ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৫) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৫) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান অলঙ্ককরণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। –অনুবাদক
___________________________________

১৪তম কিস্তির লিংক


একটা ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন, হলুদ আর ধূসর, এর সব দিকেই সিমেন্টের দেয়াল। দেয়ালের এই বাধা পেরুলেই প্লাটফর্ম, রেলের কামরা থেকে নেমে আমি ওই প্লাটফর্মের ওপরেই দাঁড়ালাম। স্টেশনটা জনশূন্য, শুধু একটা শিশু উঁচু মতো একচিলতে রাস্তার ওপর গাছের নিচে রোলার স্কেটিং করছে।
মনে হলো, অনেক আগে আমিও সেখানে খেলাধুলা করতাম। শান্ত এই জায়গাটি সত্যি সত্যি আমাকে অনেক কথা মনে করিয়ে দিলো। আমার দাদা, হাওয়ার্ড দ্য লুজ, প্যারির ট্রেন এসে থামার পর আমার সঙ্গে দেখা করতেন। অথবা তিনি যে ট্রেনে আসতেন সেই ট্রেনটা কি উল্টো দিকের কোনো ট্রেন ছিলো? গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, আমি আমার দাদি মাবেল দোনাহুর সঙ্গে এই প্লাটফর্মের ওপরেই অপেক্ষা করতাম।
একটু দূরে, একটা হাইওয়ে, কিন্তু গাড়ি চলছে খুবই কম। স্টেশন থেকেই দেখলাম রাস্তার পাশেই সিমেন্টের দেয়াল দিয়ে ঘেরা কয়েকটা বাগান।
অন্য দিকে, রাস্তার ওপর করগেট বা টিনের দ্বারা তৈরি খোলা ছাদের নিচে অস্থায়ী কাঠামোর কয়েকটা দোকান। আছে একটা সিনেমা হল। গাছের আড়ালে, রাস্তাটা যেখানে সামান্য উঁচুতে উঠে গেছে, সেখানে একটা সরাইখানাও আছে। দ্বিধাহীন পদক্ষেপে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ভালব্রুজের মানচিত্রটা আমি আগেই ভালো করে দেখে এসেছি। বৃক্ষসারির এই এভিন্যুর শেষে চারদিক ঘেরা একটা দেয়াল এবং একটা লোহার গেট, গেটের ওপরে প্রায় ভেঙে-পড়া একটা নামফলকে কিছুটা মুছে যাওয়া অস্পষ্ট হরফে লেখা : ‘সম্পদ ব্যবস্থালয়’। গেটের সোজাসুজি একটা অবহেলিত লন। একেবারে শেষ প্রান্তে ত্রয়োদশ লুই আমলের লম্বা ইট আর পাথরের বাড়ি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একতলা উঁচু প্যাভিলিয়ন। প্যাভিলিয়নের সামনের দুই প্রান্তে কয়েকটা উঁচু গম্বুজের কাঠামো। বাড়িটার সবগুলো জানালাই বন্ধ।
পতিত, জনমানবশূন্য জায়গাটা দেখার পর একটা শিরশির অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরলো : আমি সম্ভবত শতেঈর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে আমার শৈশব কেটেছিলো। লোহার গেটটা ধাক্কা দিয়ে খুললাম, সহজেই সেটা খুলে গেল। এই যে প্রবেশপথ, কত দিন আগে আমি এটা পেরিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলাম? ডান দিকে, লক্ষ করলাম, একটা দালান প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
ঘাস হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে, আমি যতটা দ্রুত সম্ভব লনটা পেরিয়ে এলাম, হেঁটে চললাম শতেঈর দিকে। নীরব বাড়িঘরগুলোর মধ্যে যেতে যেতে আমার গা ছমছম করে উঠলো। মনে হলো, আমি হয়তো দেখবো, বাড়িগুলোর প্রবেশপথের পেছনে লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গল আর ভেঙে পড়া ভবনের ইটসুরকির স্তূপ ছাড়া কিছুই নেই।
কে যেন আমার নাম ধরে ডাকলো। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে থাকা ভবনগুলোর সামনে থেকে একটা লোক হাত নাড়ছেন। তিনি হাঁটতে হাঁটতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন আর আমি লনের মাঝামাঝি জায়গায় স্থির হযে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লনটা একেবারে জঙ্গলের মতো হয়ে গেছে। লোকটাকে ঘুরে দেখলাম। লোকটা দেখতে শক্তপোক্ত আর লম্বা, গায়ে ভেলভেটের সবুজ পোশাক।
 “কি চান আপনি?”
আমার কাছ থেকে কিছুটা দূরে এসে তিনি দাঁড়ালেন। তার চুলগুলো ঘন কৃষ্ণবর্ণ, মুখে গোঁফ।
 “হাওয়ার্ড দ্য লুজ সম্পর্কে আমি কিছু তথ্য জানার জন্য এখানে এসেছি। ”
তার দিকে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। এটা কি সম্ভব যে তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন? প্রতিবার আমি এই আশাটা লালন করি আর প্রতিবারই হতাশ হই।
 “কোন হাওয়ার্ড দ্য লুজের কথা বলছেন আপনি?”
 “ফ্রেডি। ”
 
