ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আন্দামানের সেলুলার জেলে কিছুক্ষণ

সরকার আমিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১০
আন্দামানের সেলুলার জেলে কিছুক্ষণ

ছোটবেলা থেকেই আন্দামান বা কালাপানি নিয়ে কতশত গল্প শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। ব্রিটিশ আমলে  বিপ্লবীদের আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া হতো।

ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাও করা হতো। একবার নাকি এক বিপ্লবী কয়েদি ঘুড়ি বানালেন। দিলেন উড়াল। ব্রিটিশরা তো অবাক। ভারতের মাটি থেকে পনের শ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলঘেরা দ্বীপ, সেখান থেকে পালাবে সাধ্য কার? চাঞ্চল্যকর কাহিনী। কাহিনীর সত্যতা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে।   তবে কারাগার অধ্যুষিত এই দ্বীপটির চাঞ্চল্যকর কিংবদন্তির কোনো শেষ নেই। সেই অভিশপ্ত দ্বীপে যাচ্ছি বেড়াতে। বরাবরের মতো সঙ্গে আছেন সাদ কামালী। কলকাতায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন কবি প্রদীপ মজুমদারসহ আরো তিন বন্ধু।


কলকাতা থেকে বিমান। দুই ঘণ্টার ঘনজার্নি। কলকাতা থেকে জাহাজে আন্দামান যেতে লাগে চার দিনের মতো।   সে কারণে বিমানই ভরসা।   স্বচ্ছ আকাশ। জেট লাইটের বড়সড় বিমানটা আকাশে সাঁতার কাটতে কাটতে এগিয়ে যাচ্ছে আন্দামানের পথে। বিমানের জানালায় আমার সদাজাগ্রত চোখ। মন উড়ে গিয়ে বসেছে ইতিহাসের কাঁধে। ঘণ্টা দেড়েক পর চোখে পড়তে লাগল ছোট ছোট অস্পষ্ট দ্বীপ। যেন শিশুদের খেলনার মতো পাহাড়, ঘরবাড়ি আর জংলা।

পোর্টব্লেয়ারের বন্দরে বিমান থেকে নামতেই  জানলাম দ্বীপে প্রবেশ করার আগে কাস্টমস থেকে বিশেষ অনুমতিপত্র নিতে হবে। অনুমতি সংগ্রহ করার বিষয়টি অবশ্য আগেই জানতাম। এ নিয়ে যেসব ঘটনা মঞ্চস্থ হয়েছে যাত্রার কয়েক দিন আগে থেকে তা নিয়ে ধারাবাহিক নাটক হতে পারে। যাক সেসব কথা। শেষ পর্যন্ত যে পোর্টব্লেয়ার পৌঁছুতে পেরেছি সেটাই ভাগ্যের ব্যাপার। কাস্টমস অফিসার সৌজন্যের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন কেন আমি আন্দামান এসেছি।
‘এসেছি ভাই বেড়াতে, নিশ্চয়ই নির্বাসিত হতে নয়’। বললাম। অফিসার গম্ভীর হলেন।
অফিসারের কক্ষে এরই মধ্যে চলে এসেছেন এয়ারপোর্টে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। এবার রীতিমতো জেরা চলতে লাগল। আমি কে, কোথায় কাজ করি, কবে ভারত এসেছি, আন্দামানে কী করব, আরও ডজনের পর ডজন প্রশ্ন। মুখে মৃদু হাসি অব্যাহত রেখে প্রশ্নগুলোর যথাসাধ্য উত্তর দিতে লাগলাম।
মোটামুটি ঘণ্টাখানেক অম্লমধুর কথোপকথন ওরফে ইন্টারোগেশনের পর অফিসারগণ সন্তুষ্ট হলেন। তারা মৃদু হেসে অসুবিধা সৃষ্টির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললেন ‘ওয়েলকাম এট আন্দামান’। কিছুক্ষণের মধ্যেই পারমিট পেয়ে  এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে গেলাম। মনে মনে বেশ খানিকটা বিরক্ত হলেও মনকে বোঝালাম ইহা বাস্তবতা। চারদিকে যে হারে টেররিস্ট বাড়ছে এবং ভারত যেভাবে সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে তাতে বাড়তি নিরাপত্তাবোধ থাকাটা আমার জন্য বিড়ম্বনার  হলেও রাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি।

