ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শিল্পী মুর্তজা বশীরের একুশের স্মৃতি

‘আমার কাপড় রক্তে ভিজে গিয়েছিল’

সাক্ষাৎকার : রবাব রসাঁ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১১
‘আমার কাপড় রক্তে ভিজে গিয়েছিল’

মাঝারি আয়তনের ঘরে বইয়ের তাকে থাক থাক করে রাখা বই। একপাশে থাক করে রাখা ছবির ক্যানভাস।

পাশে পাঁচ ফুটেরও বড় দেশের মানচিত্র। টেবিলে সযত্নে রাখা লেনিনের বাস্ট। ঘরের ভেতর একটি চেয়ারে মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীর।

১৯৫২ সালেই এই শিল্পী লিনোকাটের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তার ‘ব্লাডি টুয়েন্টিফাস্ট’ শিল্পকর্মটিতে। এখানে তিনি তুলে ধরেছেন বায়ান্নর সেই ঐতিহাসিক দিনটিকে। তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সামনের সমাবেশ।

এই শিল্পকর্মটিতে দেখা যায় একজন গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীকে ধরে আছেন সহযাত্রীরা। তাদের হাতে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা ব্যানার। একই বছর কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা ‘পরিচয়’-এ ছাপা হয়েছিল তার লেখা ‘পারবে না’ কবিতাটি। একুশের দিনে তিনি ছিলেন রাজপথে। ছিলেন আন্দোলনে। সেই দিনের সেই উনিশ বছরের তরুণের স্মৃতি তারই জবানিতে তুলে ধরা হলো বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য। ]

রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন চলছিল সেই ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস থেকেই। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করি। সেদিন রাতে ছাত্ররা মাইকে প্রচার করল আগামীকাল ২১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সমাবেশ হবে। এর কিছুক্ষণ পর সরকারি ভ্যানের মাধ্যমে বলা হল ২১ তারিখ ১৪৪ ধারা।

২১ তারিখ সকাল ১০টায় আমাদের বেগমবাজারের বাসা থেকে বের হলাম। প্রথমে আসি নিমতলীতে ঢাকা জাদুঘরে। এখানে আমাদের ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় চিত্রপ্রদর্শনী হওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল।

নিমতলী থেকে এগিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। চারদিকে একটা থমথমে ভাব। আমতলায় এসে দেখি ছাত্রদের জমায়েত। এসে শুনলাম ‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে অনেক বাগবিতণ্ডা চলছিল। সেই সময় গাজীউল হক হঠাৎ একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে বললেন, বন্ধুরা, আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গব। লাইন ধরে যাব প্রদেশিক আইন পরিষদের দিকে। আমাদের দাবি জানাব। সাড়ে চার কোটি জনতার দাবি জানাব।

তখন প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন চলছিল জগন্নাথ হলের উল্টো দিকে, তৎকালীন প্রাদেশিক আইন পরিষদের ভবনে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল সেখানে গিয়ে একটি স্মারকলিপি দেব।

এদিকে রাস্তায় ছিল প্রচুর পুলিশ। ছেলেরাও ছিল উত্তেজিত। স্লোগান হচ্ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘চল চল অ্যাসেম্বলি চল’, ‘সাড়ে চার কোটি জনতার কণ্ঠরোধ চলবে না’ ইত্যাদি। পুলিশ ছাত্রদের দিকে কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুড়ছিল। কাঁদানে গ্যাসের অভিজ্ঞতা আমাদের এই প্রথম। এমন অবস্থায় কী করতে হবে আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না। কেউ কেউ বললেন রুমাল ভিজিয়ে চোখে-মুখে ধরতে। কিন্তু সবার পকেটে তো আর রুমাল ছিল না, তাই অনেকে গায়ের জামা ছিঁড়ে বিলিয়ে দিতে শুরু করলেন। সামনেই ছিল একটা ছোট পুকুর।

