবেলার সই রমজানের মা। কিন্তু যখন থেকে গোয়ালঘর থাকা না থাকা নিয়ে দুই পরিবারের ভেতর দ্বন্দ্ব আর ঝগড়া-ফ্যাসাদ শুরু হলো তখন থেকেই ওদের ভেতরকার কথা বন্ধ হয়ে গেলো।  
সরলার শাশুড়ি বলল ,‘বৌমা , গরু-ছাগল কই পাইবা ? আগে তো সইর বাড়ির গরু যখন তখন এই বাড়ি ছুইটা আইত। ’ চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। কারণ, শ্রাদ্ধ-শান্তির পর বাবার যে-যে প্রিয় খাদ্যদ্রব্যগুলো রান্না করে বেড়ে দেবার কথা , সেগুলোয় যদি পশুপাখি মুখ  না দেয় , তাইলে মহা অমঙ্গল ; ওদের ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে ছদ্মবেশী বিদেহী আত্মা ; বেড়ে দেয়া  খাদ্যে কেউ মুখ না ছোঁয়ালে বুঝতে হবে বাবার আত্মা অসন্তুষ্ট ; তিনি মেয়ের  খাওয়া খেতে চাইছেন না --এর চেয়ে লজ্জার ও কলঙ্কের আর কি বাকি থাকতে পারে?
ভাবতেই শিউরে ওঠে সরলা। পাশের বাড়ির গোয়ালঘরটিকে সহসা বড় আপন মনে হতে থাকে ওর। গরুগুলোকে মনে হচ্ছে ওর বাপের বাড়ির কেউ। দেখলেই মন একেবারে কাদা-কাদা।
সরলা ঘুমন্ত স্বামীকে বারকয় দেখে নিয়ে পা টিপে টিপে ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।
ঘরের বাইরে তখন নারকেলের শাঁসের মতো দুধসাদা জ্যোৎস্না। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি মিশে রয়েছে ঘনকৃষ্ণ হিমেল কাঁথায় মোড়ানো নিশুতি রাত। ঝিঁ ঝিঁ ও তক্ষকের ডাক আর পাতাহীন বড় বড় অশরীরী গাছগুলোর ডগা চুঁইয়ে টিনের চালে টপটপ করে শিশির পড়ার শব্দ কেমন যেন এক বুক ঢিপঢিপ করা অনুভব তৈরি করে চলেছে ওর ভেতর।
শীতে কাঁপছে সমস্ত শরীর। তবু শীতের ঘোলাটে জ্যোৎস্নায় ভর দিয়ে সে চলে আসে সীমানা-দেয়ালটার কাছে। তেঁতুলগাছটার চিরল পাতা বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে কুয়াশার জল সরলার গায়ে। এক একটি বিন্দু মনে হচ্ছে এক-একটি সুঁচ।
সে সারা গায় শাড়ি পেঁচিয়েও নিস্তার পাচ্ছে না সেই কামড় থেকে।
সরলা ঢেউটিনের সীমানা-দেয়ালে আঙুল ছোঁয়ায় প্রথমে। একটুও নড়ে না; সে এবার হাত দিয়ে আলতো করে তাতে ধাক্কা লাগায়; ক্যাচ শব্দ তুলে সামান্য নড়ে ওঠে সেটি। এবার সরলা জোরে এক ধাক্কা দিতেই হুড়মুড় করে টিনটা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়।
সরলা সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে ছুটে এসে ছিটকিনি লাগিয়ে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়ে। চারপাশের কেউ এতোটুকু টের পায়নি। শীতের ঘুম তো, জব্বর জমজমাট সবার!
