এর্নেস্তো সাবাতো (২৪ জুন ১৯১১-৩০ এপ্রিল ২০১১) আর্জেন্টাইন লেখক এবং চিত্রকর। লেখালেখির জন্য পেয়েছেন লিজিওন অফ অনার, মিগুয়েল দে সেরভেন্তেস পুরস্কার।
‘এল তুনেল’ (১৯৪৮), ‘সবরে হেরোস ইয়া টুম্বাস’ (১৯৬১), ‘অ্যাবানদন এল এক্সতারমিনাদোর’ (১৯৭৪) তাঁর জগদ্বিখ্যাত তিন উপন্যাস।
২১তম কিস্তির লিংক
আমার নিষ্ফলা সব যুক্তি-তর্ক, আমার হিংস্র সব অনুমান, সব বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল যেন। কল্পনায় ওর চেহারা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম, ওর অভিব্যক্তি—যে অভিব্যক্তি আমাকে অন্য কোনো কিছুর কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল যা আমি তখন শনাক্ত করতে পারিনি— এবং ওর সুষুপ্তি আর বিষাদমাখা চিন্তার ধরন। আমার হঠাৎ উপলব্ধি হল, বহু বছর ধরে নিঃসঙ্গতার ভেতরে দিয়ে লালন করা আমার অপরিস্ফূটিত প্রেম যেন এখন মারিয়ার মধ্যে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। আমার মাথায় এ রকম উদ্ভট চিন্তা কী করে এলো?
টেলিফোন আলাপ, ওর চিঠি, ওদের এসতানসায়া বা ভূসম্পত্তি, হান্তেরকে নিয়ে আমার যত রকম কুৎসিত অনুমান ছিল—সব আমি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু ব্যর্থ হলাম।
চরম উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দিনটা পার করলাম। তাড়াহুড়োয়—মারিয়া এসতানসায়া থেকে কবে ফিরবে—আমার জিজ্ঞেস করা হয়নি। ওই দিনই ছটফট করে আর থাকতে না পেরে শেষে আমি ফোন করে জানতে চাইলাম ও কবে ফিরবে। কাজের মহিলাটা জানাল—সে জানে না। আমি তার কাছে এসতানসায়ার ঠিকানা জানতে চাইলাম।
ওই রাতেই মারিয়াকে আমি মরিয়া হয়ে একটা চিঠি লিখলাম, জানতে চাইলাম ও কবে ফিরবে এবং আকুল অনুনয় করলাম যাতে বুয়েন্স আয়ার্সে ফেরা মাত্রই সে আমাকে ফোন করে—আর তা নয়তো অন্তত দু’ ছত্র লিখে যেন জানায়। প্রধান পোস্টঅফিসে গিয়ে চিঠিটা রেজিস্ট্রি করে পাঠালাম, যাতে খোয়া যাওয়ার কোনো ঝুঁকি না থাকে।
যা বলেছি, বেশ উদ্বেগাকুল ক’টা দিন পার করলাম, আর কাল পোসাদা থেকে ঘুরে আসার পর মনের মধ্যে সেই যে অজস্রবার হানা দেওয়া নানান দুশ্চিন্তার দহন শুরু হয়েছিল— তা এখনও চলছেই। একটা স্বপ্ন দেখলাম। এক রাতে জনমানবহীন এক পুরনো বাড়িতে হাজির হয়েছি। যে কোনোভাবেই হোক এই বাড়িটা আমার পরিচিত আর সেই ছেলেবেলা থেকেই এ রকম একটা বাড়ি চিন্তা করে এসেছি, কাজেই আমি যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম, পুরনো স্মৃতি যেন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একই সময়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম অন্ধকারে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি, কিংবা এ রকম মনে হতে শুরু হল যে আমার পেছনে শত্রু ওৎ পেতে আছে— যে কোনো সময় তারা আক্রমণ করে বসবে, কিংবা ওই সব লোকজন আমাকে নিয়ে ফিসফাস করছে, নানারকম উপহাস করছে আমার অকপটতা নিয়ে। ওইসব লোকজন কারা, ওরা কী চায়? এবং তারপরও, এসব কিছু সত্ত্বেও আমার বয়ঃসন্ধির রোমহর্ষ আর কাঁপন জাগানো প্রথম প্রেম ছিল ওই বাড়িতে পুনর্জন্ম নেওয়ার মধুর পাগলামী, যার সঙ্গে মিশে আছে আরও শঙ্কা আর আনন্দ। আমি যখন জেগে উঠলাম, বুঝলাম স্বপ্নের ওই বাড়ি আসলে মারিয়া।
