ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

কমলকুমার মজুমদার : স্বাতন্ত্র্যের সন্ধানে

শোয়াইব জিবরান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১১
কমলকুমার মজুমদার : স্বাতন্ত্র্যের সন্ধানে

কমলকুমার মজুমদারের জন্ম ১৯১৪ সালের ১৪ নভেম্বর কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে। পিতা প্রফুল্লচন্দ্র মজুমদার, মা রেণুকাময়ী মজুমদার।

পিতামহ বরদাকান্ত মজুমদার, তাঁদের স্থায়ী নিবাস চব্বিশ পরগণা জেলার টাকীতে। কমলকুমারের জন্মকালে তাঁর পিতা পুলিশ অফিসার হিসেবে কলিকাতায় কর্মরত, থাকতেন ভাড়া বাড়িতে। সাঁওতাল পরগণার রিখিয়ায় তাঁরা বাড়ি করেছিলেন। এ হিসেবে কমলকুমারের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত হয় বিচিত্রস্থানে। বাবা, মা, ঠাকুমা ও বাবার মামা শরৎচন্দ্র রায় চৌধুরীর অমল আশ্রয়ে। কখনো বকুলবাগানে, রাসবিহারী এভিন্যু, ব্লকমনস্ট্রিটের নাগরিক পরিবেশে আবার খোলা আকাশের রিখিয়ায়। কমলকুমারের শৈশব কৈশোর অতিবাহিত হয় শিল্পসাহিত্যের অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশে। তাঁর পরিবারের প্রতিটি স্থানেই সাহিত্য, সংগীত, অভিনয়, চিত্রকলার চর্চা ছিল। মা রেণুকাময়ীর ছিল শৈল্পিক অভিরুচি। কমলকুমার শৈশব স্মৃতিচারণে বলেছেন:
আমার মার কণ্ঠস্বরে মুগ্ধতা ছিল, যেখানে স্বরস্থান সুডৌল, রূপান্ত, যে এবং যখন ঐ স্থানে আসিত বিতরসি দিুগণে। ইহা দেশরাগে এখন সকাল হয়। অদ্ভুত সূক্ষ্মতা আমাদের ভর করিত কি পর্যন্ত দুঃসাহসে আমরা ঘোষণা করিতাম, কেশব ধৃত রাম শরীরং জয় জগদীশ হবে।

কমলকুমারের ভাই-বোনেরা সাহিত্যরুচি লাভ করেছিলেন প্রথমত মায়ের সূত্রেই। শিল্পী শানু লাহিড়ীর স্মৃতিচারণে :
মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। পড়ার খুব ঝোঁক। খাটের তলায় নিয়মিত পড়তেন, লিখতেন। প্রচুর বই। বাংলা বই, ইংরেজি বই। বলতে কি প্রথম জীবনে সাহিত্যপ্রীতি মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। মা এতো সাহিত্যপাঠ করতেন, আলোচনা করতেন যে আমরা সেই সময়েই অনেক ভারি ভারি জিনিষ জেনে গিয়েছিলাম।

সাহিত্য, ধর্ম ও পুরাণের সাথে সম্পৃক্তি ঘটে এ শৈশবেই। প্রতিদিন ভোরে রেণুকাময়ী একপাশে কমলকুমার, একপাশে নীরদ মজুমদারকে রেখে স্তোত্র গাইতেন, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী পড়ে শোনাতেন, এমনকি মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) মেঘনাদবধকাব্য (১৮৬১) পড়ে শোনাতেন। শানু লাহিড়ী সাক্ষাৎকারে বলেছেন:
ছোটবেলা থেকে পলাশীর যুদ্ধ, রামায়ণ, গোরা, পথের দাবী, মেঘনাদবধ এমনি সব ভারি বইয়ের আলোচনা শুনেছি আমি।

কমলকুমার তাঁর চরিত্রের বিপরীতমুখি দুইধারা একদিকে সূ রুচিবোধ ও শৈল্পিক অভিরুচি অন্যদিকে উদ্দামতা, খামখেয়ালিপনা, উৎকটতার সাথে চরিত্রের স্বাধীনচেতা, অনমনিয়তা পেয়েছিলেন মা বাবার সূত্রেই। মা চাইতেন ছেলেরা  শৈল্পিক অভিরুচি নিয়ে বড় হোক। চরিত্রবান হোক। বাবা চাইতেন ছেলেরা তাদের খুশিমত বড় হোক। একেবারে শৈশবেই কমলকুমারের বেপরোয়াপনাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন পিতা। চেয়েছেন সন্তান আপনার মত বড় হোক :
মা একটু রাগি ছিলেন, বাবা সবসময় ছেলেদের সেভ করতেন। দাদাকে তো কতবার বাঁচিয়েছেন বাবা। একদিন দাদা কতকগুলো মেয়ের ছবি, ন্যুড নয় তখন ন্যুড খুব একটা বেরুতো না সিনেমার পত্রিকায়। অমনি কতকগুলো ছবি রান্নাঘরের ঘুলঘুলিতে রেখেছে সেঁটে। মা তো রেগে আগুন। দাদার চরিত্রের অধোগতি দেখে এলোপাতাড়ি মারে আর কি! বাবা সেই সময় অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। বললেন, ওগুলো আমি সেঁটেছি। ওগুলো আমার। বাবা চাইতেন ছেলেরা নিজের খুশিমত বড় হোক। মা চাইতেন ছেলেরা চরিত্রবান হোক।

কমলকুমাররা ব্লকমন স্ট্র্রিটের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন তার উপরের তলায় রুচিবান ধনাঢ্য কেউ একজন থাকতেন। সে ঘরে তৎকালীন বিখ্যাত লেখক লেখিকারা আসতেন, সাহিত্য সভা হত। মহিলার সাহিত্য সংগ্রহও ছিল বিশাল। তাছাড়া, তিনি ঐ সময়ের বিখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্র পত্রিকাও রাখতেন:
আমরা যে ঘরের এক তলায় থাকতাম তার ওপরের তলায় উত্তর পাড়ার এক মহিলা, রাণী রাসমনির বাড়ির কেউ, ঐ মহিলা থাকতেন, বাড়ির মালিক। আমরা ওপরের মা বলতুম। চিরকাল ওপরের ‘মা’ বলতাম। ওপরের বাড়িতে সে যুগের সমস্ত লেখক, লেখিকারা আসতেন। মহিলা লেখকরা আসতেন। রাধারাণী দেবী আসতেন। ওপরের কাকা খুব বিলিতি ম্যাগাজিন পড়তেন। দাদা খুব সেই ম্যাগাজিন দেখতেন।

