ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কামরুজ্জামান কামুর নির্বাচিত কবিতা

কবিতা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪
কামরুজ্জামান কামুর নির্বাচিত কবিতা কামরুজ্জামান কামু

ধানবেচালোক

যারা ধানবেচালোক
ছোটো কুমড়া ফলায়
বড় জাংলি দিয়ে
তারা আসবে না আর
তোমাদের বাজারের
কোণাকাঞ্চিতে আর
তারা বেচবে না ধান
কোনো তিল পরিমাণ
দেশে খাদ্যেরও গান
পাখি গাইবে না আর
কেন কীটনাশকের
বিষে বাংলাদেশের
লোকে মরবে হেসে!
যদি ধান বেচে লাভ
কোনো নাই-বা তাদের
তবে বেচবে না ধান
হেন মোংলাকুটীর
লোকে ফটকাবাজির
গোয়া মারবে না আর!
তারা মাঠভরা ধান
তারা আমড়াবাগান
তারা গ্রাম থেকে এক
বড় পাইকারি লোক
ধরে রংপুরে যায়
সেথা হাটবাজারির
কথা কোন তা তা কয়!
এরা ধানবেচা আর
তারা ইংরেজি গায়
কেন বাংলাভাষায়!
কোনো ফর্মুলা নাই
বানে ঘর ভেসে যায়
নদীপারঘেঁষা লোক
তবু নৌকা চালায়
তারা নৌকাতে বউ
লয়ে ভিনদেশে যায়
যা যা পায় তা তা খায়
মহাজঙ্গলে ধায়
কালো ফল পেড়ে হায়
তারা বাচ্চাকে দেয়
হেন মাঘমাসে বাঘ
কেন চিৎকারিছেন
এরা কেউকেটা নয়
বাঘে ডাকলে হঠাৎ
এরা লাগবে তো ভয়!
তারা লাটসাহেবের
মত বাটপেড়ে সব
খালি রক্ত চোষার
তালে ব্যস্ত সবাই
তারা চর্বি চাটার
কাজে ব্যস্ত সবাই
তারা ইংরেজি কয়
এরা ধানক্ষেতে রয়


মাতৃভূমি

কে তুমি নিশুতি বাঙলাদেশের পাখির সুরে গো ডাকো
চি-আও! চি-আও! ধ্বনির আবেগে রাত জেগে বসে থাকো
না না পাখি নয় তারা নয় সে তো দুর্বিনীত নিগার
আমার হাড্ডি খুলে বাঁকা করে গড়ে সে নিজের হাড়
 
আমার শিশুরা দোলে তার কোলে যেন প্রকৃতির বুকে
বাদুড়-ছানারা ঝুলে আছে কালো মাই চুষবার সুখে
যেন বকসারি আকাশের গায়ে রেখা টেনে চলে যায়
পূর্ণিমারাতে সে যেন আমার মায়ের মাদুলি চায়
 
আমি খরগোশ কালো দাঁড়কাক সবুজ পাখির ডানা
ঝাপটাই যেন আকাশের মত নীলরঙ শামিয়ানা
ফুলে উঠে ফের খুলে পড়ে যায় চৌচির বৈশাখে
আমি শুয়ে আছি কান খাড়া করে ঠাণ্ডা মাটির ডাকে
 
শুয়ে আছি ওগো পুকুরপাড়ের গাবের গাছের তলে
ধানের ক্ষেতের পুবালী বাতাস মহামিলনের ছলে
আমাদের দেহে পরাগের মত লুটোপুটি খায় হেসে
তুমি গো আমারে জন্ম দিয়েছো তোমার বাঙলাদেশে
 
তোমার বিলের বুকের শাপলা ফোটার বর্ষাকালে
দল হয়ে আমি দু’পায়ে জড়াই বামনডাঙার খালে
গলগল করে বয়ে চলে যাই চিতল-চিত্তসম
বুকে চেপে ধ’রে দেখো তো জীবন কাঁপে কেন প্রিয়তম!
 
