ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৪) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৪) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান অলঙ্ককরণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। –অনুবাদক
___________________________________


১৩তম কিস্তির লিংক


‘মিস্টার হাওয়ার্ড আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
কোনো সন্দেহ নাই রু দ্য বাসানোর এই রেস্তোরাঁর মালিক হচ্ছেন সেই নারী যার চুল ঘন কৃষ্ণবর্ণ, চোখ ধূসর। আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য তিনি অনেকটা ঘুরে আরেক নারীকে অনুসরণ করতে থাকলেন। আমরা সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে নেমে এলাম আর সেই নারী আমাকে একটা ঘরের পেছনে নিয়ে এলেন। থামলেন এমন একটা টেবিলের সামনে যেখানে একজন লোক আত্মমগ্ন হয়ে বসে আছেন। লোকটা আমাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
“আমি ক্লোদ হাওয়ার্ড,” বললেন তিনি।
চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে বসলেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়লাম।
“আমি একটু দেরি করে ফেলেছি, ক্ষমা করবেন। ”
“একেবারেই না। ”
তীব্র কৌতূহল নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। লোকটা কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
“আপনার টেলিফোন কলটা আমাকে অনেক কৌতূহলী করে তুলেছে,” তিনি বললেন।
কথাটা শুনে আমি হাসতে চেষ্টা করলাম।
“বিশেষ করে হাওয়ার্ড দ্য লুজের ফ্যামিলি সম্পর্কে আপনার কৌতূহল আমাকে ভাবাচ্ছে। আসলে আমিই হচ্ছি সেই পরিবারের সর্বশেষ প্রতিনিধি…”
তার কথায় শ্লেষ আর আত্মকৌতুকের সুর।
“আরও আছে, আমি নিজেকে হাওয়ার্ড বলে থাকি। ব্যাপারটা অবশ্য তেমন জটিল কিছু নয়। ”
আমার হাতে মেনুটা তিনি ধরিয়ে দিলেন।
“আমি যে খাবারগুলোর অর্ডার দেবো আপনাকে সেগুলো অর্ডার দিতে হবে না। আমি পাকস্থলী বিষয়ক কলাম লেখক… ওদের যেসব বিশেষ বিশেষ খাবার আছে, আমাকে সেই খাবারগুলো খেতে হবে… মিষ্টি রুটি আর ফিস বৌলন…”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কী ম্রিয়মান স্বরেই না কথাগুলো বললেন তিনি।
“এইসব আমি অনেক খেয়েছি… আমার জীবনে যাই ঘটুক, সবসময় আমি এরকম খাবার খেতে বাধ্য…”

