ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৩) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৩) ||  অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান অলঙ্ককরণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। –অনুবাদক
___________________________________

১২তম কিস্তির লিংক

১৩তম কিস্তি
একটা চওড়া সড়ক, তার পাশেই অতঈ রেসকোর্স। এর একদিকে ঘোড়াচলার পথ, অন্যদিকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফ্ল্যাটবাড়ি। সব ফ্লাটই একই প্যাটার্নের, ফ্লাটগুলোর মাঝে খোলামেলা শূন্য জায়গা। আমি এই অভিজাত সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে এমন একটা স্থানে এসে অবস্থান নিলাম যেখানে গে অরলভ আত্মহত্যা করেছিলো। জায়গাটার ঠিকানা হচ্ছে ২৫, এভিন্যু দ্য মারেশাল লেওতে। কোন তলায় তা ঘটেছিলো? বাড়িটার কেয়ারটেকার যে ছিলো, এতদিনে তার বদলে নিশ্চয়ই অন্য কেউ কাজ করছে। আজও কি এখানে এমন কেউ আছেন যিনি সেদিন সিঁড়িতে গে অরলভের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন? অথবা অন্য কেউ যে তার সঙ্গে এলিভেটরে ছিলেন? আমি তো প্রায়ই এখানে আসতাম, আমাকে চিনতে পারেন এমন কেউ কি আছেন আজ? অনেক সন্ধ্যা গেছে যখন আমি ২৫, এভিন্যু দ্য মারেশালের সিঁড়িগুলো একের পর এক টপকে গেছি আর আমার হৃৎপিণ্ড তখন হাপড়ের মতো ওঠানামা করতো। সে থাকতো আমার অপেক্ষায়। তার ঘরের জানালাগুলো দিয়ে রেসকোর্সের দিকটা দেখা যেতো। সেই উঁচু জানালা দিয়ে রেস দেখাটা ছিলো অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ঘোড়াগুলো আর তাদের বিন্দুবৎ চেহারার জকিরা সার বেঁধে শুটিং গ্যালারির দিকে এগিয়ে যেতো। ওই ঘোড়াদের সবগুলোকে যদি টপকে যাওয়া যেতো, তাহলেই জেতা যেতো বড় অঙ্কের পুরস্কার।

কি ভাষায় আমরা পরস্পর কথা বলতাম? ইংরেজি? বুড়ো জিয়োরজিয়াদেজের সঙ্গে যে ছবিটা তোলা হয়েছে সেই ছবিটা কি এই অ্যাপার্টমেন্টে তোলা? অ্যাপার্টমেন্টটা তখন কেমন সাজানো-গোছানো ছিলো? তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতো কিভাবে? এইভাবে কি যে-আমি, হাওয়ার্ড দ্য লুজ, ‘অভিজাত পরিবারের মানুষ’ আর ‘জন গিলবার্টের বিশ্বস্ত বন্ধু,’ সাবেক নৃত্যশিল্পী, জন্ম মস্কোতে, পাম আইল্যান্ডে যিনি লাকি লুসিয়ানো নামে পরিচিত ছিলেন?

অদ্ভূত মানুষের জীবন। প্রথমে মানুষের অবয়ব অস্পষ্ট হতে থাকে, তারপর যায় মিলিয়ে। হুতি আর আমি এইধরনের লাপাত্তা মানুষ সম্পর্কে প্রায়ই আলাপ করতাম। একসময় শূন্য থেকে তাদের আবির্ভাব ঘটে আর সামান্য ঝলকানি শেষে আবার শূন্যেই তারা ফিরে যায়। রূপের রানী। রমণীমোহন পুরুষ। প্রজাপতিকুল। এদের অধিকাংশই—যতক্ষণ তাদের প্রাণ থাকে—বাষ্প হয়ে থাকা ছাড়া তাদের সারবস্তু বলে কিছু থাকে না। ওই বাষ্প কখনই ঘনীভূত হয় না। হুতি, দৃষ্টান্ত হিসেবে বলতে পারি, একজন ‘সমুদ্রতটের মানুষে’র কথা প্রায়ই বলতেন। ওই লোকটা তার জীবনের চল্লিশটা বছর বিচে বা সুইমিং পুলেই কাটিয়ে দিয়েছেন। চমৎকার আলাপ জমাতে পারতেন গ্রীষ্মকালে সমুদ্রভ্রমণে আসা ভ্রমণকারী আর অবসর উপভোগ করা মানুষদের সঙ্গে। হাজার হাজার সুখী মানুষের সমুদ্রে ছুটি কাটানোর সময়ে তোলা গ্রুপছবির পাশে বা পেছনে তাকে দেখা যেতো, কিন্তু কেউ তার নাম জানতেন না, জানতেন না কেনই-বা তিনি ছবি তোলার সময় সেখানে উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু এরপর একদিন কেউ আর খেয়াল করেননি কেন তিনি অন্যদের ছবি থেকে হঠাৎ অনুপস্থিত থাকছেন। হুতিকে বলার সাহস আমার হয়নি, কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, ওই ‘বিচ ম্যান’ বা সমুদ্রতটের মানুষটি ছিলাম আমি নিজেই। আমি স্বীকার করলেও তেমন কিছু হতো না, ব্যাপারটা হুতিকে খুব একটা বিস্মিত করতো না। হুতি সবসময় বলতো, যাই বলেন, আমরা সবাই শেষ পর‌্যন্ত ‘বিচ ম্যান’, আর ওই যে ‘বালুতট’, আমি হুতিকে উদ্ধৃত করছি– “ওই বালুতট কয়েক মুহূর্তের জন্য শুধু আমাদের পায়ের চিহ্ন ধরে রাখে। ”

