ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

অপরাহ্ণ | সাইফুল্লাহ সাইফ

গল্প/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৪
অপরাহ্ণ | সাইফুল্লাহ সাইফ অলঙ্করণ : শারমিন সুলতানা

ঋতুর এ পেশায় পোশাক পরিচ্ছদের সাথে সাঁজটা নিখুঁত থাকা জরুরি। কাজে নামার পর, শুরুর দিকে ঋতু চাহিদা অনুয়ায়ি ঠিকমতো সাজাতে পারতো না নিজেকে।

কোথাও না কোথাও একটি ত্রুটি লেগেই থাকতো যেন। হয় কপালে টিপ একপাশে সরে আসবে, না হয় ঠোটের আশেপাশে লিপস্টিক লেপটে গেছে, অথবা শাড়িটি ঠিকমতো পরা হয়নি। শাড়ি পরা তার সবচেয়ে অসহ্য লাগে। শাড়ির এ প্রান্ত ঠিক করতে না করতে অন্যপ্রান্ত বেসামাল হয়ে গেলো! ঠিকমতো কুঁচি হলো কি হলো না হাজারটা ঝাক্কিঝামেলা একসাথে সামলাও। সর্দারটাও অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে তাকে আর ‘এইটা হয় নাই’, ‘ওইটা হয় নাই’- বলে চোখ রাঙ্গানি তুলবে, চওড়া-উত্তপ্ত বাক্যে আওয়াজ দেবে। এই মানুষটা যেন ত্যাড়া ভাষা ছাড়া কথা বলতে জানে না। আর দলে তো কেবল সে একা নয়, আরও আটদশজন কাজ করে একই দলে। কই আর কারো কোনো ত্রুটি তো সর্দারের নজরে আসে না! অবশ্য দলের বেশিরভাগই শুরু থেকে ঋতুর প্রতিকূলে খেটে আসছে। সর্দারকে ক্ষেপিয়ে তার বিরুদ্ধে একটা না একটা ঘাপলা বাঁধাবেই তারা। এতে ওরা আনন্দ পায়।

ব্যতিক্রম কেবল ছন্দা। দলের মধ্যে একমাত্র ছন্দাই প্রথম থেকে তাকে পজেটিভলি একসেপ্ট করেছে। ছন্দার সাথে ঋতুর সম্পর্কটি অন্যরকম। ওদের দুজনের বোঝাপড়া ভালো। ছন্দার আন্তরিকতা না পেলে ঋতুকে নির্ঘাত পথে বসতে হত এখন। নিজের হাতে কাজের সব নিয়ম কানুন শিখিয়ে ঋতুকে দলে অন্তর্ভুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে ছন্দা। তারপর আপন করে তাকে বানাল প্রাণের সই। নিজে যত্ন নিয়ে ঋতুকে শাড়ি পরিয়ে চুল ঠিকঠাক করে দিতো, মেকআপ মেখে দিতো। শেখাতো, কীভাবে কথা বলতে বলতে কথার স্রোতে শরীরকে চালাতে হয়। ঋতুর নিজের চেষ্টাও কি কম ছিলো! প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতো। একটু সময় লাগলেও ঋতু ষোল আনাই কব্জা করে ফেলেছে এরইমধ্যে। দলের একজন দক্ষ কর্মী সে এখন।

সকাল আঁটটার মধ্যে রেডি হয়ে ঋতুকে চলে আসতে হয় কাজে। প্রথমে সর্দারের নির্দেশে দলের সদস্যরা একটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে একত্রিত হয় । তারপর কাজ লেগে পড়ে ।

সপ্তাহ বাদে ঈদ । ঈদ মরসুমে ওদের বাড়তি ইনকাম । আজকের শিডিউল পুরাতন বাস টার্মিনাল । এখানকার ব্যবসা জমজমাট । ব্যবসায়ীদের হাতে কাঁচা পয়সা । পঞ্চাশ একশো ছাড়তে দ্বিধা করে না তারা । তবে একটু বারগেনিং করতে হয় কিছু কিছু আঁতেল ব্যবসায়ীদের সাথে । এরা সহজে পকেট খসায় না । সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে একটু নেচে-কুদে গায়ে ডলাডলি করতে হয় এদের সাথে ।

এই দলের সর্দার রত্না আগে মরদ হিজড়া ছিলো। কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া থেকে সেক্স কনভার্ট করে এখন পুরোপুরি মাগি সেজে এসেছে। তার দাপট এখন দেখে কে! ওপর তলার লোকজনের তলি পর্যন্ত তার হাত পৌঁছে গেছে। বেশ কয়েকটি বাংলা ফিল্মেও হিজড়ার পার্টে কাজ করেছে রত্না। ফিল্ম টিল্ম ভালোই বুঝে সে। র‌্যাব, পুলিশ কাউকে তোয়াক্কা করে না সে। এজন্যই এতো বড় একটি দল কি অনায়াসে তার আনুগত্যে চলে!
সর্দার ঋতুকে কাজে নিতে চায়নি প্রথমে। ঋতু তার পেছনে আঠার মতো লেগে থেকেছিলো বহুদিন । সর্দারের এক জবানের কথা, ‘এইটা কোনো সহজ কাম না যে ইচ্ছা হইলো করলা, ইচ্ছা হইলো ছাইড়া দিলা । এই লাইনে কাম করতে চাও তো ভালো কইরা নিয়মকানুন জানো আগে। যোগ্য হোয়া আসো, কামে লমু। কোনো ধোঁকাবাজির জায়গা না এইটা। আমরা জান দিয়ে ভালোবাসি এই পেশা। এঁরে তো কলঙ্ক দেওন যায় না!’
সর্দারের ইঙ্গিত বুঝতে পারে ঋতু। যোগ্য হওয়ার অর্থ কি তা সে ভালো করেই জানে। কিন্তু সর্দারের এই কঠোর নিয়মের গণ্ডিতে নিরুৎসাহিত না হয়ে ঋতু বরং একগুঁয়েভাবে লেগে থেকেছিলো তার সাথে। সর্দারকে বাধ্য করেছে তাকে কাজে নিতে। ছন্দারও হাত আছে দলে তার জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে। তার বর্তমান অবস্থা দলের অন্যসব সদস্যদের তুলনায় খুব একটা খারাপ না। ইতোমধ্যে তারও আলাদা একটা পরিচিতি দাঁড়িয়ে গেছে। ঋতু হিজড়াকে অনেকেই চেনে এখন। কেউ কেউ তাকে ‘ডার্লিং! ডার্লিং!’ সম্বোধন করে। তার সাথে দুষ্টুমি তামাশা করতে আসে।