এ-বাড়ির সূত্রেই কমলকুমার বালক বয়সেই সে যুগের বিখ্যাত বিখ্যাত লোকদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন। কমলকুমারের মনে সে বয়সের স্মৃতি আজীবন জাগরুক ছিল:
ছেলেবেলাতে আমাদের ব্লকম্যান স্ট্রীটের বাড়িতে, আমরা নিরূপমা দেবী, সরলা দেবী, শরৎ বাবু বহু গণ্যমান্যকে আসিতেন দেখিয়াছি তাহাদের প্রণাম করিয়াছি। তখনকার এই সকল জমায়েত স্মৃতি এবং ঐ সমালোচনা ও লেখা পাঠ আমাদের সর্বসময় জাগাইয়া রাখিয়াছে।

৭/৮ বৎসর বয়সে কমলকুমার ও ভাই নীরদ মজুমদার চব্বিশ পরগণা জেলার বিষ্টুপুর ‘শিাসংঘে’ ভর্তি হন। কমলকুমার তাঁর শিক্ষাজীবনেও শৈশবের মতোই উছৃঙ্খল বেপরোয়া কিন্তু মেধার পরিচয় প্রদান করেন। স্কুল পালানো, শিক্ষকের সাথে বেয়াদবি, মারামারি, বাবার হাতের লেখা নকল করে ছুটি নেয়া সবই করেছেন। কিন্তু পড়াশুনায় সর্বত্রই রেখেছেন অসাধারণ মেধার ছাপ। ছোটবোন চিত্রশিল্পী শানু লাহিড়ীর ভাষ্যে :
দাদাদের বয়স তখন ৭/৮ বছর। তখন থেকেই পুলিশের এক ভদ্রলোকের স্ত্রীর কাছে ফ্রেঞ্চ শিখতো। স্কুলে থাকতো না প্রায়ই, পালিয়ে আসতো। খুব বদমায়েস। দুষ্টুমি করতো সবসময়। একবার কি কারণে বোর্ডিং -এ সুপারকে মেরেছিল খাবার টেবিলে। ছুটে আসতে আসতে খাবার টেবিলের সমস্ত খাবার, কাঁচের প্লেটগুলো ছুঁড়তে ছুঁড়তে এসেছিল। সেই স্কুল ছাড়লো। তারপর ক্যাথিড্রাল মিশন স্কুল। সেখানেও এক ইতিহাস। রোজ রোজ বাবার নামে নিজে লিখে চিঠি দিত, স্কুল পালাত। ... তখন দাদা সেভেন কি এইটে পড়ে। তারপর স্কুল ছাড়িয়ে বললেন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টের কাছে যাও। এক্সপার্ট তো প্রথম দিনেই বললেন এতো অলরেডি এক্সপার্ট। তারপর সেটাও ছেড়ে ঢুকলেন ভবানীপুর টোলে।

এই ভবানীপুর টোল কমলকুমারের জীবনে প্রচণ্ড ছাপ ফেলে। কমলকুমারের জীবনে যে ভগবৎ সাধনা, ব্রাহ্মণ্যচেতনার পরিচয় পাওয়া যায় তার সূচনা এ সংস্কৃত টোলে। মা ঠাকুমার প্রভাবে শৈশবেই কমলকুমার ভগবৎ সাধনার দিকে ঝুঁকেছিলেন। এ টোলে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। মাথা ন্যাড়া করে, টিকি রেখে ধর্ম, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য পাঠ করেন। এ সময়কার কথায় শানু বলেছেন :
একদিন দু’ভাই টোল থেকে ফিরে এল ন্যাড়া মাথা, টিকি রেখে। সবাই বলে কি ব্যাপার বাবা মা কেউ মারা গেছেন নাকি। বাবা মাও অবাক। দাদারা বললেন, টোলে পড়লে অমনি টিকি রেখেই পড়তে হবে। দেখ কাণ্ড। অনেকদিন সংস্কৃত পড়ে দু’ভাই।   তারপর লেখাপড়ার পাঠ চুকলো।

লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কমলকুমার পৃথিবীর বৃহত্তর পাঠশালায় নাম লেখান। শৈশবে মায়ের সাথে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন, বাবার সাথে হিমালয়। ভাই নীরদকে নিয়ে সাইকেলে অনেক দূর। ১৯৩৪ সালে মুঙ্গেরে ভূমিকম্প হলে নীরদকে নিয়ে রিলিফ টীমের সাথে যাত্রা করেন। এ ভূমিকম্পে মানুষের দুর্দশা কমলকুমার অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। এ ভূমিকম্পের বর্ণনা কমলকুমার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা উষ্ণীশ প্রথম সংখ্যায় ছেপেছিলেন। সে বছরই মামাবাড়ি লক্ষ্মৌ আসেন। লক্ষ্মৌ এক বছর ছিলেন। এখান থেকে পরে মুলতান যান। মুলতানে মদ, নিষিদ্ধ পাড়ায় গমন এ সকল অভিজ্ঞতা লাভ করেন। পরের বছরই ১৯৩৬ সালে রাজশাহিতে বেড়াতে আসেন। রাজশাহির খেতুরির মেলায় আউল বাউলদের সাথে মেশেন। পদ্মার তীরবর্তী অঞ্চলের চাষা মেটেদের সাথে মেশেন। লোককথা, লোকছড়া, বাউলদের শব্দের গূঢ়ার্থে ব্যবহার ল করেন :
এখানে দেখিয়াছি বঙ্গের সর্বত্র হইতে লোক আসিত এবং শব্দ লইয়া আলোচনা হইত। ইস্টিমারের ঢেউ, টেলিগ্রাফ, একমণ (ওজন), স্কুল, আবার কত না গঞ্জ শহরের নাম আসিয়াছে ক্রমাগত সাটে পরিবর্তিত হইতেছে।

তারুণ্যের এ-সময়টা কমলকুমার ভ্রমণ, পত্রিকা সম্পাদনা, নাট্য পরিচালনা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকেন। এসময়ই কাঁচা হাতে লালজুতো, মধু, প্রিন্সেস ছোটগল্প রচনা করেন। এ রচনাগুলোতে কমলকুমারের স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি।

যৌবনের সূচনায় কমলকুমার জাহাজে এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট, মাছের ভেড়ি, ডি. ডি. টি. প্রভৃতি ব্যবসা আরম্ভ করেন। এ সকল ব্যবসায় তিনি সাময়িক সাফল্যও লাভ করেন। হাতে আসে কাঁচা টাকা। এ টাকায় কমলকুমার চূড়ান্তভাবে বেহিসেবি, বিলাসী হয়ে ওঠেন। পোশাকে-আশাকে, চলাফেরায় একেবারে অভিজাত বাবু। এ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন শানু :
পোশাকে-আশাকে দাদা ছিলেন ভীষণ বাবু, স্মার্ট। মার্শেল স্মিথ বলেন যে, জিন্নার পর ভারতবর্ষে এত ওয়েল ড্রেসড ভারতীয় আর দেখেননি। এ সময় প্রচুর টাকা আয় করতেন। আমার দিদির বিয়ের সমস্ত খরচটাই দিয়েছেন দাদা। কত যে ব্যবসা করেছেন তার হিসেব নেই। ডি. ডি. টি. এক্সপোর্ট, ইমপোর্ট, মাছের ভেড়ি, কতকিছু।

