ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৪১) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৪১) ||  অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক


এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।

৪০তম কিস্তির লিংক

এসতানসায়ায় কয়েক দিন থাকার পরিকল্পনা ছিলো আমার, কিন্তু আমি থাকলাম কেবল এক রাত। পরের দিন, ভোরবেলা, আমার স্যুটকেস আর রঙের বাক্স সঙ্গে নিয়ে, আমি পায়ে হেঁটেই রওনা হয়ে গেলাম। এটা শুনতে পাগলামী মনে হতে পারে, কিন্তু একটু পরই বুঝবে, আমি সঠিক কাজটিই করেছি।

হান্তের আর মিমিকে তো বাইরে রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমরা, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম আমার কাল্পনিক ছবির খোঁজে, এরপর আমার রঙ আর ছবির প্রমাণস্বরূপ স্কেচের খাতাকেই চালিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নিচে নেমে এলাম। পরের এই ফন্দিটা মারিয়ার।

এসে দেখলাম দু’ভাইবোন আগেই চলে গেছে। যাহোক, এরপর থেকেই মারিয়ার মেজাজ খানিকটা হালকা হতে শুরু করলো, এবং ততক্ষণে আমরা পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে সাগরতীরে চলে এসেছি, এর মধ্যে দারুণরকম উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে মারিয়া। শহরের দুঃখ-যন্ত্রণায় চিরে-চ্যাপ্টা হওয়া যে নারীকে আমি চিনি, এই নারী তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। দারুণ রোমাঞ্চকর, দারুণরকম প্রাণময়। ওর মধ্যে এমন সব ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যাপার-স্যাপার দেখছি যা আমি আগে কখনও দেখিনি, রঙ সুরভিতে আনন্দে একেবারে মাতোয়ারা: অদ্ভুতভাবে (অদ্ভূত আমার কাছে, আমার ইন্দ্রিয়সুখ হলো অন্তর্লোকের, যার পুরোটাই প্রায় নিখাদ বুদ্ধিবৃত্তিক) গাছের গুঁড়ির রঙ, কিংবা শুকনো পাতা, অথবা একটা কোনো পোঁকা, কিংবা সাগরের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে আসা ইউক্যালিপটাসের গন্ধ সব কিছুতেই বিমোহিত মারিয়া। কিন্তু এসবে আমার খুশি হওয়া তো দূরে থাক, এই নতুন মারিয়া আমাকে আরও বিমর্ষ আর দুঃখিত করে দিচ্ছে, কারণ আমি জানি আমি যে নারীকে ভালোবাসি তার এই চেহারা আমার কাছে একদম অচেনা, এই নারী নিশ্চিতভাবেই কোনো না কোনোভাবে হান্তের কিংবা অন্য কারোর।
প্রতি পদক্ষেপেই আমার মন-খারাপ-করা আরও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ হতে পারে সাগরের ঢেউয়ের ওই আঁছড়ে পড়ার শব্দ। গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর তটরেখা বরাবর উপরের আকাশের দিকে চোখে পড়লো, বুঝে গেলাম মন খারাপ হওয়াটা অনিবার্যই। আমি বরাবর দেখেছি কোনো সৌন্দর্যের, কিংবা বলা যায় নির্দিষ্ট কোনো সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলেই আমি এমন বিষন্ন হয়ে পড়ি। সব মানুষেরই কি এমন হয়, নাকি এটা আমার অন্ধকার দিকগুলোরই আরেকটা নির্দশন?

দীর্ঘ একটা সময় আমরা পাথরের উপর বসে থাকলাম, নিশ্চুপ, পেছনে প্রবল শব্দে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শুনছি, সময়ে সময়ে খাড়া পাড়ের চূড়ায় আঁছড়ে পড়া সমুদ্রের জলের মিহি কণা ছুটে এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের মুখচোখ। ঝড়ো আকাশ আমাকে টিনটোরেত্তো আর তার সেইন্ট মার্ক রেসকিউং দি স্যারাসিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

‘সঠিক সময়টা বলতে পারবো না,’ বলল মারিয়া, ‘তবে আমি এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমি তোমার সঙ্গে এরকম সাগর আর আকাশ দেখছি। ’
একটু থেমে, সে আবার যোগ করলো:
‘কোনো কোনো সময় আমার মনে হয় আমরা দুজন যেন ওই দৃশ্যের মধ্যে অনন্তকাল ধরে বাস করছি। আমি যখন তোমার পেইন্টিংয়ের জানালার ওই নিঃসঙ্গ মহিলাকে দেখলাম, আমার মনে হলো আমরা একইরকম, তুমি আর আমি, আর তুমিও আমার মনে হয়েছে তখন, অন্ধের মতো কাউকে খুঁজছ, নৈঃশব্দের মধ্যে কোনো একজন সঙ্গীকে খুঁজছো তুমি। তারপর ওই দিন থেকে আমি তোমার কথা ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবিনি। কতবার যে তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি, আর এই যে এই জায়গায় আমার জীবনের কতো সময় যে কেটেছে। একবার এমনও ভেবেছি যে তোমাকে খুঁজে বের করে, আমার এই অনুভূতির কথা তোমাকে জানাবো। কিন্তু আমার ভয় ছিলো যে, আমি কোনো ভুল করে ফেলতে পারি, এর আগেও একবার আমি ভুল করেছি, এরপর আমি তাই চেয়েছি তুমিই আমাকে খুঁজে বের করো। আমি সর্বান্তকরণে সব সময় তোমার শুভকামনা করে গেছি; প্রতি রাতে আমি তোমাকে ডেকেছি; এবং আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম যে, সময় হলেই আমাদের পরস্পরের নিশ্চয়ই দেখা হবে, আমি যখন ওই অদ্ভুত এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, আতঙ্ক নিয়ে, আমি বোকার মতো কি যে বলেছি সেদিন। তুমি যখন ঘুরে দাঁড়ালে, তারপর গুরুতর কোনো ভুল করেছো ভেবে চলে গেলে, আমি একেবারে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রায় অর্ধ্ব উন্মাদের মতো অবস্থা তখন আমার, আমি তোমার পেছনে ছুটে গেলাম। তারপর এলো প্লাসা মারতিনের ওই অপূর্ব মুহূর্ত তুমি আমার কাছে এসে সব কিছু ব্যাখ্যা করার সিদ্ধান্ত নিলে, আর আমি তোমাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার ভয় হচ্ছিল আমি বুঝি তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি, আর আমার কারণে বুঝি তোমার কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যায়। আমি তোমাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করলাম, তোমাকে বোঝাতে চাইলাম তোমার ইঙ্গিতপূর্ণ কথা আমি বুঝিনি, তোমার ওই গুপ্তবার্তা। ’
ওর কথা শেষ হওয়ার পরও আমি নিরুত্তর রইলাম। মারিয়ার বিস্ময়কর ওই কণ্ঠস্বর আর ওর কথাগুলো শুনতে শুনতেই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো এক আত্মতৃপ্তি আর গাঢ় অন্ধকারের বোধ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম যেন আমি ক্রমশ। পশ্চিম আকাশের মেঘমালায় বিচ্ছুরিত হয়ে ফিরে আসছে তখন সূর্যাস্তের শেষ আলো। আমার মনে হলো এই জাদুকরি সময় আর কথনও ফিরে আসবে না। ‘আর কক্ষনও না, আর কক্ষনও না,’ ভাবতে থাকি আমি।

(চলবে)



বাংলাদেশ সময়: ১৭২০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।