আজকের মতো কালেকশন শেষ। সন্ধ্যা প্রায়। একটি নির্জন জায়গা খুঁজে নিয়ে বসলো ওদের দলটি। চায়ের দোকানের পেছনে ছোট্ট কামরা । সর্দার একজন একজন করে আজকের আয়ের অংশ বুঝিয়ে দিচ্ছে।
ঋতু নিজের পাওনা অংশের টাকাটা গুনে দেখলো। যে বাড়তি ইনকামের ভাগ নিয়ে আজকের সারাটা দিন তার মধ্যে বাড়তি উত্তেজনা ছিলো, টাকাটা হাতে নিয়ে গুনে দেখার পর এক মুহূর্তে তার মুড পাল্টে গেলো।
ঋতু সর্দারের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হলো, ‘কম দিলা যে ওস্তাদ! আইজ তো ইনকাম ভালো। ’
সর্দারের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা ভারি অন্যায়। এই অন্যায় সাহস তার দলের কারো নেই। তাই ঋতুর প্রতিবাদকে অন্য সদস্যরা যতোটা না সমর্থন দেবে তার চেয়ে বেশি তারা অবাক হলো তার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা দেখে। ‘কত্ত বড় আস্পর্ধা অর সর্দারের লগে বিরোধ করতে যায়!’
সর্দার তার নিয়মমতো ক্ষেপে গেলো। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে এখনি যেন ঋতুর গর্দান কাটতে বসবে।
‘তোর বাবাগো ভাগেরডা কি তুই দিবি? আলম মাস্তানের চান্দা একভাগ, থানা পুলিশরে দেওন লাগে একভাগ! আবার ঐ যে ছন্দা মাগিটা অসুখে পইড়া চিত্তাইয়া আছে—অর চিকিৎসা করবো কে হু?’
‘ইনকাম বাড়ুক কমুক এইটাই তোর পাওনা। পোষাইলে থাকবি না পোষাইলে চইল্লা যাবি। তরে তো কেউ আটকাইয়া রাখে নাই। দলে যে তরে নিছি এইডাই তোর ভাইগ্য। একবার নিজেরে দেখছিস? কি আছে তোর ক তো দেহি?’
সর্দারের কথার যৌক্তিকতা ঋতু বোঝে। সত্যিই তো! কি আছে তার? এই কাজের যোগ্যতা তো এক তিলও তার নাই।

ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে আসে। তার ঘরটা একটি ঘিঞ্জির ভেতর, পুরনো আমলের বিল্ডিং। দিনের বেলাতেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত নামলে পাতালপুরির নির্জনতা এসে ঘরে ঢুকে। ঋতু ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে লাইটের সুইচটা অন করে দেয়। একটা জরাজীর্ণ ঘর। নোনা ধরা দেয়াল। মলিন আসবাব। পাশে টেবিলে সাজানো থরে থরে বই।
ঋতু ড্রেস চেঞ্জ করতে থাকে। প্রথমে শাড়ি, তারপর ব্লাউজ, ব্রা, পেটিকোট। পরচুলাটি পাশেই খাটের উপর ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর লুঙ্গি পরে। একটি সাদা সেন্ড গেঞ্জি গায়ে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। কপালের টিপটি উঠিয়ে নিয়ে সেঁটে দেয় আয়নার এক কোনে। মুখে পানি ছিটিয়ে ধুয়ে ফেলে লিপস্টিক, বাসি বিবর্ণ মেকআপ। সেলফোনটি হাতে নিয়ে একটি নম্বর ডায়াল করতে থাকে। অতপর ফোনে কথা ভেসে আসে, ‘হ্যালো! বাবা রফিক!’
এই নামে ডাকলে ঋতু হিজড়া আর হিজড়া থাকে না, রফিক হয়ে যায় ।
রফিক নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে এবার বলে, ‘মা বিকাশে টাকা পাঠাইছি । পাইছো?’
ফোনের ওপর পাস থেকে জবাব আসে, ‘হ বাবা! টাকা পাইছি! এতো দেরি করলি যে? তোর বাপের তো ওষুধ-পত্তর শেষ হইয়া গেছে!’
‘মা! অফিসের নিয়ম কানুন তো তুমি বুঝবা না! এই মাসে বেতন দিতে দেরি করছে । প্রাইভেট কোম্পানির চাকরীতে এমনিতে টাইমমত বেতন পাওয়া যায় না। তা তোমার শরীর ভালো তো?...’ 



বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।