সুখে চেপে ধ’রে রাখো তো আমারে মুখে চেপে ধ’রে রাখো
পলে ও বিপলে আতায় কাঁঠালে ঘনীভূত হয়ে থাকো
দেখো আমবনে বটনির্জনে নিখিলনদীর কুলে
কামু ফিরে যায় ভ্রুণ হয়ে তার মায়ের নাভির ফুলে


শীতকালীন কবিতা

আমার নামের শেষে পরিচিত কাম
দিয়া আমি কামিনীরে আহবানিলাম
তবু তো না সে কেন হাসে
ঠাণ্ডা লাগে নভেম্বর মাসে

তবে লাগুক না হাড়ে হাড্ডি ঠকাঠক
আমার বান্ধবী যদি খাইতে চায় বক
তাতে করে মিল দেওয়া হয়ে যায় সোজা
যত গো কামনা তত চোখ লাগে বোজা

বুজে থাকব চোখ তোমার বাড়িতে গিয়া
যা করার করবা তুমি আমার সঙ্গে প্রিয়া
আমি কত ভাল তত লাগতে পারব না
কামকাতর নভেম্বর জাগতে হয় সোনা


এ কার হৃদয়ের কাজল গ’লে যায়

আমাকে হত্যার তিমির আয়োজন চলছে। উন্মাদ
কাতেল তলোয়ার উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে।

