ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৪৭) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৪৭) || অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
_________________________________

৪৬তম কিস্তির লিংক

নিবোর্ধের মতো অনিশ্চিত হাসি হাসল পোস্ট অফিসের লোকটা, যেন ওই হাসি তার মেধার সাক্ষ্য দিচ্ছে। মহিলা আমার দিকে ফিরে বলল:
‘এটা কোনোভাবেই সম্ভব না। ’
‘আমার সঙ্গে শণাক্তকরণে কাগজপত্র আছে,’ জবাব দিলাম আমি, কিছু কাগজ বের করলাম।
‘আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা নিয়ম ভাঙতে পারব না। ’
‘কোনো নিয়ম, আমি নিশ্চিত আপনি জানেন তা অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে,’ আমার মুখ থেকে থুতু বেরিয়ে এল। মহিলার কপোলের একটা তিল থেকে বেরিয়ে আসা বেশ লম্বা কয়েকটা চুল আমার মধ্যে সত্যিই বিরক্তি উৎপাদন করতে শুরু করল।
‘আর তুমি নিয়ম জানো?’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
‘নিয়ম জানতেই হবে এটা অত্যাবশকীয় না, সিনোরা,’ ঠাণ্ডা গলায় বললাম আমি, সিনোরা শব্দটা ওকে গভীরভাবে আঘাত করবে জানি।
নির্দয় মহিলার চোখে প্রচণ্ড রাগ ঝলসে উঠল।
‘সিনোরা, আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, কোনো নিয়মই অযৌক্তিক হতে পারে না: এটা, কোনো সন্দেহ নেই, স্বাভাবিক কোনো মানুষের বানানো, কোনো পাগলের বানানো না। আমি একটা চিঠি পোস্ট করলাম আর তারপর একটু পরই আপনার কাছে এসে ওটা ফেরত চাইলাম কারণ আমি খুবই গুরূত্বপূর্ণ কিছু ভুলে গেছি, এক্ষেত্রে যৌক্তিক ব্যপারটি হবে আমার অনুরোধকে আপনার সম্মান জানানো। নাকি ডাকবিভাগের কাজ জোর করে অসমাপ্ত কিংবা ভুল চিঠি বিলি করা? এটা খুব পরিষ্কারভাবেই জানা ডাকবিভাগের কাজ হল যোগাযোগের, এটা কোনো বলপ্রয়োগকারী সংস্থা না: ডাকবিভাগ আমি না চাইলে জোর করে আমাকে দিয়ে কোনো চিঠি পোস্ট করাতে পারে না। ’
‘কিন্তু তুমি পোস্ট করতে চেয়েছ’ তার জবাব।
‘হ্যাঁ!’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘কিন্তু এখন আমি চাচ্ছি না!’
‘আমার সঙ্গে চেঁচাবে না; এটা খুবই অভদ্রতা। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। ’
‘না যথেষ্ট দেরি হয়নি, কারণ চিঠিটা এখানেই আছে,’ আমি বর্হিগামী চিঠির ঝোলাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম।
লোকজন হৈচৈ করে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছে। বদমেজাজি বুড়ির চেহারা রাগে কুঁচকে যেতে শুরু করেছে। আমি টের পেলাম আমার সত্যিকারে বিস্বাদ আর সবটুকু ঘৃণা গিয়ে কেন্দ্রিভূত হয়েছে মহিলার তিলে।
‘চিঠিটা আমি ছেড়েছি এটা আমি প্রমাণ করতে পারব,’ আমি পুনরাবৃত্তি করলাম, তাকে আমার কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র দেখালাম।
‘চিৎকার করবে না, আমি কানে কম শুনি না,’ ঝামড়ে উঠে বলল সে। ‘আমি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারব না। ’
‘তাহলে আপনার প্রধানকে ডাকেন। ’
‘আমি পারব না। অনেক লোক অপেক্ষা করছে,’ বলল সে। ‘আমরা এখানে খুবই ব্যস্ত, তুমি দেখতে পাচ্ছো না?’
‘কিন্তু এটাও তোমার কাজেরই অংশ?’ আমি যুক্তি দিলাম।
