ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৬) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৬) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান অলঙ্ককরণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। –অনুবাদক
___________________________________

১৫তম কিস্তির লিংক


‌এটাই একমাত্র ঘর যার ভেতরে কেউ ঢুকতে পারে,’ বললেন তিনি। “অন্য ঘরগুলো সিল করা। ”
“কেন?”
“বাড়িটা বন্ধক রাখা হয়েছে। ”
কথাটা শোনার পর আমার শরীর দিয়ে হিমপ্রবাহ বয়ে গেল।
সবকিছু তারা বন্ধ করে চলে গেছে। আমাকে ফেলে রেখে গেছে এখানে। কত দিন যে গেল, জানি না। ”
তিনি তার ধূমপানের পাইপটা বের করলেন আর মাথাটা দোলাতে থাকলেন।
“মাঝে মাঝে এস্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা কোথায় কি আছে খোঁজ-খবর করে যায়। তারা যে কী করবেন, এখনও ঠিক করতে পারেননি। ”
“কাদের কথা বলছেন?”
“ওই এস্টেট ডিপার্টমেন্টের লোকদের কথা। ”
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না তিনি কি বোঝাতে চাইছেন। কিন্তু মনে পড়ে গেল ভেঙে-পড়া সেই কাঠের সাইনবোর্ডটির কথা, যাতে লেখা ছিল: ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনালয়’।
“আপনি কি অনেক দিন ধরে এখানে আছেন?”
“ওহ্, হ্যাঁ... হাওয়ার্ড দ্য লুজ... ফ্রেডির দাদা, তার মৃত্যুর পর আমি এখানে আসি… এই জমিজমার দেখভাল আমিই করতাম আর ছিলাম ফ্রেডির দাদীর গাড়ির বেতনভুক চালক...”
“আর ফ্রেডির বাবা-মা?”
“আমার মনে হয় তারা অল্প বয়সেই মারা গেছেন। দাদা-দাদীই ফ্রেডিকে মানুষ করেছেন। ”
তাই যদি হয়, মনে হলো, আমার দাদা-দাদী আমাকে বড় করে তুলেছেন। দাদার মৃত্যুর পর আমি এখানে আমার দাদী মাবেল দোনাহুর কাছেই বড় হয়েছি।
“আপনার নাম কি?” আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“রবার্ট। ”
“ফ্রেডি আপনাকে কি বলে ডাকতেন?”
“ওর দাদী আমাকে বব বলে ডাকতেন, তিনি ছিলেন আমেরিকান। ফ্রেডিও আমাকে বব বলে ডাকতেন। ”
আমার কাছে বব নামের কোনো মাহাত্ম্য নাই। কিন্তু তারপরও মনে হলো তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না।
“এর পর ফ্রেডির দাদী মারা যান। অর্থনৈতিক ব্যাপারস্যাপারগুলো তখন থেকেই নাজুক হয়ে পড়ছিল। ফ্রেডির দাদা তার স্ত্রীর ধনসম্পদকে খোলামকুচির মতো দুই হাতে উড়িয়েছেন ... তার স্ত্রীর সম্পদ ছিল অঢেল...”
অবিচল ভঙ্গিতে তিনি তার পাইপ টানছেন আর নীল ধোঁয়ার সরু রেখাগুলো ঘরের সিলিংয়ের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় স্টেইন করা কাঁচ দিয়ে এই ঘরের জানালাগুলো তৈরি এবং ফ্রেডি, অর্থাৎ আমার ডেকোরেশন করা দেয়াল ও সিলিংটা নিঃসন্দেহে তার কাছে স্বর্গের মতোই লাগবে।
“এরপর ফ্রেডি কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন... কোনো কিছু না জানিয়েই... কি ঘটেছিল জানি না। কিন্তু সব ধনসম্পদ আটকে যায়। ”
আবার সেই “বন্ধকের” কথাটা ফিরে এল। মনে হলো, যখনি আমি একটা প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে চাইছি, তখনই কোনো একটা দরোজা সশব্দে যেন আমার মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
“এরপর থেকে আমি অপেক্ষা করছি… তারা আমাকে নিয়ে কী করবেন, ভেবে তার কোনো কুলকিনারা পাচ্ছি না... আর যাই হোক তারা তো আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবেন না। ”
“আপনি কোথায় থাকেন?”