একটু বিশ্রাম নিতে মনস্থ করলাম।   বিকেলে বের হলাম পোর্টব্লেয়ার ঘুরে দেখতে এবং সন্ধ্যায় গেলাম আন্দামানের মহাকুখ্যাত সেলুলার জেলে। মূলত যা দেখতে আন্দামানে এসেছি।


আমার চোখের সামনে সেলুলার জেল

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলেছেন, লড়াই করেছেন, বিপ্লব করেছেন তাদেরই অনিবার্য গন্তব্য হয়ে ওঠেছিল আন্দামান সেলুলার জেল। ১৯০৬ সালে ৬৯৮টি সেল নিয়ে তৈরি হয় এই জেলটি। সাম্প্রতিক সময়ে কুখ্যাত ইরাকের আবু গারিব  জেলের মতোই নির্মমতা ও  নিষ্ঠুরতার প্রতীক হয়ে আছে সেলুলার জেলটি। ১৩ ফুট দৈর্ঘ্য আর ৬ ফিট প্রস্থ এক একটি কক্ষে বছরের পর বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের। খাদ্যের নামে বন্দিদের যা দেওয়া হতো তা ছিল অত্যন্ত নোংরা। ছিল অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। নির্যাতন ছিল প্রাত্যহিক রুটিনের অন্তর্গত। অসংখ্য রাজনৈতিক বন্দি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এসব মহান বন্দির মধ্যে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা থেকে নির্বাসিত বন্দির সংখ্যা বিস্ময়কর রকম বেশি। এক হিসেবে দেখা গেছে জেলটিতে ১৯৩৭ সালে  মোট বন্দি ছিলেন ৩৮৫ জন। এর মধ্যে বাংলার বন্দির সংখ্যা ছিল ৩৩৯ জন। বাকি বন্দিরা বিহারের ১৯, উত্তর প্রদেশের ১১, আসামের ৫, পাঞ্জাবের ৩, দিল্লির ২ এবং মাদ্রাজের  ২ জন।

ফাঁসির মঞ্চের ছোট ঘরটির পাশে দাঁড়ালাম। তিনটি দড়ি ঝুলে আছে। নিচে  কুয়োর মতো ভূগর্ভস্থ কক্ষ। ফাঁসি কার্যকর হলে মৃতদেহ ছুড়ে ফেলা হতো গভীর সমুদ্রে। আমরা নির্বাক। আহা, ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন আমাদের পূর্বসূরিরা। অথচ কী আশ্চর্য, আমরা তাদের ভুলে গেছি। অনেকের নামও জানি না।   সেলুলার জেল থেকে বের হয়ে এলে চোখে পড়বে কয়েকজন বিশেষ বন্দির ভাস্কর্য। যারা জেলে চরম নির্যাতনের মুখে গর্জে উঠেছিলেন। ১২ মে ১৯৩৩ সালে জেলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বন্দিরা প্রথম অনশন ধর্মঘট করেন। এই অনশন শেষ হয় ২৬ জুন। অনশন করে মৃত্যুবরণ করেন মহাবীর সিংহ, মোহন কিশোর ও মোহিত মিত্র। ব্রিটিশ রাজ চমকে ওঠে এই অপ্রত্যাশিত কারা বিদ্রোহে। তারা আলোচনায় বসে কয়েদিদের সঙ্গে। কয়েদিদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়।

সেলুলার জেলের এক মহান কয়েদির নাম ভীর সাভারকার। তিনি সবার থেকে বেশি দিন জেল খেটেছেন। আন্দামানের একমাত্র এয়ারপোর্টটির নামকরণ করা হয়েছে এই মহান বিপ্লবীর নামে। বাংলাদেশের সন্তান উল্লাসকর দত্তের নাম জ্বলজ্বল করছে কারা-স্মারকে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসে তিনি ইংরেজদের দাসত্ব না করে বিপ্লবে দীক্ষা নিয়েছিলেন। পরিণামে আন্দামানে নির্বাসন। তাকে জেলে এমন নির্যাতন করা হয়েছিল যে তিনি এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আমার শৈশবে উল্লাসকর দত্তের নামে কত রোমঞ্চকর  কল্পকথাই না শুনেছি। তাঁর স্মারকের সামনে মাথা নত করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।


