ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তরুণ ভের্টরের শোক | ফরিদ আহমেদ

বিশেষ রচনা / শিল্প সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৪
তরুণ ভের্টরের শোক | ফরিদ আহমেদ

সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত দেশে দেশে অসংখ্য বই নিষিদ্ধ হয়েছে। হিসাব করলে এই সংখ্যাটা চার-পাঁচ হাজারের কম হবে না।

নিষিদ্ধের তালিকায় বহু বিখ্যাত বইও আছে। নিষিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীকালে সেই বই-ই সাহিত্যে নোবেল পেয়েছে, এমনও আছে।

বই যারা নিষিদ্ধ করে, তারা শুধু বই নিষিদ্ধ করেই থেমে থাকে নি। লক্ষ লক্ষ বই ধ্বংস করা হয়েছে, আগুনে পুড়িয়ে বহ্নোৎসব করা হয়েছে। লেখককে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছে, নাক-কান কেটে নেওয়া হয়েছে, কপালে তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছে, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়েছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। অপমান করা হয়েছে জনসম্মুখে, নির্বাসিত করা হয়েছে দেশ থেকে, কারারুদ্ধ করা হয়েছে লেখককে সেই বই লেখার অপরাধে। কখনো কখনো লেখককে হত্যাও করা হয়েছে অত্যন্ত বীভৎসভাবে।

শুধু বই পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয় নি তারা, বইয়ের লেখককেও আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে। মূলত ধর্মোন্মাদনা, গোঁড়ামি, ক্ষমতার ভিত নড়ে যাবার ভয় এবং অশ্লীলতার কারণেই বই নিষিদ্ধ হয়েছে দেশে দেশে, বিভিন্ন সমাজে, নানা সময়ে।

তবে, শুধু এসব কারণেই যে বই নিষিদ্ধ হয়েছে এমন নয়। অভিনব কারণেও কখনো কখনো বই নিষিদ্ধ হয়েছে। যেমন ধরুন, গ্যেটের রচিত "তরুণ ভের্টরের শোক" (The sorrow of young Werther) বইটা। এই বইটা অশ্লীলতার কারণে নিষিদ্ধ হয় নি, ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার কারণে নিষিদ্ধ হয় নি, এমনকি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে লেখার কারণেও নিষিদ্ধ হয় নি। এটি নিষিদ্ধ হয়েছিলো বিচিত্র এক কারণে।

'তরুণ ভের্টরের শোক' একটি নিরীহ গোছের উপন্যাস। উপন্যাস না বলে একে পত্রোপন্যাসই বলা যেতে পারে। শেষের সামান্য একটু অংশ বাদ দিলে, এই উপন্যাসটির পুরোটাই মূলত চিঠির আকারে লেখা।

প্রায় ছন্নছাড়া এক ভাবুক তরুণ ভের্টর। কবিমন তার। সারাদিন স্বপ্ন দেখে সে, স্বপ্ন রচনা করে আর বাস্তবের ঘায়ে মুষড়ে পড়ে। এরকম মানুষের যা হয় তারও তা-ই হলো। জীবনে এসে ভর করলো একরাশ ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতাকেই পুঁজি করে একদিন বড় শহর থেকে গা ঢাকা দিলো সে। চলে এলো নিরিবিলি এক মফস্বল শহরে। এখানকার এই শান্ত বিচিত্র সৌন্দর্যের মধ্যে এসে বিগত দিনের সব তাপ, জ্বালা ভুলতে পারবে, এটাই আশা তার। বাগানঘেরা সুন্দর একটা ঘরও পেয়ে গেছে সে। মনে হচ্ছে এখান থেকেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে সে গভীর নির্জনতার মধ্যে।

এই জায়গা থেকেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিলহেলমকে চিঠি লেখা শুরু করে সে।

