ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

একটি সার্টিফিকেট ও উই পোকার দল | আন্না পুনম

গল্প/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪
একটি সার্টিফিকেট ও উই পোকার দল | আন্না পুনম শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ

ধান ক্ষেতের আল বরাবর হেঁটে যায় আফজাল। অগ্রহায়ণের প্রায় শেষ।

গ্রাম জুড়ে নবান্নের আমেজ। তখনো ছিলো অগ্রহায়ণ। চলছিলো নবান্নের মরশুম। পাকাধানের সোনালি গাঢ় রং জ্বালা ধরাচ্ছিলো চোখে। বাতাসে শন শন শব্দ, মৌ মৌ ঘ্রাণ ছিলো পাগল করা। ধান ভানা, গুড়িকুটা, পিঠের আয়োজন সব থমকে গিয়েছিলো। আফজালের বয়স কতইবা ছিলো তখন! উনিশ-কুড়ি। সবেমাত্র হাইইস্কুল শেষ করেছিলো। কথা ছিলো জেলা শহরের কলেজে ভর্তি হবে। তার প্রস্তুতি চলছিলো। ম্যাট্রিকে আর্টস নিয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছিলো আফজাল। ভীষণ পড়ুয়া ছেলে। মহকুমা শহরের একটি মাত্র লাইব্রেরির সদস্য হয়ে পড়ে নিয়েছিলো নজরুল, কায়কোবাদ, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু। পাশের ঘরের হরিহরণ চক্রবর্তীর ছেলে কার্তিক চক্রবর্তী কলকাতায় কলেজে পড়ালেখা করতো। কার্তিকদার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি চেয়ে এনেছিলো, ফেরত দেয়া হয়নি আজ অবধি।

কার্তিকদা বাড়িতে দেশ পত্রিকা নিয়ে আসত মাঝে মাঝে। আফজাল ঝুমুরদিদির কাছ থেকে দেশ পত্রিকা চেয়ে নিত কখনো কখনো। ঝুমুর ব্যানার্জি পরিবারের সেজো মেয়ে। বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে অবস্থান করছে বেশ কিছুদিন। লক্ষীমন্ত মেয়ে ঝুমুর কোনো অলক্ষী ভর করে স্বামী হারালো। সাদা শাড়িতে তাকে শুভ্র দেখাতো। যেন ভোরের ঝরা শেফালি। চোখের কোনে লেগে থাকা শিশির বিন্দু প্রায়ই চিকচিক করতো। ঝুমুরের ডাগর চোখে চেয়ে আফজালের হৃদয় বিদীর্ণ হতো। মাঝে মাঝে ভাবতো আফজাল, ঝমুরদিকে নিয়ে ইন্ডিয়া পালিয়ে যাবে। কিন্তু তাতো হয়ে উঠে না। মনের কথা মনেই থেকে যায়। সমাজ-সংসার বলে কথা। সমাজের নিয়ম ভাঙতে সবাই কী পাড়ে। এমনকি ঝুমুরকে জানানো পর্যন্ত হয়নি আফজালের মনের আকুতি।

তখন একাত্তর সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছিলো, আফজাল আর আবুল বাশার একই পাড়ার তিনজন ছেলে যুদ্ধে গিয়েছিলো। এইখানে এই ধানখেতের আল বেয়ে ওরা ফিরেছিলো বিজয়ের আনন্দে স্বাধীন দেশে। আবুল বাশার ফিরেনি। আবুল বাশার মিলিটারিদের গুলিতে শহীদ হয়েছিলো। ওরা তিনজন ইন্ডিয়াতে গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিলো একসাথে। মনে হয় এইতো সেদিন। তবু কতগুলো বছর কেটে গেছে। বংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে গেছে কতো ঘটনা। দেশে ফিরে আফজাল কলেজ শেষ করেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় স্নাতকত্তোর করেছিলো। এখন শহরে একটা বইয়ের লাইব্রেরি চালায়। চলন্তিকা লাইব্রেরি। সরকারি চাকুরি সহজেই নিতে পারতো সে। মুক্তি যুদ্ধের একটা সার্টিফিকেট রয়েছে তার। কিন্তু দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যেভাবে যুদ্ধ করেছে আফজাল তার বিনিময়ে কোনো সুবিধা নিতে কুণ্ঠাবোধ হয়েছে, তাছাড়া চাকুরি ভালো লাগে না তার। স্বাধীনভাবে জীবন কাটাবে বলেই যুদ্ধে গিয়েছিলো। সারাদিন বই নিয়ে থাকতেই ভালো লাগে আফজালের। নতুন বইয়ের গন্ধ আপ্লুত করে তাকে। এ এক অপার ভালো লাগা। তাই বইয়ের দোকান দিয়েছে আফজাল। সংসারের খরচ চলে যায় মোটামুটি, শহরে পৈত্রিক বাড়িতে বসবাসের সুবাদে। ঝুমুরকে তো পাওয়া হলো না, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিনী সেলিনা বেগমকে ঘরণী করেছে আফজাল। সেলিনা স্থানীয় একটি কলেজে বাংলা পড়ায়। সুখেই আছে মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন। সেলিনা অনেকবার বলেছে, তুমি কী গো, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সার্টিফিকেটটা কোনো কাজেই লাগালে না। আমাদের ছেলে চাকুরি খুঁজছে। ওর জন্য অন্ততঃ সার্টিফিকেটটা কাজে লাগাও।

আফজাল শুধু বলেছে, অতুলকে নিযে যুদ্ধ করে একটা চাকুরি যোগাড় করতে দাও। স্বাধীন দেশে ও একটা চাকুরি যোগাড় করতে পারবে না তাও কী সম্ভব!