“পুরানো একটা বাড়িতে। ফ্রেডির দাদা সেই বাড়ির ঘরগুলোকে ঠিকঠাক করে একেবারে বদলে ফেলেছিলেন। ”
তিনি গভীরভাবে আমাকে বুঝবার চেষ্টা করলেন, পাইপটা দাঁতের মাঝে চেপে ধরলেন।
“আপনার খবর কি? আমেরিকাতে ফ্রেডির সঙ্গে আপনার কিভাবে পরিচয় হয়েছিল, বলেন তো। ”
“ওহ্… সে এক লম্বা কাহিনি…”
“আপনি কি একটু হাঁটাহাটি করতে চান? ওই দিকে যে জায়গাটা আছে, আপনাকে সেই জায়গাটা দেখিয়ে আনতে পারি। ”
“সানন্দে, চলুন। ”
তিনি ফরাসি ঘরানার জানালাগুলো খুললেন এবং আমরা পাথরের কয়েকধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে নিচে নেমে এলাম। দাঁড়ালাম একটা লনের সামনে, শতেঈ পৌঁছুবার জন্য যে লনটা অতিক্রম করে এসেছিলাম, এই লনটা মনে হলো তেমনি একটা লন। কিন্তু এখানে ঘাস ততটা উঁচু নয়। আমি বিস্মিত হলাম এটা দেখে যে শতেঈর পেছনে তেমন কোনো তোরণ বা প্রবেশপথ নেই। জায়গাটা ধূসর পাথর দিয়ে নির্মিত। ছাদটাও একইরকম নয়, টুকরো টুকরো করে কাটা ত্রিকোণ আকারের পাথর আর চাঁদওয়ারি দিয়ে ছাদের এই দিকটা কিছুটা প্রসারিত করে বানানো। প্রথম দর্শনে মনে হবে বাড়িটা বুঝি ত্রয়োদশ লুইয়ের বাড়ি। পেছন দিকে থেকে আবার মনে হতে পারে উনিশ শতকের শেষের দিকে তৈরি সমুদ্রপাড়ের কোনো রিসর্ট ম্যানশন। বিরল-দর্শন সেই সব রিসোর্টের কোনো একটা বুঝি এখনও বিয়ারিৎসেতে অস্তিত্ব বজায় রেখে টিকে আছে।     
“পার্কের এই পুরো জায়গাটা আমি সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছি,” বললেন তিনি। “কিন্তু একজন মানুষের পক্ষে এভাবে সংরক্ষণ করা সহজ ব্যাপার নয়। ”

লন ঘেঁষে কাঁকরের যে পথটা চলে গেছে, আমরা সেই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আমাদের বাঁ দিকে অনেক ঝোঁপঝাড়, মাথা সমান উঁচু, যত্ন করে ছাটা। তিনি ওই ঝোঁপের দিকেই এগিয়ে গেলেন:
“গোলকধাঁধা। এটা বানিয়েছিলেন ফ্রেডির দাদা। আমি যতটা পারি দেখে রাখছি। আসলে আগে যেমন ছিল, তেমন কিছু জিনিস তো অবিকৃত থাকা দরকার। ”
পাশের একটা প্রবেশপথ দিয়ে আমরা গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। সামনেই সবুজ ভূমি, খিলানের তল দিয়ে যাচ্ছি বলে মাথাটা নিচু করতে হলো। অসংখ্যা পথ পরস্পরকে ভেদ করে চলে গেছে। আড়াআড়ি অনেক রাস্তা, কোনোটা ঘোরানো, কোনোটা চক্রাকার, কোনোটা ডান দিক বেঁকে চলে গেছে, পথের শেষ নেই, সবুজ বেঞ্চের কুঞ্জবন... ছেলেবেলায় আমি নিশ্চয়ই এখানে আমার দাদা বা সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছি। মনোরম এই জায়গায়, যেখানে সবুজ ঘাস আর পাইনের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে, এরকম স্থানেই, আমি জানি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কেটেছে। গোধকধাঁধাটা পেরিয়ে আসার পর একটা কথা আমার গাইডকে না বলে পারলাম:
“অদ্ভুত লাগছে... জায়গাটা আমার অনেক পুরানো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে…”
কিন্তু আমি কি বলছি, তিনি তা শুনলেন বলে মনে হলো না।
লনের শেষে মাটিতে পোঁতা আছে একটা মরচেপড়া লোহার ফ্রেম, তাতে দুইটা দোলনা ঝোলানো।
“এই দোলনায় আমরা যদি কিছুক্ষণ বসি, আপনি কি ক্ষুণ্ন হবেন…”
তিনি একটা দোলনায় বসে পড়লেন এবং আবার তার পাইপটা ধরালেন।
আমি অন্য দোলনায় বসলাম। সূরয উঠছে এবং সূর‌্যের কমলা-রঙ আলো গোলকধাঁধার এই লন আর ঝোঁপঝাড়গুলোকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। শতেঈর ধূসর পাথরগুলোও একইভাবে ঝলমল করছে।
চমৎকার এই মুহূর্তটাকেই মাহেন্দ্রক্ষণ মনে করে আমি গে অরলভ, বৃদ্ধ জিয়োরজিয়াদজে আর আমার নিজের ছবিটা তার হাতে তুলে দিলাম।
“আপনি কি এই লোকগুলোকে চেনেন?”
মুখ থেকে পাইপটা না সরিয়েই দীর্ঘসময় ধরে তিনি ছবিটা নিরীক্ষণ করলেন।
“এই লোকটাকে আমি চিনি, বলতে পারি…”
গে অরলভের মুখের ওপর তর্জনীটা রেখে তিনি দেখালেন।
“রাশান মহিলা...”
স্মিত হেসে স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠে বললেন তিনি।
“হ্যাঁ, নিশ্চিত করেই বলতে পারি, এই রাশান মহিলাকে আমি চিনি…”
ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে।
“শেষের কয়েক বছর ফ্রেডি প্রায়ই তাকে এখানে নিয়ে আসতো … কয়েকটা মেয়ে… সোনালি চুলবিশিষ্ট... কিন্তু ওই মেয়েটি জানতো কেমন করে মদ্যপান করতে হয়, আমি ঠিক বলছি… আপনি কি তাকে চেনেন?”
“হ্যাঁ, চিনি,” আমি বললাম। “ফ্রেডির সঙ্গে আমেরিকায় দেখা হয়েছে। ”
“ফ্রেডি আমেরিকায় এই মহিলার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, জানেন কি সেটা?”
“হ্যাঁ। ”
“সেই-ই বলতে পারবে ফ্রেডি এখন কোথায় আছে… আপনার তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত...”
“আর রাশান মেয়েটির পাশের এই ঘন কালো চুলের লোকটা, তাকে চেনেন?”
তিনি ফটোটার দিকে আরও ঝুঁকে পড়লেন এবং ছবিটাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে থাকলেন। আমার হৃৎপিণ্ডের গতি তখন দ্রততর হলো।
“হ্যাঁ... আমি এই লোকটাকেও চিনি... একটু দাঁড়ান... হ্যাঁ, অবশ্যই আমি চিনি… ইনি ফ্রেডির এক বন্ধু... ফ্রেডি, রাশান নারী এবং আরেকটি মেয়ের সঙ্গে তিনি এখানে আসতেন... আমার মনে হয় লোকটি দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ অথবা এইরকম কোনো জায়গা থেকে আসা মানুষ…”
“আপনার কি মনে হয় না লোকটা দেখতে আমার মতো ছিলেন?”
“হ্যাঁ… হতে পারে,” অবিশ্বাসের সুরে কথাটা বললেন তিনি।

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।