রক্তের
কণিকা-পানকারী পশুরা উল্লাসে চাটছে ব্যক্তিকে
ব্যক্তি-নির্যাস, ব্যক্তি-কল্পনা, ব্যক্তি-ছন্দের
প্রস্ফুটন। যেন ফুলের বিকাশের মুহূর্তকে আজ
শোণিতে ভরে দিতে সীমার প্রস্তুত। ধারালো তলোয়ারে
ঝিলিক-মারা রোদ ঠিকরে পড়ে ওই। এখানে এই নিচে
কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।
ছোরায় শান দেওয়ার শব্দে সচকিত বলগা হরিণেরা
ছুটছে। যেন এই ত্রস্ত বনতল ডাকাত-কবলিত
রাতের বুক থেকে আমাকে লুকাইতে চাইছে প্রাণপণে।
হত্যা-হাহাকার-হর্ষ-উৎসব! ঝালর-ঝাড়বাতি
শোভিত পৃথিবীতে সবুজ ধানক্ষেত, কবি ও কাকাতুয়া
এ বুকে দোল খায় ! হাত দে’ ধরে দেখি পিণ্ড কাঁপছে!
এ কার হৃদয়ের কাজল গলে যায় অন্ধ আর্তির
মতন। লাশকাটা ঘরের দরজায় আব্বা বসে আছে
আমার বয়সের চাইতে দীর্ঘ এ দুপুরে। শব্দের
ভিতরে শূন্যতা নীরব। নিরবধি নদীর কান্নার
শব্দ নাই যেন শঙ্খ বাজে নাই আযান শোনে নাই
মানুষ কোনোদিন আবেগে আপ্লুত হইতে পারে নাই
রক্ত খায় নাই নিজের শরীরের বীর্য অন্যকে
প্রদান করে নাই জাপটে ধরে। এই শাণিত তলোয়ার
আমাকে ফালি ফালি করবে কেটে কেটে এখানে এই নিচে
কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।
এই যে গোধূলির মোষের পাল যায় লালচে সূর্যের
সামনে দিয়ে আজ হত্যাকাণ্ডের প্রাগমুহূর্তের
যেনবা একবার একটু-জ্বলে-ওঠা ছোট্ট আর্তির
মত। কে যেন হুঙ্কারের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যাওয়া
দুমড়ে দেশকাল মুচড়ে ফেলে দেওয়া মানব কঙ্কাল
দু’হাতে বুকে নিয়ে কাঁদছে। হৃদয়ের কাজল গলে যায়
বঙ্গোপসাগরে লবণ-ঢেউ উঠে আস্তে নেমে যায়
নিজেরই গহ্বরে। টিনের কৌটার মতন ভেসে থাকে
আমারই কল্পনা-প্রসূত আবেগের তীব্র ঘূর্ণিতে
জন্ম নেওয়া ওই মুক্তা। ঝিনুকের উষ্ণ গহবরে
জন্ম নিতে নিতে গলিত মরে-যাওয়া মুক্তা। উজ্জ্বল
পারদ-বিগলিত-রাতের কিনারায় বেহালা বাজানোর
করুণ প্রস্তাবে তুমি কি জাগো নাই, বলো তো, অব্যয়?
তোমাকে শেষবার দেখেই মরে যাব। গলায় তলোয়ার
বসাবে জল্লাদ, আখেরি ইচ্ছার অপারগতা হয়ে
মৌন লতাগুলি গড়িয়ে পড়ে যাবে মাটিতে। জামপাতা
নীরবে ঝরে যাবে। আর্ত কলরব থামিয়ে ভোরবেলা
বাঁশের বাগানের পাখি ও গুঁইসাপ তাকাবে বিস্ময়ে
হত্যাদৃশ্যের বরফ-হিম-ছায়া সরিয়ে রক্তের
ধারায় মিশে যাবে অর্ধবাক হয়ে অন্ধ জন্মের
আর্তনাদ। তবু আমাকে মনে রেখো। দু’চোখে কাজলের
আবার টান দিও। আবারও গলে যাবে। আবেগে থরথর
মদিরা-বিজড়িত নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের তারাগুলি
অধীর পৃথিবীকে আলিঙ্গন দিতে নামবে ধীরে ধীরে।
আদরে ভরে দিয়ো কাজল-কালো রাত। দূরের যাত্রীকে
বাহুর বাহানায় দু’দিন ধরে রেখো। বসন্তের গান
ক্ষণিক ভুলে যাওয়া কোকিল পাখিটাকে কেউ তো দেখে নাই
পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির মাটিতে তির্যক
নামার দৃশ্য তো মানুষ দেখে নাই হত্যা-উত্তর
জৈব-ধর্মের উত্তেজনাগুলি মলিন হয়ে যেতে
কেউ কি দেখে নাই লোহা ও মানুষের যুদ্ধে পরাজিত
লাশের পাহাড়ের উপরে শেয়ালের খিদায় কাতরানো
করুণ চোখ দুটি! তবুও হত্যার তিমির আয়োজন
তবুও রক্তের পিপাসা-জাগ্রত-শাণিত-লোহা দিয়ে
তৈরি তলোয়ার আমাকে কোরবানি করবে উল্লাসে
হঠাৎ থমকানো ঘূর্ণি-বাতাসের বুকের ধূলিকণা
পড়বে ঝরে। এই সুরত মুছে দিয়ে সূর্য ডুবে যাবে
তুলসিতলে জ্বেলে নীরব মোমবাতি আম্মা কোরানের
আয়াত তেলাওয়াত করবে। মর্মের অশ্রুবিন্দুর
মতন টুপটাপ ঝরবে দুনিয়ায় বেহেস্তের ফুল
দেবতা দরবেশ করবে কোলাকুলি। কণ্ঠনালীটায়
আম্মা চুমা খাবে। আমার দুই চোখে কাজল টেনে দিয়ে
নিজের আয়নায় নিজেরই মুখ দেখে পারদে গলে যাবে
মানবজন্মের দীর্ণ দুই পার। একটু পরে তার
কোলের শিশুটিকে জবাই করা হবে। মাংস রান্নার
মশলা বাতাসের লুব্ধকারী ঘ্রাণ জাগাবে মানুষের
ভিতরে মানুষের হত্যাকারী প্রাণ, হিংসা, রৌরব
রক্ত-কণিকার গন্ধে মানুষের মাতাল তলোয়ার
তুলবে ঝঙ্কার। পথের মাঝখানে হারানো সন্তান
আবার তুলে নিতে মায়ের বুকটান ছিটকে পড়ে যাবে
মানুষ দৌড়াবে নিহত মানুষের চামড়া ছেদ করে
মাংস ভেদ করে রক্ত পান করে অশ্বারোহীদের
চাবুকে চিৎকার করতে করতেই পাহাড়চূড়া থেকে
ধাবিত পাথরের ধাক্কা খেয়ে তবু মানুষ দৌড়াবে
প্রেমের পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে তপ্ত পৃথিবীর
আগুনে পোড়া হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে ফেলে ধ্বস্ত মানুষেরা
তবুও দৌড়াবে। সকালে সূর্যের সামনে ফেলে দিয়ে
কাতেল তলোয়ার আমাকে কোরবানী করবে। রক্তের
ফিনকি-লাগা-মেঘ কিছুটা উড়ে গিয়ে ঈষৎ থমকাবে
শুভ্র শরীরের রক্ত ফেলে দিয়ে আবারও উড়ে যাবে
আকাশে আপনার আকার বদলাতে। মাটির পৃথিবীতে
মহিষ ভেড়া আর গরুর পাল যায় লম্বা সার বেঁধে
রক্তমাখা ঘাস তারা তো খায় নাই। বুলেট বিঁধে যাওয়া
বাঘের গোঙানির মতন মিনতির সামনে শিকারীর
চোখের দুই কোলে রক্ত লাল হয়ে কখনো ওঠে নাই
পাতা ও বাতাসের নিবিড় সংলাপ সীমার শোনে নাই
গলায় তলোয়ার চালানোর উল্লাসে রজনী চৌচির
ব্যথায় ফেটে গেছে। গড়িয়ে পড়ে গিয়ে কে যেন মরে গেছে
সুরত মুছে দিয়ে কে যেন চলে গেল কী যেন চলে গেল
কখনো আসে নাই তবু সে মরীচিকা সুদূরে চলে গেল
দিগন্তের কালো গ্রামের ওইপারে দিনের অন্তিম
আলোর রেশটুকু ডানায় তুলে নিয়ে যে পাখি উড়ে যায়
তার এই চরাচরে কখনো খুলে-পড়া ছোট্ট পালকের
স্মৃতি কি মনে থাকে! গোপন হত্যার ছোরায় হাতছাপ
নিজেরই অগোচরে কেউ কি রেখে যায় একটু কেঁপে-ওঠা
আবেগে থরথর নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের কিনারায়!


