ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শহীদুল রিপনের একগুচ্ছ কবিতা

কবিতা/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৪
শহীদুল রিপনের একগুচ্ছ কবিতা অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

হাসপাতাল‬

কাল রাতে মারা গেছে এক কবি—তরুণ,অখ্যাত এবং অপ্রকাশিত। তার ছিল মূলত হৃদয়ের অসুখ আর নানাবিধ যৌন ও গৌণ রোগ।

সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছে আজ। কাজ নেই বলে খোঁপা খুলে চুল এলিয়ে দিয়েছে সাদা পোশাকের নার্স।
মৃত কবির শূন্য বিছানা থেকে গোপনে ছড়িয়ে পড়ছে বিষন্নতার ভয়ঙ্কর ভাইরাস।


চাবুক-শাসন


কোথাও লুকানো আছে স্বর্ণখনি, গুপ্তধন—
সন্ধান পেতে তার, এক বীভৎস দর্শন
জাদুকর আমাকে মন্ত্রবলে বানিয়ে ফেলল ঘোড়া।
খাবারের ঘাস দিল, থাকার জন্য ইস্পাতের আস্তাবল।
মুখ নেই তার, মুখাবয়বও, আশিরনখ নীলালোকে মোড়া,
লম্বা টুপির সাথে কালো বুট এবং কোমরে নিষ্ঠুর পিস্তল।
গোপন মানচিত্র নেই তার, কররেখা ছাড়া
দিকনির্দেশক মানে তো ওই দূর ধ্রুবতারা;
পরিকল্পনাহীন তবু ছুটে চলি গিরিখাত, জঙ্গল, মরুপ্রান্তরে।
পেছনের কথা ভাবি, বউ-সংসার-সন্তান—অবসরে,
ঘুমঘোরেও জাবর কাটি সেই পুরনো জীবন,
গোপনে ঝরাই দু’ফোটা অশ্রু, অক্ষমতার।
নেমে আসে তখনই ভয়াল চাবুক-শাসন—
হিসহিসিয়ে বলে: জোরসে সামনে বাড়ো, য়ু আর আ লেট স্টার্টার।


অনাহূত


সকল ব্যথার পুজা সমাপন হলো, ভাবি, লাইফ ইজ বেহতরিন।
আর তখনই তুমি ভেসে এলে হে পলাতকা সাবমেরিন—
সমুদ্রের অতল থেকে, শরীরে শ্যাওলা ও শৈবাল জড়িয়ে,
যেন মহাযুদ্ধের শেষে, টর্পেডো হানা আর লবণগন্ধ নিয়ে।
আমি তো নিয়েছি মেনে ক্ষয়ক্ষতি—ছিলাম শতছিদ্রা যুদ্ধতাঁবু;
রক্তের দাগ বৃষ্টিতে ধুয়ে ফের জন্মেছে পাতাবাহারেরা, শিম মাচাং, অলাবু।
নবপ্রাণের, নবীন সংসারে কোথায় তোমাকে রাখি, হে জলজ বাজপাখি?—আনমনে
এতোসব ভেবে ভেবে পেরেশান, ক্লান্তপ্রাণ যখন, ততক্ষণে
শাদা অ্যারোপ্লেনের কালো ছায়াপথ ধরে
ঘাসের ওপর দিয়ে গেছে উড়ে নীলডানাঅলা পাখিঝড়
অসীম মুগ্ধতার দিকে, নির্জন ভোরে—
তখন শিশিরস্নাত বসুধা টেনেছে গায়ে শেষবার কুয়াশাচাদর।
 

সন্ধ্যার পৃথিবী

উদয় হয়েই যেসব উদ্যম হারিয়েছে দম, চিরতরে,
সন্ধ্যার পৃথিবীতে—তাদের মুখের আদল মনে পড়ে;
সেইসব মৃত স্ফূলিঙ্গ— জ্বলবার আগেই দপ করে
যারা নিভে গেছে করোটির বাদামি-তরল তন্দ্রার ভেতরে;
এমনকি ফোটেনি যে-প্রসূন, ভেবে ভেবে তারও কথা
ইথারে ধ্বনিত হতে থাকে সকরুণ শোকগাথা।

ঘোর লাগে খুব—তাকিয়ে মৃত্যুর পেন্ডুলাম ফণাটির দিকে
মনে হয়, ভালোবেসে যাবতীয় অনুপস্থিতিকে,
আমিও মাতাল নৈঃশব্দের শরাব খেয়েছি গতকাল!
তথাপি দেবরাজ, শাহীন ও তমাল—
মৃতবন্ধুদের মুখ ঠিকই হাসিখুশি রয়ে যায়
জাদুমায়াময় কোনো এক পরাআয়নায়।

বার্বিডল, প্লাস্টিক সাপ এবং খড়ের বাছুর
ভালোবেসে মানুষেরা বানিয়েছে বিচিত্র পারদপুকুর;
তার জলে সাঁতরায় নার্সিং হোমে সদ্য নিহত ভ্রূণ;
মুক্তির স্বস্তিতে হাঁফ ছাড়ে প্রেমিক তরুণ,
তার তরুণীর স্বপ্নে—জরায়ুর শূন্য বারান্দায়
একঝাঁক দেবশিশু নেমে আসে রূপালি ডানায়।

মানুষ ঘুমিয়ে গেলে তার যৌনতা জেগে থাকে পূর্বাপর,
থাকে পৌরাণিক কোলাহল থেকে ছোঁড়া পঞ্চশর;
সম্পর্কেরা তবু আরো গাঢ় হয়ে, আরো ফিকে হয়ে যায়
মনে মনে, বীজ বোনে কালঘুম, বৃক্ষেরা মৃতপত্র ঝরায়,
মরে যায় না-ফোটা প্রসূন—সন্ধ্যার পৃথিবীতে—
ভেবে ভেবে তারও কথা বোধ বুঁদ হয়ে থাকে মৃত্যুগীতে।