চার্লস বার ছিলেন কমলকুমারের প্রিয় অভিনেতা। তখন তিনি কথাবার্তায়, চালচলনে অনুকরণ করতেন বারকেই। এ সময়ই কমলকুমার চলচ্চিত্র, সংগীতের প্রতি মনোযোগী হন। কিন্তু, কমলকুমারের স্বছল ও এ বাবুভাব বেশিদিন টেকেনি। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তার ঢেউ এসে লাগে কলিকাতায়। ১৯৪১ সালে জাপানি বোমার ভয়ে কমলকুমার পরিবারের সাথে রিখিয়ায় যাত্রা করেন। এ রিখিয়ার প্রভাব কমলকুমারের জীবনে অপরিসীম। এ রিখিয়ার পটভূমিতেই কমলকুমার রচনা করেন পিঞ্জরে বসিয়া শুক (১৩৭৬) উপন্যাস। এছাড়া অসংখ্য ছোটগল্পে রিখিয়ার পরিবেশ পটভূমি ছড়িয়ে আছে। রিখিয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে দয়াময়ী মজুমদার লিখেছেন :
এটি সাওতাল পরগণায়। জায়গাটা  বিহারের অন্তর্গত। শাল মহুয়ার জঙ্গল আর কোথাও কোথাও ইউক্যালিপটাসের সারিও দেখা যেত। ছোট বড় টিলা এবং পাহাড়। কিছুদূরে ছিল চিলকা হ্রদ। সর্বত্রই লালমাটি খুবই ভাল।

এ পরিবেশেই কমলকুমার আবিষ্কার করেছিলেন সুঘরাইকে, আর চেঞ্জারে আসা মনিবপতœী ও তাদের বাবু লোকজনদের। রিখিয়া এ সময় কলিকাতার অভিজাত অনেক জ্ঞানীগুণীজনদের সমাবেশে পরিণত হয়েছিল। তখনকার প্রতিষ্ঠিত কবি বিষ্ণু দে থেকে তরুণ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সকলই রিখিয়ায় এসেছিলেন। রিখিয়ায় তখন গড়ে উঠেছিল এক শিল্পীসংঘ। কমলকুমারের গৃহ অঙ্গনে গড়ে ওঠে প্রোগৃহ। কমলকুমার নিজেই দেন ক্যাফে দ্য রেকিও নামে একটি রেঁস্তোরা। সাহিত্যচর্চা, নিত্য আড্ডা আর শরণার্থীদের হৈ হুল্লোড়ে ভরে ওঠে রিখিয়া। কমলকুমারের বোন গীতা ও প্রতিবেশী দয়াময়ী মিলে এখানে প্রকাশ করেন দেয়াল পত্রিকা। সে সূত্রে কমলকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় দয়াময়ী মজুমদারের যা প্রেম থেকে পরিণয়ে পরিণত হয় ১৯৪৭ সালে।

কমলকুমার এখানেই পরিচিত হন সাঁওতাল গরীব দুঃখী মানুষজনদের সাথে। সাঁওতাল ব্রাত্যজনেরা তাকেই স্বচ্ছল মানুষ বলে জানে যে বর্তনে খায়, বালিশে ঘুমায়। এ পরিবেশে চেঞ্জারে আসা বাবু লোকজনদের সামনে ছেড়াগেঞ্জি গায়ে, পাখি হাতে দাঁড়ায় পিঞ্জরে বাসায় শুক -এর সুঘরাই।

কমলকুমার এ-সময় (১৯৪১) এফ এ পাশ করেন এবং পরের বছর ১৯৪২ সালে কলিকাতায় আসেন কর্মানুসন্ধানে। কলিকাতায় কমলকুমারের আসা ও কর্মানুসন্ধানের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য :
আমি এখন কলিকাতায় একা! কলিকাতায় পাঠ চুকিয়া গিয়াছে। ... সকলে রিখিয়ায় আমি রিখিয়া হইতে এখানে (Misore Road) বাতাসাকের বাড়ির পিছনে তিনতলায় এক ঘর ভাড়া করিয়া থাকি - বাতাসাকই ঠিক করিয়া দেয়, রান্নার পাঠ তখন নাই। ম্লান করিয়া কর্মানুসন্ধানের পথে খাওয়া সারিতাম নিজামে।  

কিন্তু কমলকুমার মজুমদার তেমন কোনো কাজ পান নি। বেকার কমলকুমার এ সময় শিল্পসাহিত্যের আড্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ সময় পুরোটাই কাটে আড্ডায়। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজ, খালাসীটোলার মদের দোকান, চিত্তরঞ্জন এভিন্যুর কফি হাউজ, পরিতোষ সেন, বিষ্ণু দে প্রমূখ চিত্রশিল্পী কবিদের বাড়ি, সিগনেট প্রেস এবং শেষদিকে চতুরঙ্গ, সুবর্ণরেখা  অফিস।

কমলকুমার এ সময় নিজের শিল্পমাধ্যম স্থির করতে পারেন নি। চিত্রকলা, নাটক, সংগীত, সাহিত্য বিচিত্র মাধ্যমে বিচরণ করছেন। এ ধারার সমসাময়িকদের সাথে আড্ডায় মিথস্ক্রিয়া করছেন। সবগুলো মাধ্যমের লোকজনের আড্ডায় তিনি মধ্যমনি:
১৯৪২ - ৪৩ সাল থেকে আমাদের আড্ডা সন্ধে  বেলায় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে বসা শুরু হল। ... আড্ডার নাটের গুরু ছিলেন কমলকুমার মজুমদার।

কফি হাউজের আড্ডার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল চলচ্চিত্র। এ আড্ডায় একত্রিত হতেন সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, পৃথ্বীশ নিয়োগী, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এ আড্ডা থেকেই ১৯৪৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। এ সোসাইটির উদ্যোগে ঘরে-বাইরে ছবি করার পরিকল্পনা করা হয়। পরিচালক হওয়ার কথা ছিল হরিসাধন দাশগুপ্তের এবং সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্যের। কমলকুমার শিল্পনির্দেশক :
‘ঘরে বাইরে’ ছবির পরিকল্পনা হচ্ছে জেনে কমলবাবু মেতে উঠলেন। চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে আর কমলবাবু ডিটেল যুগিয়ে যাচ্ছেন।

