ঢাকা, শনিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৭ জুলাই ২০২৪, ২০ মহররম ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৬) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৬) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। - অনুবাদক
___________________________________

৫ম কিস্তির লিংক

রু শার্ল-মারি-ভিদরে এসে চালকের আসনে বসলেন তিনি। তাকে বললাম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। আমি এসে দাঁড়ালাম রাশান চার্চের সামনে। আমাদের ট্যাক্সিটা যে দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে, আমি এসে দাঁড়িয়েছি ঠিক তার উল্টো দিকে।

না, ওখানে কেউ নেই। ওরা কি তাহলে এরই মধ্যে চলে গেল? যদি গিয়েই থাকে, তাহলে আমার স্তিওপ্পা দ্য জাগোরেভকে অনুসরণ করার আশা আর নাই। প্যারির অ্যাড্রেসবুকের কোথাও ওর নাম নাই। রাস্তা থেকে দেখছি, চার্চের সেই বহুবর্ণিল জানালা। জানালার পেছনে, অর্থাৎ ঘরের ভেতরে রাখা উৎসবের মোমবাতিগুলো তখনও জ্বলছে। আমি কি আসলে সেই বৃদ্ধাকে চিনি, যার জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই অনুষ্ঠান? কোনো সন্দেহ নাই, আমি যদি স্তিওপ্পার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হতাম, তাহলে তিনি হয়তো আমাকে মারি দ্য রোজেনসহ অন্য বন্ধুদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যাকে নিয়ে এই অনুষ্ঠান, আমাদের সময়ে নিশ্চয়ই তার বয়স আমাদের চাইতে অনেক বেশি ছিল।

আমি দরোজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এই দরোজা দিয়েই তারা ঢুকেছিল। এই দরোজা দিয়েই হয়তো চ্যাপেলের দিকে যাওয়া যায়। দরোজাটির ওপর এখন আমার সার্বক্ষণিক নজরদারি চলছে। হঠাৎ দেখলাম সেটা খুলে গেল আর সৈনিকের হ্যাট পরা সেই সোনালি চুলের রমণীটি দরোজার ফ্রেম জুড়ে দাঁড়ালো। তার পেছন পেছন আসছেন বাদামি চুলের কালো শাল পরা আরেক রমণী। তাদের পেছনে ধূসর রঙের স্ট্রাইপ স্যুট পরা পিতা ও পুত্র। তারা প্লাস্টারসদৃশ বৃদ্ধকে চলতে সাহায্য করছেন। বৃদ্ধটি আবার কথা বলছেন সেই মাথা-ন্যাড়া মঙ্গোলীয় চেহারার লোকটির সঙ্গে। দীর্ঘদেহী মানুষটিকে আবারও মাথা নিচু করতে হলো। তিনি এতটাই ঝুঁকে পড়ে কথা বলছেন যে তার কান যেন সঙ্গী মানুষটির ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর তো আর ফিসফিসানির চেয়ে খুব উঁচু হবে না। অন্যেরা, দেখছি, তাদেরকেই অনুসরণ করছেন। আমি খুঁজছিলাম স্তিওপ্পাকে, ওর কথা ভাবতেই আমার হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।

স্তিওপ্পার আবির্ভাব ঘটলো সবার শেষে। যদিও উপস্থিত মানুষের সংখ্যা কম নয়, প্রায় চল্লিশ জনের মতো, তবু তার দীর্ঘ দেহ এবং নেভি ব্লু ওভারকোট আমার চোখ এড়ালো না। এই অনুষ্ঠানে যারা এসেছেন তাদের অধিকাংশেরই বয়স হয়েছে, কিন্তু আমি কয়েকজন কম বয়সী তরুণী, এমনকি শিশুদেরও দেখলাম। সারি বেঁধে তারা রাস্তায় নেমে এসেছেন আর নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছেন।