“ফ্রেডি”শব্দটা আমি ভিন্নভাবে উচ্চারণ করলাম। এমনভাবে এই নামটার শব্দপ্রক্ষেপণ ঘটালাম যেন এই নামটা আমারই, বহু বছর ভুলে থাকার পর উচ্চারণ করছি।
তিনি আমার দিকে তাকালেন।
“ফ্রেডি...”
ওই মুহূর্তে আমার মনে হলো তিনি আমার ডাকনাম ধরেই ডাকছেন।
“ফ্রেডি? কিন্তু তিনি তো আর এখানে থাকেন না...”
না, তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। কেউ-ই আমাকে চিনতে পারেন না।
“আসলে সত্যি করে বলেন তো আপনি কি চান?”
“ফ্রেডি হাওয়ার্ড দ্য লুজের জীবনে আসলে কী ঘটেছিল, আমি জানতে চাই সেই সব কথা...”
তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন আর তার একটা হাত ট্রাউজারের পকেটের মধ্যে চেপে ধরলেন। তিনি একটা বন্দুক আনতে গেলেন আর আমাকে হুমকি দিলেন। না, কিছুই তিনি করলেন না। ট্রাউজারের পকেট থেকে তিনি একটা রুমাল বের করলেন আর সেই রুমাল দিয়ে চোখের ভ্রুতে জমে থাকা ঘাম মুছলেন।
“আপনি আসলে কে?”
“অনেক আগে আমেরিকাতে ফ্রেডির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। আমি তার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চাই। ”
হঠাৎ এই মিথ্যাচার শুনে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
“আমেরিকায়? আপনি ফ্রেডিকে আমেরিকায় থাকতে চিনতেন?”
“আমেরিকা”শব্দটি, মনে হলো, তাকে স্বপ্নলোকে নিয়ে গেলো। “আমেরিকা থাকতে”ফ্রেডিকে আমি জানতাম বলে তিনি আমার প্রতি দারুণভাবে সকৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন। মনে হলো, আমাকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
“আমেরিকায়? ওহ্… তাহলে তিনি যখন আমেরিকায় ছিলেন, আমেরিকায়, আপনি তাকে চিনতেন...”
“জন গিলবার্টের সঙ্গে কাজ করতেন তিনি। ”
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার সব সন্দেহ পানি হয়ে গেলো।
তিনি আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
“আসেন, আপনি আমার সঙ্গে এই পথে আসেন। ”
চারদিকের দেয়ালের প্রান্ত-ঘেঁষা ঘাস যেখানে ততটা উঁচু নয় আর পথ করে করে যেখান দিয়ে হাঁটা যায়, বাঁ দিকের সেই পথ দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন।
 “দীর্ঘদিন ধরে ফ্রেডির কোনো খবর আমি জানি না,” ঐকান্তিক গম্ভীর স্বরে বললেন তিনি।
তার পরনের সবুজ ভেলভেটের স্যুটের কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। এই পোশাকটার কাঁধে, কনুইতে আর হাঁটুর কাছে সেলাই করা চামড়ার তাপ্পি লাগানো।
“আপনি কি আমেরিকান?”
“হ্যাঁ। ”
“ফ্রেডি আমেরিকা থেকে আমাকে অনেকগুলো পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন। ”
