ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ভাত ও লালশাকের প্রশ্নবোধক ইতিকথা | সাইফুল্লাহ সাইফ

গল্প/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪
ভাত ও লালশাকের প্রশ্নবোধক ইতিকথা  | সাইফুল্লাহ সাইফ

১.
ভাতের ভেতর লাল লাল রং ছোপ। আলতা রঙা জলের মতো।


বাটি থেকে হাতমুঠো করে প্লেটে বাড়া হচ্ছে ভাত। মুঠোর ভেতরে উঠে আসা ভাত থেকে কিছু লালভাত, সাদাভাত, কিছু লালসাদা ভাতের স্থানচ্যুতির আপত্তিকর ইঙ্গিত যেন। পড়ে যাচ্ছিল হাত ফসকে বাটিতে কিংবা, ঠিক হাতে অথবা পাতে কোথাও উঠতে চাচ্ছিলো না ভাতগুলো।

একজন বিব্রত নতমুখী রমণী। হাতের কয়েকগাছা বিবর্ণ চুড়ি বেজে উঠেছিলো ভাতের সাথে সমর্থন দেখিয়ে, যেন একটু মিষ্টি প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ঝরে পড়ছিলো ভাতের সাথে। ঝুন ঝুন....রিন ঝিন... ঝিন ঝিনে...

ফ্যাকাসে চেহারা তার, ভাঙা দৃষ্টি। লুকোচুরির মুখছাপ রমণীর চোখেমুখে লেগেছিলো সস্তা প্রসাধনীর মতো। যার চোখকে অদৃশ্য করার চেষ্টা চলছিলো এই লুকোচুরি আবর্তনের ভেতর, সে হয়তো এতক্ষণে দেখে ফেলেছে দৃশ্যটি। প্রতিক্রিয়াহীন, ভাবান্তরিত ও দৃঢ়দৃষ্টিসম্পন্ন। হয়তো বুঝতেই পারেনি যে, তাকে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে কিংবা দেখানো উচিত। অথবা বুঝতে পেরেও বোঝেনি সে।

ভাত বাড়া শেষ হলে লোকটি হাত ধুতে ধুতে পানি ও হাতের সংযোগ বিন্দুর দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে কপালে বিরক্তি প্রকাশকারী ভাঁজ এনে স্বগতোক্তির মতো করে বললো, ‘লালহাকের আইটা হাতে ভাত বাড়া অইছে বাটিতে?’

প্রত্যুত্তরহীন রমণী পুঁটিমাছ আর আলুর সালুনের বাটি কাত করে তর্জনী ও মধ্যমা দুই আঙুলে সালুন দিচ্ছিলো লোকটির ভাতের পাতে। হয়তো লালশাকের আইটা হাতে ভাত বাড়া হইছে কিনা প্রশ্নটির হ্যাঁ বাচক উত্তর ছিলো তার নীরবতায়। লোকটিও হয়তো তাই বুঝে নিয়েছিলো। ‘লালহাক আনো নাই?’ ভাতের প্লেটের দিকে
অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে বললো লোকটি। তারপর আবার,  ‘লালহাক কই?’

‘না, নাই। দুপরে শ্যাষ ওয়া গ্যাছে পুরাটা। ’
‘ওহ!’

লোকটি ভাত মাখানো শুরু করলো। লাল ভাতের সাথে পুঁটিমাছের জবজবে ঝোল। মুখে পুরে দিচ্ছে, ভাত চিবুচ্ছে। গলা দিয়ে নামাচ্ছে। সাপ চলার মতো করে ভাতগুলো চলছিল গলা বেয়ে খাদ্যনালীর ভেতর পাকস্থলীর দিকে। লোকটির ক্ষুধাচেতন সুখানুভূতির প্রকাশ পাচ্ছিলো তার চেহারাব্যাপী।

২.

যাদের নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা হচ্ছিলো তাদের একজন আয়াতুল্লাহ। তার খাতাপত্তরের নাম আয়াতুল্লাহ হলেও মৌখিকভাবে তাকে ডাকা হয় আতা মাস্টার। গ্রামের নামগুলো সাধারণত এমন করেই ভাঙতে ভাঙতে হ্রস্বস্বরী হয়ে ওঠে। তাতে অবশ্য কারো কোনো আপত্তি থাকে না, কেননা নিয়মটিতো কারো একার জন্য নয়। সর্বজনীন হওয়ায় সর্বভুগি।

আয়াতুল্লাহ; সে একজন স্কুল মাস্টার ছিলো বলে তার পরিচয় দেয়া যায়। এর বেশি কিছু তার পরিচিতির খতিয়ানে নেই।