আমার পেছনের কিছু লোক পরামর্শ দিল আমার চিঠিটা ফেরত দিক তারপর সে কাজ করুক। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল সে, অন্য কোনো কাজে ব্যস্ততার ভান করল। অবশেষে উঠে গিয়ে অফিসে ঢুকল, তারপর দীর্ঘ সময় পার করে তেতো একটা মুখ করে ফিরে এল। ঝোলার ভেতর হাতড়ে খুঁজল চিঠিটা।
‘কোন এসতানসায়া বললে তুমি?’ ফোস ফোসানির মতো বলল সে।
‘লস ওমবিউয়েস,’ বিষদগ্ধ শান্ত গলায় জবাব দিলাম আমি।
এরপর খোঁজায় ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে, একটা চিঠি উঁচিয়ে ধরল সে তারপর কেউ তার কাছে ওটা বিক্রি করতে চেয়েছে এমনভাব করে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল, ওটা কেনার ব্যপারে যেন তীব্র সন্দেহ রয়েছে তার।
‘আদ্যক্ষর আর ঠিকানা ছাড়া তো আর কিছু নেই,’ অবশেষে মুখ খুলর সে।
‘তো?’
‘এই চিঠিটা যে তুমিই ছেড়েছো তার কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?’
‘আমার কাছে খসড়াটা আছে,’ বললাম আমি, দেখালাম ওটা তাকে।
ওটা হাতে নিয়ে দেখল সে, তারপর আমাকে ফিরিয়ে দিল।
‘এটাই যে ওই চিঠির খসড়া সেটা আমরা কি করে বুঝব?‘
‘এটা তো সহজ; খাম খুলুন, খুলে দেখুন। ’
দ্বিধা করল সে, মুখবন্ধ খামটার দিকে তাকাল, তারপর বলল:
‘আর এই চিঠি যে তোমারই সেটা নিশ্চিত না হয়ে এই খাম খুলি কিভাবে? আমি এটা করতে পারব না। ’
লোকজন আবার অভিযোগ জানাতে শুরু করল। আমি বুঝলাম মারমুখি হওয়ার একেবারে মেষ সীমায় পৌঁছে গেছি আমি।
‘এই কাগজপত্র যথেষ্ট না,’ উপসংহার টানল নিষ্ঠুর বুড়িটা।
‘পরিচয়পত্র দেখালে যথেষ্ট হবে?’ শ্লেষাত্মাক শিষ্টাচার দেখানোর মতো জিজ্ঞেস করলাম।
‘পরিচয়পত্র?’
আরেকবার সে চিন্তা করল, আরও একবার খামটা নেড়েচেড়ে দেখল, তারপর ঘোষণা করল:
‘না, ওটা হবে না, কারণ এতে ইনিসিয়াল ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তোমার ঠিকানার প্রমাণও আমার লাগবে। অথবা, তোমার কাছে ওটা যদি না থাকে, তাহলে ড্রাফট কার্ড (সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের চিঠি) জাতীয় কিছু থাকলেও চলবে; যাতে তোমার ঠিকানা উল্লেখ আছে। ’
এ নিয়ে আরেক প্রস্থ চিন্তা করল সে, যাহোক, তারপর সে যোগ করল:
‘আঠারো বছরে তুমি ঠিকানা বদল করোনি এরকম কিছু দেখালে অবাক হব না। না, তোমাকে স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণ হাজির করতে হবে। ’
সীমাহীন রাগে শেষমেষ ফেটে পড়লাম আমি সঙ্গে এই রাগ গিয়ে পড়ল মারিয় আর, অদ্ভুতভাবে মিমির ওপর।
‘যাও, পাঠিয়ে দাও ওটা, সঙ্গে তুমিও জাহান্নামে যাও! চিৎকার করে বললাম।
প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে কাঁপতে আমি ডাকঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বিস্মিতভাবে একবার মনে হলো আবার যদি ওই কাউন্টারে ফিরে যাই আমি, তাহলে নির্ঘাৎ ওই চিঠির থলিতে কোনো না কোনোভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আসব। কিন্তু কিভাবে? দেশালাই ছুড়ে দেবো? দেশলাইয়ের আগুন নিভে যেতে পারে। আমি যদি তেল ছিটিয়ে নেই আগে, তাতে ফল পাওয়া যাবে নিশ্চিত; কিন্তু এতে ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। আমি তার চেয়ে বরং কর্মচারী সব বিদায় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তারপর রাস্তায় ধরব খিটখিটে বুড়িটাকে।  

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।