ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৩৫) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (৩৫) || অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
___________________________________

৩৪তম কিস্তির লিংক

আলেন্দে একেবারেই অন্যসব গ্রামীণ স্টেশনের মতো, এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে গুটিকয় লোকজন, হাতাগুটানো স্টেশনমাস্টার, একটা ওয়াগন, আর কিছু দুধের ক্যানেস্তারা।

দুটো জিনিসে আমি খুব বিরক্ত হলাম: মারিয়া স্টেশনে আসেনি, পরিবর্তে একজন সোফার ধরনের লোক এসেছে।

ট্রেন থেকে নেমেছি মাত্র, তখুনি লোকটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল:
‘আপনি সিনর কাস্তেল?’
‘না,’ শান্ত মুখে জবাব দিলাম আমি। ‘আমি সিনর কাস্তেল না। ’

সঙ্গে সঙ্গেই, মনে হল, ফিরতি ট্রেনের জন্য এই স্টেশনে বসে থাকাটা সাংঘাতিক ক্লান্তির হবে; হয়তো দিনের অর্ধেকটা সময় বসেই পার করতে হবে। বিরক্তি লাগলেও, শেষে নিজের সঙ্গেই দ্রুত রফা করে নিয়ে, স্বীকার করলাম আমিই উল্লিখিত ব্যক্তি।

‘হ্যাঁ,’ দ্রুত সংশোধন করে বললাম। ‘আমি সিনর কাস্তেল। ’
সোফার লোকটা বিস্ময় গোপন করতে পারল না।
‘এটা ধরো,’ আমার সুটকেস আর রঙের বাক্সটা ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে।
গাড়ির দিকে এগোলাম।
‘সিনোরা মারিয়ার শরীর ভালো  না,’ ব্যাখ্যা দিল লোকটা।
‘শরীর ভালো না!’ বিড়বিড় করে বললাম আমি। আল্লা, এ ধরনের প্রতারণায় তো ও বরাবরই পারদর্শী! আবারও বুয়েনস আয়ার্সে ফিরে যাওয়ার কথাটা মাথায় খেলে গেল চকিতে, কিন্তু বুঝলাম, ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার পাশাপাশি বাড়তি আরেকটা ঝামেলাও যোগ হয়েছে: এখন, হয় সোফার লোকটাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমি, আসলেই কাস্তেল নই, অথবা আমিই কাস্তেল তবে আমি কোনো উন্মাদ না। বিকল্প দুটো দ্রুত পর্যালোচনা করে, কিন্তু বুঝলাম, আমি যা-ই করি না কেন, সোফারকে বিশ্বাস করানো সহজ হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ঠিক আছে আমার শরীর না হয় এসতানসায়ায় গেলই। আর তাছাড়া, ফিরে গেলেই বা কী লাভ হচ্ছে আমার? এর উত্তরও সোজা; আবারও আগের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে শুরু করবে: আমি রাগে আবার ফুটতে শুরু করব, আর এই রাগ যেহেতু আমি মারিয়ার ওপর ঝাড়ার কোনো সুযোগ পাচ্ছি না কাজেই ক্রমেই তা বিকট রূপ নিতে শুরু করবে; আর ওর সঙ্গ না পাওয়ার কারণেও আমি তীব্ররকম অশান্তিতে ভুগতে থাকব; কোনো কাজকর্ম করতে পারব না— আর এসব মিলে ধুমিয়ে ওঠা অনুমাননির্ভর কিছু অভিযোগের শিকার হবে মারিয়া। আমি ‘অনুমাননির্ভর’ বলছি এ কারণে যে আমার জানা মতে এরকম প্রায় অসাড় কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে অপমান করলে তাতে খুব একটা ফলবান হয় না।

হান্তের দেখতে খানিকটা আলেন্দের মতোই (আমার মনে হয় আমি আগেই বলেছি ওরা সর্ম্পকে চাচাত ভাই)। বেশ লম্বাই ও, গাঢ় গায়ের রঙ, বেশ পাতলা গড়ন, অস্থির চোখের দৃষ্টি। ‘এই লোক একদম একটা ভণ্ড, পুরো দুর্বলচিত্ত যাকে বলে,’ মনে মনে বললাম। এবং চিন্তাটা বেশ চনমনে করে তুলল আমাকে (কিংবা ওই সময়ের জন্য অন্তত ওরকমই মনে হল)।