ওরা যে ঘরটিতে শোয় এর পাতিটিনের বেড়া জুড়ে অজস্র ফোঁকর; সেই ফোঁকরগুলো দিয়ে মাকড়শার জালের মতো ঘোলা জ্যোৎস্নার সরু বলগুলো এসে ওর আর স্বামীর শরীরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
সরলা চোখ বুঁজে ঘুমানোর চেষ্টা করে। আধো তন্দ্রা আর আধো ঘুমের ঘোরে সে দেখতে পায় একটি বড় কলাপাতায় খাবার বেড়ে দিচ্ছে ওর বাবার উদ্দেশে। বেগুনভাজা, আলুভাজা, ডাল, ডালনা, বড় মাছের টুকরো আর পায়েস দিয়ে সাজানো কলাপাতা; ওর শাশুড়ি এসে ওর হাতে একটি সিগারেট গুজে দিয়ে বলে উঠলো, ‘এই লও। তুমার শ্বশুরের থন চাইয়া নিছি। তুমার বাপে না খুব ভাল পাইতো? কলাপাতার এককোনে রাইখা দ্যাও। ’
‘আমি তো বাবারে কুনসময় সিগারেট খাইতে দিই নাই। দেখলেই কাইড়া নিছি। অহন দিমু মা?’
‘দিবা না? তুমার বাপের পছন্দের জিনিস সিগারেট। আর তো কুনদিন খাওয়ান লাগবো না তুমার বাপেরে। তো খাওয়াইতে অসুবিধা কই? দ্যাও। আমরার নিয়ম আছে। ’
সরলা ওর বাবার উদ্দেশে নিবেদনকৃত খাদ্যপত্রের এক কোনে সিগারেটটি যত্ন করে রেখে দেয়। পায়েসের রস এসে সিগারেটটি ভিজিয়ে দেয়ায় তামাক পাতার সঙ্গে মিশে ধীরে ধীরে পায়েসের রং কালচে হতে শুরু করে।
পিছনে শ্বশুরবাড়ির সব আত্মীয়স্বজন। মজা দেখবার জন্যে মুখে কাপড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেপুলেদের চোখেমুখে এক অপার বিস্ময়। আত্মা নামের অদ্ভুত জীবটি কী বেশে এসে ধরা দেয় তা দেখার জন্যে এক জটলা অমিয় দাসের বাড়ির আঙিনা জুড়ে।
নতুন বউ সরলা প্রথমে ওর বাবার ক্লিষ্ট মুখখানা স্মরণ করবার চেষ্টা করে। তারপর রমজানদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ডেকে ওঠে, ‘আয় আয়। আয় আয়। ’
অনেকগুলো কাক তেঁতুল গাছের মগডালে বসে উঁকিঝুকি মারলেও কেউ আর সাহস করে ছোঁ মারতে চাইছে না খাদ্যপত্রে। সম্ভবত সমবেত মানুষগুলোকে ভয় পাচ্ছে ওরা।
অনেক্ষণ ধরে দাঁড়ানো সরলা। গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা বুকের তলায়। একটা কাক অন্তত কলাপাতায় ঠোকর বসালেও হত; কিন্তু কেউ আর নামছে না। এমনকি, রমজানের বাড়ি থেকে ঢেউটিনের ভাঙা বেড়া ডিঙিয়ে যে একটি ছাগল বা গরু এসে লোভনীয় এই খাদ্যসম্ভারে মুখ দেবে তাও হচ্ছে না।
সরলার বাবা বেঁচে থাকতেও কখনো কোনোদিন এমন করে অপেক্ষা করতে হয়নি ওকে। মা ব্যস্ত থাকলে ও বাবার পাতে ভাত বেড়ে দিতো। তাছাড়া, বাবা হচ্ছে মুখচোরা নরোম টাইপ এক মানুষ। সবকিছু মেনে নেবার ধাত তার। প্রতিবাদ কেন, মুখ তুলে সামান্য কথা বলতেও যার বাধে,  সেই লোক বেড়ে দেয়া খাদ্য অস্বীকার করবে? অসম্ভব, এ তো তার প্রকৃতির সঙ্গে যায় না। তবু সরলাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে গাছতলায়।
যতো সময় গড়াচ্ছে ততো পাড়া-প্রতিবেশি আর আত্মীয়স্বজনের ভ্রকুটির সাইজ দীঘল হচ্ছে।
ঘামের চিকর রেখা সরলা টের পায় ঘাড়ের কাছে। শীতের পড়ন্ত বেলায় ঘাম?
