ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১১
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব

১৮. রামপালের চরমপত্র
রামপালের চিঠি নিয়ে এসেছে চার অশ্বারোহী।
    বরেন্দির সীমায় প্রবেশমাত্র ওদের বন্দি করেছে কৈবর্তসৈন্যরা।

কিন্তু ওরা সঙ্গে নিয়ে আসা  সাদা ধ্বজা দেখিয়েছে। সাদা ধ্বজা হচ্ছে সন্ধি-শান্তি-আলোচনার প্রতীক। চার অশ্বারোহী বরেন্দির সীমান্তরীদের জানিয়েছে যে, তারা মহারাজ রামপালের একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র বহন করে নিয়ে যাচ্ছে কৈবর্তরাজ ভীমের কাছে। সীমান্তরীরা বলেছিল পত্রটি তাদের হাতে দেওয়া হোক। তারাই রাজা ভীমের কাছে পৌঁছে দেবে রাজা রামপালের পত্র। কিন্তু রামপালের প্রেরিত দূতরা সম্মত হয়নি। বলেছে যে এই পত্র তাদের নিজহাতে তুলে দিতে হবে রাজা ভীমের হাতে। এটাই মহারাজ রামপালের নির্দেশ। এই নির্দেশের অন্যথা তারা করতে পারবে না। তাছাড়া তাদেরকে একথাও বলা হয়েছে যে, ভীম এই পত্র পাঠ করে যে প্রতিক্রিয়া জানাবেন, অর্থাৎ পত্রের যে উত্তর দেবেন, সেই উত্তরপত্রটিও তাদেরকেই নিয়ে যেতে হবে রামপালসকাশে। তারা এমনকি এই পত্রটি বরেন্দির সীমান্তরীদের দেখতে দিতে পর্যন্ত সম্মত নয়। আর রাজার কাছে পাঠানো পত্র সৈন্যরা পড়বেই বা কোন সাহসে! তাই তাদের চারজনকে নিয়ে আসা হয়েছে ভীমের কাছে।
    রামপালের পত্রদূতরা যথাবিহীত অভিবাদন জানিয়েছে ভীমকে। রাজকীয় শিষ্টাচার মেনে চার পত্রদূতকে অতিথিনিবাসে নিয়ে যেতে বলেছে ভীম। তাদের আপ্যায়নে যেন কোনো ত্রু টি না থাকে তেমন নির্দেশ দিয়েছে সহচরদের। চার দূতকে বলেছে বিশ্রাম গ্রহণ করতে। পত্রপাঠ করার পরে নিজের উত্তর লিখে তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে সময়মতো।
    পদ্মনাভ এবং হরিবর্মাকে ডেকে নিয়ে রামপালের পাঠানো পত্রের মোড়ক খোলে ভীম। খুবই মূল্যবান বস্ত্রে মোড়ানো একটি সুদৃশ্য ভূর্জপত্র। তাতে মুক্তোর মতো হস্তারে লিখিত রামপালের পত্র। পদ্মনাভ হাত বাড়িয়ে নিতে চান পত্রটি। কিন্তু তাকে নিরস্ত করে ভীম। সে নিজেই পাঠ করবে পত্রটি। রামপাল লিখেছে-
    “পরমসৌগত মহারাজ রামপাল কর্তৃক গৌড়-বরেন্দ্রী-পুণ্ড্রবর্ধনের অবৈধ অধিপতি ম্লেচ্ছ কৈবর্তনেতা ভীমের প্রতি প্রেরিত চরমপত্র।
    পর সমাচার এই যে, তোমার পিতা রুদোক এবং পিতৃব্য বিশ্বাসঘাতক দিব্যোকের পথ ধরে তুমি এবং তোমার সঙ্গীরা মহান পাল-সম্রাটদের জনক-ভূ বরেন্দ্রীকে অবৈধভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছ। তোমাদের কুশাসন এবং অপশাসনে রাজ্যের প্রজাবৃন্দের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
    কিন্তু তোমাদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আমি, পাল-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজাধিরাজ গোপালের অধঃস্তন বংশধর রামপাল তোমাকে এই মর্মে জানাচ্ছি যে, আমি আমার পিতৃরাজ্য পুনরাধিকারের নিমিত্তে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। আমার ইন্দ্রসেনাসম বীর সৈন্যবাহিনীর তরবারি তোমার এবং তোমার কুকর্মের সঙ্গীদের রক্তপিপাসায় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। তবু আমি রাজকীয় সদাচার অনুযায়ী তোমাকে আত্মসমর্পণের জন্য সর্বশেষ সুযোগ প্রদান করছি। তুমি যদি নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণপূর্বক আমার হাতে বরেন্দ্রী প্রত্যর্পণ করো, তাহলে আমি এবং আমার অমাত্য-পরামর্শকবৃন্দ তোমার ও তোমার পরিবারের প্রতি সর্বোচ্চ মা প্রদর্শন করতে সচেষ্ট হবো। আর যুদ্ধই যদি তোমার কাম্য হয়ে থাকে, তাহলে পত্রবাহকদের তোমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়ো। তোমার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, পত্রবাহকরা ফিরে আসার ঠিক একুশ দিবস পরে আমি তোমাদের সমুচিত শাস্তি বিধান করার উদ্দেশ্যে বরেন্দ্রী আক্রমণ করব। বীরধর্ম পালন করে আমি তোমাকে যুদ্ধের দিন-ক্ষণ জানিয়ে দিলাম। তোমার এবং তোমার বর্বর সৈন্যদের সামর্থ্য থাকলে আমার ইন্দ্রসেনাদের গতিরোধ করুক!”

