ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

জীবনানন্দের মৃত্যুবার্ষিকীতে

কবিতার কথা : কবিতার ইশতেহার | রহমান মতি

বিশেষ রচনা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪
কবিতার কথা : কবিতার ইশতেহার | রহমান মতি

কবিতা কী,কবিতা সম্পর্কিত আর কী কী সূক্ষ্ম চিন্তা থাকে, কবিতার চেতনাগত দিক, পাঠক ও কবির সম্পর্ক, সমালোচক ও সমালোচনা কবিতা পাঠকের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা। ব্যক্তিদৃষ্টির সূক্ষ্মতর প্রকাশে যে কোনো শিল্প তাঁর নিজস্বতার পাশে অনেকখানি শিল্পিত হয়।

তাঁর নিজের বলার বা বিশ্লেষণের ইচ্ছা থাকতে পারে। কবি যখন গদ্যশিল্পী হন ‘অন্তঃস্থল’ বলতে যে ভাণ্ডার থাকে সেখান থেকে বের হতে থাকে গূঢ় কথা বা বিশ্লেষণ। পাঠ করবার সময় অপরিমেয় ‘আনন্দ’ থাকে। প্রমথ চৌধুরী বলেন, ‘সাহিত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে আনন্দ দান করা। ’ আনন্দই একজন প্রকৃত সাহিত্যিকের ‘শিল্প’ আর পাঠকের পাওয়ার মতো উপযুক্ত আস্বাদ। কবি জীবনানন্দ দাশের ‘কবিতার কথা’ বইটি কবিতাপিয়াসী পাঠকের সে আনন্দযোগ নিটোলভাবেই।

‘কবিতার কথা’ প্রথমত একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ। সাহিত্যের বিচারকে সবসময় দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। জনপ্রিয়তা ও মানদণ্ড। ‘কবিতার কথা’ দুটিই বহন করে। জনপ্রিয় না হলে মূলত বহুল পঠিত হয় না। মানদণ্ডের বিচারে কবিতার কথা অবিসংবাদিতভাবে আদর্শ। কবিতাকে দেখবার বহুমাত্রিকতায় অন্তর্দৃষ্টিজাত উপলব্ধি এবং এ সম্পর্কিত কিছু স্বতন্ত্র প্রত্যয় সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্যসহযোগে কবিতার আবহমান আবেদনকে মূল্যময় ভেবেছেন জীবনানন্দ। কবিতাকে ভালোবেসেই ‘কবিতার কথা’ পাঠে মিলবে সচেতন একজন পাঠকের সহজানন্দ।
 
কেউ কেউ কবি
বহুল পঠিত এ উক্তিটি একটি সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের কণ্ঠস্বর এর মধ্যে বর্তমান। উক্তিটি জীবনানন্দ দাশ একজন প্রকৃত কবির সাতন্ত্র্যকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। যে কেউ চাইলেই কবি হন না। কবিকে তাঁর স্বতন্ত্র ‘সারবত্তা’র কাছে দায়বদ্ধও থাকতে হয়। ‘সারবত্তা’ শব্দটি মৌলিক, সুনির্বাচিত এবং অসাধারণ। শব্দটি গবেষণালব্ধ। জীবনানন্দ বলেছেন ‘উপমাতেই কবিত্ব’। ‘উপমা’ নিজেই অন্যতম সারবত্তা। ‘উপমা’ কবিতা রচনার অন্যতম উপকরণ বা শিল্পগত উপায়। উপমার ব্যবহারে এমন অনেক কবিতা আছে যা আমাদের পরিচিত এবং বহুল পঠিত হয়ে থাকে। সে সূত্রে উপমার ব্যবহার শুধুমাত্র কবির ক্ষেত্রেই সম্ভব যেহেতু তিনি বুঝে কবিতা লেখেন। জীবনানন্দের কবিতার কথাই বলা যায়—
        মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো।
                            [হাওয়ার রাত, বনলতা সেন]
‘স্বতন্ত্র সারবত্তা’ এটাই। ‘সার’ বিষয়টি প্রধান বা মূল হিসেবে দেখানো হয়। যেমন— সারকথা। সে সূত্রে সারবত্তা প্রধান বা মূলকে কেন্দ্র করে থাকে। সারবত্তার কাছে দায়বদ্ধ একজন শিল্পীকে জীবনানন্দ ‘কবি’ বলতে চান। হৃদয়ে কল্পনার স্থান এবং কল্পনা থেকে চিন্তার উৎপত্তি। সমস্ত বিশ্ব চরাচর তার উৎপত্তির স্থান।