“আপনার কাছে কি সেগুলো আছে?”
“অবশ্যই। ”
শতেঈর দিকে আমরা এগুতে থাকলাম।
“আপনি এর আগে কখনও এখানে আসেননি?” তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“কখনও না। ”
“তাহলে আপনি এখানকার ঠিকানা পেলেন কোথায়?”
“ক্লদ হাওয়ার্ড দ্য লুজ, ফ্রেডির এই কাজিনের কাছ থেকে...”
“আমি তাকে চিনি না। ”
গম্বুজ-অলা একটা প্যাভিলিয়নের দিকে আমরা এগুতে থাকলাম। এর দুই প্রান্তেই দেখলাম প্রবেশপথ আছে। আমরা পাশ কাটিয়ে চলতে থাকলাম। তিনি একটা ছোট্ট দরোজার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন :
এটা হচ্ছে এখানকার একমাত্র দরোজা যেখান দিয়ে আপনি ভেতরে ঢুকতে পারবেন। ”
তালার মধ্যে তিনি একটা চাবি ঢুকিয়ে ঘোরালেন। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। তিনি আমাকে একটা অন্ধকারচ্ছন্ন শূন্য কক্ষের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর একটা করিডোর দিয়ে হাঁটতে থাকলেন। আমরা আরেকটা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, ঘরটার জানালাগুলো কাচের, স্টেইন করা। ফলে এই ঘরটাকে একটা চ্যাপেল বা শীতকালের বাগানের মতো লাগছিলো।
“এই হলো গ্রীষ্মকালীন ডাইনিং রুম,” বললেন তিনি।
একটা পুরানো ডিভান ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই। ডিভানটার গদি লাল ভেলভেট দিয়ে আচ্ছাদিত, সেটার ওপরেই আমরা বসে পড়লাম। তিনি তার পকেট থেকে একটা পাইপ বের করলেন আর খুব শান্তভাবে তাতে আগুন ধরালেন। স্টেইন করা বিবর্ণ নীল রঙের জানালা ভেদ করে দিনের আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকলো।
মাথা উঁচু করে দেখলাম, ঘরের সিলিংটার রঙও হালকা নীল, মাঝে মাঝে উজ্জ্বল ছোপ ছোপ মেঘমালা। তিনি আমার দৃষ্টি অনুসরণ করলেন।
“ফ্রেডি এই সিলিং আর দেয়ালগুলো রঙ করেছিলো। ”
ঘরের একটা মাত্র দেয়াল সবুজ রঙ করা। তাতে একটা তাল গাছ আঁকা, যা এখন প্রায় মুছে যাওয়ার পথে। যখন আমরা এখানে বসে খাবার খেতাম, তখন ঘরটা কেমন ছিলো, আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। সিলিংটাতে আমি একটা আকাশ এঁকেছিলাম। তালগাছসহ দেয়ালটাকে করে তুলেছিলাম সবুজ, ভেবেছিলাম এভাবেই হয়তো দেয়ালটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহ পাবে। যে জানালাগুলোতে নীল রঙ লাগিয়েছিলাম, সেই স্টেইন করা জানালা ভেদ করে নীল রঙ আমাদের মুখে এসে পড়বে। কিন্তু কার কার মুখ ছিল সেগুলো?

(চলবে)       

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।