ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নোবেলজয়ী লেখকের উপন্যাস

নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৩) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান

অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪
নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (৩) || অনুবাদ : মাসুদুজ্জামান অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

___________________________________

 ‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য।

‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। - অনুবাদক
___________________________________

২য় কিস্তির লিংক

অর্তের আমাকে বারান্দায় নিয়ে এলো। বারান্দার ওপর থেকে একটা পুকুর দেখা যায়। বাঁ দিকে কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু ছোট্ট একটা সেতু। পুকুরের অন্য দিকে চীনা ঘরানার আরেকটা বাংলো। ফরাসি জানালাগুলো আলোয় ঝলমল করছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, জানালাগুলোর পেছনেই দম্পতিরা নড়াচড়া করছেন। তারা জোড়ায় জোড়ায় নাচছে। গানের ঝঙ্কার আমাদের কানে এসে পৌঁছুচ্ছে।

“খুব বেশি লোক হয়নি,” বললেন তিনি। “আমার মনে হচ্ছে এই বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষ অব্দি লাগামহীন পানাহারের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ”
তিনি তার কাঁধটা ঝাঁকালেন।
“গ্রীষ্মের সময় আপনার এখানে আসা উচিত। আমরা তখন রেস্তোরাঁর বারান্দায় বসে খেতে পারি। আপনার খুব ভালো লাগবে। ”
আমরা রেস্তোরাঁর পেছন দিকটায় এলাম এবং অর্তের ফরাসি জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন।
“আমি সামান্য কিছু সহজপাচ্য খাবার রান্না করেছি। ”
তিনি আমাদের বসার জন্য ইশারা করলেন। ওরা দুজন আমার মুখোমুখি হয়ে পাশাপাশি বসলো।
“কী মদ খাবেন আপনি?” অর্তের আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনার যা পছন্দ। ”
“শাতো পেত্রু নিই?”
সোনাশিৎজে বললেন, “দারুণ পছন্দ তো আপনার, জঁ। ”
শাদা জ্যাকেট পরা এক তরুণ আমাদের ওয়েটার। দেয়ালের বাঁকানো ল্যাম্পের আলো সরাসরি আমার ওপর এসে পড়ছে আর আমি সেই আলোতে রীতিমতো ঝলমল করছি। অন্যেরা বসে আছে ছায়ায়। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই তারা আমাকে এমন একটা জায়গায় এনে বসিয়েছে যাতে আমাকে ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করতে পারে।

“ঠিক আছে, জঁ। ”
অর্তের গ্যালেনটাইন খাওয়া শুরু করলো আর মাঝে মাঝে খুব তীক্ষ্ণভাবে আমাকে দেখতে থাকলো। সোনাশিৎজের মতো তার গায়ের রঙ ঘন কালো, আবার তারই মতো চুলে কলপ লাগানো। চিবুকে ছোপ ছোপ দাগ আর থলথলে। পানাহারের ফলে ঠোঁট দুটো পাতলা হয়ে গেছে।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ ...,” সে বিড়বিড় করতে থাকলো।
আলোর কারণে আমার চোখ পিট পিট করছে। তিনি আমাদের গ্লাসে খানিকটা মদ ঢেলে দিলেন।
“হ্যাঁ … আমার বিশ্বাস আমি এই ভদ্রলোককে আগে দেখেছি …
“সত্যিই এটা একটা ধাঁধা,” সোনাশিৎজে বললেন। “তিনি কোনো ক্লু-ই আমাদের দিতে পারছেন না ...”
মনে হলো, হঠাৎ একটা কিছুর ভাবনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন।
“সম্ভবত আপনি তা পারবেন না। আমরা অবশ্য এ নিয়ে আর তো কোনো কথাও বলিনি? আপনি কি ছদ্মবেশে থাকাটাই বেশি পছন্দ করছেন?”
আমি হেসে বললাম, “না, একেবারেই না। ”
তরুণ ওয়েটার আমাদের জন্য একটা মিষ্টি রুটি দিয়ে গেল।
“আপনি এখন কী কাজ করছেন?” অর্তের জিজ্ঞেস করলেন।
“আট বছর আমি একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করেছি, সি. এম. হুতি এজেন্সি। ”
ওরা দুজনেই আমার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকালেন।
“কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার পূর্বজীবনের সঙ্গে এই কাজের কোনো সম্পর্ক নাই। সুতরাং উদ্বিগ্ন হবেন না। ”
“স্ট্রেঞ্জ,” আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অর্তের ঘোষণা করলেন, “আরে মিয়া, আপনার বয়স তো বোঝাই যায় না। ”
“কারণটা হলো এই গোঁফ, সন্দেহ কী। ”
“গোঁফ না থাকলে,” সোনাশিৎজে বললেন, “আমরা আপনার বয়স ঠিক ঠিক আন্দাজ করতে পারতাম। ”