কিছু মানুষকে দিয়ে জগতের কোনো প্রকারের কাজ সম্ভব হয় না। আতার ক্ষেত্রেও তাই। একবার এদের গ্রামে একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে গণশিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়েছিলো। সর্বসম্মতিক্রমে ঐ গণশিক্ষা কেন্দ্রের একমাত্র শিক্ষক হিসেবে আতাকে নির্বাচন করে দেয় এলাকার মেম্বার। আতা যেহেতু দুই কলম লিখতে পারে, পড়তে পারে, তার সাথে বলতেও পারে এবং সে যেহেতু কোনো কাজকর্ম করে ঘরে দুই পয়সা রোজগার করতে ব্যর্থ ছিলো, তাই এই পদটি একমাত্র তারই প্রাপ্য। যদিও এমন কোনো বেতনভুক্তি তার ছিলো না মাস্টার পদবির ভারতলে, তবুও আতা ও তার পরিবারের একটু হলেও স্বস্তি ছিলো আতার মাস্টারিতে।

কিন্তু আতার আসলে কপালটাই ছিলো খারাপ, না হয় ঐ জিনিস ক্যান দুইদিন পরই ফুটে যাবে বেলুনের মতো করে, আর আতার একমাত্র কর্মভাগ্যে ছেদ পড়ে যাবে?
আতা কোনো কাজেরই মানুষ না। ঘরের পাশে এক টুকরো সবজি খেতে আতাকে দিয়ে সর্বোচ্চ একটু খাটুনি করানো যায়। ঐ পর্যন্তই আতা। ওইটুকুই আতার দৌড়। বাকিটা আতার কুঁড়েপনা ও অসামর্থ্যতা।

তো এই করে কি আর সংসার চলে?

না, আতার সংসার কখনো আতানির্ভর ছিলো না। ছিলো আনুফানির্ভর। ঘরে বাইরে পুরাটাই আনুফা।

৩.

তো সেই আতাকে নিয়ে স্ত্রী আনুফা ঢাকায় যাচ্ছিলো চিকিৎসা করাতে। পেটের বেদনার অসুখটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আতার। এতদিন কেবল সপ্তাহ সপ্তাহ দুই একদিন উঠতো বেদনা কিন্তু ইদানীং প্রায় প্রতিদিন উঠছে এবং ঘণ্টা ঘণ্টা ব্যাপী চরম বেপরোয়াপনা। অসম্ভব নিদারুণ, নিষ্ঠুর জ্বালাতন। চিৎ হয় কি কাত হয়, উপুড় হয় কি নিচু হয়, তবু আতা স্থির হতে পারে না, শান্তি পায়না একদণ্ডও।

খোদার শতনাম জপে যখন কোনো কর্মফল পাওয়া যায় না, তখন আতা ঠিক আগের চেয়ে দীর্ঘস্বরে ভারি বাতাসের মতো করে প্রবাহিত হতে থাকে। অকথ্যভাষায় গালি দিতে থাকে তার খোদাকে, খোদার নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকে আতা সাক্ষী রাখে মুহূর্ত সময়বেদির ভেতরে। যেন পেটের জ্বালা ও খোদার উদ্দেশ্যে পাঠানো গালি পরস্পরকে কাটাকাটি করে দেবে—এই তার বিশ্বস্ত এবং একান্ত মতবাদ।

প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই চিকিৎসা অন্তত গ্রামের রুহুল ডাক্তার অথবা মোখন খনকার কাউকে দিয়ে আর বয়ে নিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। গত্যন্তর ঢাকাই আতার ভরসা।

তাই এতদিনের খেয়ে না খেয়ে পড়ে থাকা জীবনের একমাত্র ভাতকাপড়ের জোগানকারী জমিটুকুতে হাত বসাতে হলো এবার। জমি বেচা টাকা পকেটে পুরে আতা ঢাকার পথে নদী ভাঙছিলো। দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী।

৪.