লেবুর পাতা

কে যেন রে বন্ধু ব’লে ডাক দিল আমারে
আমি এই ঘর থেকে ওই ঘরে যাই
                     লেবুর পাতা দোলে রে
আমার ঘর-দুয়ারের মায়ায় বন্ধু
                      লেবুর পাতা দোলে রে
কে যেন রে বন্ধু বলে ডাক দিল আমারে
 
আমার আয়নার সামনে লজ্জা লাগে
সেই আদরের অনুরাগে আয়না ভাইঙ্গা পড়ে
আমার যুগল সুরত ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা পড়ে রে
ওই যে লেবুর গাছের ডালে বন্ধু
                        লেবুর পাতা দোলে রে


আসাদ

(মম তনুর ময়ুর সিংহাসনে
এসো রূপকুমার ফরহাদ— কাজী নজরুল ইসলাম)

আসাদ, আমার নাম মনে নাই তোর?
বুকের ভিতরে জাপটে ধ’রে রাখা সেই
বুকের উষ্ণতা হয়ে আরেকবার ডাক
আমার সমস্ত কিছু যা আছে আমার
আমার গলার মালা যা আছে আমার
যা আমার নাই তার না থাকার ফাগ
সবকিছু ফেলে দিয়ে তোর কাছে যাব
বুকের-বিলয়-তলে বিজয়-বেদনা
রে আসাদ, বন্ধু মোর, শিশিরের কণা,
ঝাঁপ দে রে আমার বুকে, জন্মের শূন্যতা
চুমায় ভরিয়ে দে রে! আঁকড়ে ধর, যাদু!
এত আলো এত আলো কেন রে ভুবন!
আসাদ! আসাদ! আমি মরে যাচ্ছি রে!