ইতিমধ্যে রেস্তোরাঁর লোকেরা তার জন্যে কিছু মাংসের পাই এনে রাখলেন। আমি সালাদ এবং ফলের অর্ডার দিলাম।
“আপনি সৌভাগ্যবান… আমি খেতে বসেছি... আমাকে এই খাবার-দাবার নিয়ে সন্ধ্যার লেখাটা লিখতে হবে। গোল্ডেন ট্রাইপ প্রতিযোগিতা থেকে এইমাত্র ফিরলাম… আমি ওই প্রতিযোগিতার একজন বিচারক ছিলাম। প্রতিযোগিতায় দেড় দিনে বিচারক হিসেবে একশো সত্তর ধরনের ট্রাইপ খাবার আমাদের গিলতে হয়েছে...”
লোকটির বয়স কতো বলতে পারবো না। তার কালো চুল মাথার পেছনের দিকে আঁচড়ানো। চোখ বাদামি, গায়ের রঙ বিবর্ণ হলেও চেহারাতে নিগ্রোদের ছাপ আছে। আমরা বসেছি রেস্তোরাঁর বেজমেন্টের পেছন দিকে। চারপাশটা কাঠের কাঠামো দিয়ে ঘেরা, তাতে বিবর্ণ নীল রঙের ছোঁয়া, শাটিন কাপড় আর স্ফটিকস্বচ্ছ আসবাবপত্রে ঠাসা। সবমিলিয়ে একধরনের সস্তা আঠারো শতকি আবহ বিরাজ করছে ঘরটাতে।
“টেলিফোনে আপনি আমাকে যা বলেছিলেন সেটাই বসে বসে ভাবছিলাম। … হাওয়ার্ড দ্য লুজ সম্পর্কে আপনি আগ্রহী... লুজ হচ্ছেন, নিঃসন্দেহে, আমার কাজিন ফ্রেডি…”
“আপনি কি তাই মনে করেন?”
“হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। কিন্তু আমি তাকে সেইভাবে চিনি না...”
“ফ্রেডি হাওয়ার্ড দ্য লুজ?”
“হ্যাঁ। আমরা যখন ছোট ছিলাম, কিছুদিন একসঙ্গে খেলাধূলা করেছি। ”
“আপনার কাছে কি ওর কোনো ছবি আছে?”
“না, একটাও নেই। ”
মুখে পোরা মাংসের একটা পাই তিনি গিলে ফেললেন আর স্ফীত উদর ভেতরের দিকে সেঁধিয়ে রাখলেন।
“ফ্রেডির তো কোনো চাচাতো, মামাতো বা ফুপাতো ভাই বা বোনও নাই… কিন্তু একবার কি দুইবার তার নামটা বাদ পড়ে যায়… হাওয়ার্ড দ্য লুজ নামের লোক তো খুব বেশি নেই। আমার মনে হয় ওই নামের মানুষ হিসেবে আমাদেরই অস্তিত্ব ছিল এবং এখনও আছি– আমি, বাবা, ফ্রেডি আর ফ্রেডির দাদা। জানেন, আমরা হচ্ছি এমন একটা ফরাসি পরিবার যারা মরিসাশ থেকে ফ্রান্সে চলে আসে...”
ক্লান্ত বিধ্বস্ত ভঙ্গি করে তিনি তার খাবারের প্লেটটা দূরে ঠেলে দিলেন।
“ফ্রেডির দাদা খুবই ধনী এক আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন...”
“তার নাম কি মাবেল দোনাহু?”
“হ্যাঁ, এই নামই তো... অরনি রাজ্যে তাদের চমৎকার কিছু জমিজমা আর অঢেল সম্পদ ছিলেন...”
“ভালব্রুজে?”
“বাহ্, আপনি তো দেখছি চলমান একটা বিশ্বকোষ। ”
বিস্ময়বিমুগ্ধ চোখে তিনি আমাকে দেখলেন।
“কিন্তু এরপর, আমার মনে হয়, তারা সব খুইয়ে বসেন... ফ্রেডি আমেরিকায় চলে যান… আপনাকে আসলে আমি এর বেশি তথ্য দিতে পারবো না... এর সবই আমি জেনেছি উত্তরাধিকারসূত্রে... আমি এটাও জানি না ফ্রেডি এখনও বেঁচে আছেন কিনা...
“কি করে এটা জানা যায় বলেন তো?”
“আমার বাবা যদি এখানে থাকতেন... তাহলে আমাদের পরিবারের খবর তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারতাম… কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো...”
পকেট থেকে আমি গে অরলভ আর বৃদ্ধ জিয়োরজিয়াদজের ছবি বের করলাম। এরপর আঙুল দিয়ে সেই ছবির ঘন কালো চুলের লোকটাকে দেখালাম, যে দেখতে ঠিক আমার মতো:
“দেখেন তো, আপনি কি এই লোকটাকে চেনেন কিনা?”
“না। ”
“আপনার কি মনে হয় না এই লোকটা দেখতে আমার মতো?”
ঝুঁকে পড়ে তিনি ছবিটা দেখতে থাকলেন।
“হতে পারে,” আত্মবিশ্বাসহীনভাবে বললেন তিনি।
“আর এই যে সোনালি চুলের নারী, তাকে কি চেনেন আপনি?”
“না। ”
