ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কাকলী প্রধানের ক্যামেরায় ভূমি বঞ্চিত নারীর গল্প | মোহাম্মদ আসাদ

আলোকচিত্র/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪
কাকলী প্রধানের ক্যামেরায় ভূমি বঞ্চিত নারীর গল্প | মোহাম্মদ আসাদ

টাকার নাড়চার করেন পুরুষ তাই ভূমি তার আয়ত্বে থাকবে এটাই নিয়ম। এর বাইরে গেলেই বিপদ, সর্বশান্ত হতে হয় সে নারীকে।

যাদের কাছে নারী তার অধিকার পাওয়ার করুণ কাহিনী জানাবে তারাও পুরুষ অথবা পুরুষ শাসিত সমাজের বাসিন্দা। সে কারণে নারীর অধিকার আদায়ের আশা দুরাশাই থেকে যায়। আর সে নারীটি যদি হয় সংখ্যালগু অথবা আদিবাসী, তাহলে তার দুঃখের সীমা থাকে না। বিষয়টি সমাজের একটি কঠিন ব্যাধি হলেও এই নির্মম অত্যাচারের খবর সাধারণ মানুষ খুব কমই পায়। কখনও জীবন গেলে সংবাদ হয় ছোট্ট করে। তাই নারীর ভূমি অধিকার আদায়ে বঞ্চনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন আলোকচিত্রী কাকলী প্রধান। প্রায় সারাদেশ ঘুরে তার ক্যামেরা বন্দি করেছে হাজারও ভূমি’র অধিকার বঞ্চিত নারীদের গল্প। কতো রকমে যে নারী ভূমির অধিকার বঞ্চিত হয়ে চলেছেন তার সামান্য চিত্র এই প্রদর্শনী।

কেউ বঞ্চিত হচ্ছেন ধর্মের কারণে, কেউ বর্ণের কারণে। কেউ শিক্ষার অভাবে তার ভূমি থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন। শিক্ষিত ও আধুনিক ভূমি অধিকার বঞ্চিত নারীও উঠে এসেছে কাকলীর ক্যামেরায়। কোনো ছবিতে বঞ্চিতদের প্রশ্ন তুলে দিয়ে তার বুকের বেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন, কোনো ছবিতে বিবেকবান মানুষের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন আলোকচিত্রী নিজেই। বেশির ভাগ ছবিতেই কাকলী প্রধান চেয়েছেন ভূক্তভুগীদের আবেগটুকু তুলে আনতে। সেখানে আলোকচিত্রী শতভাগ সফল হয়েছেন। বৃদ্ধার চোখের পানি গড়ানো সর্বস্ব হারানো নারীর প্রতিচ্ছবি বোঝতে ক্যাপশনের প্রয়োজন হয় না। আবার চুলে কুমড়ো ফুল গুঁজে দেয়া দুই কিশোরীর হাসি মাখা ছবিতে ‘কে হিন্দু, কে মুসলিম’ বলে প্রশ্ন করে ধর্ম-বিভেদের পাহাড়ে আঘাত করে ভাবনার সাগরে ফেলেন। এখানে প্রদর্শীত ৪৫টি ছবির প্রতিটি ছবির সামনে যাওয়ার পর অবশ্যই আপনাকে ভাবাবে, অনেক্ষণ ভাবতে হবে। অবশ্যই আপনি ভাববেন, নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে কেন আমরা একপেশে? 

বিষয়ে যেমন নতুনত্ব আছে, নতুনত্ব আছে ছবি প্রদর্শনের বেলায়ও। বিলবোর্ড সাইজের বিশাল বিশাল ৪৫টি ছবি ফ্রেমবন্দী করে রেখে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বটতলায়। কোনোটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে, কোনোটা গ্রিলের সঙ্গে। বিশালাকৃতির ছবি হওয়ার কারণে দূর থেকে দাঁড়িয়ে সমস্ত ছবি দেখে নেয়া যায়। তারপরও মানুষের চাইতে বেশি উচ্চতার ছবির সামনে গিয়ে সবাই দেখছে খুঁটে খুঁটে। কেউ ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তুলে নেয় সেলফি। দর্শক ও বিশাল ছবি মিলিয়ে আবার তৈরি হচ্ছে নতুন এক ছবির। ছবি আলো আর গাছের ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের আলো ছবিতে পরে ভিন্ন এক দ্যোতনা সৃষ্টি হচ্ছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা প্রাঙ্গনে ছবি প্রদর্শনের বিষয়ে আলেকচিত্রীর সহজ উক্তি ‘আমাদের সকল অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকেই। ভূমি অধিকার বঞ্চিত নারীদের অধিকারের আন্দোলনটাও এখান থেকেই শুরু হলো’। এখন এই আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার পালা। দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তারা এই আন্দোলনকে বেগবান করবেন।

