ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৩৭) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস/শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৩৭) ||  অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
___________________________________

৩৬তম কিস্তির লিংক


এখন রহস্যোপন্যাস নিয়ে কথা চলছে: আমি শুনলাম মহিলা হান্তেরকে জিজ্ঞেস করছে সে সেভেন্থ সার্কেল সিরিজের সর্বশেষ উপন্যাসটা পড়েছে কিনা।
‘কেন?’ হান্তের জিজ্ঞেস করলো। ‘সব ডিডেকটিভ উপন্যাস তো একইরকম। বছরে একটা হয়তো পুষিয়ে দেয়। কিন্তু সপ্তায় একটা পাঠকের খুবই দীন কল্পনাশক্তিরই ইঙ্গিত করে। ’
মিমিকে ক্রুদ্ধ দেখালো। আমার মনে হলো, রেগে যাওয়ার ভান করছে সে।
‘বোকার মতো কথা বলো না,’ বললো সে। ‘রহস্যকাহিনীর উপন্যাসই একমাত্র আমি পড়ার জন্য সঙ্গে করে আনি। আমি বলতে চাই, ওগুলোই একমাত্র মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার মতো! সবকিছু এমন জটিল হয়, আর ওই বিস্ময়কর সব গোয়েন্দারা, সবকিছু যাদের একেবারে নখদর্পণে মিঙ রাজবংশের চিত্রকলা, হস্তলিপিবিদ্যা, আইনেস্টাইনের ত্বত্ত্ব, বেসবল, প্রত্নত্বত্ত্ব, হস্তরেখাবিদ্যা, এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে ভারতে খরগোশ পালন পর্যন্ত। ওদের এই অব্যর্থ ভূমিকা আমার খুব পছন্দ। তুমি আমার সঙ্গে এক মত?’ আবারও মতামতের জন্য ফিরলো সে আমার দিকে।
একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় ভেবে পেলাম না কি জবাব দেবো।
‘হ্যাঁ, এটা সত্যি,’ জবাব দিলাম আমি, কিছু একটা বলার জন্য বলা।
এবারও হান্তেরের মতভিন্নতা স্পষ্ট।