দৃশ্যটা যেন কোনো একটা গ্রামের স্কুলের খেলার মাঠের মতো। বৃদ্ধ মানুষটি, যার মুখটা প্লাস্টার করা হয়েছে দেখতে এমন, একটা বেঞ্চের ওপর এসে বসলেন আর প্রত্যেকেই তার কাছে এসে কুশল বিনিময় করতে থাকলেন। এই লোকটা আসলে কে? পত্রিকায় যার নাম ছাপা হয়েছিল সেই “জর্জ শাখার” নয়তো? নাকি পেজ স্কুলের প্রাক্তন কোনো গ্রাজুয়েট? খুব সম্ভবত সবকিছু তছনছ হওয়ার আগে এই লোকটি এবং মারি দ্য রোজেন অল্প কিছুদিনের জন্য পিটার্সবার্গে অথবা কৃষ্ণসাগরের উপকূলে মহাসুখে একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন। মঙ্গোলীয় চোখের মোটাসোটা ন্যাড়া মাথার লোকটাকেও অনেকেই ঘিরে ধরেছেন। পিতা ও পুত্র, তাদের স্ট্রাইপ করা স্যুট পরে শুধুই চক্কর মারছেন। মনে হলো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা বুঝি নাচছেন, এক টেবিল থেকে যাচ্ছেন আরেক টেবিলে। এই দুজন তাদের নিজেদের মধ্যেই ডুবে আছেন। পিতা তো মাথা ঝাঁকিয়ে সমানে হেসেই চলেছেন। তার হাসি, আমার কাছে এই অনুষ্ঠানের মধ্যে একেবারেই বেমানান বলে মনে হলো।

স্তিওপ্পা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধূসর বর্ণের হ্যাট পরা রমণীর সঙ্গে শান্তভাবে কথা বলছেন। তার হাত পরম স্নেহ আর আভিজাত্যের ভঙ্গিতে রমণীর বাহু ও কাঁধের ওপর রাখা। স্তিওপ্পাকে নিশ্চিতভাবে একজন সুদর্শন পুরুষ বলা যায়। আমার মনে হলো তার বয়স বড়ো জোর সত্তর হবে। স্তিওপ্পার মুখমণ্ডল কিছুটা চওড়া, চুল কমে আসছে, কিন্তু সেই বাহারি নাক আর মাথার গড়ন আভিজাত্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে। স্তিওপ্পাকে দূর থেকে দেখে এমনটাই মনে হচ্ছে আমার।

এদিকে সময় গড়িয়ে চলেছে। প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেল তবু তারা কথা বলেই যাচ্ছেন। আমার ভয় হচ্ছে, অবশেষে তাদের কেউ হয়তো ফুটপাতে দাঁড়ানো আমাকে দেখে চিনে ফেলবেন। আর ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার? ওর কথা মনে পড়তেই লম্বা লম্বা পা ফেলে আমি শার্ল-মেরি-ভিদরে সড়কে ফিরে এলাম। ট্যাক্সির ইঞ্জিনটা তখনও চলছে আর ড্রাইভারটা চালকের আসনে বসে আছে। ডুবে আছে তার হলুদাভ সবুজ পত্রিকায়।

সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “হলো আপনার?”
“এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না,” বললাম আমি। “মনে হয় আমাদের আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। ”
“আপনার বন্ধু কি এখনও চার্চ থেকে বের হন নাই?”
“হ্যাঁ, তিনি বের হয়েছেন, কিন্তু তিনি এখন অন্যদের সঙ্গে আলাপে মশগুল। ”
“আপনি কি তাকে আপনার সঙ্গে আসতে বলতে পারেন না?”
“না, পারি না। ”
আতঙ্কগ্রস্ত ড্রাইভারটি এবার বড় বড় নীল চোখ দিয়ে আমাকে দেখলো।
আমি বললাম, “উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ”
“এই উদ্বেগ আমার জন্য নয়, আপনার জন্য। ... আপনি যেভাবে বলবেন আমি শুধু সেইভাবে চলবো ...। ”

কথা শেষ করে আবার আমি রাশান চার্চের ঠিক উল্টো দিকে এসে অবস্থান নিলাম।

(চলবে)

৭ম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।