ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মেসনের জীবন | কিংসলে আমিস | অনুবাদ: ফজল হাসান

অনুবাদ গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪
মেসনের জীবন | কিংসলে আমিস | অনুবাদ: ফজল হাসান পেইন্টিং: সালভাদর দালি

‘আমি কি অংশগ্রহণ করতে পারি?’
অপরিচিত মুখের লোকটি পেটিগ্রিউর দিকে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনুমতি চাইলো। লোকটির দেহের গড়ন মাঝারি এবং পরনে সাদামাটা আটপৌরে পোশাক।

পেটিগ্রিউ একাকী কোণার একটা টেবিলে বসে আছে। তার হাতে বিয়ারের গ্লাস।

যাহোক, পেটিগ্রিউর ঋজু এবং সুঠাম দেহের গড়ন সুন্দর এবং দৃষ্টিনন্দন। ভিন্ন সময় হলে সে হয়তো লোকটির অনুমতির জবাব অন্যভাবে দিতো। কিন্তু এ মুহূর্তে সে সম্মতি সূচক ভঙ্গিতে ভদ্রভাবে বললো, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই পারেন। নির্দ্বিধায় বসুন। ’

বলেই পেটিগ্রিউ—আগন্তুক লোকটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার জন্য কি কোনো পানীয় আনতে বলবো?’
‘না, আমার কিছু লাগবে না, ধন্যবাদ। ’
কথা বলার সময় মাঝারি গড়নের লোকটি এমন অঙ্গভঙ্গি করে যেন তার সামনে ভরা বিয়ারের গ্লাস। কাউন্টারের পেছনে মোটামুটিভাবে সাজানো মদের বোতল রাখার সেলফ্, দোকানি এবং টেবিলে একজন বা দু’জন করে বসা খদ্দের ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু চোখে পড়ার মতো নয়।

‘আগে আমাদের কখনোই মোলাকাত হয়নি। নাকি?’
‘আমার যদ্দুর মনে পড়ে, আগে আমাদের পরিচয় হয়নি। ’
‘ভালো, বেশ ভালো। আমার নাম পেটিগ্রিউ, ড্যানিয়েল পেটিগ্রিউ। আপনার নাম?’
‘মেসন। আপনি জানতে চাইলে বলছি, আমার পুরো নাম জর্জ হার্বার্ট মেসন। ’
‘হ্যাঁ, এতেই চলবে। আপনারও কি তাই মনে হয় না? জর্জ... হার্বার্ট... মেসন...। ’
মেসনের পুরো নামের তিনটি শব্দকে পেটিগ্রিউ এমনভাবে টেনে বললো যেন সে রীতিমতো মুখস্থ করছে। তারপর সে বললো, ‘এখন আপনার টেলিফোন নম্বর বলুন। ’

পেটিগ্রিউর অযাচিত দাবির প্রেক্ষিতে মেসন হয়তো পুনরায় বিরক্ত হতে পারতো, কিংবা প্রচণ্ড রাগ করতে পারতো। কিন্তু চোখেমুখে বিরক্তি বা রাগের কোনো চিহ্ন না ফুটিয়ে সে শুধু বললো, ‘আমার নম্বর টেলিফোন বইয়ে খুঁজে পাবেন। ’
‘না, হয়তো এই শহরে একই নামের একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারে। যাহোক, এ মুহূর্তে মোটেও আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়। অনুগ্রহ করে এবার নম্বরটা বলুন। ’
‘তাই তো! ঠিক আছে। যাহোক, এটা তো আর গোপনীয় নয়। দুই-তিন-দুই, পাঁচ...’
‘থামুন, মশাই। আপনি খুব তাড়াহুড়ো করছেন। দুই-তিন-দুই... তারপর?’
‘পাঁচ-চার-পাঁচ-চার। ’
‘কি অদ্ভুত ব্যাপার! আপনার টেলিফোন নম্বর খুবই সহজ। অনায়াসে আমি মনে রাখতে পারবো। ’
‘আমার টেলিফোন নম্বর আপনার কাছে যদি এতই মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় হয়, তাহলে কেন কাগজে লিখছেন না?’ ভ্রুক্ষেপ করে মেসন বললো।

মেসনের কথা শুনে পেটিগ্রিউ দাঁত কেলিয়ে হাসে। ক্রমশ ঠোঁটের ফাঁকে সেই হাসির রেখা মিলিয়ে যায় এবং চোখেমুখে একধরনের বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। সে বললো, ‘আপনি কি জানেন না, এতে কোনো ফায়দা হবে না। যাহোক, দুই-তিন-দুই-পাঁচ-চার-পাঁচ-চার। আপনাকেও আমার টেলিফোন নম্বরটা দেওয়া উচিত। সেভেন...’
‘আপনার টেলিফোন নম্বর আমার মোটেও প্রয়োজন নেই, মিস্টার পেটিগ্রিউ। ’ মেসনের কণ্ঠস্বরে বিরক্তির সুর বেজে ওঠে। তবুও সে আরো বললো, ‘এখন বুঝতে পারছি, আপনাকে আমার টেলিফোন নম্বর দিয়ে রীতিমতো ভুল করেছি। ’