আন্দামান ১৮৪টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। ১৭৮৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেব মিস্টার ব্লেয়ার আন্দামানে অধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তখন দ্বীপজুড়ে বসবাস করতেন বেশ কিছু আদিবাসী মানুষ। একপর্যায়ে সাহেবরা প্রতিকূল আবহাওয়ায় নাকানিচুবানি খেয়ে দ্বীপ ছেড়ে চলে আসেন। তবে জরুরি প্রয়োজনে ইংরেজরা ১৮৫৮ সালের জানুয়ারির দিকে ভেবেচিন্তে  সিদ্ধান্ত নিলেন ভারতবর্ষের বিদ্রোহী মানুষকে এই দ্বীপে এনে বন্দি করে রাখলে বেশ হয়। কারণ জঙ্গলে প্রচুর হিংস্র প্রাণী আছে। আর পাহারার কাজে থাকবে প্রচুর হিংস্র ইংরেজ ও তাদের পোষ্য। এরই মধ্যে তথাকথিত ‘সিপাহি বিপ্লব’ ওরফে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু  হলো। সিপাহিরা  ও শেষ নবাব বাহাদুর শাহ পরাজিত হলেন। ইংরেজরা ভয়াবহ প্রতিশোধ নিতে লাগলেন। হাজার হাজার সিপাহি ও দিল্লির অধিবাসীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। দিল্লির প্রায় প্রতিটি গাছের ঢালেই তখন ঝুলেছিল বিদ্রোহীদের লাশ। এত ঝোলানোর পরও প্রচুর মানুষ বাদ থেকে যায়। কান্ত ইংরেজ প্রশাসন বুদ্ধি বের করল। তারা আবিষ্কার করল পুনরায় আন্দামানকে। শুরু হলো জেল গড়ার কাজ।

১০ মার্চ ১৮৫৮।   জে বি ওয়াকারের নেতৃত্বে ২০০ জন বিদ্রোহীকে নিয়ে প্রথম জাহাজ ভিড়লো আন্দামানে। দ্বিতীয় ব্যাচ বন্দি-বিদ্রোহী আসেন করাচি থেকে ১৮৬৮ সালে। তাদের সংখ্যা ছিল ৭৩৩। তারা সবাই ছিলেন যাবজ্জীবন দণ্ড প্রাপ্ত। এরপর আর হিসাব-নিকাশ নাই। হাজার হাজার বিদ্রোহী মানুষ যারা ইংরেজ রাজত্ব চাননি ভারতবর্ষে, তারা আসতে লাগলেন আন্দামানে ইংরেজদের হাতে আক্ষরিক অর্থেই শৃঙ্খলিত হয়ে, দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে। তাদের সংখ্যা, তাদের নাম, তাদের ঠিকানা কেউ কোনোদিন জানবে না আর। সব তথ্য নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

তখনকার আন্দামান ছিল বন্দিদের সামনে নরকেরই জাগতিক সংস্করণ। সারা বছর লেগে থাকা বর্ষা, কর্দমাক্ত পথ, বড় বড় পাহাড়ি জোঁক। জল ও খাবারের অসীম অভাব। কয়েদিদের শ্রমে পাহাড় কাটা, জংলা সাফ করার বাধ্যতামূলক কাজ।

মার্চ ১৮৬৮। ২৩৮ জন কয়েদি চেষ্টা করলেন পালাতে। কিন্তু এপ্রিল মাসের মধ্যেই সবাই আবার ধরা পড়লেন ইংরেজদের হাতে। জেলার ওয়াকারের আদেশে ৮৭ জনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয় পালানো চেষ্টার অভিযোগে। তারপরও প্রতিরোধ চেষ্টা থেমে থাকেনি। ওহাবি আন্দোলনের সূত্রে আন্দামান এসেছিলেন শের আলী যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে। লর্ড মেয়কে বাগে পেয়ে শেরআলী সোজা চাকু বসিয়ে দিলেন তার বুকে। লর্ড নিহত হলেন বন্দি শের আলীর হাতে। এ ছিল প্রতীকী খুন। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৭২-এ কাইপার আইল্যাণ্ডে শের আলীকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

১৮৯৬ সালে সেলুলার জেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাজটি শেষ হয় ১৯০৬ সালে। এই জেলে সেলের সংখ্যা ৬৯৮টি। এ কারণে জেলের নামকরণ করা হয় সেলুলার জেল।
ভারতবর্ষে ইংরেজদের জন্য বিপজ্জনক বন্দিদের এনে রাখা হতো এইসব নির্জন সেলে। একটি ম্লান সন্ধ্যায় সেলুলার জেলের একটি নির্জন সেলে দাঁড়িয়ে আমি সেইসব মহান বন্দির দীর্ঘশ্বাস আর তীব্র মনোবলকে যুগপৎ অনুভব করেছিলাম।
 [email protected]

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৯১৬, জুলাই ২৩, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।