এইখানেই ভের্টরের পুনর্জন্ম হয়। তার আর বই দরকার নেই, দরকার নেই কোনো বন্ধুর। দরকার নেই সভ্যতার কোনো প্রয়োজনীয় উপাদানও। প্রকৃতির অপরূপ রূপ আর সৌন্দর্যের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে সে। সামনেই ভালহাইম গ্রাম। গ্রামের মধ্যেই পান্থশালা। সেখানে চমৎকার গরম কফি মেলে। কফি হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকো। দু'চোখ মেলে দেখে নাও প্রকৃতির সৌন্দর্য, যতখানি পারো। মানা করার কেউ নেই, বিরক্ত করার কেউ নেই। ধোঁয়া ওঠা গরম কফির কাপে হালকা চুমু দিতে দিতে কাব্য পড়ো। এই সুখের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর কোনো জটিলতাই প্রবেশ করে নি এই শান্ত, নিস্তব্ধ পুকুরে।

প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখায় একদিন ছেদ পড়লো ভের্টরের। হঠাৎ করেই তার সাথে দেখা হলো শারলোটের। এক বলনাচের অনুষ্ঠানে। এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের মেয়ে সে। যৌবন যেনো উপচে পড়ছে সারা গা বেয়ে, অথচ কী মোহনীয়, কী শান্ত, কী স্নিগ্ধ তার রূপ। শারলোট, আলবার্ট নামের এক লোকের বাগদত্তা। এটা জেনেও প্রথম দর্শনেই শারলোটের প্রেমে পড়ে যায় ভের্টর। এই অনুষ্ঠানে আলবার্ট অনুপস্থিত ছিলো। সেই সুযোগটাই নিলো ভের্টর। কারো সতর্কবার্তাতেই কান দিলো না সে। শারলোট যে অন্যের বাগদত্তা, সেটা বলেও কেউ তাকে ফেরাতে পারলো না আগুনে ঝাঁপ দেবার রাস্তা থেকে।

হঠাৎ করে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় সেখানে। এমন দুর্যোগে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না কারোরই। রাতটা সেখানেই কাটাতে হলো সবাইকে। এই সুযোগে শারলোটের সাথে নিরিবিলি আলাপের অবকাশ পেয়ে গেলো ভের্টর। । আলাপের এক ফাঁকে শারলোটকে চুমু খাবার লোভও সামলাতে পারলো না সে। বৃষ্টিভেজা সকালে শারলোটকে বাড়ি পৌঁছে দিলো সে।

এর পর থেকে শারলোটের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় তার। আলবার্টের সাথেও পরিচয় হয়। শিক্ষিত, ধীর-স্থির, সৌম্য এবং ভদ্র এক তরুণ। শারলোটকে দেখলে তার সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগে, আঙুলে আঙুল ঠেকলে শিরায় শিরায় রক্তের দাপাদাপি শুরু হয়। তাকে না পেলে জীবনে বাঁচবে না, এই অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে তার।

সব জেনে বন্ধু ভিলহেলম বলে, 'বন্ধু, তোমার অবস্থাতো দেখছি খুবই শোচনীয়। হয় শারলোটকে সোজাসুজি দাবি করে বসো, নয় তো বাসনা ছাড়ো। এভাবে কাবাবের মাঝখানে হাড্ডি হয়ে বসে থেকো না। '

কাবাবের মাঝখানে হাড্ডি সে, এটা জানে ভের্টর। এই অবস্থার অবসানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আলবার্টকে সরিয়ে দেওয়াটাই হচ্ছে উচিত কাজ। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে যে, আলবার্টকে সে শত্রু ভাবতে পারে না। এর মানে এই না যে কামনা-বাসনাহীন বিরাট মহৎ কোনো মানুষ সে। আলবার্টকে ঈর্ষা করে সে, ঈর্ষা করে তার সৌভাগ্যকেও। কিন্তু তাকে ডিঙিয়ে শারলোটকে জোর করে নিজের করে পেতে খুব একটা মনের সায় পায় না সে। আর তাছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গেলে সে টিকবে কি না, সেটা নিয়েও সংশয় কাটে না তার। আলতু ফালতু লোক তো আর আলবার্ট নয়। অভিজাত বংশের চালু ছেলে সে।