গায়ে হাত দিয়ে ভেজা ঘাম অনুভব করতে চায় সে; আর ঠিক তক্ষুণি তন্দ্রাটুকু ভেঙে যায় সরলার। সে হারাধনকে জড়িয়ে ধরে। লোকলজ্জার ভয় ওকে কুকড়ে-মুকড়ে ভ্রুণের মতো করে দেয়।
সে নিজেকে দলা পাকিয়ে ফের শোবার চেষ্টা করে। মাঝেমাঝে বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলিয়ে পড়া চাঁদের টুকরোগুলোর উপর চোখ রাখে।  
সহসা মনে হলো চাঁদের জ্যোৎস্না বেয়ে প্যাঁচানো দড়ির মতো একটি সরু ক্লিষ্ট হাত ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
এই হাতটি সে খুব চেনে। ছোটোবেলায় দুষ্টুমি করলে বাবা ওকে পাশে শুয়ে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
প্রথমে ওর কাজের স্রোতে বাধা দেয়ায় বাবার উপর রীতিমতো বিরক্ত হত সরলা। ছাগশিশুর মতো ঘাড় উঁচিয়ে বারবার উঠে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতো। কিন্তু বাবার শক্তিশালী বাহুডোরের কাছে শিশু সরলার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর একসময় ওকে আত্মসমর্পণ করে মাথা ফেলে রাখতে হতো বালিশে;  কিছুক্ষণ বাদে অদ্ভুত এক মাদকতা ওর চোখ জুড়ে ঘুম এনে দিতো। বুঝতেই পারতো না কখন চোখের পাতায় ঘুম জড়িয়ে এসেছে বাবার হাতের আদর মেশা সেই স্পর্শে।
শক্তিও যে কখনো মাদকতার আবেশ এনে দিতে পারে তা প্রথম বাবার কাছেই শেখা।
এখনো সে চোখ বুঁজলে সেই অনুভবটির মুখোমুখি হতে পারে এবং সত্যি সত্যি এই মুহূর্তে টের পাচ্ছে ওর চুলে কেউ একজন ঠিক সেরকমভাবে বিলি কেটে দিচ্ছে। চুলের গোড়ায় সেই অলস আদরের ছোঁয়া; ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরে তা ছড়িয়ে পড়ছে।
ওর চোখ বুঁজে আসছে অদ্ভুত এক আবেশে।  
কিন্তু সরলা আজ ঘুমায় না; প্রশান্ত ও মদালস নিদ্রায় ডুব দেবার আগে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কিভাবে যেন ফের তেঁতুলগাছটার তলায় চলে আসে।
বিকালের মলিন আকাশের দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো সরলা ডেকে ওঠে, ‘আয় আয়। আয় আয়। ’
সে মনে করবার চেষ্টা করে ওর বাবার মুখখানা। মানুষটির স্নেহার্দ্র মুখ আর দুটো নিঃস্বার্থ বাহু-  চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার;  চুলের গোড়ায় চিরচেনা ভালো লাগার অনুভূতি।
সহসা এসময় ওকে চমকে দিয়ে একটি কাক ছোঁ মারে খাদ্যপত্রে; ফের ওকে চমকে দিয়ে আচমকা রমজানের ভাঙা বেড়া পেরিয়ে ঢুঁস মারতে মারতে একটি গরু এসে সেখানে মুখ দেয়।
সরলার চোখ ফেটে ভালোবাসা ও বাৎসল্যের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
পিছনে বৌ-ঝিরা উলুধ্বনি দিতে থাকে।
এক ভ্রুণশিশুর মতো ফটফটে জ্যোৎস্নায় ভাসতে ভাসতে শেষবারের মতো সরলা কঁকিয়ে ওঠে, ‘বাবা, বাবাগো। ’



বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।