কাকলী প্রধানের প্রদর্শনী দেখে দর্শকে হোঁচট খেতে হয়। সাধারণ দর্শক কাকলীকে মডেল ফটোগ্রাফার হিসেবেই চিনেন। তার সুন্দর মডেল বা নায়িকার ছবি তুলে আনার দক্ষতা দেখেন পাঠক প্রতিনিয়ত। ভূমি অধিকার বঞ্চিত নারীর ছবি তোলার সময়ও তিনি কাজ করেছেন মনের মাধুরি মিশিয়ে। আমি ২০০৯-১০ সালে দেড় বছর কাজ করেছি এই আলেকচিত্রীর সঙ্গে। আমাদের কম্পিউটার দুটি ছিল পাশাপাশি। সামনে তাকালেই দুটি মনিটর চোখে পড়তো। সে সময়ে কাছে থেকে দেখেছি তার কাজ। বিকেলে এসাইনমেন্ট শেষ করে এসে বসতেন আলো ঝলমলে মানুষগুলোর ছবি তৈরি কাজ নিয়ে। তারপর শুরু করতেন ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়ার মানুষগুলোর ছবি নিয়ে। কখনও এসিডদগ্ধ নারীর আবেগপ্রবণ চোখের ছবি, কখনও নির‌্যাতিত নারীর চোখের পানি। গড়িয়ে পড়া সে চোখের অশ্রু পরিবেশ ভারি করে তুলতো। যেদিন নতুন কাজ করতো, সেদিন ডেকে দেখাতো এবং বর্ণনা করতো ভুক্তভুগীর করুণ কাহিনী। নারীর বঞ্চনা নিয়ে তার আরো কাজ দেখেলেও শুধু ভূমি অধিকার বঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করে ফেলবেন এমনটি ভাবিনি। আমি তার নারীর বঞ্চনা জীবনের যে ছবি দেখেছি তার ক্ষুদ্র একটি অংশ ‘ভূমি অধিকার বঞ্চিত নারীদেও গল্প’। তার অন্য ছবিগুলো প্রদর্শীত হলে নারীর বঞ্চনার অনেক অজানা চিত্র ফুটে ওঠবে।

যেখানেই নারীর বঞ্চনার কথা শুনেছে সেখানে কাকলী ছুটে গেছেন। নিজে একজন নারী হিসেবে উপলব্ধি করেছেন তাদের দুঃখ-কষ্ট। র্দীর্ঘ আট বছর কষ্ট করে দাঁড় করিয়েছেন এই প্রদর্শনী। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি আলোকচিত্রে সুশিক্ষিত কাকলী প্রধান চাকরি, সংসার, নারীদের নিয়ে কাজ নিয়েই থেমে থাকেনি। দেশের দুর্যোগ, উৎসবে তিনি ক্যামেরা নিয়ে হাজির হন সময় মতোই। এই প্রদর্শনী কাকলীর সুন্দর একটি শুরু। আশা করি নারীর বঞ্চনার করুণ কাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাবেন অনেক দূর।

এতোসব ভালোর মধ্যে একটু সমালোচনা না করলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। দূরাঞ্চলের ছবিগুলোর জন্য আরোও একটু সময় ব্যয় করলে ছবির আলোর সমস্যা থেকে বাঁচতে পারতেন। আর ছবির ওপর লেখা, ছবিটিকে ছবির চাইতে সংবাদ হিসেবে নিতে দর্শকদের বাধ্য করে। এতো সুন্দর ও সময়োপযোগী আয়োজনের মধ্যে এসব অনেক ছোট ত্রুটি। তার একটি ছবির গল্প দিয়ে শেষ করতে চাই। ‘চার বোনের পর রুবির দুই ভাই জন্মগ্রহণ করে। এখন তারা বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। দুই ভাইকে বড় করে তোলার দায়িত্ব রুবির ওপর। পাঁচ বছর বয়সে রুবিকে ঢাকায় আসতে হয় কাজের জন্য। ’ মেয়েটির মুখের পাশে আলোকিচিত্রী সহজে কথাটি লিখে দিলেও সমাজের অসঙ্গতির ভিত ধরে টান দিয়েছেন। রুবি ঢাকার ঝিয়ের কাজ নিয়েছে, অনেক বঞ্চনার মধ্যে সে টাকা সংগ্রহ করে দুই ভাইকে বড় করে তুলবে। তারপর সে চলে যাবে অন্যের ঘরে। উত্তরাধিকারীদের বাঁচিয়ে সে উত্তরাধিকার হারাবে! এই কঠিন সত্যের সহজ চিত্রায়ণই কাকলীর সফলতা।     

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।