এর থেকে বরং নিজেকে শারলোটের কাছ থেকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিলো সে। শারলোটের বাড়িতে যাওয়া আসা কমিয়ে দিলো। শারলোটকে এই জনমে বাস্তবে আর পাওয়া হবে না তার। পেলে, শুধু স্বপ্নেই পাওয়া সম্ভব, এর বাইরে নয়। এই মর্মভেদী বেদনা, এই হতাশা সম্বল করে সে থাকবে কী করে, বাঁচবে কী করে? ক্রমশ বিমর্ষ, বিষণ্ণ হয়ে পড়তে লাগলো ভের্টর। দুঃসহ যাতনা সহ্য করতে না পেরে ভের্টর স্থির করলো যে, সে ভালহাইম ছেড়ে চলে যাবে চিরতরে। বন্ধুকে লিখলো তার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করতে।

চাকরি জোগাড় হলো। নিজের সঙ্গে অজস্র বোঝাপড়া করে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো সে। যাবার আগে শেষবারের মতো আলবার্ট আর শারলোটের সাথে ঘণ্টা দু'য়েক সময় কাটালো সে। কিন্তু ঘূণাক্ষরেও তাদের জানতে দিলো যে, সে চলে যাচ্ছে এখান থেকে। শারলোটের বিদায় সম্ভাষণ সইতে পারবে না সে।

নতুন জায়গায়, নতুন কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো ভের্টর। লক্ষ্য শারলোটকে ভুলে থাকা। কিন্তু, হাজারো চেষ্টাতেও কোনো কাজ হলো না। যতোই সে ভুলে থাকার চেষ্টা করে, ততোই শারলোট আরো শক্তভাবে এসে গেড়ে বসে তার হৃদয় রাজ্যে। দিন যায়, কাজও আর ভালো লাগে না তার। যার অধীনে কাজ করে সে, তাকেও অসহ্য লাগে। দুঃসহ এক অবস্থা। ভের্টরের মনে হয় যে ভিলহেলমই ষড়যন্ত্র করে তাকে এনে ফেলেছে এখানে। যেনো সে শারলোটের সাথে মিলতে না পারে। এরকমই এক বিভ্রান্ত অবস্থায় শারলোটকে চিঠি লেখে সে। উত্তর আসে আলবার্টের কাছ থেকে। আলবার্ট জানায়, কিছুদিন আগে শারলোটের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার।

এই ভয়াবহ দুঃসংবাদে আর কোনো কিছুই ভালো লাগে না ভের্টরের। তার জীবনের সব আলো কেউ যেনো এক ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে। কাজে ইস্তফা দিয়ে দেয় সে। নিষ্ক্রিয় বিষণ্ণ ভাববিহ্বলতার মধ্য দিয়ে সময় কাটে তার। কী করবে, কোথায় গেলে শান্তি পাবে, এর কোনো কিছু বুঝতে পারে না সে। বিভ্রান্তির গোলকধাঁধার মধ্যে আটকে পড়ে সে। এখান থেকে উদ্ধারের কোনো উপায় জানা নেই তার।

দুর্বিষহ এবং অতীষ্ঠ হয়ে উঠলো ভের্টরের জীবন। চারিদিকে শুধু হাহাকার এবং শূন্যতা। অন্ধকার রাজ্যের গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে যে। কোথাও কোনো আলো নেই। কোথাও কোনো আশ্রায় নেই, নেই সামান্যতম মমতা। শেষমেষ ভালহাইমেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় সে। শারলোট যেখানে আছে, অন্তত সেখানে তো সে থাকতে পারবে। এটুকু অন্তত জানবে যে, শারলোট আশেপাশেই কোথাও আছে।