‘কিন্তু আপনাকে অবশ্যই আমার নম্বর নিতে হবে। ’
‘অসম্ভব। আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না। ’
‘ঠিক আছে, চলুন এই সকাল বেলা আমরা একটা কথায় সহমত পোষণ করি। ’
‘দয়া করে আমাকে বলবেন, এসব কী হচ্ছে?’
‘শুনুন, আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। ’
‘একই কথা বারবার বলছেন। এটা...’
‘যেকোনো সময় সবকিছু বদলে যেতে পারে। আমি হয়তো অন্যসময় আমাকে আলাদাভাবে দেখতে পাবো এবং আপনিও আপনাকে দেখতে পাবেন। যাহোক, আপনার এই সন্দেহের ব্যাপারে আমার কিছুই করণীয় নেই। ’
‘মিস্টার পেটিগ্রিউ, এক্ষুণি আমাকে সবকিছু পরিষ্কার করে বলুন, নতুবা জোর করে আপনাকে তুলে দিতে আমি বাধ্য হবো। ’
‘ঠিক আছে। ’

পেটিগ্রিউর চোখেমুখে হতাশার ছায়া আরো বেশি গাঢ় হয়। সেই হতাশা মাখা মুখে সে বললো, ‘কিন্তু আমার মনে হয়, এতে ভালো কিছু হবে না। জানেন, আমরা যখন আলাপ শুরু করেছি, তখন আমার মনে হয়েছিল যে, আপনি একজন আসল মানুষ। কেননা আপনি যেভাবে...’
‘কসম লাগে, কথাটা আপনি আরেকবার বলুন। আমি একজন আসল মানুষ নই,’ অপমানিত মেসন বিড়বড় করে।
‘কথাটা আমি এমনভাবে বলিনি। যথাসম্ভব সহজ ভাষায় বলেছি। ’
‘হায় ঈশ্বর! আপনি কি উন্মাদ, মাতাল, নাকি অন্য কিছু?’
‘ওরকম কিছুই না। আমি তো ঘুমিয়ে আছি। ’
‘ঘুমিয়ে আছেন?’ পলকেই অবিশ্বাসের একটুকরো কালো মেঘ উড়ে এসে মেসনের চোখেমুখে ছায়া ফেলে।

‘হ্যাঁ, যা বলেছিলাম, প্রথমেই আমি আপনাকে আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়া অন্য একজন আসল মানুষ হিসেবে ভেবেছিলাম। আমি ছিলাম গভীর ঘুমে নিমজ্জিত, স্বপ্ন দেখায় মগ্ন, ঘটনা জানার জন্য সচেতন এবং নাম ও টেলিফোন নম্বর আদান-প্রদানের জন্য রীতিমতো উদ্বিগ্ন। আমার মনে হয়েছিল, পরদিন সকালে আমাদের এই অভিজ্ঞতাকে একে অপরের কাছে সত্য বলে মেনে নেওয়া হবে। তাহলে মন সম্পর্কে সেটা হতো একটা স্মরণীয় ঘটনা, তাই না? ঘুমের ভেতর স্বপ্নের গভীরে থেকেও একজন মানুষ অন্য আরেকজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তবে এটা খুবই দুঃখজনক যে, কদাচিৎ একজন অন্যজনের স্বপ্নকে অনুধাবন করতে পারে। গত কুড়ি বছরে আমি মাত্র চার কিংবা পাঁচবার এই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, একবারও সফল হতে পারিনি। আমি হয়তো ঘটনার বিশদ ভুলে গেছি, নতুবা বিশেষ প্রকৃতির লোকের সাক্ষাত পেয়েছি, যা আজকের ঘটনার মতো একই ধরনের। তবে আমি আমার কাজ চালিয়ে যাবো...’
‘আপনি অসুস্থ। ’
‘আরে না। ’

সঙ্গে সঙ্গে হালকা প্রতিবাদের সুরে পেটিগ্রিউ বললো। তারপর একটু থেমে কণ্ঠস্বর বদলিয়ে সে আরও বললো:

‘অবশ্য এটা কল্পনা করা স্বাভাবিক যে, আপনার মতো মানুষ আছে। যদিও বেমানান, কিংবা আপনি যদি সরাসরি বুঝতে পারেন, তাহলে আমার মনে হয় এ বিষয়ে তর্ক করা উচিত নয়। আমি যা বলেছি, হয়তো বলাটা আমার ভুল হয়েছে। ’
‘এটা সত্যি আশাব্যাঞ্জক যে, আপনি নিজেই কথাটা বলেছেন। ’