জীবনানন্দ নিবিড়তার অনুভব করেন ‘কল্পনা’র কার্যকরী একটি স্থানকে। একটি গ্রামের দৃশ্য, মাঠের সবুজ ঘাস, দিগন্তের সূর্য কল্পনাকে জাগ্রত করতে পারে। ব্যবহার হবে চিন্তা থেকে। কল্পনা থেকে কবির চিন্তার উদ্ভাসন হয় স্তরে স্তরে—
        আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়
        হয়তো মানুষ নয়—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।
                            [আবার আসিব ফিরে, রূপসী বাংলা]
উদ্ধৃতিতে ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায়, হয়তো মানুষ নয়’— এ পর্যন্ত পাঠ করবার পরে দেখা যাবে ‘হয়তো’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্য তৈরি করে। এরপর, ‘মানুষ নয়’—‘হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে’— এখানে ‘হয়তো’র মধ্যেখানে ‘বা’ অব্যয়টি উপমা ‘শঙ্খচিল শালিখ’কে মূর্ত করে। চিন্তার অবস্থানটিও ঠিক এখানেই। এই চিন্তা জন্মান্তরের কল্পনার সঙ্গে মিশে কবিসত্তার একান্ত ইচ্ছাকে তুলে ধরে। ‘সারবত্তা’ এটাও, যার এটি আছে সেই ‘কবি’। ‘কবি’ পরিচয় তাহলে কোনো সাধারণ বিষয় নয়। ‘সকলেই কবি নয়’ উক্তিটি আরো বড় পরিসরে ‘অ-কবি’দের প্রতি এক প্রকার‘ভর্ৎসনা’ও বলা যায় কিংবা প্রতিবাদও বলা যায়। শিল্পের দায়বদ্ধতা না থাকলে একজন কবির এ ধরনের সচেতনতা থাকে না। জীবনানন্দের দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী। তাই, আধুনিক একুশ শতকেও আমরা তাঁর এ উক্তিটিকে বাদ দিই না। মৌলিক এবং সর্বজনীন শিল্প উপকরণ কখনোই বাদ যায় না।

কবিতা প্রয়োজন কিনা
জীবনানন্দ প্রশ্ন করেন—
কবিতা আমাদের জীবনের পক্ষে সত্যিই কি প্রয়োজন? [কবিতার কথা, কবিতার কথা]
প্রশ্নটি মৌলিক একারণে যে সমালোচকগণ বিশ শতকে এসেও প্রশ্ন করেন কবিতা আসলেই কি দরকার নাকি দরকার নেই। জীবনানন্দ প্রশ্ন করেই বসে থাকেন নি। নিজেই উত্তর করেছেন। কবিতা বেশ অল্প পাঠক পড়ে এটা চিরন্তন সত্য। এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি আরো কিছু প্রশ্ন করেন—
বেশি লোকে কবিতা বুঝলে ও ভালোবাসলে সকলের মঙ্গল হবে কি না বা কবিতাকে বাস্তবিক ব্যবহার করতে পারবে কি না। মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে সর্বাঙ্গীন ও সুখের করে গড়বার সংগ্রামে কবিতার স্থান আছে কি না। [কবিতার কথা, কবিতার কথা]

তিনি প্রশ্ন করে বলেছেন লাইনগুলোর মধ্যেই উত্তর আছে। আমরা দেখতে পারি জিনিসগুলো কোন কোন ক্ষেত্রকে প্রতিনিধিত্ব করছে।
প্রথমত, কবিতা জীবনের পক্ষে সত্যিই প্রয়োজন। শৈশবের সময়টিতে যাঁরা বর্তমান সমাজের এত অগ্রগতি দেখে নি তারা একসময় পাঠ করতো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কবিতা—
        সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
        সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি
        আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে   
        আমি যেন সেই কাজ, করি ভালো মনে।
                           [আমার পণ, মদনমোহন তর্কালঙ্কার]
নীতিকবিতার সুরটি সম্পূর্ণভাবে এখানে আছে। উপদেশ হিসেবে একজন বালক তার জীবনে এটি মানতে চাইতো। পূর্বপুরুষদের মন-মানসিকতায় এ ধরনের কবিতার প্রতি আকর্ষণ এবং সংস্কৃতি চর্চার উপাদানরূপে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। জীবনের পক্ষে তাহলে এই কবিতা প্রয়োজন। উপদেশ দিয়ে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার পক্ষে গুরুত্ব আছে।