পত্রপাঠ শেষে ভীম পদ্মনাভ এবং হরিবর্মার দিকে তাকিয়ে বলে- উত্তর কী হবে আপনারা তা জানেন। এ নিয়ে কী আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে?
    দুজনেই মাথা ঝাঁকায়। প্রয়োজন নেই।
    ভীম বলেÑ রামপাল তার সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি এটিকে একটি বড় সুযোগ বলেই মনে করছি। কারণ এই যুদ্ধে পরাজিত হলে রামপাল আর কোনোদিনই বরেন্দির ওপর আক্রমণ করার মতো অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে পারবে না। তার ফলে বরেন্দির নিরাপত্তা দীর্ঘদিনের জন্য নিশ্চিত হয়ে যাবে। তাই এই যুদ্ধে আমাদের জয়লাভ করতেই হবে!
    হরিবর্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ভীম- আমাদের সকল শক্তি এবং সৈন্যবিন্যাস কি একুশ দিবসের মধ্যে সম্ভব হবে?
    হরিবর্মা উত্তর করে- হ্যাঁ। সম্ভব হবে। এবং সুচারুভাবেই আমাদের শক্তিবিন্যাস করা সম্ভব হবে।
    ভীম বলেÑ এখন আপনারা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত জানান একটি বিষয়ে। তা হচ্ছে, যুদ্ধ কোথায় হবে? আমরা কি গঙ্গা পেরিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করব? না কি রামপালের বাহিনীকে গঙ্গার এপার থেকেই প্রতিরোধ করব?
    হরিবর্মা বলে- গঙ্গার এপার থেকে, অর্থাৎ নিজেদের ভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ করাটাই বেশি ফলদায়ক হবে বলে আমি মনে করি। এটি করলে আমাদের সরবরাহ-পথ মুক্ত থাকবে। আমরা দেশের ভেতর থেকে প্রয়োজনীয় যুদ্ধ-উপকরণ সরবরাহের নিশ্চয়তা পাবো।
    পদ্মনাভের দিকে তাকিয়ে ভীম জিজ্ঞেস করে- আপনার কী মত?
    পদ্মনাভ মাথা ঝাঁকান- আমিও সেনাপতি হরিবর্মার সাথে সহমত পোষণ করি।
    ভীম এবার একজন সহচরকে ডাকে। তার হাতে তুলে দেয় তীক্ষ্ণ একটি তীর। বলে- এই তীরটিকে একটি লাল রঙের কাপড়ে মুড়িয়ে রামপালের দূতদের হাতে দিয়ে দাও। বলে দাও যে রামপালের জন্য এটিই আমার উত্তরবার্তা!

১৯.অপেক্ষায় আছে যে নারী
ঘোড়া থেকে নামার আগেই চোখে পড়ে কুরমির সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর।
    মুহূর্তে পপীপের সমস্ত দেহ অবশ-বিবশ হয়ে যায়। কুরমির বিয়ে হয়ে গেছে! ঘোড়ার পিঠেই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে পপীপ।
    বাইরে ঘোড়ার শব্দ পেয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছে কুরমি। সে যে উত্তেজনায় বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে, সেটাও বোঝা যায়। কিন্তু তার মুখে জ্বলছে বরেন্দির চৈত্রমধ্যাহ্নের সূর্যের মতো আলো। ভেতরের আনন্দ আর খুশি তাকে আলোকিত করে রেখেছে। কিন্তু পপীপের মুখ অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘোড়া থেকে নামার কথাও যেন ভুলে গেছে সে।
    এসব লই করে না কুরমি। সে আরো কাছে ছুটে আসে। এই কয়েক মাসে যেন আরো সুন্দরী হয়েছে সে। পূর্ণতার জোয়ার এসেছে যেন তার দীঘল শরীরে। তাকে দেখাচ্ছে মুক্ত-আনন্দে বন দাপিয়ে ছুটে বেড়ানো চঞ্চলা হরিণীর মতে। কুরমি এসে একেবারে ঘোড়ার পাশে দাঁড়ায়। এত কাছে অচেনা মানুষ দাঁড়ালে যে কোনো ঘোড়াই অস্বস্তি প্রকাশ করবে। পপীপের ঘোড়াটিও মাথা ঘুরিয়ে কুরমিকে দেখে। তারপর শান্ত হয়ে দাঁড়ায়। কুরমির সংস্পর্শ মেনে নিয়েছে সে।
    কুরমির হাসি যেন বাঁধ মানছে না। সে লক্ষই করে না পপীপের মুখাবয়বের অন্ধকার। হাত ধরে টানে পপীপকে নিচের দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতেই বলে- আমি জানতাম তুমিই আসছ। অশ্বখুরের শব্দ পেয়েই বুঝেছি অশ্বারোহী তুমি ছাড়া আর কেউ নয়। এমন ছন্দে আর কেউ-ই ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু এখনো তুমি বসে আছ কেন ঘোড়ার পিঠে? নেমে এসো! ঘরে এসো ঘরের মানুষ! ভেতরে এসো মনের মানুষ!