এই সান্ত্বনা মরীচিকা। তারপরেও এই মরীচিকার টানেই ফিরে আসে সে ভালহাইমে। একদিন দেখা-ও হয়ে যায় তার সাথে আলবার্ট এবং শারলোটের। আনন্দোচ্ছ্বল দুই তরুণ-তরুণী। সদ্য বিবাহের সুখের উচ্ছ্বাস লেগে রয়েছে তাদের হাসিতে, কথাবার্তায়, কাজে, কর্মে, চলাফেরায়। তাদের দেখে ভের্টরের অন্তরাত্মা হাহাকার করে উঠে। ওরা এতো আনন্দে কেনো আছে? কেনো এতো সুখ ওদের জীবনে? আরেকটু অন্যরকম কি হতে পারতো না? সুখের বদলে আলবার্টের চেহারায় কি থাকতে পারতো না বেদনার ছায়া? এই তীব্র হতাশায় ভিলহেলমকে চিঠি লেখে ভের্টর। সেই চিঠি তার মানসিক বিভ্রান্তির এক জ্বলন্ত দলিল। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে সামঞ্জস্যহীনতা, অসংবদ্ধ কথপোকথন, আর অপরিমিত প্রলাপবচন।

আলবার্ট এবং শারলোট কিন্তু খুশি মনেই গ্রহণ করেছিলো ভের্টরকে। শারলোটের জন্য তার প্রেম, হতাশা, বেদনা, কিছুই জানতে বাকি নেই তাদের দুজনের। এজন্য যথেষ্ট করুণা এবং সহানুভূতি রয়েছে ভের্টরের প্রতি তাদের দুজনেরই। কিন্তু এর বাইরে কিছুই যে করার নেই তাদের। ভের্টরের দুঃখের অবসান ঘটানোর সামর্থ্য তাদের নেই। এর মধ্যে আবার আরেক ঘটনা ঘটলো। ভের্টর একজন অসুস্থ লোকের সংস্পর্শে এলো। এই লোকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে। ভের্টর জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা চালালো তাকে রক্ষা করার। কিন্তু ব্যর্থ হলো। এই ব্যর্থতা তাকে মানসিকভাবে একেবারেই ভেঙে দিলো।

ভের্টরের এই বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে আলবার্ট এবং শারলোটও শান্তিতে নেই। প্রবল অন্তর্জ্বালায় জ্বলে মরছে দুজনেই। ভের্টরের জন্য সহানুভূতির কমতি নেই তাদের কারোরই। কিন্তু, ভের্টরের শোক এমনই প্রবল যে, তাকে শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনাটা দুঃসাধ্যই বটে। আলবার্টের সাথে পরামর্শে বসে শারলোট। সেই পরামর্শ অনুযায়ী একদিন শারলোট ভের্টককে জানিয়ে দেয় যে, তাদের মধ্যে আর দেখা সাক্ষাৎ না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। ভের্টর যেনো তাদের বাড়িতে আসা কমিয়ে দেয়।
এমনিতেই বেঁচে থাকার কোনো অর্থ ছিলো না ভের্টরের। কফিনের শেষ পেরেক হয়ে এলো শারলোটের এই সিদ্ধান্ত। এই অভিশপ্ত, এই ব্যধিগ্রস্ত, এই অপ্রয়োজনীয় জীবন রাখার কোনো মানে নেই। এর অবসান হওয়াটাই সবার জন্য মঙ্গল। বন্ধু ভিলহেলমকে জানালো বেঁচে থাকার আর কোন আকর্ষণ তার নেই। জীবনের এই দুঃসহ বেদনার অবসান সে নিজের হাতেই করতে যাচ্ছে। তবে, এই আত্মহত্যা করা মানে কাপুরুষতা নয়। এ হচ্ছে অসহ্য দুঃখ সইতে না পারার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আত্মহত্যার স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে সে লিখেছেঃ

"মানুষের ক্ষমতা পরিমিত। পরিমিত সুখ অথবা পরিমিত দুঃখ সে সহ্য করতে পারে - তার বেশি হলে হয় তার অসহ্য। নৈতিক সবলতা অথবা দুর্বলতার কথা নয়, কথা হচ্ছে দুঃখ কতটা সওয়া যায়; আমি মনে করি কেউ আত্মহত্যা করল বলে তাকে কাপুরুষ বলা তেমনি অদ্ভুত যেমন অদ্ভুত কেউ জ্বলে মরলে তাকে কাপুরুষ বলা। "
আত্মহত্যার জন্যও অবশ্য তাকে নির্ভর করতে হলো আলবার্টের উপর। আলবার্টের একটা পিস্তল ছিলো। ওটা আনার জন্য চাকর পাঠালো সে। এক অপ্রত্যাশিত যাত্রায় বের হচ্ছে সে, পিস্তলটা সে কারণেই প্রয়োজন, এই হচ্ছে অযুহাত। আলবার্টের পিস্তল হাতে আসার পরেই সেই রাতে নিজেকে গুলি করে ভের্টর। সাথে সাথে মারা যায় না অবশ্য। পরদিন দুপুর বেলা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় সে। এই পৃথিবী হারায় এক শোকগ্রস্ত, বিষণ্ণ এবং জীবন সম্পর্কে হতাশ এক তরুণকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এমন নিরীহ একটি করুণ প্রেমের উপন্যাস নিষিদ্ধ হলো কোন কারণে?