দ্বিতীয়ত, বেশি লোকে কবিতা বুঝলে ও ভালোবাসলে মঙ্গল হবে কিনা। প্রশ্নের পেছনে মৌলিকতার স্বর আছে। বেশি লোকে কবিতা যেহেতু পড়ে না তাহলে বোঝার বা ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারতম্য থাকে। বেশি লোক যদি সেটি করেও থাকে সবাই বুঝতেও পারবে না। কারণ, কবিতা শেষ পর্যন্ত তারাই বুঝবে যাদের কবিতার জন্য আলাদা রুচি, আগ্রহ, মানসিকতা, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি থাকবে। আরো বড় ব্যাপার কবিতার শিক্ষা যারা ধারণ করবে ব্যক্তিবিশেষের সাতন্ত্র্যে এবং মঙ্গলজনক হিসেবে কাজে লাগাতে পারবে তারাই গ্রহণ করবে। মঙ্গল সবাই করতে পারে না সুতরাং প্রসঙ্গটি আপেক্ষিক।

তৃতীয়ত, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সুখ ও সংগ্রামের ভূমিকায় কবিতার স্থান আছে। ব্যক্তিগত সুখের ক্ষেত্রে এখানেও রুচি, গ্রহণযোগ্যতা, মানসিকতা, চর্চা ইত্যাদির স্থান থাকে। ব্যক্তিগত জীবনের অনেক আনন্দময় মুহূর্তকে স্মৃতিময় করার ক্ষেত্রেও কবিতার স্থান সর্বাগ্রে। এক্ষেত্রে গান যেমন কার্যকরী তার পাশাপাশি কবিতাও। ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিকে যদি কেউ দুঃখের কবিতা ভাবে তা পুরোপুরি ঠিক হবে না। এটি পাঠকের ব্যক্তিজীবনের আনন্দ বা রোমান্সের একটি উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
সামাজিক বিষয়টি আরো বিস্তৃত। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার যে রাজনৈতিক স্বর তার সামাজিক ভূমিকা আছে। তাঁর ‘চল চল চল’ কবিতাটি প্রথমে কবিতার আকারে লেখা হয়। পরে গান করা হয়। যখন এটি গান করা হলো তখন গণমানুষ প্রভাবিত হয়েছে। ‘কুলি মজুর’ কবিতার ক্ষেত্রেও বলা যায়—
তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে আমরা রহিব নীচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিব সে ভরসা আজ মিছে।
                            [কুলি মজুর, কাজী নজরুল ইসলাম]
এটি প্রতিনিধিত্বমূলক কবিতা। নজরুলকে সাম্যবাদী বলা হয় তার কবিতার এ ধরনের স্বরকে কেন্দ্র করে। নজরুলের মাধ্যমে গণমানুষ বেশি প্রভাবিত হয়েছে। সুকান্ত ভট্টাচার্যও সেখানে অগ্রণী। জীবনানন্দ যে সমাজের মঙ্গলের প্রসঙ্গ তুলেছেন— কবিতা তাই করেছে ও করে থাকে। সামাজিকভাবে সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত সচেতনতার অংশ। মিছিলের একটি শব্দ বা শ্লোগান যদি সামাজিকভাবে কাজে লাগে তাও কবিতার শব্দ বা লাইনের মাধ্যমে। যেমন—
কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।
                            [নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়, হেলাল হাফিজ]
অতঃপর কবিতার প্রয়োজন আছে।