আমতলা থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও ধরপাকড় শুরু করল। এমন সময় শোনা গেল মেয়েদের হল থেকে একটা মিছিল বের হয়ে এদিকেই আসছিল। কিন্তু পুলিশের বাধা পেয়েছে। সমাবেশ উপলক্ষে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। ছাত্ররা মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের দিকের রাস্তায় এগিয়ে গেল। পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে, ছাত্রদের স্লোগানও চলছে।

এখন যেখানটায় শহীদ মিনার আছে সেখানটায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে একটা আমবাগান ছিল। পরে ব্রিটিশরা সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের জন্য অনেকগুলো ব্যারাক তৈরি করেছিল। পরবর্তী সময়ে সেই ব্যারাকগুলো মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে রূপান্তরিত হয়।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা দেয়াল ছিল। দেয়ালের ওপরে ছিল সুঁচালো চারকোনা লোহার রড সারি সারিভাবে গাঁথা। আমরা সেই দিকে গেলাম। কেউ কেউ লোহার শিক টপকে ওপারে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে ঢুকল। পরে ছাত্রদের ঠেলাঠেলির চাপে সেই দেয়ালের একটা অংশ ভেঙ্গে যায়। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছিল।

আমরা কলেজের ছাত্রাবাসে জড়ো হলাম। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বা ঘাসে বসে। এখানেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের সেল ছুড়তে শুরু করল। অনেকে সেই সেল কুড়িয়ে নিয়ে কলসির পানিতে চুবিয়ে দিল। আমরা সেই সেল পাল্টা ছুড়ে মারছিলাম পুলিশের দিকে।

এরপর হঠাৎ নিস্তব্ধতা। আমার পাশে ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। আমরা গল্প করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম গেটের দিক থেকে পুলিশ হাত ইশারা করে ডাকছে। কিছু ছাত্র এগিয়ে গেল। এমন সময় পেলাম গুলির শব্দ। যে যেদিকে পারলাম দৌড়ে পালালাম। পরে ভেবে নিলাম, পুলিশ ছাত্রদের ভয় দেখানোর জন্য হয়ত ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। তাই কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলাম। একটু লজ্জাও লেগেছিল, এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলাম বলে।

ফিরে এসে আবার বসলাম মাঠে। অনেকে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। হঠাৎ দেখলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ছাত্রাবাসের সীমানায় যে দেয়াল তার পাশ দিয়ে পিপঁড়ে যেমন শস্যদানা মুখে নিয়ে এগিয়ে যায় ঠিক তেমনি একটি চলন্ত জটলা। আমি দৌড়ে ওদিকে গেলাম। ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই দেখি, লোকজন একজন মানুষকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছে। লম্বা, শ্যামবর্ণ, শার্ট-ইন করা মানুষটির মুখে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘাম। তার তলপেটের দিক থেকে রক্ত ঝরছে। ঠিক যেমন পাইপকল ছেড়ে দিলে রক্ত পড়ে, তেমনি।

লোকটি কাতরাচ্ছিলেন। আমি তার কাছে দাঁড়ালাম। আমিও তাকে ধরেছিলাম অন্যদের সাথে। আমার কাপড় রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আমার মাথা ছিল তার মুখের কাছে। সে ‘পানি, পানি’ বলছিল। তার জিভ যেন কাটা মুরগির মতো কাঁপছে। কাঁদুনে গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য আমার হাতে ছিল ভেজা রুমাল, যেখানে আমার ঘামও লেগেছিল। আমি খানিক ইতস্তত করলাম। পর মুহূর্তেই সঙ্কোচ ফেলে রুমালটি নিংড়ে তার মুখে ধরলাম। লোকটি আমাকে বললেন, ‘আমার বাড়িতে খবর দিবেন, নাম আবুল বরকত, ঠিকানা বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পল্টন লাইন। ’

বরকতকে নিয়ে আমরা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখি লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাসে অনেক আহত লোক। তাদের নিয়েই নার্স ও মেডিকেলের ছাত্ররা অনেক ব্যস্ত। যে মুহূর্তে আহতরা তাকে দেখল, তারা বলল, ‘আগে ওর চিকিৎসা করুন’।