আসাদ-২

আমি খিলিপানের মতন ক’রে হাসি
কেন হাসি লাগে রে আমার তনু
জাগে রে আমার কেন আগে রে আমার
তুই পাবি? কেন এই হাড্ডির চিৎকার তুই
পান ক’রে যাবি? কেন আমার বিকার
রে আসাদ! কালো ঘোড়া! গত জনমের
পহেলা বৈশাখ তুই, আমি তোকে চাই
রগের ভিতরে রক্ত হয়ে তুই থাক রে আমার
ছিটকেপড়া বীর্যের বিরহ হয়ে থাক রে আমার!
খাঁখাঁ এই বুকে আয়, ঝাঁপ দে রে আসাদ
দুপুরের পুকুরে আমার! আমার শূন্যের বুকে
আমার দিগন্তে তুই নেমে আয়! খোকা!
সোনার ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে ছুটে আসি
এই নে হাড্ডির রক্ত, পান কর, হাসি...


আসাদ-৩

আসাদ আমার বন্ধু, ভগ্নাংশ আমার
আমার জলার মাছ, লালপুঁটি, তার
বুকের ঢিপঢিপ ধ্বনি বাজে রে আমার
বুকের তলের জলে! দুধের বোঁটায়,
তলপেটে সে আমার থেঁতলে যাওয়া ছেলে!
সে আমার ঠোঁট থেকে আস্তে খুলে যাওয়া
ঠোঁটের অনুরাগ হয়ে সুদূরে মিলায়!
রে আসাদ! ভাই আমার! সোহাগের ধন!
ফিরে আয় ফিরে আয় ফিরে আয় বুকে
আমার আতার ফুল ছিঁড়ে আয় বুকে
আমার নাড়ির টান আমার পাতাল
আমার দাফন শেষে ছিটানো আতর
গন্ধের মতন তুই উড়ে যাবি, সোনা!
তোকে আর এই দেশে জীবনে পাব না...
আমার বাংলাদেশ! আমার বিফল
তনু! ভীরু ধানক্ষেত! মায়ের পেটের
ভিতরের দুই ভাই আমি ও আসাদ...


আসাদ-৪

আমি তোকে আর রক্ত দেখাবো না রে
আমি তোকে আর গলাব না এই ক্ষার-এ
আমি শুধু এই এপারে আমার শুয়ে
রবো রে আসাদ, পারানির সিকি খু’য়ে
তুই তো আমার পাঁজরে পা রাখবি না
জানবি না কেন কাঁপে এই ছোট সিনা
মানবি না তোর পেড়ে আনা সেই মুখ
লুকায়ে রাখুক এই চির-উজবুক


আসাদ-৫

আসাদ! আসাদ! চল আমরা খলখল ক’রে
দৌড়াই পাকা ধানের শীষের উপর দিয়ে
চল আমরা মেঘ খাই
চল দামামা বাজাই, চল রে আসাদ
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই
উপরের দিকে, উপরের সীমাহীনতার
ওপারের সাদাকালো গ্রাম
পার হয়ে আরও এক দূর...
গ্রামের ভেতর দিয়ে নূর
হয়ে মোরা বয়ে যাই চল…


আসাদ-৬

চল আমরা কাঠবিড়ালির সাথে
লাফ দিয়া গাছে উঠি
গাছের ডালের ফাঁকের আলোছায়ায়
এ-ডাল ও-ডাল করার মতো খেলি
আমাদের হিরণ্ময় আমগাছগুলি
আমাদের আমের তলের ছোটঘর
আমরাই তো বাঁধিয়াছি হেসে
দুজনে দোঁহারে ভালোবেসে
সে-ভালবাসার দিন আদিঅন্তহীন
গোলাপের বাগানের মত ফুটে রবে
এপারের এ-ঘরের
চালার উপর দিয়ে
উড়ে চলে যেতে গিয়ে থমকায়
যে-বাতাস, তার
হৃদয়ের গান আমি গাহিয়াছি
আমি তারে ডাকি রে আসাদ!


আসাদ-৭

আমার বাঁশের তলে পড়ে আছে বাঁশপাতা
রে আসাদ, তুই আমার
কবিতার খাতা রে! আসাদ!
তুই আমার ব্রহ্মপুত্রের পারে
ঝাউবন, বিবাহ-মন্দির...
তুই আমার স্বপ্নে-পাওয়া
সোনালি ধারের তলোয়ার...
তুই আমার আত্মারই আলয়
আদিকালে বৃষ্টির আঘাতে
ধ্বসে-পড়া জীবন্ত নগর
ভূ-পাতন, ইন্দ্রিয়ের শৈথিল্যের
নিচের শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া চন্দ্রমুখী-নাও...
শৈবালে ঠোকর দেওয়া রাজহাঁস
উড়ে যাওয়া পাখিদের
উন্মূল ছায়ার নিচে
মম ভগবান!


