ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

দুটি কবিতা | তাপস গায়েন

কবিতা/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪
দুটি কবিতা | তাপস গায়েন

সময়বূহ্যে অভিমন্যু [১৮]  

‘ও সে ফুলের মর্ম জানিতে হয় । ’ [লালন ফকির]            

জন্মান্তরে আপনি আমার গৃহে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন, এবং আপনাকে আমি পিতাশ্রী অভিধায় জানিয়াছি।

আপনার দৃষ্টিতে চোখ রাখিলে আমার হৃদয় কাঁপিয়া ওঠে;  আপনার চাহনিতে অনির্দ্দিষ্ট সময় কিংবা অজানিত ভূগোলের যে সংকেত বার্তা জাগিয়া ওঠে, তাহাকে আমি প্রকৃতির অতিপ্রাকৃতিকতা বলিয়া মান্য করি। মনে হয়,  অলৌকিক বলিয়া এই পৃথিবীতে আজো কোথাও কিছু রহিয়া গিয়াছে। আপনার ঠোঁটে যখন মাতৃস্তন্য গলিয়া পড়ে, তখন লতাগুল্ম আর বৃক্ষ পরিবেষ্টিত গ্রামীণ জনপদে শীর্ণ এক খালের পাড়ে শরতের কোনো এক অবকাশে আমার কৈশোর আসিয়া উপস্থিত হয়, দিন ও রাত্রির সন্ধিক্ষণে জোয়ারভাটার কথা মনে পড়ে, যেখানে বয়ে গেছে জল অনুগত সন্তানের মতো এবং হেরাক্লিটাসের সত্যে আনুগত্য রেখেও এখন বিভ্রম জেগেছে: মনে হয় সেই প্রবাহে এই পূর্ণিমায় একই জলস্রোত আজো বহমান। পলিমাটির সন্তান আমি, জেনেছি জোয়ারভাটার সত্য, তবু জীবনের সত্য কি জানা হয়! বহুদিন হলো, পলির বিগ্রহে প্রাণের অধিষ্ঠান নিবৃত্তি রেখেছি। জীবন কি শাদা কাশবন অতিক্রমী অপুর দৃষ্টির বিস্ময় নিয়ে দ্রুতগামী ট্রেন না কি অশেষ প্রত্যয় নিয়ে ভবিষ্যত পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকা।  

দেখেছি, মানুষ উদ্বাস্তু হলে দেবতারা চলে যান; লোকায়ত বাংলা ছেড়ে তারও বহু আগে চলে গেছেন দেবী বিশালাক্ষী; কে যে কোথায় চলে যায়। পরিযায়ী পাখিরা ফিরে আসে, আমিও কি ফিরে আসি কোনো এক বৃত্তে না কি বৃত্তহীন চলেছি প্রব্রজ্যায়! তবু জোয়ারভাটার জল এই জীবনের মর্মে এসে লাগে!  জন্মগ্রহণ করে আমরা যারা গিয়েছি শহর থেকে শহরতলী, নগর থেকে মহানগরীতে, পাড়ি দিয়েছি সুবিশাল মহাদেশ আর অতিদীর্ঘ নদী, অবশেষে হয়েছি দেশান্তরী তারা কি বুঝেছি পলির সৌরভ! বিগ্রহের সাধনা জেগেছে বাংলার এই পলিতে, এখানেই জেগেছেন মহামায়া কালী (কালের ঈশ্বরী) আর শক্তিরূপেন দশভূজা দুর্গা।  

আমি তো বুঝিনি মায়ের রূপ, আর কেইবা জেনেছে ফুলের মর্ম! ফুলের পাত্রহীন আমি আছি এক ভিন্ন লোকালয়ে। পিতাশ্রী, আপনি আমার পুত্র, অন্যথায় আপনি আমার জন্মদাতা পিতা! শিশ্নোদরপরায়ণ এই পৃথিবীতে কে আর আছেন মাতা?  

আমি তো জানি নি ফুলের মর্ম! পিতাশ্রী, আপনার অলৌকিক চাহনিতে দৃষ্টি রেখে জগৎ-জননী-হীন আমি কাঁদি!