ওখানে অলি আহাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি তাকে বরকতের নাম-ঠিকানা বলে একটু বের হয়ে আসছিলাম। এমন সময় দেখি স্ট্রেচারে একটা লাশ। মাথায় গুলি লেগে উড়ে গেছে ওপরের অংশ। মগজটি পাশে রাখা। শুকনো ঘাস তখনো লেগেছিল সেখানে।

এরপর, স্ট্রেচারে আরেকটি লাশ আসতে দেখলাম। গুলি লেগে এর পায়ের গোড়ালি ফাঁটা বাঁশের মতো হা হয়ে গেছে।

আমি জাদুঘরে ফিরে এলাম। এখানে দেখি কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, রশীদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকই। তারা আমার গায়ে রক্তমাখা জামা দেখে চমকে গেল। আমি তাদেরকে ঘটনাটি বললাম। আমাদের চিত্র প্রদর্শনীটি সেই দিন বিকেলে উদ্বোধন করার কথা ছিল গর্ভনরের স্ত্রী লেডি ভিকারুন নেসা নূনের।

আমি বললাম, আমরা এই প্রদর্শনী বন্ধ করে দিব ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলল, আগে উদ্বোধনটা হয়ে যাক, পরে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। কিন্তু আমি এর বিরোধিতা করে বললাম, না, আমি তা মানি না। আমি আমার ছবি নামিয়ে নেওয়ার জন্য হলের দিকে এগুলাম। এরপরে, অনেকেই আমার সঙ্গী হলো।

বিকেলের দিকে রিকশা করে বাসায় ফিরছিলাম। আমাকে রাস্তায় লোকে জিজ্ঞেস করল, ‘গুলি বলে চলেছে?’ আমি মাথা নাড়াতে তারা মেডিকেল কলেজের দিকে ছুটে গেল।

বাসায় ফিরতেই মা বললেন, ‘বাবু তোমাকে ডাকে’। আমার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে আমরা ‘বাবু’ বলে ডাকতাম।

বাবার কাছে যেতেই তিনি রাগত স্বরে বললেন, ‘তোমাকে না বলেছি আজ বের না হতে। ’ আমি রাজনীতি করি তা তিনি পছন্দ করতেন না। এমনকি আমি যখন ৫০ সালে কয়েক মাসের জন্য জেলে ছিলাম, আমার মা দেখা করতে এলেও বাবা কখনও আসেননি। যা হোক, আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন’।

আমার চকলেট রঙের জামাটিতে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সাদা পাজামায় রক্তের ছোপ, হাতে বরকতের রক্তভেজা রুমাল। এসব দেখে বাবা হচকচিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেউ কি মারা গেছে?’ আমি রক্তভেজা রুমালটা তার দিকে এগিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’। বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমার কালো আচকানটা দাও। ’

বাবার একটা বাদামি রঙের চামড়ার ছোট সুটকেস ছিল। তিনি প্রায়শই মফস্বলে যেতেন বলে সেখানে কিছু কাপড় গোছগাছ করে রাখা থাকতো। মা সেখান থেকে আচকানটা বের করে বাবার হাতে দিলেন। বাবার গোঁফ ছাঁটার একটা ছোট কাঁচি ছিল। সেটা দিয়ে আচকানের নিচের অংশ এক ফালি লম্বালম্বি কেটে আমাকে বললেন, ‘এটা আমার হাতে বেঁধে দাও। ’

তারপর বললেন, ‘ভাষার জন্য যদি তোমার জীবন যেত তাহলে আমার কোনো আফসোস থাকত না। ’

সারা জীবন তার যে শ্রশ্রুমণ্ডিত সৌম্য ও শান্ত চেহারা আমি দেখেছি হঠাৎ লক্ষ করলাম তা ঘৃণায় ছেয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সময় ১৯৫২, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।