খানিকটা অবজ্ঞা নিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল হান্তের, তারপর অতি চর্মসার এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে, তার হাতে ধরা অদ্ভুতরকমের দীর্ঘ একটা সিগারেট-হোল্ডার। কথা বলে প্যারিসীয় উচ্চারণে, কলহপ্রিয় আর ক্ষীণদৃষ্টি, আর এর নাম হচ্ছে মিমি আলেন্দে।

কিন্তু মারিয়া কোন চুলোয়? ওর কি সত্যিই শরীর ভালো না? ওর চিন্তায় আমি এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে আছি যে এইমাত্র সাক্ষাৎ ঘটা দুই সন্দেহভাজন চরিত্রের কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। আমি কোথায় আছি আচমকা মনে পড়ল আমার, আমি দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে তীব্রচোখে তাকালাম হান্তেরের দিকে, আমর দৃষ্টিতে কর্তৃত্ব স্পষ্ট। ওর মতো লোকেদের বেলায় এই কায়দা, দারুণ ফল দেয়।

হান্তেরের চোখে উপহাস ফুটে উঠলেও, দ্রুত তা গোপন করার চেষ্টা চালাল ও।

‘মারিয়া ভালো বোধ করছে না, শুয়ে আছে,’ বলল সে। ‘তবে শিগগিরই নিচে নামবে ও। ’

আমার অপ্রস্তুত অবস্থা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় মনে মনে নিজেকে অভিশাপ দিলাম; এই দুটোর সঙ্গে আসলে আমাকে সারাক্ষণই সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি, এটাও ঠিক করলাম ওদের চিন্তা কিভাবে কাজ করে, ওদের রসবোধ, ওদের প্রতিক্রিয়া, ওদের আবেগ—এসব ব্যাপারগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে নজর করতে হবে আমাকে, পরে মারিয়ার সঙ্গে হয়তো এসব দারুণ কাজে আসবে। কাজেই, আমাকে খেয়াল করে শুনতে হবে এবং নজর রাখতে হবে, আর এটা ভালোভাবে করার জন্য আমি মানসিকভাবে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকতে চাই। কিন্তু তারপরও নিজেকে আরেকবার অভিনন্দন জানালাম, এই দুটোকে ঘিরে থাকা কপটতার মধ্যেও আমি মেজাজ হারাইনি বলে।

‘ও, তুমি তাহলে পেইন্টার,’ বলল ক্ষীণদৃষ্টির মহিলা, আধবোজা চোখজোড়া আরও কুঁচকে জরিপ করার চেষ্টা করল আমাকে, যেন ধুলোঝড়ের ভেতর দিয়ে দেখছে সে। তার ওই কুঁচকানো মুখচোখ, চোখে চশমা না পড়ে খালি চোখে দেখার দেখার চেষ্টা করায় (যেন চশমা তাকে খুব কুদর্শন করে দেবে), তার চেহারার ঔদ্ধত্য আর কপট অভিব্যক্তি আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে।

‘হ্যাঁ, ম্যাডাম,’ রাগী জবাব দিলাম। আমি নিশ্চিত এই মহিলা অবিবাহিত।
‘কাস্তেল দুর্দান্ত একজন পেইন্টার,’ মহিলার সঙ্গী ব্যাখার গলায় বলল। তারপর সে এর সঙ্গে যোগ করতে শুরু করল একের পর এক অসাড়, প্রশস্তি, মন্তব্য, আর আমার প্রত্যেকটা প্রদর্শনী নিয়ে সমালোচকরা যে সব গাধার মতো কথা বলে তার পুনরুক্তি: ‘বলিষ্ঠ,’ এরকম আরও যত কথা আছে। আমি এটা অস্বীকার করতে পারব না ও যখন এসব ক্লিশেগুলো উদ্বৃত করছে আমি তার মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম উপহাসের সুরও সনাক্ত করতে পারছিলাম। আমি খেয়াল করলাম মিমি আবারও তার ছোট কোঁচকানো চোখে আমাকে জরিপ করার চেষ্টা করছে, এতে আমি খানিকটা বিচলিত বোধ করলাম, ও কী বলতে পারে অনুমান করার চেষ্টা করলাম। এখন পর্যন্ত, আমি নিশ্চিত না ওর কাছে আমার চাওয়া কী হবে।