এভিন্যু দ্য মারেশালের একদিকে যে অনেকগুলো ভবন আছে সেই বাড়িগুলোর সামনের দিকটা অনেকটাই খোলামেলা, তবে জায়গাটাকে বিরান বলে মনে হলো। এর অনেকটা জুড়ে গাছের ঝাড়, ঝোঁপজঙ্গল, একটা লনও আছে, যা দীর্ঘদিন হলো পরিষ্কার করা হয়নি। এই বিকেলে, সেখানে একটা বালির স্তূপের সামনে, একটা শিশু একা একা শান্তভাবে খেলছে। লনটার পাশেই আমি বসে পড়লাম আর আমার মাথাটা উঁচু করে ভবনটাকে দেখতে থাকলাম, বিস্মিত হবো না যদি এখান থেকে গে অরলভের জানালাগুলো দেখতে পাই।


এখন রাত। এজেন্সি অফিসের চামড়ায় মোড়ানো হুতির ডেস্কের ওপরে  প্রতিফলিত হচ্ছে পাথুরে বাতির আলো। আমি তার ডেস্কে বসেই কাজ করছি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত হয়েছে এমন পুরনো রাস্তা আর ট্রেড ডাইরেক্টরির পাতা ওল্টাচ্ছি। ওল্টাতে ওল্টাতে যেসব তথ্যের দরকার সেই সব তথ্যের নোট নিচ্ছি:
হাওয়ার্ড দ্য লুজ (জ্যঁ সিমেতি) এবং এমমি, ভালব্রোযের মাবেল দোনাউয়ে জন্ম, অরনে, টি. ২১ এবং ২৩, রু রেউনার, টি. আউত. ১৫-২৮। – সিজিপি – এমআ

সামাজিক এই ডাইরেক্টরিতে যে তথ্য পেলাম তা প্রায় তিরিশ বছর আগেকার। এতে কি আমার বাবার কথা আছে?
একই তথ্য পরের ডাইরেক্টরিগুলোতেও পেলাম। নানা রকম ছাপচিহ্ন আর সংক্ষিপ্তকরণ করা তালিকাটা দেখলাম।
একটা ছাপচিহ্নের অর্থ: মিলিটারি ক্রস।
সিজিপি অর্থ: ক্লাব দ্য গ্রঁ পাভোয়া, এমএ অর্থ: কোত দাযুর মোটর ইয়াচ ক্লাব, এবং সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত নৌযানের ছাপচিহ্ন: নৌযানের মালিক।
কিন্তু দশ বছর পরের ডাইরেক্টরিতে এই তথ্যগুলো নেই: ২৩, রু রেউনার, টি. আউত. ১৫-২৮। আরও নেই: এমএ এবং নৌযানের ছাপচিহ্ন।

পরের বছর যে তথ্য পাচ্ছি তাহলো: হাওয়ার্ড দ্য লুজ, এমমি, ভালব্রোযের মাবেল দোনাউয়ে জন্ম, অরনে, টি. ২১।
পরে আর কিছুই নেই।

পরবর্তী ধাপে আমি দশ বছরের প্যারিসীয় ইয়ারবুকগুলো তন্ন তন্ন করে দেখতে থাকলাম। প্রতিবার হাওয়ার্ড দ্য লুজের নামটা এইভাবে রয়ে গেছে:
হাওয়ার্ড দ্য লুজ, সি. ৩ স্কয়ার অঁরি-পাতে। ১৬তম – এমওএল৫০-৫২।
তার কোনো ভাই কি আছে? কাজিন?
ওই বছরের সোস্যাল ডাইরেক্টরিগুলোতে তার কোনো রেফারেন্স পেলাম না।

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।