প্রতিভা ও বিশ্বস্ততা
তাঁর প্রতিভার প্রতি কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্তি প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয় মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের খেতে বুননের জন্য। [কবিতার কথা, কবিতার কথা]
কথাগুলো একজন সহৃদয় সাহিত্যকর্মীর জন্য। যিনি নিজে প্রণোদিত হয়ে কবি ও কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরবেন। কবি নিজেই সেই ব্যক্তিসত্তা যিনি নিজস্ব কর্তব্যবোধকে নিজেই জাগ্রত করেন। কবির নিজের যে প্রতিভা আছে সেই প্রতিভাই তাঁর কর্তব্যবোধকে জাগ্রত করবে। প্রতিভা, মূলত আত্মবিশ্বাসের মৌলিক উপাদান। বিশস্ততার অবিসংবাদিত শর্ত। সাহিত্যকর্মী কবি নিজেও। কিন্তু কবির নিজেরও দায়িত্ব অন্য কবিকেও তাঁর প্রতিভার মাধ্যমে একজন সাহিত্যকর্মী হিসেবে তাঁর প্রতিভার সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য অনুপ্রাণিত করা। ব্যক্তিকবি তাই প্রতিভাকে বড় মনে করে। এটি তাঁর সুসীম পৃথিবীকে অসীম কার্যক্ষমতার পথে নিয়ে যায়। চিরসত্য একটি বাণী। আশ্চর্যজনকভাবে আপন প্রতিভার স্বর্ণগর্ভ ফসল রবীন্দ্রনাথ সবোর্চ্চভাবে বুনতে পেরেছেন। তাঁর হৃদয়ও হয়েছে মৃত্যুহীন।

ভাবপ্রতিভা
কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘ইমাজিনেশন’কে জীবনানন্দ বলেছেন ‘ভাবপ্রতিভা’। ‘ভাব’কে আমরা কল্পনা বলে জানি। কল্পনার সঙ্গে চিন্তার একটি সম্পর্ক থেকে ‘ভাবপ্রতিভা’র প্রসঙ্গ এনেছেন। জীবনানন্দের ‘ভাব’ ও ‘প্রতিভা’ শব্দ দুটি আলাদা অর্থবহন করে আলাদা প্রয়োগের মাধ্যমে। ‘প্রতিভা’ মূলত নিজের বিশ্বস্ততার প্রতীক যা জীবনানন্দ নিজে বলেছেন। এই ‘প্রতিভা’ তার ‘ভাব’ বা ‘চিন্তা’কে ‘dominate’ করে। আমরা ভাবতে গিয়ে ‘ভাবাক্রান্ত’ হই। ভাবজগতের একটি প্রাধান্য থাকে। কবির ক্ষেত্রে আরো সত্য হলো কবি বেশি ভাবাক্রান্ত হন। সেজন্য সমাজের আর পাঁচজন থেকে তিনি আলাদা এবং কেউ কেউ তাকে অসংলগ্ন বলে থাকেন। ‘ভাবনা’র বিষয়টি কবির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। সুতরাং, ‘ভাবপ্রতিভা’ অবশ্যই কবির সৃষ্টিকর্ম, কবিতার শর্ত। ‘ভাবপ্রতিভা’র প্রসঙ্গটি আধুনিক নিরীক্ষাপ্রবণ কবিত্বের বৈশিষ্ট্যচিহ্নিত অংশ। যার দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবাক্রান্ত হই।

চিরপদার্থ
‘‘Universality’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ বলা হয় ‘সর্বজনীন’ বা ‘বিশ্বজনীন’ কিছু। আকার বা গঠন অনুসারে কবিতায় কোথায় কিভাবে তা লুকিয়ে থাকে সেটাই দেখায় বিষয়। ‘চিরপদার্থ’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করার পূর্বে ‘চিরকালীন’ শব্দটি বিশ্লেষণযোগ্য। ‘চিরকালীন’ হলো যা কিছু আবহমান। যেমন—  ‘মানুষ মরে যায়’। এরকম কোনো সত্য বক্তব্য কবিতাও বহন করে। ‘মহাভারত’ বা ‘রামায়ণ’ যে অর্থে চিরকালীন, জীবনানন্দ সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের কাব্যশিল্পকে চিরকালীন মনে করেন। জীবনানন্দের কথার সূত্রে ‘কালকেতু উপাখ্যান’কে বাঙালি লোকজীবনের  একটি পর্যায়ে বিশ্লেষণ করলে নতুন সাহিত্যমূল্য বেরিয়ে আসবে।
চর্যাপদ-এর ক্ষেত্রে:
            অপনা মাংসে হরিণা বৈরী
            খনহন ছাড়স ভুসুক অহেরি। [চর্যা ৬, ভুসুকপাদ]
লাইন দুটির অর্থ হয় নিজের মাংসের জন্যই হরিণ নিজের শত্রু। ক্ষণকালের জন্যও ভুসুকু শিকার ছাড়ে না। হরিণ নিজের সুশ্রী দেহের জন্য নিজেই অন্যের কাছে অর্থাৎ হিংস্র প্রাণীর কাছে খাদ্যবস্তু। লাইনটি অসামান্য সত্যকে তুলে ধরে। বলা যেতে পারে, যে রাষ্ট্রে নিরেট শান্তি বিদ্যমান তার বিরুদ্ধে অন্য শক্তিময় রাষ্ট্র আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব এভাবেই তৈরি হয়। প্রাচীন চর্যাপদও এক্ষেত্রে সূক্ষ্মজীবনবোধের পরিচায়ক। আগামী বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব কখনোই শেষ হয়ে যাবার মতো নয়। কারণ পৃথিবীতে সাম্রাজ্য এখন বাড়বে, কমবে না। তাই, ঔপনিবেশিক শক্তির উত্থান ঘটবে অনায়াসে।