কমলকুমারের চলচ্চিত্র নিয়ে পরিকল্পনা ছিল ব্যাপক। এ সময় তিনি ছবি পরিচালনার কথা ভেবেছেন, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা চলচ্চিত্র (১৯৫০) প্রকাশ করেছেন :
কমলবাবুর নিজেরও ফিল্ম করার ইচ্ছে ছিল। সম্ভবত কোনো কোনো বিশেষ কাহিনীর চিত্ররূপ তিনি কল্পনা করতে ভালবাসতেন। দুটি কাহিনীকে আশ্রয় করে কিছুসময় ও চিন্তাও তিনি ব্যয় করেছিলেন। সে দুটি হল শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’। দুটিরই জন্য নাকি দু’হাজারের উপর ফ্রেমস্কেচ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে ‘অভাগীর স্বর্গ’র জন্য করা খান পঞ্চাশেক স্কেচ আমাকে দেখিয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালে ফরাসি চিত্রকর আগুস্ত রেনোয়ার পুত্র দ্য রিভার খ্যাত জঁ রেনোয়া কলিকাতায় ঐ ছবির শ্যুটিং করতে এলে কমলকুমার তাঁকে ছবির বিষয়ে, ভারতে লোকশান নির্বাচনের বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন, উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি রেনোয়াকে বলেছিলেন :
বাংলাদেশে ছবি করতে হলে হোটেলে থাকলে চলবে না। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, রাস্তাঘাটে ঘুরতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, একপেট খেয়ে গরমকালে বটগাছের ছায়ায় ঘুমোতে হবে, জলে ভিজতে হবে, গঙ্গার রূপ দু’চোখ ভরে দেখতে হবে।
কিন্তু ১৯৫৫ সালে বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে এবং একই সাথে সুনাম অর্জন করলে কমলকুমার চলচ্চিত্র থেকে হঠাৎ একেবারে সরে আসেন। ছবিটি দেখার পর এমনকি সত্যজিৎ রায়ের সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ করে দেন :
১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাবার পর অনেকবার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও কমলবাবুর মনে ছবিটি দেখা সম্বন্ধে কোন উৎসাহ সঞ্চার করতে পারিনি। ... শেষে একদিন যখন সত্যিই দেখলেন, তখন হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন।

চলচ্চিত্রে সত্যজিতের প্রতিষ্ঠা ও কমলকুমারের সরে আসার ঘটনার মধ্যে দিয়ে কমল মনের গভীর কূটৈষার (পড়সঢ়ষবী) দিকটি ধরা পড়ে।

চলচ্চিত্রে সত্যজিতের প্রতিষ্ঠা কমলকুমারকে ঈর্ষান্বিত করেছিল বলে আমাদের মনে হয়। সত্যজিৎ রায়কে এমনিতে তিনি আড়ালে ঢ্যাঙাবাবু বলে ডাকতেন, এমনকি একদিন সত্যজিৎ উপযাচক হয়ে কথা বলতে গেলে কমলকুমার তাঁকে অপমানসূচক উত্তর দেন :
আগে প্রায় সাক্ষাৎ হত; কোন একটা বিশেষ কারণে দীর্ঘকাল ছেদ পড়ে। ভদ্রলোককে দেখে অসুস্থ মনে হওয়াতে জিগ্যেস করলাম কী হয়েছে। বললেন হাঁপানি। তা জন্য কী করেন জিজ্ঞেস করতে বললেন- রাত্তিরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। প্রশ্ন করলাম চিকিৎসে করান না ? কমলবাবু বললেন- না সাফরিং এর মধ্যে একটা গ্র্যাঞ্জর আছে।

সত্যজিৎ বিশেষ কারণে সম্পর্কচ্ছেদের কথা বললেও আমরা বুঝতে পারি কারণটি কি। কারণটি সত্যজিৎ পূর্বের উদ্ধৃতিতেই বলেছেন - ‘কমলকুমার ছবিটি দেখার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেন’। সত্যজিতের চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠায় কমলকুমার বুঝেছিলেন এ পথ তাঁর নয়। তাঁর মাধ্যম ভিন্ন, স্বাতন্ত্র্যের, একক প্রতিষ্ঠার। কিন্তু অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯) উপন্যাস প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত কমলকুমার নির্দিষ্ট কোনো শিল্প মাধ্যমে স্থির হতে পারেন নি। এসময় তিনি নাট্যচর্চা ও চিত্রকলায় মনোনিবেশ করেন। চিত্রকলা ও ক্রাফট্সের শিক হিসেবে যোগ দেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। যদিও সচেতনভাবে চিত্রশিল্পী হওয়ার কোনো  ইচ্ছা তাঁর ছিল বলে মনে হয় না।

সত্যজিতের পথের পাঁচালী মুক্তি ও কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রা প্রকাশের পর কফি হাউজে কমল সত্যজিৎ আড্ডা ভেঙে যায়। এরপর খালাসীটোলার মদের আড্ডায় কমলকুমার নিয়মিত হয়ে ওঠেন। তখন পাণ্ডিত্যে জ্ঞানের গভীরতায়, শিল্প সাহিত্যের অড্ডায় তাঁর ঈর্ষণীয় দখল :
খালাসীটোলার সেরা আকর্ষণ ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। তাঁকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল শিল্প মনস্ক অথচ নানান বয়েসী নানান মেজাজের মানুষের সেই যৌথ পরিবার।

এই খালাসীটোলায় তৎকালীন কলিকাতার শিল্প সাহিত্যের বিখ্যাত অখ্যাত সবাই আসতেন। কিন্তু কমলকুমারই এ খালাসীটোলাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। মূলত তাঁর জন্যই খালাসীটোলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে:
বস্তুত স্বর্গীয় ও আরাধ্য কমলকুমার মজুমদারের জন্যই খালাসীটোলা বাংলা সাহিত্যে এল খ্যাত হল।

খালাসীটোলা কমলকুমারের জন্য বিখ্যাত হলেও কমলকুমার এখানে বেশিদিন আড্ডা দেন নি। খালাসীটোলার আড্ডা ভেঙে যাওয়ার পর কমলকুমারের আড্ডাগুলো মূলত হয়ে ওঠে সাহিত্যকেন্দ্রিক। চতুরঙ্গ পত্রিকা অফিস ও সুবর্ণরেখা প্রকাশনা সংস্থা কেন্দ্রিক। এর আগে সিগনেট প্রেসের মালিক দীলিপকুমার গুপ্তের বাড়িতেও আড্ডা বসেছিল। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাট্যদল হরবোলা। এহরবোলাকে কেন্দ্র করে কমলকুমার নাট্যপরিচালনায় অনেকদিন জড়িয়েছিলেন। কিন্তু ও নাটকেও স্থির হন নি। ততোদিনে তাঁর বেশকিছু ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে এবং সাহিত্যেও তাঁর প্রতিষ্ঠাভূমি তৈরি হতে শুরু করেছে। তখন তাঁর আড্ডাগুলো মূলত হয়ে ওঠে সাহিত্যকেন্দ্রিক। এ আড্ডাগুলো জমতে থাকে চতুরঙ্গ ও সুবর্ণরেখায়। সর্বশেষ ১৯৫৯ সালে নহবৎ শারদীয় সংখ্যায় অন্তর্জলী যাত্রা প্রকাশিত হলে সাহিত্যে কমলকুমারের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠাভূমি নিশ্চিত হয়ে যায়।

