ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রতিদিনের ধারাবাহিক

টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২৫) || অনুবাদ: আলীম আজিজ

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২৫) || অনুবাদ: আলীম আজিজ অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।

এছাড়াও তিনি ছিলেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য জগতের বেশ প্রভাবশালী লেখক। তাঁর মৃত্যুর পর স্পেনের এল পায়েস—তাঁকে উল্লেখ করেন ‘আর্জেন্টিনাইন সাহিত্যের শেষ ধ্রুপদী লেখক’ বলে।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
___________________________________

২৪তম কিস্তির লিংক

এক মাসের বেশিই হবে, আমাদের প্রায় প্রতিদিনই নিয়মিত দেখা হল। আমি ওই সময়ের বিস্ময়কর সুখস্মৃতি আর ক্রান্তিকালের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে চাই না। ওই সময়ে এমন অনেক অসুখি মুহূর্তও আমি পার করেছি, যা স্মৃতিচারণা হিসেবেও কিছুতেই পুর্নযাপন করা যায় না।

মারিয়া নিয়মিত আমার স্টুডিওতে আসতে শুরু করল এক সময়। এই সময়েও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মতো ঘটনার মঞ্চায়ন, নানা মত ভিন্নতার ঘটনা বেশ কবারই ঘটল, তারপরও আমি এই বিশ্বাসে বুঁদ হয়ে থাকলাম ও আমাকে প্রকৃতই ভালোবাসে, বিশেষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদিও ওর ভালোবাসাকে মনে হয় যেন মা আর বোনের ভালোবাসা। একটা সময় আমি এই বিশ্বাসেও পৌঁছুলাম যে শরীরী মিলনের মধ্য দিয়েই ও যে আমাকে সত্যিই ভালোবাসে তা আরও ভালোভাবে প্রমাণ হবে।

এই মুহূর্তে আমি শুধু এটাই বলব আমার অন্য আরও অনেক সহজ-সরল অলীক কল্পনার মতোই এটাও কল্পনাই ছিল, এবং এখন বুঝি আমার এই সারল্যের কারণেই, মারিয়া আমার আড়ালে হেসেছে। আর শারীরিক সর্ম্পক আমার জন্য স্বস্তি তো দূরে থাকুক, বরং এর কারণে আমি আরও নিদারুণ যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়েছি, আর এর সূত্র ধরেই হাজির হয়েছে মনের মধ্যে নিত্য হানা দেওয়া নতুন নতুন সন্দেহের যন্ত্রণা, মনোমালিন্যের বেদনাদায়ক ঘটনা, আর মারিয়ার সঙ্গে নানা নিষ্ঠুর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আমার স্টুডিওর সময়গুলোর কথা আমি কখনোই ভুলব না। তখনকার পুরো সময়টা আমার আবেগ—মারিয়ার উল্লিখিত পরস্পরবিরোধী আর অব্যাখ্যায়—কখনও দোল খেয়ে গিয়ে ঝুঁকেছে শুদ্ধ ভালোবাসার দিকে আবার কখনও ঝুঁকেছে বুনো ঘৃণার দিকে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমার কাছে ওর যে নিঃশর্ত সর্মপণ, তা একসময় বদলে গিয়ে আমার মনে আচমকা এই বোধের জন্ম দিল যে, এসবের পুরোটাই ওর ভান। কিছু সময়ের জন্য ওকে আমার মনে হয় নিষ্পাপ এক তরুণী, কিন্তু পরমুহূর্তেই আচমকা ও আমার কাছে পরিণত হয়ে ওঠে দুশ্চরিত্রা এক খলনারীতে, তারপর দীর্ঘ সময় আমার মন জুড়ে সন্দেহের নানারকম দোলাচাল চলতে থাকে: কোথায়? কিভাবে? কতজন? কখন?

ওইসব ক্ষেত্রে মনের মধ্যে এই চিন্তা কিছুতেই চাপা দিয়ে রাখতে পারি না যে মারিয়া আসলে আমার সঙ্গে অতি সূক্ষ্ম আর নিষ্ঠুর এক খেলায় মেতেছে, আর আমি হলাম ওর হাতের সেই বোকাসোকা বালক যাকে অনায়াসেই ছেলেভুলানো গল্প বলে রাতের খাবার খাওয়ানো কিংবা ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায়। এসবের, এক সময়ে দেখা গেল আমার মধ্যে প্রবল নীতিবোধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, কাপড়চোপড় পরেই, ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছি খোলা বাতাসে, নতুন করে আবার নাড়াচাড়া করে দেখছি মনের যত সন্দেহ আর নানা উপলব্ধিগুলো। আরেক দিন দেখা গেল আমার প্রতিক্রিয়া ভীষণরকম আক্রমণাত্মক আর নৃশংস। আমি মারিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, লোহার মতো বজ্রআঁটুনিতে ওর হাত খাঁমচে ধরে, মুচড়ে পেছনে নিয়ে আসছি, তারপর জোর করে ওর কাছ থেকে এই নিশ্চয়তা আদায়ের চেষ্টা করছি যে, ওর ভালোবাসা খাদহীন—সত্যিকারের ভালোবাসা।

কিন্তু আসলে ঠিক এসব কথা বলা আমার উদ্দেশ্য না। আমাকে একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে ‘সত্যিকারের ভালোবাসা’ বলতে আসলে কী বোঝায় আমি নিজেও তা জানি না। কিন্তু কৌতুকের বিষয় হলো মারিয়াকে প্রশ্ন করার সময় এই কথাটা আমিই বারবার জিজ্ঞেস করে গেছি, অথচ আজকের আগে আর কখনোই আমি সতর্কভাবে এটা নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তাই করিনি। আমি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছি? এমন এক ধরনের কোনো ভালোবাসা—যার সঙ্গে শরীরী প্রেমেরও যোগসূত্র থাকবে? হতে পারে আমাদের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার ব্যাপারে আমার যে মরিয়া চেষ্টা ছিল তারমধ্যে আমি শারীরিক প্রেমকেও খুঁজে পেতে চেয়েছি। আর আমি এ ব্যাপারেও নিশ্চিত যে কিছু কিছু সময়ে আমরা সত্যিই পরস্পরের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পেরেছিলাম, কিন্তু সেটা এতটাই সূক্ষ্ম ছিল, এতটাই স্বল্পস্থায়ী, এতটাই ক্ষীণ, যে এরপরে ভালোবাসা পুনর্নির্মাণের স্বপ্ন থেকে উৎসারিত অনিরূপিত এক অতৃপ্তি আমাকে অন্য আর সব সময়ের চেয়ে, আরও নিদারুণভাবে একা করে দিয়েছে।

আচমকা মনে এটাও জানান দিয়ে গেল যে, গোধূলির সময়ে আমাদের পার্কে বসে থাকা অথবা বিদেশী মালবাহী জাহাজের বন্দর ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকনের সময়, আমাদের সত্যিই কিছু দুর্লভ সময় কেটেছে। আর এটা তো জানাই, এ ধরনের সময়কে ঘিরে থাকা সব সময়কার নিঃসঙ্গতা দুজন থাকলেই কেবল খানিকটা কম অনুভূত হয়—আর এ তো সৌন্দর্যকে পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পারারই নিশ্চিত ফল। এ সময়ে আমরা করার মধ্যে এই তো করি: মুখোমুখি বসে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর মনে মনে ধরে নেই যে আমরা শুধু পরস্পরকেই ভাবছি, অনুভব করছি, পরস্পরে মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছি।

(চলবে)

২৬তম কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।