জীবনানন্দ তুলনামূলক ব্যাপ্তিতে শেকস্‌পীয়র, রিলকে, দান্তে বা এলিজাবেথীয় কবির পাশাপাশি মেটাফিজিক্যাল কবিগোষ্ঠীকেও আনেন। শেকস্‌পীয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর জিঘাংসাবৃত্তি একালে এসে ছবির মত দেখা যায় গোটা সমাজব্যবস্থার মধ্যেই। মিলবে রিলকেতে—
For Beauty’s nothing, but begining of Teror, We are still just able to bear, and why we adore it so is because it serenely disdains to destroy us.
                                [Rikle, Selected Works]
‘সৌন্দর্য ধ্বংসাত্মক’— এই বোধ থেকেই বিষণ্নতার জন্ম। আমাদের ভালোবাসার ভিতরেও এই বিষণ্নতার বাস।

জীবনানন্দের নিজের কবিতার ক্ষেত্রে চিরপদার্থ বা চিরকালীন সত্যের সুর অনেক। ‘বনলতা সেন’ কবিতার আবেদন এবং আধুনিকতার অন্যতম উৎস নিঃসঙ্গতার বড় শক্তি একে মহৎ কবিতায় পরিণত করেছে। শেষের লাইনগুলো—
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
                                    [বনলতা সেন]
জীবনচক্রে ‘পাখি’ এবং ‘নদী’ মহাকালের উপাদান হয়ে মিলেছে চিরকালের ব্যক্তি নিঃসঙ্গতার উপাদানে। প্রেম এবং শূন্যতায় কবির আত্মসমর্পণ। চিরপদার্থ উপাদান হিসেবে শিল্পসৌন্দর্যে আলোকোজ্জ্বল ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি। সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের চিরকালীন ভঙ্গিরও স্বাভাবিকতা এটা।

আধুনিক কবিতা
আধুনিকতা নদীর স্রোতের মতো। গড়িয়ে যাচ্ছেই। গড়ানোর ফলে তার বৈশিষ্ট্য ক্রমশ বদলে যায়। বহমানতা থাকে সবার উপরে। তাই, আধুনিকতা পরিবর্তনশীল এবং সে পরিবর্তনশীলতা অবশ্যই গতিশীল। জীবনানন্দ দাশের আধুনিক কবিতার সঙ্গে মহৎ বিষয় জড়িত—
মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।
                    [আধুনিক কবিতা, কবিতার কথা]
লেখকের মধ্যে মহৎ বিষয়ও থাকে। আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্যই মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। কবিতাকে ঘিরে সমাজ-রাষ্ট্র যে ধরনের সংলগ্নতা পায় তার ভেতরে পরিবর্তনশীলতা থাকে গভীরতলে। একালের রাজনৈতিক তাৎপর্যশীলতায় অভিজাততন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের দিকে সমাজ ও রাষ্ট্র কিভাবে পরিবর্তন হলো তার জন্য ‘ইডিপাস’ বা ‘ইলিয়াড’ পড়া জরুরি কারণ রাজনৈতিকভাবে গ্রিক সমাজ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে সাহিত্যক্ষেত্রে। তাদের রাজনৈতিক দর্শন আমাদেরকে শিক্ষিত করেছে, প্রভাবিত করেছে এবং সচেতনভাবে গণতন্ত্রকে শান্তিময়তার শাসন হিসেবে গ্রহণীয় মানসিকতার জন্ম দিয়েছে। ‘Wasteland’-এর এলিয়ট সাম্রাজ্যবাদকে যেভাবে দেখান বাংলা অনুবাদে তার অর্থ হয় ‘পোঁড়ো জমি’। রিক্ত, অর্নুবর ভূমি। এর পেছনে সাম্রাজ্যের গ্রাস ছিল তাই মাটি আর মাটি নেই। এমন এক সময় হয়তো আসবে যখন আর কিছুই আশার জন্ম দেবে না। তবুও আশা নিয়ে বাঁচার আকুতি। মাহমুদ দারবিশ আধুনিক যন্ত্রময় সভ্যতার অস্ত্র প্রদর্শনী করা ইসরাইলকে সাম্রাজ্যবাদের প্রতীকে তাঁর কবিতায় দেখান। সাম্রাজ্যবাদ আধুনিক যুগের অনেক প্রাসঙ্গিক সমস্যা। এটি শুধু যান্ত্রিকই নয় বরং মননেও ঘটে থাকে। জীবনানন্দ দেখান—
        কেবলই ব্যক্তির—ব্যক্তির মৃত্যু শেষ করে দিয়ে আজ
        আমরাও মরে গেছি সব— [সূর্যপ্রতিম, বেলা অবেলা কালবেলা]
সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীতে ব্যক্তির মৃত্যু হয় সবার আগে, ব্যক্তির মৃত্যুই জাগায় ব্যক্তির স্বাধীনতাহীন পরিবেশকে এবং তাকে কখনো কখনো পলায়নবাদী করে তোলে।

