ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৫) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৫) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। - অনুবাদক
___________________________________

৪র্থ কিস্তির লিংক

৩.
সময় পৌনে ছটা। আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারকে রু শার্ল-মারি-ভিদরেতে আমার জন্য অপেক্ষা করতে বললাম। এরপর যেখানে রাশান চার্চটা অবস্থিত, সেই রু ক্লোদ লর‌্যাঁতে পৌঁছানো অব্দি হাঁটতে থাকলাম।

একটা বিচ্ছিন্ন, একতলা ভবন, জানালায় জাল দিয়ে তৈরি পর্দা টাঙানো। ডান দিকে একটা প্রশস্ত রাস্তা। আমি বাড়িটার মুখোমুখি ফুটপাতে গিয়ে অবস্থান নিলাম।

প্রথমে আমি দেখলাম দুজন রমণী রাস্তার দিকে মুখ করা একটা দরোজার কাছে এসে থামলেন। একজনের চুল ছোট করে কাটা, চুলের রঙটা বাদামি। গায়ে কালো উলের শাল। আরেক জনের চুল সোনালি, চমৎকার মেকআপ করা। মাথায় ধূসর রঙের হ্যাট, অনেকটা সৈনিকদের মাথার টুপির মতো। শুনলাম তারা ফরাসি ভাষায় কথা বলছেন।

একজন বেশ শক্তপোক্ত বয়স্ক পুরুষ, পুরাপুরি ন্যাড়া, তার মঙ্গোলীয় চেরা চোখের চাহনির তলায় ভারী ব্যাগ, একটা ট্যাক্সি থেকে টেনেহিঁচড়ে নিজেকে নামালেন। ওরা সবাই পথটা ধরে চলতে থাকলেন।

বাঁ দিক থেকে পাঁচজনের একটা দল, রু বোয়ালো থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের সামনে দুজন বয়স্ক মহিলা হাত ধরে একজন বৃদ্ধকে চলতে সাহায্য করছেন। বৃদ্ধটির সব চুল শাদা, কী যে ফুরফুরে আর পলকা, মনে হচ্ছে তার শরীরটা শুকনো প্লাস্টার দিয়ে তৈরি। পেছনেই দুজন পুরুষ, যারা দেখতে অনেকটা একইরকম, কোনো সন্দেহ নেই, এরা বাবা ও ছেলে। দুজনেই পরেছে চমৎকার কাটিংয়ের ধূসর রঙের স্ট্রাইপ দেয়া স্যুট। বাবা তার চেহারাসুরত নিয়ে বেশ সতর্ক, ছেলের সোনালি চুল ঢেউখেলানো। ঠিক এইসময় পাঁচ জনের ওই দলটার কাছে এসে আরও একজন সতর্ক, স্থির বৃদ্ধ—যার শরীর মোটা ওয়াটারপ্রুফ লডেন কেপ কোট দিয়ে ঢাকা—গাড়ির ব্রেক কষে দাঁড়ালেন এবং গাড়ি থেকে নামলেন। তার গায়ে সৈনিকদের পোশাক। এই লোকটাই কি স্তিওপ্পা?
তারা সবাই একটা সাইড ডোর দিয়ে পথের মাথায় অবস্থিত চার্চে ঢুকলেন। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল তাদের ফলো করি, কিন্তু আমার উপস্থিতি তাদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করতে পারে ভেবে বিরত থাকলাম। আমি কি ভালো করছি, না মন্দ, এই দ্বিধাটা যতই বাড়ছে ততই ভাবছি আমি হয়তো স্তিওপ্পাকে চিনতে পারবো না।

ডানের একটা জায়গায়, কিছুটা দূরে, সজোরে একটা গাড়ি এসে থামলো। দুজন পুরুষ গাড়ি থেকে নামলেন, এরপর নামলেন একজন মহিলা। পুরুষ দুজনের একজন দীর্ঘকায় এবং তার পরনে নেভি ব্লু ওভারকোট। আমি রাস্তাটা পার হলাম এবং তাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।

তারা ক্রমশ কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছেন। অন্য দুজনের সঙ্গে হাঁটা শুরুর আগে, আমার মনে হলো, ওই লম্বা লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছে। বর্ণালী জানালার কাচের পেছনে, যে জানালা দিয়ে ভেতরে কী ঘটছে দেখা যায়, মোমবাতিগুলো জ্বলছিল। দরোজা দিয়ে ঢোকার সময় তাকে অনেকখানি ঝুঁকে পড়ে ঢুকতে হলো। দরোজাটি তার জন্যে অনেকটাই নিচু, আমি জানি এই হচ্ছে স্তিওপ্পা।