লঞ্চ চলছে। লঞ্চের যাত্রী তারা। ভোলা থেকে আতা ঢাকা যাচ্ছে। রাত্রিবেলা। পরদিন ভোরে লঞ্চ এসে পৌঁছবে ঢাকার বৃহত্তবর্তে। ডেকের উপরে ঢালাওভাবে বিছানা পাতা, শতশত মানুষে গিজগিজে চারপাশ, কোলাহলের ভারী শাসন চলছিলো সমস্ত ডেকজুড়ে। যাত্রীরা একেকজন একেক ভঙ্গিতে। কেউ বসে আছে, কেউ শুয়ে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ ভাত খাচ্ছে।

এই একজোড়া মানুষের দিকে চারপাশের মানুষগুলোর অস্বাভাবিকরকম কৌতূহল ছিলো। ওদের কথোপকথন শুনতে কান খাড়া ছিলো, ওদের কর্মচিত্র দেখতে

স্থিরদৃষ্টিগুলো ওদের দিকে তাক করানো ছিলো মুখোমুখি অস্ত্রের মতো করে।  

‘তুমি খাইবা না?’ খাবারে মনোযোগী আতা স্ত্রীকে বললো।

‘আমার ভুখ মইরা গ্যাছে। আপনে খান। ’

ডেকের চারদিকে টানা ভারি কালোপর্দা। বাতাস ও বৃষ্টিরোধী খোলা ডেকের একমাত্র অস্থায়ী দেয়াল এই পর্দা।

লঞ্চের দেয়ালপর্দার ফাঁক গলে এক ঝটিকা বাতাস এসে হঠাৎ করে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো রোগকাতুরে আতাকে। তার প্রচণ্ড শীতবোধ হলো গায়ের অনাবৃত লোমকূপে। আনুফা টের পেলো। সে উঠে গিয়ে ডেকের সরে যাওয়া পর্দাটাকে গিট দিতে যাচ্ছিলো মোটা লোহার পাতের সাথে। অমনোযোগিতার ফলে তার গিট মিলছিলো না পর্দা ও লোহার মিত্র বন্ধনের সাথে।

হয়তো আনুফা ভাবার সময় নিচ্ছিলো, সেই আইটা ভাতের রহস্যভেদের। সূত্র খুঁজতে হাল চালাচ্ছিলো আপন মস্তিষ্কে স্মৃতির অনুর্বর ক্ষেতে।
আনুফা তো আইটা হাতে ভাত বাড়ে নাই! তাইলে?

আনুফা স্মৃতি পড়ে পড়ে এগোয় সন্মুখবর্তী। ফিরে যায় দু-তিন ঘণ্টা আগে। বাটিতে অর্ধেক ভাত বাড়ার পর কোথায় যেন একটা ঝটকা টান লাগে আনুফার। একটু

চিনচিনে ব্যথাবোধ হয় বুকের মধ্যে কোনো অংশে। হঠাৎ আনুফার অচৈতন্যে একটি মরা লাশ ভেসে ওঠে। আনুফার ভেতর পড়শিদের নৈরাশ্যের উক্তিগুলো বাজতে থাকে গির্জার ঘণ্টা ধ্বনির মতো।

‘এই রোগী বাঁচে না গো.... আমার কাকার এই রোগ আছিলো! ঢাকা যাইয়্যা বড় ডাক্তার দেখাইলো। কিন্তুক কাজ অয় নাই। কাকারে বাড়ি আনার কয়দিনের মইধ্যে মিত্যু অয়!’

‘আমার ফুফুর আছিলো এই রোগ... বড় কষ্ট পাইয়া মরছে....’
‘বড়ভাই মরা পড়ছে... এইটা একটা মরণরোগ...’

আনুফার ভেতরে কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। তখন চৈতন্য ফিরে আসতে মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে তো আতার কোনো আলাপ প্রলাপ নাই! নাকি....
আনুফা হাতের ভাত রেখে দৌড়ে চলে আসে আতার কাছে।

না, আতা ঠিকই আছে। একটু একটু ঝিমুচ্ছে। বেদনাটা এখন একটু কম বোধ হয়।

তারপর ফিরে গিয়ে দেখে ভাতের পাতিলে মুখ ডুবে আছে দু-তিনটা মুরগি। আনুফা মুরগি তাড়িয়ে পাতিলের উপর থেকে কিছু ময়লা ভাত ফেলে দিয়ে বাটির বাকি অর্ধেক পূর্ণ করে নেয়।
৫.
একটু আগে আনুফা ভাতের ভেতর থেকে রক্তে টসটসে যে জোঁকটি আতার দৃষ্টিভ্রান্তি করে লুকাতে সক্ষম হয়েছিলো তা কি তখন ঐ মুরগিগুলোর কোনো একটির ঠোঁট থেকে পড়েছিলো?

হয়তো। কারণ, এই মুরগিগুলোর বিচরণভূমি তাদের একমাত্র সবজি ক্ষেতটি। আর আতা কি তাহলে জোঁকের রক্তকেই লালশাকের আইটা বলেছিলো?

আনুফা ভাবে...

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।