কমলকুমার তাঁর সমকাল, সমকালের প্রত্য কল্লোল ও কোলাহল দ্বারা যতটা না প্রভাবিত হয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন পরো তথা অধীতবিদ্যার মাধ্যমে। কমলকুমারের একাডেমিক পড়াশুনা যতই হোক না কেন, তার অপ্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে সমকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

লোকনাথ ভট্টাচার্য, অশোক মিত্রের মতো পণ্ডিতজন তো বটেই বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দের মতো বিশ্বসাহিত্যের পাঠকরা পর্যন্ত তার পঠনবিশ্ব সম্পর্কে বিস্ময় জ্ঞাপন করেছেন। অশোক মিত্র সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
প্রশ্ন : কমলকুমারের শিাগত যোগ্যতা এমন কিছু ছিল না। তিনি কি কুণ্ঠিত হতেন আপনাদের মত উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের সাথে মিশতে ?
 উত্তর : তাঁর মতো শিক্ষিত মানুষ আমি দেখিনি। তাছাড়া তার কতদূর পড়াশুনা কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। করার দরকার মনে হয়নি। ফরমাল এডুকেশন বেশি ছিল না, কিন্তু তিনি জানতেন না কী ?
    ... কমলবাবু জিনিয়াস। অসাধারণ পাণ্ডিত্য এমন মানুষ কয়েকটিই দেখেছি। দু’একজনকে দেখেছি। তার সঙ্গে তর্ক করতে যাবে এমন সাহস কার আছে এমন পাণ্ডিত্য।

কমলকুমার শৈশব থেকেই ফরাসি ভাষা শিখেছিলেন, টোলে শিখেছিলেন সংস্কৃত। এছাড়া ইংরেজি, বাংলা ভাষায় দতা তো ছিলই। সংস্কৃত ও বাংলা জানার কারণে ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্য পাঠের দ্বার অবারিত হয়েছিল। এবং ফরাসি ও ইংরেজির কারণে বিশ্বসাহিত্য। কিন্তু, কমলকুমারের এ বিশাল পঠনবিশ্বের বিস্তৃত বর্ণনা কোথাও আমরা পাই না, মাঝে মাঝে বিভিন্ন রচনাকর্মের উল্লেখে ক্ষীণ আলোকিত হই। তবে, শেষ বয়সে নির্বাচিত বই শিরোনামের একটি রচনায় তার প্রিয় বই ও ব্যক্তিদের সংপ্তি বর্ণনা দিয়েছিলেন। এ তালিকাটি কমলমানস উপলব্ধির জন্য জরুরি। অন্যান্য রচনার মতো ‘মাধবায় নম’ ‘তারা ব্রহ্মময়ী’ বলে রচনার সূচনা। রামকৃষ্ণ ও রামপ্রসাদ ভক্তি, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগরের ভাষা তথা কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত ভালোলাগার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। কমলমানস গঠনে স্বস্তিবচন, রামকৃষ্ণ, কেশব চন্দ্র, রামপ্রসাদ ভক্তি প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার দাবি রাখে।

কমলকুমার তাঁর প্রথম সার্থক উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রার ভূমিকাতে লিখেছেন :
এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের। রামপ্রসাদ আমাদের শুদ্ধ মন আনিয়া দেন।
খেলার প্রতিভা উপন্যাসের সূচনায় লিখেছেন :
মাধব যে তুমি মহাপ্রভুতে, মাগো যে তুমি বর্গভীমা, ঠাকুর জয় রামকৃষ্ণ। যে এখন আমরা এখানেতে নিজেরে বিস্তারিব; যাহা ঘটিল, তাহারে নির্মাণ করি; এবং এই অভিমান ভূয়া না হউক, যে মানে, আমাদের বোধিত হনের যেমন ধারা, যেমন প্রকৃতি, যেমন উপাদান, যেমন ভিৎ তাহা এইটিতে উল্লেখিত থাকিবেক; যে আমরা হই অতীব সরল, যেইটি হয় আমাদের সব।

রচনার শীর্ষে এই স্বস্তি বচন, মা তারাময়ী বন্দনা, কিংবা রামকৃষ্ণের প্রতি ভক্তি সাহিত্যে প্রভূত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কমল সমালোচক তাঁকে পৌত্তলিক বলে আখ্যায়িত করেছেন:
... ভারতীয় পৌত্তলিক চেতনা কমলকুমারের রচনায় চালিকাশক্তি। কমলকুমারের চৈতন্য ও রামকৃষ্ণের আস্থা এবং হিন্দুত্বের ধারণার কেন্দ্রবিন্দু এই পৌত্তলিক জীবন দর্শন।

নবনীতা দেবসেন কমলকুমারের ভাষা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং এ চর্চাকে প্রায় বাতুলতা বলেছেন। কিন্তু, তিনি ভাষাকে নষ্ট করার জন্য নয়, ভাষার মাধ্যমে কমলকুমার যে ভাব ব্যক্ত করেছেন তাকে বলেছেন প্রতিক্রিয়াশীল :
বাংলা ভাষার গায়ে আলতো ঢিল ছুঁড়ে কমলকুমার কোনদিন বাংলা ভাষার তি করতে পারবেন না। কিন্তু তার ভাষার অন্তরালে যে ভাবধারাটি প্রবাহিত, যে মূল্যবোধ নিহিত, তা সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক হতে পারে। কারণ সেক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাটি প্রগতি বিদ্বেষী ইতিহাসবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল।

কিন্তু এতদিনের কমলকুমার-চর্চায়, কমল রচনা পাঠে একথা প্রতিনিয়তই প্রতিভাত হচ্ছে সমালোচকদের এ অভিমত অনেকটাই খণ্ডিত। আমাদের বিবেচনায় কমলকুমারের এ   স্বস্তিবচন লেখা, রামকৃষ্ণ বা তারাময়ীর নাম নেয়া অনেকটাই নতুন সাহিত্য সংরূপ নির্মাণের প্রয়াস। এর সাথে চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকতে পারে মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রকরণ বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের বা রোমান্সধর্মী প্রণয়োপাখ্যানের কবিগণ কাজের শুরুতে দেবী বা আল্লাহ, নবী, পীর ফকিরের নাম বন্দনা করেছেন। চর্যাপদেও এ ভণিতা দুর্ল নয়। এ হিসেবে কমলকুমারের গদ্য রচনায় নতুন রূপে এ ঐতিহ্য গ্রহণ অস্বাভাবিক নয়।