    ইতোমধ্যেই বাড়ির বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে কুরমির হাসিমুখ মা, তার ছোট বোন। হড়জনকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো বা ক্ষেতের কাজে বাইরে রয়েছে।
    মাকে দেখে লজ্জা পেয়ে পপীপের হাত ছেড়ে দেয় কুরমি। কিন্তু এবার এসে হাত ধরে তার মাÑ আয় বাপ! আমরা তো রোজই তোর পথ চেয়ে থাকি। অনেক দূর থেকে এসেছিস। ভেতরে আয়। একটু ঠাণ্ডা হ আগে। তারপরে কথা বলা যাবে। ওরে কুরচি, দাদার হাত-মুখ ধোয়ার জল দে।
    ঘোড়া থেকে নামতে নামতে খটকা লাগে পপীপের। কোনো একটা ভুল হয়ে গেছে। কিছু একটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কুরমির সিঁথিতে সিঁদুর দেখে বোঝা যাচ্ছে তার বিয়ে হয়ে গেছে। অথচ  তাহলে তার সাথে এমন ব্যবহার করছে কুরমি যেন কিছুই ঘটেনি। আবার তার মা এবং বোনের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে যেন তাদের জামাই এসেছে বাড়িতে।
    তাকে সেই ঘরের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে কুরচি, সে আশ্রিত অবস্থায় যে ঘরটিতে ছিল। বারান্দায় আসন পেতে দিয়ে প্রথম মুখ ঝামটা মারে কুরচিÑ তোমার সাথে আমার আড়ি নেওয়াই উচিত। আচ্ছা আমাদের কথা না হয় তুমি ভুলেই গেছিলে, কিন্তু দিদির কথা তো তোমার ভুলে যাবার কথা নয়কো বটি!
    এবার আরো তালগোল পাকিয়ে যায় পপীপের মাথার মধ্যকার সবকিছু। আরো জট পাকিয়ে যায় চিন্তাগুলো। সে কুরচির কথার কোনো উত্তর দেবার আগেই একটা অম্লমধুর কটা হেনে চলে যায় কুরচি। সম্ভবত জল আনতে।
    কিন্তু জল নিয়ে আসে কুরমি। হাতে-পায়ে ঢালার জন্য নিয়ে এসেছে ঘড়ুলি(ঘাড়ু) পূর্ণ জল। সে জল ঢালার উদ্যোগ করতেই পা সরিয়ে নেয় পপীপ। একটু অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকায় কুরমি- কী হলো!
    চাপা ক্রোধকাঁপা কণ্ঠে পপীপ বলে- পরস্ত্রীর সেবা গ্রহণ করা উচিত নয় কোনো পুরুষের। আর কোনো সধবা নারীরও উচিত নয় কোনো পরপুরুষের সেবা করা।
    কুরমি এবার পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে পড়ে- এসব কী বলছ তুমি! পরস্ত্রী পরপুরুষÑ এসব কী  কথা?
    পপীপ এদিক-ওদিক তাকায়। একেবারে কাছে-ভিতে কেউ নেই। গলা চড়িয়ে না বললে কেউ শুনতে পাবে না তাদের কথা। সে আগের মতোই রাগতকণ্ঠে বলে- তোমার দেখছি বিয়ে হয়ে গেছে! সিঁথিতে সিঁদুর।
    তখনো পপীপের রাগের কারণ বুঝতে পারেনি কুরমি- বিয়ে তো হয়েইছে। আর বিয়ে হলে মেয়েদের সিঁদুর পড়তে হয়। এতে দোষের কী হলো?
    দোষের নয়! পপীপের কণ্ঠে এখন আরো বেশি ঝাঁঝÑ মানকুর বউ হয়ে তুমি আমার সেবা করতে এসেছ। তোমার লজ্জা করে না?