“মনে করিয়ে দিই, তিনি কিন্তু আপনার কাজিন ফ্রেডির বন্ধু ছিলেন। ”
হঠাৎ কি যে হলো, অনেক কথা তার মনে পড়ে গেলো।
“একটু দাঁড়ান... স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে... ফ্রেডি আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন। মনে পড়ছে, আমেরিকায় যাবার পর তিনি জন গিলবার্টের পরম বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠেন যিনি গিলবার্টের গোপনীয় তথ্য সংরক্ষণ করতেন...”
জল গিলবার্টের বন্ধু। দ্বিতীয় বারের মতো এই তথ্যটা আমাকে শুনতে হলো। কিন্তু এই তথ্য যে আমাক বিশেষ কোথাও পৌঁছে দেবে, কোনো দিশা দেবে, সেটা মনে হলো না।
“আমেরিকা থেকে ফ্রেডি আমাকে যে পোস্টকার্ডটা পাঠিয়েছিলেন, সেই পোস্টকার্ড থেকেই আমি এসব কথা জেনেছি...”
“আপনি কি কার্ডটা সংরক্ষণ করেছেন?”
“না, কিন্তু এখনও সেই হৃদয়-উৎসারিত কথাগুলো মনে আছে : ‘সবকিছুই দারুণ। আমেরিকা একটা চমৎকার দেশ। আমি একটা কাজ পেয়েছি। কাজটা হলো অভিনেতা জন গিলবার্টের গোপনীয় সব তথ্য সংরক্ষণের কাজ। আপনি এবং আপনার পিতার প্রতি শ্রদ্ধা। ফ্রেডি। ’ কথাগুলো আমাকে নাড়া দিয়েছিল...”
“যখন তিনি ফ্রান্সে ফিরে আসেন তখন কি আপনি তাকে দেখেননি?”
“না। তিনি যে ফ্রান্সে ফিরে এসেছেন, সেটাও আমি জানতাম না। ”
“আর ধরুন, এখন যদি সে ঠিক আপনার উল্টো দিকে এসে বসেন, আপনি কি তাকে চিনতে পারবেন?”
“সম্ভবত নয়। ”
আমার এমন সাহস হচ্ছিলো না যে তাকে বলি ফ্রেডি হাওয়ার্ড দ্য লুজ আসলে আর কেউ নয়, আমি নিজেই। আমার কাছে অবশ্য এর কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু আমার বিশ্বাস আমিই সেই ফ্রেডি।
“যে ফ্রেডিকে আমি জানতাম, তার বয়স ছিলো দশ বছর... আমার বাবা তার সঙ্গে খেলবার জন্য আমাকে ভালব্রুজে নিয়ে যেতেন…”
রেস্তোরাঁতে আমাদের মদ দিচ্ছে যে লোকটি, তিনি টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। ক্লোদ হাওয়ার্ড হয়তো কোনো একটা পানীয় পছন্দ করবেন, আর সেই মদ সার্ভ করার জন্যেই লোকটি অপেক্ষা করছেন। কিন্তু হাওয়ার্ড তার উপস্থিতি লক্ষ করলেন না। তিনিও মদ সার্ভ না করতে পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, অনেকটা এক পাহারাদারের মতো।
“আপনাকে সত্যি কথাটা বলি, ফ্রেডি মনে হয় মৃত...”
“এরকম একটা কথা বলা আপনার ঠিক হচ্ছে না...”
“আপনার অনুগ্রহ যে আপনি আমাদের মতো ভঙ্গুর, দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া একটা পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমাদের ভাগ্যটা আসলে খুব ভালো ছিল না... আমার মনে হয় ওই পরিবারের সদস্য হিসেবে আমিই শুধু বেঁচে আছি, আর দেখেন, বেঁচে থাকার জন্য আমাকে কি না করতে হচ্ছে...”
ওয়েটার যখন ফিস বৌলন নিয়ে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন, তখনই তিনি টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মারলেন। বিরক্তিকর একটা হাসি দিয়ে রোস্তোরাঁর মালিক যে মহিলা, সেখানে ছুটে এলেন।
“মিস্টার হাওয়ার্ড… গোল্ডেন ট্রাইপ কি এবছর আপনাদের ভালো সেবা দিতে পারছে না?” কথাগুলো ক্লোদ যেন শুনলেন না, আমার দিকে তিনি আরও ঘেঁষে বসলেন। “সত্যি বলছি,” তিনি বললেন, “আমাদের মরিশাস ত্যাগ করা ঠিক হয়নি...”

(চলবে)


বাংলাদেশ সময়: ১১৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।