উড়ুক্কু

(কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে)

প্রতিবার সঙ্গম শেষে, পাখনা-ডানায় ভেসে, ঘনঘোলাজলা থেকে রোমন্থন ফেলে রেখে, নক্ষত্রের দিকে, দূরে, ক্রমাগত যেতে থাকে উড়ে, আলোড়িত-শিহরিত একঝাঁক সমুজ্জ্বল মাছ।

ভালোবাসবার পরে, অগোচরে, পুঞ্জীভূত হওয়া অবসাদ পাতে দহন ফাঁদ। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখে, দ্রুত স্পন্দিত বুকে, পরিতৃপ্তি নয়, স্ফূট হয় পরাজয় ।
বিন্দুতে সিন্ধুর বাস, বারদোষে তার সর্বনাশ। তবুও শরীর জাগে, তনুমধ্যায় পুলক লাগে। আদিরসে রসাতল, ছল্কায় ঘোলাজল। পুনঃপুনঃ লীলা চেয়ে শোনিতে কার্পাস ফেটে যায়।

সফল সঙ্গম শেষে নোঙ্গর গ্লানির দেশে। কী খুঁজি কামের মাঝে, কোনো স্মৃতি—জানি না যে—কীহেতু উজ্জ্বল সঙ্গম শেষে, বিস্মরণ থেকে ওঠে ভেসে একঝাঁক গাঢ়নীল কামজর্জর উড়ুক্কু মাছ!


উদ্ভাসন


কিশোরীর অতল থেকে উঠে এলো স্নানসিক্ত রমণী। আমি
স্তব্ধ থাকি গাছের অধিক— পত্রহীন, ডালের কঙ্কাল, বৃক্ষমমি।

ভূমিকম্প হলো কি? —কেন তবে কেঁপে ওঠে অজস্র ফাটল নিয়ে
দরদালানেরও হৃদয়— অসংখ্য ভগ্নাংশে যায় ছড়িয়ে
        দু’চোখের দৃষ্টি অপস্রিয়মান, সাদা?

বহুগামী মেঘে ঢেকেছে সূর্যঘড়ি— কতটা সময় গড়িয়ে গেল রাধা?

প্রবল ঝ্ঞ্ঝা আসছে। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে
তীরে অপেক্ষায় আছি—কী রূপে আমাকে আবার দেয় সে ফিরিয়ে।


এখনই নয়

কংক্রিটে চাপা পড়ে আছে হলুদ শরীরের মৃত ঘাস,আমি আজ পার্কে যাব না। গলির বাঁকে ওঁৎ পেতে থাকা মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরব, সিগারেট খাব না। ঘুমের কাছে সঁপে দেবো ক্লান্তি,মৃত্যুভীতি,অসতর্ক জিজ্ঞাসা।

স্বপ্নে ঘুরে আসব মামাবাড়ি,হরিতকিডাঙ্গা। বুনোদের শ্যামল গ্রামে ফ্রকপড়া বালিকার বিনুনীর লালফিতার মতো দুলে দুলে নেচে হবো জবাফুল;আমের বোলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা ফাগুনে বাতাসের প্রযত্নে বইয়ে দেবো হাসির ফল্গুস্রোত।
লেজঅলা রঙিন ঘুড়িতে ঢেকে দেবো পড়ন্ত বিকেলের লাল আসমান।

কেন রক্তরঙা হয় গোধূলি? ঘুম ভেঙে এপ্রশ্ন জাগবেই,তবু সেটা ইগনোর করে কফি খেতে খেতে কুমির শিকার দেখব ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে, টিভিতে সংবাদ বুলেটিন দেখব না, মেয়েকে কাছে ডেকে আদর করবো খুব।

তবু কেন হানা দেয় নচ্ছার মৃত্যুভয়? তোমার সাথে কি তবে দেখা হয়ে যেতে পারে যে কোনো সময়? কতটা নিকটে ঘনিয়ে তুমি আসছ? ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে কি খুব হাসছ?

আজ ভ্রুযুগলের মাঝে মনকে জড়ো করে বলবো,হে অমোঘ এখনই নয়, এখনই নয়।
 

আম্মার আলমারি

ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে লবঙ্গগন্ধী আঙুল চিবুক ছুঁয়েই বাতাসে মিশে পেরিয়ে গেল জানলা। চোখ মেলে দেখি দুলছে পর্দা তখনো,জানলার ওপারে বৃক্ষপত্র—প্রস্থানের নীরব এবং ত্রস্ত তালে।

চোখ বুজলেই আচমকা কখনো গান কখনো নৈঃশব্দ বিদ্যুচ্চমক হয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছে করোটির অতলে। জিভের লালায় গুলে যাচ্ছে আমলকির অম্লতার মতো ঝাপসা অতীত আর ভবিষ্যতের ফোটোগ্রাফসমূহ।

লবঙ্গগন্ধী স্পর্শে বিস্মৃতির চৌবাচ্চা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে যাবতীয় বিপর্যয়;আসছে তরল-তরল শৈশব— কলতলা-জ্বরঘোর-আলকুশি-নড়বড়ে দুধদাঁত। রসুইঘরে ডুবে যাচ্ছি,আম্মার মশলার আলমারিতে জয়ত্রী-মৌরি-মেথি-দারচিনি-এলাচের গন্ধের ভেতর।



বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।