অনেক সমালোচকের মতে, ইংল্যান্ডে ঊনিশ শতকে যে রোম্যান্টিক মুভমেন্ট চরমে উঠেছিলো, তার সূত্রপাত হয়েছিলো গ্যেটের এই তরুণ ভের্টরের শোক থেকে। এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিলো চার্লস ডিকেন্স প্রমুখ লেখকদের লেখায়। নেপোলিয়ানের অসম্ভব প্রিয় ছিলো এই বই।

এই বইটা প্রকাশিত হয় ১৭৭৪ সালে। প্রকাশিত হবার পরেই দেশে বিদেশে বিস্ময়কর আলোড়ন তোলে তা। চীনদেশে চিনামাটির বাসনে আঁকা হয় শারলোট এবং ভের্টরের মূর্তি। তরুণদের মধ্যে ভের্টরের কেশবিন্যাস নকলেরও তীব্র প্রবণতা দেখা দেয়। ভের্টরের হলুদ প্যান্ট এবং নীল রঙের জ্যাকেটও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে, এগুলো কোনো বড় সমস্যা ছিলো না। যে কোনো মহৎ সাহিত্যই সমসাময়িক তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করে, এতে বিশেষ কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু, তরুণ ভের্টরের শোকের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রভাব বড় ধরনের একটা সমস্যা তৈরি করলো। প্রেমে ব্যর্থ হওয়া যুবকেরা ভের্টরের মতো আত্মহত্যা করা শুরু করলো। অনেকটা আমাদের দেশে দেবদাসের মতো। দেবদাস পরবর্তী যুগে প্রেমে ব্যর্থ হবার পরে প্রেমিকের মদ খেয়ে বিরহ-যন্ত্রণা ভোলার প্রচেষ্টা ছিলো একেবারে স্বাভাবিক একটা প্রবণতা। ভের্টরের কারণে প্রথমে আত্মহত্যা করলো একজন বা দুইজন। শুরুতে কেউ খেয়াল করে নি এটা, গুরুত্বও দেয় নি সেরকম করে। এই এক, দুই থেকে পরে সংক্রামক আকারে ছড়িয়ে পড়লো তা। একটি বা দুটি আর নয়, আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক। তরুণদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে চলছে আত্মহত্যার হিড়িক। প্রেমে সামান্য ব্যর্থতা তো করো আত্মহত্যা ভের্টরের মতো। আর এই আত্মহত্যা শুধু সীমাবদ্ধ ছিলো না জার্মানিতেই। ইউরোপের দেশে দেশে, এমনকি প্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়লো তা।

পরিস্থিতি শেষে এমন দাঁড়ালো যে, প্রকাশ হবার মাত্র দুই-তিন বছরের মাথাতেই জার্মানির অনেক জায়গায়, মিলান শহরে এবং ডেনমার্কে কড়া আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হলো 'তরুণ ভের্টরের শোক' বইটা।

কপিক্যাট সুইসাইডকে এখন ভের্টর এফেক্ট বলা হয়। আমাদের বাংলাদেশেও এক সময় এই ভের্টর এফেক্ট দেখা দিয়েছিলো। নব্বইয়ের দশকে সুদর্শন নায়ক সালমান খানের আত্মহত্যার পরে (পরে জানা যায় যে, আত্মহত্যা করেন নি তিনি, বরং হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয়েছিলেন। ) অসংখ্য স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিলো।



বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।