অপরপক্ষে, বাংলা সাহিত্য পশ্চিমা সাহিত্য বিশেষ করে, ইংরেজি সাহিত্য প্রভাবিত যে আধুনিকতার সূচনা ও বিকাশ, কমলকুমার তার ঘোর বিরোধী ছিলেন:
কমলকুমার মনে করেন যে ভারতবর্ষে ইংরেজ আগমন, উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক নবজাগরণে বাংলাদেশ তিগ্রস্থ হয়েছে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তিকর জীবনযাত্রার প্রতিবাদে তিনি গ্রহণ করেছেন রামপ্রসাদ, ঠাকুর রামকৃষ্ণ ও বঙ্কিমের ধর্মবোধকে; রামপ্রসাদ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ লোকায়ত জীবন চর্চায় প্রজ্ঞামথিত অভিজ্ঞতায় তিনি আলোড়িত।

পশ্চিমা, বিশেষত ইংরেজি উপন্যাসতাত্ত্বিক ও তত্ত্বকেও তিনি অপছন্দ করতেন। উপন্যাসতাত্ত্বিক ই. এম. ফরস্টার কমলকুমারকে চিঠি লিখলে তিনি গুরুত্ব দেন নি। তাঁর সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছেন :
একবার এখানে মি: ই. এম. ফ্রসটার এক লেখকের বাড়িতে আসেন। কালীঘাটের পাণ্ডার মতন তখনকার লেখকদের দেখি ফিরিঙ্গি ধরিতে। আমরা কহিলাম ঐ লেখককে যাহার গৃহে ঐ ইংরেজ লেখক আসেন, মহাশয় উহাকে কি প্রশ্ন করিবেন, রবিবাবুকে কেন তামাশা করিয়াছেন - এবং উনিই বা নিজে কি পদের লেখক ... উহারা ভাবে ইংরাজই সব।

একথা ঠিক, প্রবল স্বাতন্ত্র্যবোধ, ইতিহাস ঐতিহ্য সচেতন, শেকড়চারী কমলকুমার ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসন ও শিল্প-সংস্কৃতিতে পশ্চিমা আধুনিকতা পছন্দ করেননি। সেজন্য ভারতীয় লোকায়ত ঐতিহ্য-প্রয়াসী কমলকুমার স্বভাবতই রামমোহন পূর্ববর্তী বাংলা শিল্পসাহিত্য উত্তরাধিকারকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছেন এবং সে ঐতিহ্যকে সাহিত্যে পুনর্জাগরণের চেষ্টা করেছেন। এ পুনর্জাগরণের পুননির্মাণের একটি অংশ হতে পারে এ স্বস্তিবচন, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ।

রামমোহন থেকে কল্লোলের কোলাহল পর্যন্ত যে বাংলা সাহিত্য তা মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতিশাসিত। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ত্রিশের কবি ও ঔপন্যাসিকবৃন্দ যে পথ বেছে নিয়েছিলেন কমলকুমারের পথ তাঁদের থেকেও ছিল ভিন্ন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্র উপন্যাসের উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের স্থানে কমলকুমার প্রান্তিক ব্রাত্যজন, রবীন্দ্রনাথের নিরাকার পরমব্রহ্ম, জীবনদেবতার স্থানে কমলকুমার মা আনন্দময়ীকে বেছে নিয়েছিলেন। ত্রিশ দশকের কবি, ঔপন্যাসিকরা রবীন্দ্র বিরোধিতায় যেখানে ঈশ্বরকে অস্বীকার, অস্তির স্থানে নেতিকে গ্রহণ করেছেন, কমলকুমার সেখানে করেছেন বিকল্প শক্তি গ্রহণ। এক্ষেত্রে কমলকুমার গ্রহণ করলেন লোকায়ত সংস্কৃতি, জীবনবোধ ও ধর্মচেতনাকে। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে কমলকুমারের স্বাতন্ত্র্য তুলনারহিত, একক, অদ্বিতীয়, বিতর্কে কণ্ঠকাকীর্ণ নিঃসঙ্গ নির্মাণ।

কমলকুমার তাঁর জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। আড্ডায়, পাণ্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা, পরচর্চায় ও নতুন নতুন কাহিনী সৃষ্টিত তিনি নিজেই কাহিনী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্প পর্যায়ে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ, সমকালীন কবি বুদ্ধদেব বসু থেকে অনুজপ্রতিমদেব নিয়েও তিনি ঠাট্টা রসিকতা করতেন। কিন্তু আড়ালে যাকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করতেন দেখা গেল কাজের ক্ষেত্রে তিনি তাকেই সম্মান করছেন। সামনে এলে সম্মান করে কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলেছেন:
... আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল যেমন আর কোন মানুষের মধ্যে দেখিনি।

রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ‘বেম্মো’ বলে অবজ্ঞা করতেন। অথচ শানু লাহিড়ী বলেছেন কমলকুমার প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে মঞ্চায়ন করেছেন :
তিনি রামকৃষ্ণ বলেই ব্রাহ্মদের বিরোধী, যে কারণেই রবীন্দ্রনাথকেও বেম্মো বলে অবজ্ঞা দেখান, অথচ মুক্তধারা অভিনয়ের সময় তিনি স্থির করেছিলেন একটি শব্দ ও বাদ বা বদল করা চলবে না।

সত্যজিৎ রায় ছিলেন কমলকুমারের অন্যতম বন্ধু, গুণগ্রাহী। তাঁরা দু’জনে মিলে ফিল্ম সোসাইটি করেছেন, ছবি পরিচালনার পরিকল্পনা করেছেন। সত্যজিৎ ব্রাহ্ম হওয়ায় হিন্দুদের অনেক সংস্কৃতি সংস্কার জানতেন না। পথের পাঁচালী তৈরির সময় বল্লালী বালাই ইন্দিরা ঠাকুরণ চরিত্রে সে হিন্দু সংস্কারগুলো আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন, ডিটেল যুগিয়েছেন। অথচ, আড়ালে তিনি সত্যজিৎকে ঢ্যাঙাবাবু ডাকতেন। পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার পর দেখতে পর্যন্ত নারাজ ছিলেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্র নিয়ে যখন বিশ্বব্যাপী মাতামাতি তখন কমলকুমার তার চলচ্চিত্র জ্ঞান নিয়ে ঠাট্টা করেছেন। খালাসীটোলার মদের আড্ডায় উদয়ন ঘোষের সাথে আলাপচারিতায় বলেছেন :
-    কমলদা, এতযে প্রশ্ন করি আপনাকে, বিরক্ত হন না তো ?
-    আমি তো ছাত্র, উত্তর দানে ছাত্রকে কি বিরক্ত হলে চলে ?
-    আরেকটা প্রশ্ন করি ?
-    করুন, ঠাকুর।
-    ছবি আর চলচ্চিত্রে কি তফাৎ ?
-    এ প্রশ্ন তুমি ঢ্যাঙ্গাকে কর ....
-    ঢ্যাঙ্গা ?
-    ঢ্যাঙ্গা চেনো না ? তোমাদের হরবোলার মানিকবাবু।
-    কিন্তু কমলকুমার অপর কারো মুখে সত্যজিতের নিন্দা সহ্য করতে পারতেন না।
বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর সাথে তার ছিল প্রীতি-শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সুধীন দত্ত রিখিয়ায় গেলে কমলকুমারের বাড়িতেই উঠতেন। রিখিয়ায় সুধীন দত্তের জন্য অধীর আগ্রহ অতিথির জন্য ঘরদোর ঝাড়মোছার কথা কমলকুমার নিজের চিঠিতেই লিখেছেন। অথচ সুধীন দত্ত সম্পর্কে আড্ডায় বলেছেন :
বুঝলেন বাবু আপনাদের সুধীন দত্ত একটা চোর।