‘অবিশ্বাস’ ও ‘অনিশ্চয়তা’কে প্রতিবন্ধকতা মনে করেছেন অনেকে কিন্তু জীবনানন্দ ভাবেন নি। সব কবিরই  আশাবাদী হওয়া উচিত বলে ধারণাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। আবু সয়ীদ আইয়ুব কী বলছেন দেখা যাক—
আমাদের এমন কোনো চিত্তজাগরণ বা বিশ্বনিরীক্ষা, যার মধ্য দিয়ে চিন্তা ও বেদনা সমান মিশেছে, যাতে কর্মপ্রেরণাও সঙ্গম ঘটেছে, কবিতায় তার সম্যক প্রকাশের পথ ঊনবিংশ শতকের চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ত হয়েছে আজ। অর্থাৎ মানুষের ভগ্নাবশেষ নিয়ে কবিতা আর ক্ষান্ত নয়, সম্পূর্ণ মানুষের সঙ্গে তার কারবার পাতা হলো। [আধুনিক কাব্যের সমস্যা: বিশ্বাস, পথের শেষ কোথায়]
‘বিশ্বনিরীক্ষা’—কথার গুরুত্ব অনেক। আধুনিক কবিতা অর্থগতভাবে এসব বিশ্লেষণে আশার প্রতীক, উন্মুক্ত পরিবেশের প্রকাশ বা রক্ষণশীলতার দমন ইত্যাদি। প্রগতির কবিতায় তাই আধুনিক কবিতার যাত্রা। জীবনানন্দ দাশও এগুলোর পক্ষে। বৈজ্ঞানিক সত্যতা এবং প্রয়োগ তাঁর ধূসর পাণ্ডুলিপিতে আছে। ‘এনট্রপি’, ‘প্যারাডিম’, ‘আর্কেটাইপ’ ইত্যাদির ব্যবহারও প্রচুর। সবই আধুনিক সভ্যতাকে দেখায় এবং হিংস্রতাকে দূর করার পক্ষে। জীবনানন্দ প্রকৃত আধুনিক কবিতার স্রষ্টা হয়ে, ‘কবিতার কথা’র প্রকৃত ভাষ্যকার হয়েছেন প্রথমেই।

বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে
জীবনানন্দ কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে বলতে গিয়ে দর্শন ও বিজ্ঞানের বিরোধী অবস্থান সম্পর্কে একটি মতামত প্রদান করেন। দর্শন মূলত বিজ্ঞানকেই শাসন করে। দেখার পরে গবেষণা। পুরোটা দর্শনের ধারাবাহিক কার্যকারিতা। বিজ্ঞান যেভাবে  তথ্যকে  ব্যাখ্যা করছে, জটিল করছে, কবিতা ঐ তথ্যকে কাব্যময়তা দিয়ে থাকে। প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা কিন্তু গন্তব্য প্রায় কাছাকাছি। সভ্যতা যেমন বিজ্ঞানের অবদান, দর্শনেরও অবদান। কবিতায় তার দুটিই থাকে। একটি কবিতা একটি সভ্যতাকে  উপস্থাপনের ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীকে সচেতন করার ক্ষমতা রাখে। সাম্প্রতিককালে গুন্টার গ্রাস-এর কবিতা পুরো পৃথিবীতে আলোচিত হয়েছে। এটি অন্য কবিতার প্রসঙ্গ। বাংলা কবিতা অবয়ব বা কাঠামোগত দিক থেকে পরিবর্তন হতে পারে এটি জীবনানন্দ বিশ্বাস করতেন। নতুন নতুন প্রকরণের মধ্যে কবিতার নানারকম পরিবর্তন আসবে যেগুলো পরীক্ষামূলক। রবীন্দ্রনাথের পরে আধুনিককালে কবিতার যে নতুন যুগ তার মধ্য থেকেই পরীক্ষামূলক পরিবর্তনগুলো আসার কথা। নতুন ‘পঞ্চপাণ্ডব’ও এর মধ্যে নতুন পরীক্ষামূলক অবস্থা তৈরি করে। পরীক্ষার বিষয়ে কবিতা নিয়ে নতুন কাঠামোগত ব্যাখ্যাগুলো জীবনানন্দ দেখান—
দীর্ঘকবিতার সম্ভাবনা আসতে পারে।
কাব্যনাট্য থাকতে পারে।
মহান কবিতা হিসেবে ‘শ্লেষ কবিতা’র উদ্ভব হতে পারে।
খণ্ড কবিতার ভবিষ্যৎ থাকবে না।
[বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, কবিতার কথা]

সম্ভাবনার দিক থেকে তখনই অর্থাৎ জীবনানন্দের সময়েই কাব্যনাট্য রচিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য ছিল। বাংলাদেশে আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ শামসুল হকরা কাব্যনাট্যকে চর্চা করেছেন। খণ্ড কবিতা এখন দেখা যায়। দীর্ঘকবিতার ভালো সম্ভাবনা জীবনানন্দেরও ছিল। তিনি নিজেও রচনা করেছেন। ‘কোরাস’-ভিত্তিক কবিতা জীবনানন্দের পরীক্ষামূলক কবিতার বিশেষ লক্ষণ ছিল। দীর্ঘকবিতা আশি বা নব্বই দশকেও ছিল। শূন্য দশকের কবিতাতেও এর প্রবণতা আছে। গদ্য কবিতা একটি বিশেষ কবিতা লক্ষণ। গদ্যকবিতার ধারা বক্তব্য প্রকাশ এবং শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নতুন কবিতার অংশ। গল্প বলায় ভঙ্গি, অন্ত্যমিলজনিত গতানুগতিক ছন্দের কবিতার বাইরে দীর্ঘ পয়ারভিত্তিক কবিতার ব্যবহার আছে এখন। এসব কবিতা জটিল আধুনিক জীবন সমস্যাকে তুলে ধরে। উত্তরাধুনিক প্রবণতাও জড়িত থাকে। জীবনানন্দের ভবিষ্যৎ বাংলা কবিতার বাণী অনেক সত্য। জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কবি হয়ে বিশ্বাস রাখেন আধুনিক কবিতার ওপরেই। বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নির্দেশও মূলত জীবনানন্দ কাব্যিক দায়িত্ববোধ থেকে করেছেন। এর মধ্যে প্রকৃত আধুনিক কাব্যদর্শন বিদ্যমান।

এত আয়োজন একটা কারণেই কবিতাকে ভালোবাসা। কবিতার প্রতি ভালোবাসা থেকে জীবনানন্দ বড় কবি। বড় মনমানসিকতা থেকে বড় কথা বলা যায়, নতুন কিছু বলা যায়, বলা যায় বড় বড় কথাও যা অন্যের থেকে সহজেই আলাদা করার মতো। কবিতার পাঠক ও নতুন কবির আধুনিক পথ চলাতে একটি ‘কবিতার কথা’ বই বড় পথকেই চেনাবে। কবি ও কবিতার দায়কে চিনতে শিখলে তবেই ধন্য হবে কাব্যশিল্প। আর জীবনানন্দ সে কাব্যশিল্পে করছেন আবহমান আহবান।



বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।