এরপর তিনি তার হাতটা বের করলেন। হাতের খোলা তালু দিয়ে আমার নাকের তলার গোঁফটা লুকিয়ে ফেলে মডেলের সামনে যেমন পোট্রেটশিল্পীরা করেন, সেইভাবে চোখ-মুখ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন।

অর্তের বললেন, “যতই আমি এই ভদ্রলোককে দেখছি ততই আমার মনে হচ্ছে সেই ভীড়ের মধ্যে ইনিও ছিলেন...”
“কিন্তু কখন?” জিজ্ঞেস করলেন সোনাশিৎজে।
“ওহ্ … সে অনেক আগের কথা … আমরা যখন নাইট ক্লাবগুলোতে কাজ করছিলাম তার পরের কোনো একটা সময় হবে হয়তো, পল …”
“তোমার কি মনে হয় আমরা যখন তানাগ্রাতে কাজ করছিলাম, এটা সেই সময়ের ঘটনা?”
অর্তের আরও গভীর তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখতে থাকলেন।
তিনি বললেন, “মাফ করবেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য একটু দাঁড়াবেন?”
তিনি যা বললেন আমি তাই করলাম। তিনি কয়েকবার আপাদমস্তক আমাকে দেখলেন।
“হ্যাঁ, বিশেষ একজন কাস্টমারের কথা আপনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন। আপনার উচ্চতা … দাঁড়ান দাঁড়ান … একটু দাঁড়ান। ”
তিনি তার হাত ওঠালেন এবং নিথর হয়ে বসে পড়লেন। মনে হলো ভাসমান কিছু স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছেন।
“জাস্ট ওয়ান মোমেন্ট … শুধু এক মুহূর্ত … আমি পেয়ে গেছি, পল …”
তিনি বিজয়ীর হাসি হাসলেন।
“আপনি এখন বসতে পারেন ...”

বিজয়ের আনন্দে তিনি ভীষণ উৎফুল্ল। কী বলছেন আর তার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, নিশ্চিত তিনি। সাড়ম্বরে তিনি সোনাসিৎজে আর আমার গ্লাসে কিছু মদ ঢেলে দিলেন।
“আপনি সবসময় একটা লোকের সঙ্গে থাকতেন, লোকটা আপনার মতোই লম্বা... হয়তো আপনার চাইতেও বেশি লম্বা হতে পারে... আপনি কি মনে করতে পারছেন, পল?’
সোনাশিৎজে জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা কোন সময়ের কথা বলছি, বলেন তো?”
“আরে, অবশ্যই তানাগ্রা সময়ের কথা বলছি ...”
“একটা লোক, ওর মতো লম্বা?” সোনাশিৎজে পুনরুক্তি করলেন, “তানাগ্রায়? ...”
“আপনি দেখেন নাই?”
অর্তের সম্মতিসূচক কাঁধ ঝাঁকালেন।
এবার সোনশিৎজের পালা, তিনি বিজয়ীর হাসি হাসলেন। মাথা হেলিয়ে হাঁ-সূচক ভঙ্গি করলেন।
“আমি তো দেখতে পাচ্ছি ...’
“আচ্ছা, কী দেখছেন?”
“স্তিওপ্পা। ”
“হ্যাঁ, সেই তো, অবশ্যই স্তিওপ্পা ...”
সোনাশিৎজে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন।
“আপনি কি স্তিওপ্পাকে চিনতেন?”
“হয়তো,” আমি সতর্কতার সঙ্গে বললাম।
“অবশ্যই আপনি চিনতেন।
“হয়তো,” আমি সতর্কতার সঙ্গে বললাম।
অর্তের বললেন, “অবশ্যই আপনি চিনতেন …। ” “আপনি প্রায়ই স্তিওপ্পার সঙ্গে থাকতেন … এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ...”
“স্তিওপ্পা...”
সোনাশিৎজে যেভাবে উচ্চারণ করলেন তাতে মনে হলো অবধারিতভাবেই এটা একটা রাশান নাম।
“তিনিই সেই লোক যিনি সবসময় ‘এলভারদি’ ব্যান্ড সংগীত বাজাতে বলতেন,” বললেন অর্তের। “এটা একটা ককেসীয় সংগীত ...”
আমার হাত অত্যন্ত শক্ত করে ধরে সোনাশিৎজে বললেন, “আপনি কি মনে করতে পারছেন?” “এলভার্দি...”

তিনি ব্যান্ডের সুরটা শীষ দিয়ে বাজাতে থাকলেন, তার চোখ চকচক করে উঠলো। হঠাৎ, আমিও চমকে উঠলাম। সুরটা আমার বেশ পরিচিত মনে হলো।
ঠিক তখনই, যে ওয়েটারটা খাবার সার্ভ করছেন, অর্তের দিকে এগিয়ে এলেন আর ঘরের শেষ প্রান্তে কোনো একটা কিছুর প্রতি ইঙ্গিত করলেন।

(চলবে)

৪র্থ কিস্তির লিংক



বাংলাদেশ সময়: ১৮০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।