ত্রিশ-চল্লিশ দশকের কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্কে কমলকুমারের ধারণা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি তাঁদের পাশ্চাত্যমুখিতাকে এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞতাকে বিচিত্র স্থানে সমালোচনা করেছেন। ত্রিশের কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে এবং ত্রিশ-চল্লিশের দশকের কবিদের সম্পর্কে তাঁর ধারণার পরিচয় :
ঘটনা বলি, একদিন কয়েক বছর পূর্বে ইন্দ্রনাথের দোকানে বসিয়া আছি হঠাৎ আমাদের সে প্রশ্ন করিল কাহার কাহার মহাভারত ইংরেজিতে আছে। আমরা কহিলাম কেন? কোন ... মেটে ফিরিঙ্গি এ টুকু বলিতেই সে ক্ষিনুকণ্ঠে কহিল ‘অমুকের’ লোক দাঁড়াইয়া আছে এবং মাস কয়েক পর শুনিলাম তিনি মনোজ্ঞ মহাভারত কথা লিখিতেছেন। এরূপ আমাদের দেশীয় পণ্ডিত। ৩০-৪০ এর কবি পণ্ডিতরা ইদানিং উপনিষদ চর্চা করিতেছে ইহারা জবর প্রগতিশীল সাম্যবাদী। ইহারা আমাদের পূর্বগামী। আমরা ইহাদের নিকট কিছুই পাই নাই।

আমরা বুঝতে পারি এ মনোজ্ঞ মহাভারত কথার লেখক বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু কমলকুমারকে তাঁর বই উপহার দিলে সে বই কমলকুমার টেবিলের নড়াচড়া বন্ধ করার জন্য পায়ার নিচে রাখার কথা বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদকে বলেছেন উড়ি অনুবাদ এবং শাটুলকে দিয়ে মদ্যশালায় এ আবৃত্তি সকলকে শুনাবেন বলেছেন। অথচ বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে রেখো মা দাসেরে মনে শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধ যখন প্রেসে ছাপা হয়, তখন প্রেসে প্রুফ দেখতে গিয়ে বলেছেন, এ লেখাটি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে লেখা কোথাও যেন ভ্রান্তি না থাকে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পংক্তি থেকে নিজের ছোটগল্পের শিরোনাম রেখেছেন। হ্লোস্পদ কবিদেরও সমালোচনা করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন:
একদিন শক্তিকে (চট্টোপাধ্যায়) ইন্দ্রের দোকানেতে ধরিয়াছি, বল, বাঙলার পদ্য বল। মোটামুটি নাম বল এবং একের পর তা চর্যা হইতে বৈষ্ণব পদাবলী, রামপ্রসাদ, ঈশ্বরগুপ্ত, মধুসূদন, বলদেব। তবে শক্তি বেচারা স্বীকার করিল যে সে জানে না।

কমলকুমার রাজনীতি বিমুখ ছিলেন। অথচ রাজনীতির সকল বিষয়েই সজাগ ছিলেন। রাজনৈতিক সংকটে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মর্মস্পর্শী ভাষায় লিখেছেন পূর্ব বাংলার সংগ্রাম বিষয়ে। শোষিত, প্রান্তিকজনদের নিয়ে সারাজীবন লিখেছেন। তার বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই ছিলেন তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির। অথচ কমিউনিস্ট পার্টি ও এ সম্পর্কিত রচনার বিষয়ে তিনি অসহিষ্ণু ছিলেন। তাঁদের চরিত্র হননে তৎপর ছিলেন :
কফি হাউজের স্মৃতির মধ্যে কমলবাবুর কথার ধারের কথাটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। জনৈক বামপন্থী কবি সম্বন্ধে তার মন্তব্য হল - ভদ্রলোক সোশ্যাল কনটেন্ট না থাকলে নস্যি নেন না। চাষী মজুরদের হাল সম্পর্কে শহরের মার্কসিস্ট বাবুরা উৎকণ্ঠিত সে কথা চাষী মজুর জানে কী ? কমলবাবুর ভাষায় - ব্যাঙের একটা ল্যাতিন নাম আছে ব্যাঙ তা জানে কি ?  

কমলকুমারের এই আপাত স্ববিরোধ, চরিত্রের প্যারাডক্স ও কমপ্লেক্স -এর ভেতরই লুকিয়ে আছে কমলমানসের মূল রহস্য।
কমল জীবনীকার হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন এটা কমলকুমারের মুখোশ। সত্যজিৎ রায় লিখেছেন :
তিনি যেন অত্যন্ত সাধারণভাবেই একটি রুক্ষ অমার্জিত, আটপৌরে চেহারায় নিজেকে সবার সামনে হাজির করতেন।  

এই স্ববিরোধী, রুক্ষ অমার্জিত চেহারা কমলকুমারের জন্য অবশ্যম্ভাবী ছিল। আমাদের বিবেচনায় কমলকুমারের রচনার বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য তাঁর এ স্ববিরোধী, রুক্ষ, অমার্জিত চেহারার রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কমলকুমারের সাহিত্যে আগমন, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয়া সঙ্গত কারণেই জরুরি।

পূর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি কমলকুমারের পরিবার ছিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। শৈশবেই তাঁদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে সাহিত্য নাটক চর্চার রীতি ছিল। সে রীতিতেই তিনি শৈশবে নাটক চর্চায় জড়িত হন।