সময়বূহ্যে অভিমন্যু [১৯]            

সূর্যের আলোয় পরিশ্রুত জল এবং জলে বিধৌত আলো—এই পরিশুদ্ধি নিয়ে যদিও এই মানবজন্ম, তবু অন্তহীন আকাঙ্ক্ষায় আমাদের পুনর্জন্ম আছে, আছে দেশান্তর! দীর্ঘ দ্বীপান্তরের পরে পরিযায়ী পাখিরা ফিরে আসে, কিন্তু কোনো কোনো মানুষ কখনও ফিরে না; বালুয়াড়ির মতো তাদের কপালের ভাঁজ মনে পড়ে, তাদের সংলাপ কড়া নাড়ে মনের গভীরে। মৃত্যুকে মৃত্যুর অধিক জেনে নবজাতকের চোখে দেখেছি বিস্ময়, জেনেছি অতিলৌকিকতা, আর পূর্বজন্মের স্মৃতি। ধুলো ওড়ে, দিনশেষে পৌষসংক্রান্তির মেলা জমে, সূর্যের আলোয় প্রচ্ছায়ায় জন্মেছে যে বৃক্ষ আমি তার নিচে বসে আছি! দীর্ঘকাল এই বসে থাকা। অতিপ্রাচীন এই বটবৃক্ষের পাদদেশে মনসাদেবীর পূজা ছিলো। আজ পূজারীরা দিকচিহ্নহীন; দূরাগত মানুষ বহুদূর থেকে আসা প্রবাহিত বাতাসের মতো অপসৃয়মান, যা এসে নিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতি, আর অনিঃশেষ সময়ের বৈভব। আকাশে নক্ষত্র ভাসে, জাগে পিতাশ্রীর মুখচ্ছবি। একদিন আমার এই নবজাতক অতিক্রম করে যাবে মাতৃস্তন্য, যেভাবে একদিন আমরা প্রত্যেকে একাকী স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছি! পলিবিধৌত এই বঙ্গে এই নদী যেন মায়ের মুখচ্ছবি।
  
এখন দিন শান্ত, অনুগত, উজ্জ্বল; তবু মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। গ্রীষ্ম আর শীতের মাঝে এই এক উজ্জ্বলতর কাল;  তবু উন্মাদ হাওয়ায় পাতা ঝরে, নিত্যদিনের সংবাদ নিয়ে ওড়ে খবরের কাগজ। কর্মোদ্যমী মানুষের পদচারণায় দীপ্ত এই নগরী, তবু সেই একই মানুষ অতিপ্রত্যুষে কিংবা দিনশেষের সাবওয়ে ট্রেনে বড়বেশি ক্লান্ত, বড়বেশি ম্রিয়মাণ, যেন জীবন কখনো ছিলো না আয়াসসাধ্য! জীবন যদি না হয়ে ওঠে জীবনের অধিক, যদি সেখানে না থাকে অনিঃশেষ বুদ্দুদ, যদি না থাকে উন্মাদনার অস্থিরতা, তবে সে তো রঙধনুহীন প্রব্রজ্যার জীবন, যা কবরের মতো শান্ত, নিঃসঙ্গ! দিনরাত্রিভর লাল, হলুদ, খয়েরি—এইসব উজ্জ্বল পাতা ঝরে পড়ে, কিন্তু দিনান্তে সেই পতন হয়ে ওঠে অনেক বেশি দৃশ্যমান, যেমন দিগন্তে পাহাড়ের চূড়া নগ্ন নারীর স্তনের মতো প্রতীয়মান। এই শেষ বিকালের আলোয়, এক স্কাইস্ক্র্যাপার প্রতিবিম্বিত হয়ে ওঠে অন্য স্কাইস্ক্র্যাপারে, যদিও মানুষ এখন আর বিম্বিত হয়ে ওঠে না একে অপরের চোখে! এই সেই অতিনাগরিক জীবন, যেখানে চকিত চাহনি আছে, কিন্তু অবলোকন নেই!

এই হেমন্তে জমেনি শিশির, শুধু নেমেছে বৃষ্টি। সেই জল করেনি ধৌত এই স্ট্রিট ল্যাম্পের আলো কিংবা এই আলো করেনি পরিশ্রুত এই বৃষ্টির জল। জেনেছি, এই জীবন সীমায়িত, কিন্তু বোধ করি অপরিচ্ছন্ন নয়। তথাগত, আমি তবু ভাবি, দ্বীপান্তর শেষে আমাদের কী পুনর্জন্ম হবে? 

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।