ট্যাক্সির ইঞ্জিনটা তখনও সচল, কিন্তু চালকের আসনে কেউ নেই। একটা দরোজা সামান্য খোলা, যে কোনো সময় হয়তো ড্রাইভার ফিরে আসবে। কোথায় এখন থাকতে পারে এই ড্রাইভার ব্যাটা? আমি নিজেকে একনজর দেখলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম সমস্ত জায়গাটা হেঁটে ওকে খুঁজে দেখবো। কাছেই, রু শারদোঁ-লাগাশের একটা কাফেতে, ড্রাইভারকে পেয়ে গেলাম। সে একটা টেবিলে বসে আছে, সামনেই বিয়ারের গ্লাস।

“আপনি কী আরও সময় নেবেন?” ড্রাইভারটা আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
“ওহ্ ... আরও বিশ মিনিট। ”
চমৎকার সোনালি চুল, গাত্রবর্ণ ধূসর, ভারী চিবুক, বিস্ফারিত চোখ। আমার মনে পড়ে না আমি কখনও এতটা মাংসল কানের লতিঅলা কোনো মানুষ দেখেছি।
“ট্যাক্সির মিটারটা যদি চালু রাখি তাহলে কি সমস্যা হবে?”
“না, কোনো সমস্যা হবে না,” আমি বললাম।
সে শান্তভাবে হাসলো।
“তুমি কি ভয় পাওনা যে তোমার ট্যাক্সিটা চুরি হতে পারে?”
কাঁধটা ঝাঁকালো সে।
“ওহ্ ... তাহলে তুমি জানো যে হতে পারে ...”
সে একটা পেতি স্যান্ডুইচ অর্ডার দিল এবং ধীরে ধীরে খেতে থাকলো, বিষণ্ন চোখে দেখতে থাকলো আমাকে।
“আপনি আসলে কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন?”
“এমন একজন মানুষের জন্য, যে কিনা অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া অব্দি রাশান চার্চ থেকে বেরুবে না। ”
“আপনি কি রুশ?”
“না। ”
“ব্যাপারটা সিলি মনে হচ্ছে... যখন তিনি যাচ্ছিলেন তখনই তো আপনি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন... তাহলে আপনার ক্ষতিটা কম হতো...”
“যাই হোক, কিছু মনে করবেন না। ”
সে আরেক গ্লাস বিয়ার অর্ডার দিল।
“তুমি কি আমাকে কোনো পত্রিকার দোকানে নিয়ে যেতে পারো?” তিনি বললেন।
বাকি টাকাটা দেওয়ার জন্য সে পকেট হাতড়াতে থাকলো, কিন্তু আমি তাকে থামিয়ে দিলাম।
“উদ্বিগ্ন হবেন না ...। ”
“ধন্যবাদ। আমাকে ল্য এবিযোঁতে নিয়ে চল। আবারও ধন্যবাদ...”

একটা পত্রিকার স্ট্যান্ড খুঁজে পাওয়ার আগে আমাকে কিছুক্ষণ দ্য ভার্সাই এভিন্যুতে ইতস্তত ঘুরতে হলো। ল্য এবিযোঁ পত্রিকাটি একধরনের ঘন সবুজ কাগজে ছাপা হয়।

তিনি পড়ছেন, চোখের ভ্রু আঁচড়াচ্ছেন এবং তর্জনীতে জিভের থুতু লাগিয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছেন। আর আমি এই মোটাসোটা সোনালি চুলবিশিষ্ট নীল চোখের মানুষটিকে, যার গাত্রবর্ণ শাদা, সবুজ পত্রিকা পড়ছেন, নিবিড়ভাবে দেখতে থাকলাম।

তার পড়ায় বিঘ্ন ঘটে সেরকম কিছু করার সাহস আমার হলো না। অবশেষে তিনি তার ছোট্ট ঘড়িটার সঙ্গেই শলাপরামর্শ সারলেন।
“আমাদের এখন যেতেই হবে। ”

(চলবে)

৬ষ্ঠ কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।