‘আমি গিওর্গিকে জানাবো রহস্য উপন্যাস—এমনকি ওর সিরিজও তোমাকে কাবু করে ফেলে,’ হান্তেরের দিকে তেরছা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রেখে যোগ করলো মিমি।
‘আমি বলিনি আমাকে কাবু করে ফেলে; আমি বলেছি ওগুলো সব আমার কাছে একরকম মনে হয়। ’
‘যাই বলো, আমি গিওর্গিকে বলে দেবো। ওপরঅলাকে ধন্যবাদ যে, তোমার মতো অন্য সবাই এমন পণ্ডিত না। এই যে এখানে, আমাদের ক্যাস্তেল, ওকেই উদাহরণ দেই; তুমি তো রহস্য কাহিনী পছন্দ করো, তাই না?’
‘আমি?’ আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘অবশ্য,’ মিমি তার সিদ্ধান্তে অটল, এবং আবারও আমার জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে হান্তেরের দিকে ফিরলো সে, ‘সবাই যদি তোমার মতো পণ্ডিত হতো, তাহলে বেঁচে থাকার কোনা অর্থই থাকতো না। আমার নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে তোমার কাছে গোয়েন্দা উপন্যাস সর্ম্পকে নিশ্চয়ই বিস্তারিত কোনো ত্বত্ত আছে। ’
‘বাস্তবতা হলো, আছে,’ হাসলো হান্তের, দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান সে গ্রহণ করেছে।
‘তোমাকে আমি বলিনি,’ কঠিন সমালোচনার গলায় বললো মিমি, তার সাক্ষী হিসেবে আমাকে তালিকাভুক্ত করতে আমার দিকে ফিরলো। ‘হাহ্, এই লোককে আমি একটু বেশিই চিনি। এসো, তোমার জ্ঞান দিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দাও। আমি জানি তুমি তোমার এই বিখ্যাত তত্ত্ব আমাদের শোনানোর জন্য মরে যাচ্ছো। ’
এটা সত্যি হান্তেরের খুব বেশি প্ররোচনার প্রয়োজন নেই।
‘আমার তত্ত্ব,’ শুরু করল সে, ‘এটা এরকম। মধ্যযুগের বীরত্বের কাহিনী যেমন সারভেন্তেসের সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে তেমনি বিশ শতককে প্রতিনিধিত্ব করছে রহস্য উপন্যাস। আমি আরেক ধাপ এগিয়ে বলবো: দোন কিহোতের মতো একই ধরনের কাজ রহস্যেও করা সম্ভব: ডিডেকটিভ উপন্যাসের স্যাটায়ার আর কি ‘ঠিক কিহোতে যেমন মধ্যযুগের বীরত্বের কাহিনী। এখন এই ব্যাপারটা চিন্তা করো কেউ একজন তার সারা জীবন কাটিয়েছে রহস্য উপন্যাস পড়ে তারপর তার উন্মাদনা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছালো যে, সে এক সময় বিশ্বাসই করতে শুরু করলো যে, পৃথিবীটা চলছেই নিকোলাস ব্লেক কিংবা এলারি কুইনের উপন্যাসের মতো করে। তারপর আরও একটু কল্পনা করো ওই বেচারা শেষে এসে ঠিক করলো যে, সে নিজেই এখন থেকে অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে নেমে পড়বে, বাস্তব জীবনেই রহস্য উপন্যাসের গোয়েন্দার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেলো সে। আমি মনে করি এসব বই হতে পারে বিনোদনমূলক, বিয়োগান্তক, ব্যাঙ্গাত্বক...সুখপাঠ্য। ’
‘ তাহলে তুমি নিজে করে দেখাচ্ছ না কেন?’ খোঁচা দিলো মিমি।
‘দুটো কারণে: আমি সারভেন্তেস না...আর আমি খুবই অলস। ’
‘আমি মনে করি প্রথম কারণটাই যথেষ্ট’ মন্তব্য মিমির।
তারপর, মন্দ কপাল আমার, মিমি আমার দিকে ফিরলো:
‘এই লোক,’ হান্তেরের দিকে তার অদ্ভূত সিগারেট হোল্ডার নাচিয়ে নাচিয়ে বললো সে,‘রহস্য উপন্যাসের নিন্দা করছে কারণ যেহেতু তার নিজের ও রকম একটা লিখে দেখানোর ক্ষমতা নাই ‘এমনকি সেসব যদি দুনিয়ার সবচেয়ে বোরিং উপন্যাসও হয়। ’
‘আমাকে একটা সিগারেট দাও দেখি,’ চাচাত বোনকে বললো হান্তের, তারপরই কেবল সে মুখ খুললো:
‘তুমি বাড়িয়ে বলা রপ্ত করলে কবে থেকে? প্রথম কথা হলো, আমি রহস্য উপন্যাসের কোনো ‘নিন্দা’ করিনি। আমি শুধু সাধারণভাবে বলেছি দোন কিহোতের সমসময়েও ওরকম রহস্য কাহিনী লেখা সম্ভব ছিলো। দুই, তুমি যদি মনে করে থাকো এ ধরনের কাজে আমার কোনো প্রতিভা নেই তাহলে ভুল করছ। এক সময় আমার কাছে রহস্য কাহিনীর অসাধারণ একটা আইডিয়া ছিল। ’
‘স্যঁ ব্লাগে (সত্যিই),’ এই পর্যন্ত বলেই ক্ষান্ত থাকলো মিমি।
‘হ্যাঁ, আমি তোমাকে বলি। এক্ষুনি: একজন লোক, তার সঙ্গে থাকে তার মা, স্ত্রী, আর ছোট্ট এক ছেলে। এক রাতে মাটা রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে গেলো। পুলিশ তদন্ত করে কিছুই পেলো না। কিছুদিন পর তার স্ত্রীও খুন হয়ে গেলো: এবারও একই গল্প। শেষে, ছোট ছেলেটাও খুন হয়ে গেলো। শোকে প্রায় পাগল হয়ে গেলো লোকটা, অসম্ভব ভালোবাসত সে এদেরকে, বিশেষ করে ছেলেটাকে। মরিয়া হয়ে, সে ঠিক করলো নিজেই খুনের তদন্ত করবে। সাধারণ কায়দায় যোগ, বিয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ, এরকম যা যা করতে হয়, গোয়েন্দা উপন্যাসের ওই প্রতিভাধরদের মতো সব পদ্ধতিই অনুসরণ করলো সে, তারপর সে এই উপসংহারে পৌঁছালো যে নিশ্চিতভাবেই চতুর্থ আরেকটা খুন করবে খুনী, নির্দিষ্ট একটা দিনে, নির্দিষ্ট একটা সময়ে, এবং নির্দিষ্ট কোনো একটা জায়গায়। তার উপসংহার হলো খুনির পরবর্তী লক্ষ্য হল সে নিজে। কাজেই নির্দিষ্ট দিনে এবং সময়ে, চতুর্থ খুনটা যে জায়গায় সংঘটিত হবে সেখানে গিয়ে হাজির হলো সে, খুনির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু খুনি এলো না। লোকটা তার হিসেব-নিকেশ আবার নতুন করে পর্যালোচনা করল: ভাবলো, স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সে কোনো ভুল করেছে; না, জায়গা ঠিকই আছে। সময়ে হয়তো কোনো ভুল হয়েছে; না, সময়ও ঠিক আছে। তারপর যে উপসংহারে পৌঁছালো তা তার জন্য খুবই অসহণীয়: খুনি ওখানে উপস্থিত হয়েছিলো। অন্য কথায়: হত্যাকারী আসলে সে নিজেই, খুনগুলো সে-ই করেছে তার কোনো এক মানসিক অবস্থায়। অর্থাৎ গোয়েন্দা আর খুনী দুজনেই এক ব্যক্তি। ’

(চলবে)



বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।