১৯৩২ সালে দুর্গাপূজায় প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করেন রিখিয়ায়। নাট্যকার ও পরিচালক কমলকুমার নিজেই। ১৯৩৭ সালে ৮, রামময় রোড, ভবানীপুর থেকে উষ্ণীষ, সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প লালজুতো প্রকাশ করেন, দ্বিতীয় সংখ্যায় মধু ও তৃতীয় সংখ্যায় প্রিন্সেস গল্প প্রকাশ করেন। আমরা জানি এ গল্পগুলো অত্যন্ত সাধারণ মাপের। লালজুতোয় ক্ষীণ হলেও অন্য দুটো গল্পে কমলকুমারের পরবর্তী রচনা সম্ভাবনার কোন ছিটেফোটাও ধরা পড়ে নি। কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রায়ন ও ভাষা সবই অত্যন্ত সাদামাটা, তরল, সমকালীন গল্পের তুলনায়ও দুর্বল।

কমলকুমার স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যে ন্যূনতম দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন নি। এমতাবস্থায়, তিনি মূলত জড়িয়ে পড়েন ব্যবসা ও চাকরির খোঁজে। কোনোটাই তাঁর হয়নি। ফলাফল অবসর আড্ডা। এ বিষয়ে পূর্বেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ সময় তিনি চলচ্চিত্র ও নাটক চর্চায় মেতে ওঠেন। সম্ভবত প্রিন্সেস ও মধু গল্পের সমকালে রচনা করেন শবরীমঙ্গল উপন্যাস। উপন্যাসটির দুর্বল গঠন, ভাষা ও গাঁথুনি তারি স্যাক্ষ বহন করে। এর কোনোটিই তাকে সাফল্য এনে দেয় নি। স্বাতন্ত্র্য মণ্ডিত হওয়া তো দূরের কথা। দীর্ঘ বিরতির পর ১৩৫৫ সালে সাহিত্যপত্র পত্রিকায় প্রকাশ করেন গল্প জল। এ জল গল্পে কমলকুমারের নিজস্বতা প্রথমে ফুটে ওঠে। এ গল্পের :
‘কানাই’ কানাই হয় তার নাম। সে ফজল মোল্লা নয় এবং যে ফজল হয় ভাল লোক পরের ধান কাটে না, কেননা খোদা তার উপর দয়া রাখেন। (জল)

গল্পের প্রথম বাক্যই কমলকুমারের উপস্থিতি আমাদের জানিয়ে দেয়। চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় এ গল্প সম্পর্কে লিখেন বাংলা গদ্যে চিত্র। তারপর প্রকাশিত হয় একে একে তেইশ ও মল্লিকা বাহার গল্পদ্বয়। জল, তেইশ ও মল্লিকা বাহার গল্প বাংলা সাহিত্যে কমলকুমারকে অনেকটা স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত করে দেয়। কিন্তু, কমলকুমার তখনও সাহিত্যে স্থির হতে পারেন নি। তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকাশ মাধ্যম খুঁজছেন। এসময় তিনি চিত্রকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাট্যদল হরবোলা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের এ সময় শিল্পকলার সবগুলো শাখাই তখন উত্তাল। বিভূতিভূষণের মৃত্যু হলেও মানিক তারাশঙ্কর এ সময় নতুন নতুন মোড় ফেরানো মূলধারার উপন্যাস রচনা করছেন। কল্লোলযুগের সকল লেখকেই প্রায় সচল, সতীনাথ ভাদুড়ী ও বনফুল লিখছেন নিরীক্ষামূলক উপন্যাস। কবিতায় জীবনানন্দসহ ত্রিশোত্তর অন্যান্য প্রধান কবি সক্রিয়। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর, যামিনী রায়, বিনোদ বিহারী। উচ্চাঙ্গ সংগীতে আলাউদ্দিন খাঁ, রবিশঙ্কর। রবীন্দ্রসংগীতে রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা বন্দোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্র। শ্যামাসংগীতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, লোকসংগীতে নির্মলেন্দু চৌধুরী, নৃত্যজগতে উদয়শঙ্কর, নাটকে শম্ভুমিত্র। দল হিসেবে বহুরূপী, গণনাট্য সঙ্ঘ ও লিটল থিয়েটার।

শিল্প সাহিত্যের এই উত্তাল সময়ে কমলকুমারের পক্ষে নতুন কিছু করা চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। চিত্রকলা, সংগীত বা নাটক তিনি সারাজীবন চর্চা করেছেন। কিন্তু সম্ভবত পেশা হিসেবে নিতে চান নি। কিন্তু পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রকেই নিতে চেয়েছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু, পথের পাঁচালীর মুক্তি ও তাঁর বিশ্বজয় কমলকুমারের এ পথকে রুদ্ধ করে দেয়, তিনি চলচ্চিত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে আসেন।

এ অবস্থায়ই প্রকাশিত হয় তার প্রথম সার্থক উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৫৯)। এ উপন্যাসটি রচনার প্রস্তুতি তিনি পূর্ব থেকেই গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে হয়। কেননা, সত্যজিৎ রায়কে ক্যানিং ঘাটে নৌকার গায়ে আঁকা চোখ ও জলের ঢেউয়ে সে চোখকে সিক্ত করার যে বর্ণনা কমলকুমার দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, তা থেকে এ প্রস্তুতি বুঝা যায়।

পূর্ববর্তী জল গল্পে কমলকুমার প্রথম স্বতন্ত্র বাংলা গদ্যের সূচনা করেন। যা পরবর্তী তেইশ মল্লিকা বাহার গল্পে সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসেই সকল দিক থেকে কমলপ্রতিভা ও নিরীক্ষার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তিনি সকল অর্থেই এ উপন্যাসে মুন্সিয়ানা, স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেন। এ উপন্যাসেই ভাষা ও ভাবের মনিকাঞ্চন যোগ ঘটেছিল এবং কমলকুমারের তৎকালীন ও বর্তমান সকল প্রতিষ্ঠার ভিত্তি এ উপন্যাস। কমলজীবনীকারের মতে :
‘অন্তর্জলী যাত্রা’ বাংলা ভাষা এবং উপন্যাসের প্রবাহে এক অভিনব সংযোজন। এই উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিরূপ মন্তব্য আর খ্যাতি অখ্যাতির নায়ক হয়ে উঠলেন কমলকুমার।

যে খ্যাতি অখ্যাতি এতদিন ছিল ব্যক্তি কমলকুমারকে ঘিরে এ উপন্যাসের কারণে তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যিক খ্যাতির নায়ক। বাংলা উপন্যাস ধারায় তার স্বতন্ত্র আসন নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তাঁর পরবর্তী ৭টি উপন্যাসসহ অন্যান্য রচনার প্রকাশ এ খ্যাতিকে আরো উজ্জ্বতর করেছে, তাঁকে আরো স্বাতন্ত্র্যিক মহিমায় মহিমান্বিত করেছে।

বাংলাদেশ সময় ১৮০০, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।