‘তোমার পছন্দের পেইন্টার কারা?’ জিজ্ঞেস করল সে, অনেকটা পরীক্ষা নেওয়ার ধরনে।

না, এখন আমার মনে পড়েছে, এটা সাক্ষাৎকারের ব্যাপারটা একেবারে শুরুতেই ঘটেনি, গাড়ি ছেড়ে কিছুদূর আসার পর ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। এগিয়ে আসার পর, ওই মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই হান্তের আমাকে, মহিলা বাগানে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো একটা টেবিলের পাশে বসেছিল, এরপর হান্তের আমাকে পথ দেখিয়ে আমার কামরায় নিয়ে আসে। আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছিলাম (দোতলা বাড়ি এটা), ও তখন বাড়ির বর্ণনা দিচ্ছিল, ছোটখাটো পরিবর্তন ছাড়া, কার্যত এই বাড়িটা বানিয়েছে ওর দাদা, তার প্রপিতামহের জমিদারির ওপর নির্মিত হয়েছে পুরো বাড়িটা। ‘এটা শুনে আমার কী হবে?’ ভাবলাম আমি মনে মনে। বুঝতে পারছি এই ব্যাটা নিজেকে বেশ আন্তরিক আর খোলামেলাভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোন উদ্দেশে সে এটা করছে আমি এখনও তা ধারণা করতে পারছি না। সে যখন আমাকে সূর্যঘড়ির কথা বলছিল, কিংবা সূর্যের সঙ্গে সর্ম্পক আছে এরকম কিছু একটার কথা বলছিল, আমি তখন এক মারিয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর কথাই ভাবছিলাম না, ভাবছিলাম এই উপরতলারই কোনো একটা রুমে আছে ও। আমার মুখচোখের কৌতূহলী চাহনি দেখেই হয়তো, হান্তের বলল:
‘উপরে শোবারঘর বেশকটা। আসলে, এই বাড়িটা খুবই আরামদায়ক, যদিও এটার নকশায় বেশ মজার ছাপ আছে। ’
আমার মনে পড়ল হান্তের নিজে একজন স্থপতি। কিন্তু এ বাড়ির নকশা যদি হান্তেরের কাছে মজার ঠেকে থাকে তাহলে মজার না কোনটি।
‘এটা ছিল আমার দাদার শোবারঘর; এখন এটা আমি ব্যবহার করি,’ সিঁড়ির ঠিক মাথায়, মাঝখানের একটা কামরা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল হান্তের।
এরপর পাশের আরেকটা ঘরের দরজা খুলল সে।
‘এটা তোমার ঘর। ’

আমাকে ঘরে একলা রেখে, বাগানে চা খাওয়ার সময় আবার দেখা হবে বলে বিদায় নিল। যে মুহূর্তে ও বিদায় নিল, মারিয়া এখানকারই কোনো একটা শোবারঘরে আছে এই চিন্তা মনে আসতেই আমার হৃদ্কম্প বেড়ে গেল, এমন কি মনে হল আমার ঠিক পাশের রুমটাতেও ও থাকতে পারে। ঘরের মাঝখানের নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, কী করব বুঝতে পারছি না। এ সময় মাথায় বুদ্ধি এল একটা: পাশের ঘরের দেয়ালের কাছে গিয়ে (অবশ্যই হান্তেরের না) আলতো করে টোকা দিলাম। তারপর জবাবের অপেক্ষায় থাকলাম, কিন্তু নীরবতা ছাড়া আর কোনা সাড়াশব্দ পেলাম না। করিডোরে বেরিয়ে এসে আশপাশটা দেখে নিলাম কেউ আছে কিনা; দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে এলাম পাশের রুমটার সামনে, রুদ্ধশ্বাসে, টোকা দেওয়ার জন্য হাত উঁচু করে আছি। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না কিছুতেই, এবং বাস্তবতা হল প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম আমি। কিছুক্ষণ পর নিচের বাগানে নেমে এলাম। একেবারে বিত্রস্ত অবস্থা আমার।

(চলবে)



বাংলাদেশ সময়: ১৬৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।