ইতোমধ্যে মেসন খানিকটা শান্ত হয়েছে। একপর্যায় সতর্কতার সঙ্গে সে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে। তারপর ফুঁ করে এক মুখ ধোঁয়া বাতাসের মধ্যে ছেড়ে বলে, ‘এ বিষয়ে আমি বেশি কিছু জানি না। তবে আপনার ভুল হলে আপনি বেশি দূর এগোতে পারবেন না। এখন আমাকে নিশ্চিত হতে দিন যে, পাঁচ মিনিট আগে আপনার মস্তিষ্কের ভেতর আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আমার নাম, ইতোমধ্যে আপনাকে বলেছি, জর্জ হার্বার্ট মেসন। আমার বয়স ছেচল্লিশ বছর, বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক এবং আমি আসবাবপত্রের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি। ধুর ছাই! সাধারণ স্মরণ শক্তি সম্পন্ন একজন লোকের মতো আমার জীবন কাহিনী সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে গেলে সারা রাত কেটে যাবে। চলুন, আমরা পান শেষ করি। তারপর আমার ঘরে চলুন। সেখানে আমরা...’

‘আমার স্বপ্নের ভেতর আপনি একজন মানুষ,’ পেটিগ্রিউ উঁচু গলায় বললো। তারপর কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে আরো বললো, ‘দুই-তিন-দুই-পাঁচ-চার-পাঁচ-চার। আমি আপনাকে ফোন করবো, তবে নম্বরটা যদি আদৌ থেকে থাকে। আমি জানি, অন্য প্রান্তে তখন বর্তমানের এই আপনি থাকবেন না। দুই-তিন-দুই...’
‘আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, মিস্টার পেটিগ্রিউ?’
‘কারণ যে কোনো মুহূর্তে আপনার একটা কিছু ঘটতে পারে। ’
‘কী... এটা কি একধরনের হুমকি?’

পেটিগ্রিউ ঘনঘন নিঃশ্বাস টানতে থাকে। ক্রমশ তার কোমল চেহারা কঠিন হয়ে ওঠে এবং খসখসে পশমী জ্যাকেটের নকশি কাজগুলো ঝাপসা হয়ে আসে।
‘টেলিফোন?’ আচমকা পেটিগ্রিউ চিৎকার করে ওঠে। ‘আমি যে সময় ভেবেছি, নিশ্চয়ই এখন দেরি হয়ে গেছে। ’
‘টেলিফোন?’ কয়েকবার দ্রুত পলক ফেলে মেসন পেটিগ্রিউর দিকে তাকিয়ে পুনরাবৃত্তি করে। সেই সময় আস্তে আস্তে পেটিগ্রিউর মুখের আদল মিলিয়ে যেতে থাকে।
‘আমার বিছানার পাশের টেবিলে! আমি জেগে উঠছি!’

মেসন এক হাত বাড়িয়ে অন্য হাত আকড়ে ধরতে যায়। কিন্তু বাড়িয়ে দেওয়া হাতের অনেকটা অংশ নেই এবং যেটুকু আছে, তাও ইতোমধ্যে অবশ হয়ে গেছে। নিজের প্রসারিত হাতের দিকে সে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। তার হাতে কোনো আঙুল নেই, এমনকি হাতের এপিঠ-ওপিঠ এবং চামড়াও নেই।
___________
___________

লেখক পরিচিতি: প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি এবং সমালোচক স্যার কিংসলে উইলিয়াম আমিসের জন্ম ১৯২২ সালের ১৬ এপ্রিল, দক্ষিণ লন্ডনের ক্ল্যাপহ্যামে। ১৯৫৪ সালে প্রথম উপন্যাস ‘লাকি জিম’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই একজন বোদ্ধা লেখক হিসেবে তার নাম সাহিত্যাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে। এই উপন্যাসের জন্য তাকে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ বলা হতো। তিনি চল্লিশটিরও বেশি গ্রন্থের (বিশটিরও বেশি উপন্যাস) রচয়িতা। সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্যা বায়োগ্রাফার্স ম্যাসটাশ্’ ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। অসংখ্য ছোটগল্প এবং কবিতাও লিখেছেন তিনি। ‘দ্য ওল্ড ডেভিলস্’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৬ সালে ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালে ‘নাইট’ উপাধি অর্জন করেন। ২০০৮ সালে ‘দ্য টাইমস্’ তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পঞ্চাশজন প্রথিতযশা ব্রিটিশ লেখকের মধ্যে নবম স্থানে আসীন করেছে। ১৯৯৫ সালের ২২ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গল্পসূত্র: ‘মেসনের জীবন’ গল্পটি ১৯৭২ সালে লেখা কিংসলে আমিসের ‘মেসন’স্ লাইফ’ ছোটগল্পের অনুবাদ। গল্পটি ২০১১ সালে প্রকাশিত লেখকের ‘কমপ্লিট স্টোরিজ’ সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। এর আগে গল্পটি ১৯৭৬ সালে ‘গোস্টলি, গ্রিম অ্যান্ড গ্রুসাম’ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গল্পটিতে ঘুমের ভেতর দু’জন অপরিচিত লোকের সাক্ষাতের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।



বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।