সেলিনা রাগ করে বলেছিলো, তোমার একগুঁয়েমি আমার ভাল্লাগেনা। আমি কি বাড়ি-গাড়ি চেয়েছি? ছেলের ভবিষ্যৎ বলে কথা। তোমার খেয়ালিপনার কোনো জবাব নেই আমার কাছে। প্লিজ তুমি বাড়ি থেকে সার্টিফিকেটটা নিয়ে এসো। অতুল চাকুরির জন্য এপ্লাই করছে।

আফজাল নীরব থেকেছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তর্ক করতে আজকাল আর ভালো লাগে না। এমনকি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন করে কারো কাছে পরিচয় দিতেও ইচ্ছে হয় না। কী করে সেলিনাকে বুঝাবে সে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে প্রাণ বাজি রেখে তার বিনিময়ে কোনো প্রতিদান চায়না সে। নিজের অহংকার বিসর্জন দিতে পারবে না। আফজাল আজ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আনতে। মা বেঁচে থাকতে পুরোনো কাঠের আলমারিতে নিজ হাতে যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন আফজালের সার্টিফিকেটগুলো। মা যেদিন মারা গেলেন সেদিন ভাইয়েরা আলমারির চাবি নিয়ে কতো রাজনীতি করেছিলো। আলমারি খুলে জমিজমার দলিল হাতিয়ে নিয়েছিলো। সম্পদ ভাগবাটোয়ারা করার জন্য পারিবারিক মিটিং বসিয়েছিলো। আফজালের কষ্ট লেগেছিলো। দাফন-কাফন শেষ হতে না হতেই অমন মিটিং নাকরলেই কী চলতো না। তাই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা অটুট রাখতে অভিমান করে মায়ের আলমারিতেই আফজাল নিজের সার্টিফিকেটগুলো রেখে এসেছিলো।

দক্ষিণের পাকা রাস্তাদিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আফজাল। রাস্তার পূবদিকের ভিটে বাড়িটা এখন প্রায় পরিত্যক্ত। ওখানেই একসময় হরিহরণ চক্রবর্তীর নিবাস ছিলো। একাত্তরের পাকিহানাদাররা  হরিহরণকে গুলি করে মেরেছিলো। ঝুমুরকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো সেনা ক্যাম্পে। মুক্তিযুদ্ধের পর  কার্তিক এসে ঝুমরকে কোলকাতায় নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। ওরা কেউ আর কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে আসেনি। মনে পড়ে আফজালের, যুদ্ধের দিনগুলোতে স্বাধীনবাংলা বেতারে দেশের গান শুনে যেমন অনুপ্রেরণা পেতো— তেমনি অনুপ্রেরণা পেতো এই ভেবে, দেশ স্বাধীন হলে পতাকা হাতে যেদিন সে দেশে ফিরবে সেদিন আর কোনো সংস্কার মানবেনা। ঝুমুরকে বউ করে ঘরে আনবে। মাকে বুঝিয়ে বলবে ভালোবাসার কাছে ধর্ম কোনো বাঁধাই নয়। হরিহরণ কাকু, কার্তিকদা মানতে না চাইলেও আফজাল নিশ্চয়ই তাদের বুঝাতে সক্ষম হবে।

আফজাল শুনেছে ঝুমুর বেঁচে আছে। তবে মানসিক ভারসাম্যহীনভাবে। আর তার যুদ্ধ শিশুটি পুত্র কী কন্যা ছিলো তা জানেনা। সন্তানটি হয়তো জানেনা তার পিতৃ পরিচয়। জানেনা তার দেশকে।

হেমন্তের দুপুরে কমলা রঙের ঝিলিক খেলে যাচ্ছে বাড়ির উঠোনে। হাঁসগুলো কোমর দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পুকুরে সাঁতার দিতে। গোয়ালঘরটা শূন্য। আফজালের মা মারা যাবার বছর গাভীটাও মারা গিয়েছিলো প্রসব বেদনায়। তারপর আর কেউ গোয়ালঘরের দিকে ফিরেও তাকায়নি।

বাড়িতে এখন কেউ থাকেনা, তাই মায়ের ঘরটাও তালাবদ্ধ থাকে। ভর দুপুরে আফজাল একাই তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। আলমারি খুলতেই পুরোনো ন্যাফথ্যলিনের গন্ধ নাকে এসে লাগে। মায়ের শাড়ি, পিতলের ফুলদানি, পানের বাটার আড়ালে যত্ন করে রাখা আছে আফজালের ব্যক্তিগত ফাইলটা। ওটা হাতে নিতেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেলো। মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে যেন এখনো। আসলে সেলিনার অনুরোধে নয়। নিজের কৌতূহল থেকেই বাড়ি এসেছে আফজাল। ভেবেছিলো এ বছর বিজয় দিবসে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে জাতি কলঙ্ক মুক্ত হচ্ছে। তা আর হলো কই! পত্রিকার পাতা থেকে অজস্র উঁইপোকা উঠে এসেছে আফজালের সার্টিফিকেটে। নিজের অজান্তেই হাত থেকে পড়ে যায় মায়ের হাতে বহু যত্নে রাখা ফাইলটা তার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।