ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৫২) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৫২) || অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
_________________________________

৫১তম কিস্তির লিংক

কোনো আপেল খেয়েছি কিনা আমার মা কখনই জিজ্ঞেস করত না, কারণ আমরা স্বীকার করব না জানত সে। বরং সে জিজ্ঞেস করত কয়টা খেয়েছি, প্রশ্নটা এমন চতুরভাবে করা যে উত্তরটি সে জানতে চায়: আমরা ফলটি খেয়েছি কিনা, তা যেন এমনিই বেরিয়ে আসে। আর আমরা, সুক্ষ্ণভাবে সংখ্যার উল্লেখে পাতা এই ফাঁদে ধরা দিতাম, বলতে বাধ্য হতাম যে আমরা মাত্র একটা আপেল খেয়েছি।

লারতিগুতে ফল মিলল না কারণ ও একেবারে নির্বোধ না: ও সন্দেহ করল আমার এই প্রশ্নের সঙ্গে আরও কোনো ব্যাপার জড়িত, যে কারণে কৌশলে প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে যেতে চাইল সে:
‘আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। ’

বলেই সে আবার তার বই আর পুরস্কার নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। সত্যিকারের বিরক্তিতে আমি চেচিয়ে উঠলাম:
‘তোমার বই নিয়ে তো বিরাট অন্যায় হয়ে গেছে দেখছি!’

এটা বলে বাড়ি ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। লারতিগু বোকা না, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে অনেক কিছুই বলে ফেলেছে।
তিনটা বাজে। এতক্ষণে মারিয়ার বুয়েন্স আয়ার্সে পৌঁছে যাওয়ার কথা। স্টুডিওতে ফেরা পর্যন্তু ধৈর্য থাকল না আমার, এক ক্যাফে থেকে ফোন করলাম ওকে। জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বললাম:
‘তোমার সঙ্গে এক্ষুণি দেখা করতে চাই। ’

আমার ঘৃণা গোপন রাখার চেষ্টা করলাম যথাসম্ভব, কারণ আমি ভয় পাচ্ছিলাম ও যদি কোনোরকম সন্দেহ করে বসে, তাহলে ও আসবে না। বরাবরের মতো, লা রিকোলেতায় পাঁচটার সময় দেখা হবে ঠিক হল।
‘যদিও আমি জানি না দেখা হলে কি লাভ হবে,’ সম্মতি দিয়ে দুঃখিত গলায় বলল ও।
‘হবে,’ জবাব দিলাম আমি। ‘অনেক লাভ হবে। ’
‘তুমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করো?’ নিরাশার গলা ওর।
‘অবশ্যই। ’

‘কি জানি, কিন্তু আমার বিশ্বাস আমরা পরস্পরকে শুধু আরও আঘাতই করব, যে ছোট ভঙ্গুর প্রায় সেতুটা এখনও আমাদের মধ্যে আছে সেটুকুও ধ্বংস করে ফেলব, পরস্পরকে আরও নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে করে...তোমার পীড়াপিড়ির কারণেই শুধু আমি আসছি, কিন্তু আমার আসলে এসতানসায়াতেই থেকে যাওয়া উচিত। হান্তের অসুস্থ। ’
‘আরেকটা মিথ্যা,’ মনে মনে বললাম আমি।
‘ধন্যবাদ,’ শুকনোভাবে জবাব দিলাম। ‘তাহলে এসো, ঠিক পাঁচটায় দেখা হবে। ’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সম্মতি জানাল মারিয়া।

পাঁচটার আগেই লা রিকোলেতার পৌঁছুলাম, বরাবর আমরা যে বেঞ্চটায় বসতাম, তার কাছে আসার পর, নিরাশাপূর্ণ একজনে পরণিত হলাম: এখানকার গাছ, রাস্তা আর বেঞ্চগুলো দেখেই মন বিষন্ন হতে শুরু করল, এগুলো সব আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী। বিষাদের সঙ্গে মনে পড়ছে লা রিকোলেতা আর প্লাসা ফ্রানসিয়ার বাগানে কাটানো আমাদের সেই সব মুহূর্তের কথা, আর কিভাবে, সেসব দিন এখন কত দূরের স্মৃতি হয়ে গেছে, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম আমাদের ভালোবাসা চিরস্থায়ী হবে। সব কিছু তখন ছিল চোখ ধাঁধানো, অলৌকিকতায় ভরা, কিন্তু এখন পৃথিবী ঢেকে গেছে আধারে, ঠাণ্ডায়, পৃথিবীর আর কোনো অর্থ নেই। এই সময়ে মুহূর্তের জন্য, এখনও সামান্য যা কিছু প্রেম অবশিষ্ট আছে তাও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক পেয়ে বসল আমাকে, সঙ্গে একাকিত্বের ভয়ও আমাকে পুরো দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলল। আমি মনে মনে ভাবলাম যে সন্দেহে আমি নিদারুণভাবে দগ্ধে মরছি, তা কি সম্ভব এক পাশে সরিয়ে রেখে দেওয়ার। আমাদের সম্পর্কের বাইরে মারিয়ার কার সঙ্গে সর্ম্পক রাখল তাতে আমার কি যায় আসে? এই বেঞ্চ আর এই গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে, আমার মনে হল ওকে ছাড়া কখনই আমি নিজেকে ভাবতে পারি না, শুধু এমনও যদি হয় আমার থাকার মধ্যে থাকল কেবল ওর সঙ্গে ওই যোগাযোগের মুহূর্তগুলো, আর আমাদের একত্রিত করা রহস্যময় ওই প্রেম। কিন্তু আমি যত বেশি এটা নিয়ে ভাবলাম, ততই আমার মধ্যে নিশর্তভাবে ওর ভালোবাসা মেনে নেওয়ার একটা চিন্তা ক্রমশ গ্রহণীয় হয়ে উঠতে শুরু করল, আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করল আমার নিজের নিঃস্ব হয়ে পড়ার আতঙ্ক, যাকে বলে একেবারে নিঃস্ব হওয়া। আর এই আতঙ্ক থেকেই অঙ্কুরিত হয়ে পরে পুষ্পে পরিণত হল, যা আসলে এক ধরনের নমনীয়তা, যা কেবল উপায়ন্তরহীন লোকদেরই থাকে। এখনও কিছুই হারিয়ে যায়নি, এরকম একটা উপলব্ধি হওয়ার পর আমার মধ্যে কুলপ্লাবি এক সুখবোধের জন্ম হল, মনে হল এই মুহূর্তই হয়তো নতুন এক জীবনের সূচনা করতে পারে।
 
দুভার্গ্যজনকভাবে, মারিয়া আবারও আমাকে বিফল করল। পাঁচটায়, আতঙ্কিত, প্রায় উন্মাদের মতো আমি মারিয়াকে ফোন করলাম। ওরা আমাকে জানাল মারিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে এসতানসায়ায় ফিরে গেছে। আমি কোনো কিছু ভাবনা চিন্তা না করে, কাজের মহিলার উদ্দেশে চিৎকার করে উঠে বললাম:
‘কিন্তু ও আমাকে বলেছিল পাঁচটায় আমাদের দেখা হবে!’

‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না, সিনর,’ জবাব দিল সে, কেমন যেন ভীত গলা। ‘কিছুক্ষণ আগে একটা গাড়ি করে রওনা দিয়েছেন সিনোরা, এবং কমপক্ষে এক হপ্তা থাকবে বলেছেন। ’

(চলবে)


বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।