সীমান্ত

আমাদের হাওয়া গিয়ে তোমাদের জামপাতা মৃদুভাবে নাড়ে
ফলে কি জামের বন আত্মীয়প্রবণ হয়ে ওঠে

আমরা কোকিল ছাড়ি তোমার কাকের গৃহে ডিম পেড়ে আসে
তোমাদের পক্ষীছানাগুলি এপারের ডালে বসে বিষ্ঠা ত্যাগ করে

সীমান্তরক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পিপিলিকাশ্রেণী
খাদ্য বহন করে নিয়ে আসে এপারের থানায় থানায়

একই জলে স্নান করে দুই ভূগোলের দু’টি লোক
বিদেশ! এতোটা নিকটে থাকে! এতোখানি শিলাময়!


মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

ভিড়ের মধ্যে যাকে আমি নাম ধরে ডাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় খুঁজে পাই না
ফলে, নিরুপায় হয়ে আজও আমি যার ভরণপোষণ সহ্য করি বউবাচ্চাসহ
তিনি আমাকে বললেন, তুমি জানো নাকি কিসব কারণে যেন একাত্তরে
একটা যুদ্ধ হয়েছিল, ঐযে যে-বছর তোমাকে জন্ম দিয়ে আমি জীবনে একটা
ভুল করলাম! ঐযে তোমার চাচাজ্যাঠারা পরস্পর খুব গুলির শব্দ করল!
মাঝখান থেকে আমার বিলের পাখিগুলা সব উড়ে গেল...
দেখিস তো দেখিস তো আজগার, তিনি তার ছোটভাইকে
ফিসফিস করে বলেন, দেখিস তো সেই বালিহাঁসগুলা আবার আসে নাকি...


বাণিজ্যের স্বাদ

একদা এ ধরণীতে আমিও বেকারি দেব
আমিও বসাবো এক লোহার মেশিন
তাতে বিস্কুট তৈয়ারি হবে। আমার কোম্পানি
ফুড প্রসেসিং শিল্পে নামবে একদিন

সিনেমায় লগ্নি করে পুঁজির বিস্তার হবে
এত টাকা পয়সা দিয়া কী করিব আমি
আমি উট কিনব উট নিয়ে বালির সাগর
পেরিয়ে তোমার কাছে যাব ওগো স্বামী

এ জীবনে যাহা কিছু বাণিজ্যের স্বাদ আমি
লভিয়াছি তোমা হতে ওগো বিত্তবতী
ওগো শিলা ওগো পাথরিনী একদিন জানি
মেশিনেরই মুখ দিয়ে বের হবে রতি


মামুজির নৌকায়

আমরা নদী নৌকা আর ছইয়ের মধ্যে
বসে বসে লেখতেছিলাম গদ্যে এবং পদ্যে
হঠাৎ মামুজি বলল চলেন মাল খাই
সকলেরই কমবেশি চর্বির আকাঙ্ক্ষা

বাইরে বাতাস বয় দুলতে রয় তীর
আমাদের বাকবিতণ্ডা হইতেছে অস্থির
মামুজি চালাক ব্যক্তি হাত দিলেন ঘটে
ঘট ফাইটা ঘটনারা ঘাটে ঘাটে রটে

রটুক দিনের বেলা কুমড়া খাউক ছাগে
নৌকা ভাসানের কালে ঠেলা দেওয়া লাগে
দেওয়া লাগে বলেই আমরা সকলেই দেই
তাই বলে আমরা কিন্তু উই আর নট পেয়ি

একসঙ্গে টেক্কা মারা এক পদ্যে হারা
মাঝি বলল ছোট নৌকা নদীতে গা-ঝাড়া
দিচ্ছে গাঙচিলগুলি এমন বাস্তব—
ভাবে মনে হয় সব কল্পনার স্তর

Baner_Arts

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।