ওর চিঠি আসার দিন যত ঘনিয়ে আসতে শুরু করল, আমার মনের অবস্থা দাঁড়াল কুয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তরে পথ হারিয়ে ফেলা এক অভিযাত্রীর মতো: একবার এখানে আরেকবার ওখানে, টান টান চোখের পাতা, চকিতে ভেসে উঠছে অস্পষ্ট সব মানুষের ছায়ামূর্তি, নানা স্থাপনা, ঝাপসা গভীর বিপদের সব ফাটল আর গহ্বরের অবয়ব। চিঠি আসার পর মনে হল, মেঘের আড়াল থেকে যেন সূর্য বেরিয়ে এসেছে।
কিন্তু এই সূর্য কালো সূর্য, নিশি রাতের সূর্য। আমি জানি না তোমরা হয়তো এটা বলতে পারো, আমি কোনো লেখকও না তাই আমার কথাই ঠিক হবে সে দাবিও আমি করি না, তবে নিশি বা রাতের সূর্য কথাটা আমি প্রত্যাহার করবো না। নৈশ শব্দটা হয়তো ভাষাকে অশুদ্ধতা দিচ্ছে, কিন্তু মারিয়ার জন্য এটাই উপযুক্ত শব্দ।
এই হল ওর চিঠি:
তিনটা অদ্ভুত দিন আমি পার করলাম: সাগর, সৈকত, পথ যা আমাকে পেছনের অন্য দিনগুলির স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছিল। শুধু চিত্রকল্প না, কণ্ঠস্বরও আছে, আছে চিৎকার-চেঁচামেচি তারপর অন্য আরেক সময়ের দীর্ঘ নৈঃশব্দ। এটা কৌতূহলোদ্দীপক, কিন্তু জীবনের ধর্মই হলো ভবিষ্যৎ স্মৃতি নির্মাণ; এই মুহূর্তে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে বসে আছি আমি, আমি জানি, আমি এমন কিছু স্মৃতি তৈরি করতে যাচ্ছি ভবিষ্যতে যা আমার জন্য বয়ে আনবে শুধু বিষাদ আর একাকীত্ব।
আমার সামনে বিশাল সমুদ্র, চিরন্তন আর দুর্বার। আমার অন্য সময়ের কান্না এখন অর্থহীন; অর্থহীন আমার এই একাকী সমুদ্রসৈকতে বসে থাকাও। তুমি কি কোনোভাবে আমার মন পড়তে পারছ, কিংবা আমাদের মতো অন্য অনেকের মনও কি তুমি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পারো?
তোমার প্রতিচ্ছবি আমার সামনে এখন বিমূর্ত হয়ে উঠেছে; সাগর আর আমার মাঝখানে এখন তুমি দাঁড়িয়ে আছো। আমাদের চারচক্ষের মিলন হল। তোমার শান্ত মুখচোখ, একটু যেন বিষাদমাখা। আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছো, যেন আমার সাহায্য তোমার দরকার।
- মারিয়া।
(চলবে)
২৩তম কিস্তির লিংক
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৪
শিল্প-সাহিত্য
প্রতিদিনের ধারাবাহিক
টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২২) || অনুবাদ : আলীম আজিজ
অনুবাদ উপন্যাস / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
![টানেল | এর্নেস্তো সাবাতো (২২) || অনুবাদ : আলীম আজিজ](public/uploads/2014/10/20/Arts_bg_641959647.jpg)
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।