    এবার খিলখিল করে হেসে ফেলে কুরমি। পপীপের রাগ, তার থমথমে মুখের রহস্য এতণে উন্মোচিত হয় তার কাছে। সে হাসতে হাসতেই বলেÑ আমি মানকুর বউ হতে যাব কোন দুঃখে? আমি তো তোমার বউ!
    বলে আবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে কুরমি।
    পপীপের বুক তখন অনেকটা হালকা হয়ে এসেছে সবটুকু না বুঝেই। তবে এটুকু অন্তত সে বুঝে ফেলেছে যে তার কুরমিকে সে হারায়নি। বুক থেকে নেমে গেছে পাষাণভার। ওদিকে কুরমির খিলখিল হাসির শব্দে তার মা এবং বোন দুজনেই হাসিমুখে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে। কুরচি দূর থেকে বেশ উচ্চকণ্ঠেই বলে- বাব্বাহ, আজ কতদিন পরে যে দিদিকে হাসতে দেখছি!
    মুখে শাটিকার আঁচল গুঁজে হাসি থামানোর চেষ্টা করে কুরমি। পপীপ অনুনয়ের সুরে বলেÑ আমাকে সব বুঝিয়ে বলো কুরমি!
    অত কথা আমি বলতে পারব না। তুমি চলে যাওয়ার পরে আমি কুরচিকে বললাম যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে তোমার সঙ্গে। কুরচি বলল মাকে। মা বলল বাবাকে। বাবা তখন বলল মানকুর বাবাকে। হয়ে গেল!
    এত সহজে মিটে গেল সব ঝামেলা!
    একটু ঝামেলা হয়েছিল। মানকুর বাবা আর গাঁয়ের মানুষের কাছে বাবাকে দেওয়া কথা ভঙ্গ করার জন্য মা চাইতে হয়েছে। আর ক্ষতিপূরণ এবং কথা ফিরিয়ে নেবার মূল্য দিতে হয়েছে। এক দ্রোণ ধানী ক্ষেত পেয়ে নিজেদের দাবি তুলে নিয়েছে মানকু আর মানকুর বাপ। আমিও সেদিন থেকে সিঁথিতে সিঁদুর পরে অপো করছি তোমার।
    এত খুশি এবং এত আবেগ ভিড় করে এসেছে পপীপের বুকে যে সবার সামনেই কুরমিকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে তার। কুরমি বুঝতে পেরেই যেন চোখ পাকায়Ñ উঁহু কোনো দস্যিপনা চলবে না এখন!
    পপীপ আবার আড়চোখে তাকায় কুরমির মা আর বোনের দিকে। আরো চাপাকণ্ঠে জানতে চায়- তাহলে কখন চলবে?
    তার কণ্ঠশব্দের সাথে মিশে থাকা কামনা বুঝতে বাকি থাকে না কুরমির। নিজেও সে কেঁপে ওঠে একটু। ফিসফিস করে বলে- যখন সময় হবে, তখন আর বলে দিতে হবে না।
    হড়জন শশব্যস্তে বাড়িতে ঢোকে- পপীপ এসেছে নাকি?
    উঠে কাছে গিয়ে পায়ের ধুলা নেয় পপীপ। কুরচি জিজ্ঞেস করেÑ তুমি কীভাবে জানলে বাবা যে তোমার জামাই এসেছে?
    আরে গাঁয়ের লোক দেখেছে ঘোড়ায় চড়ে কেউ একজন গাঁয়ে এসেছে। তা আমি শুনেই বুঝেছি সে আমাদের পপীপ না হয়ে যায় না। গাঁয়ে আর এমন কি কেউ আছে যার জামাই ঘোড়ায় চড়ে আসতে পারে!- হড়জনের কণ্ঠে গর্ব ঝরে পড়ে।

    শ্বশুর-জামাইয়ের দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পপীপকে শুতে দেওয়া হয়েছে বাড়ির সবচাইতে আরামদায়ক ঘরটিতে। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ। কিন্তু ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। ঝাঁপটা ঠেলে দিলে মনে হয় পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। ঘরের মধ্যে স্বস্তিকর তাপমাত্রা। অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে পপীপ। এই রকম স্বস্তিকর ঘর এবং বিছানা পেয়ে তার এতক্ষণে ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই পপীপের চোখে। এপাশ-ওপাশ করছে বিছানায়। যত সময় গড়াচ্ছে তত অভিমান জমছে কুড়মির ওপর। আসছে না কেন কুড়মি! রেগে গিয়ে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয় সে ঘুমিয়েই পড়বে। কুড়মি এসে তখন হতাশ হবে। বেশ হবে! সেটাই ঠিক হবে!
    কিন্তু ঘুম যে আসে না! পপীপ তখন ঠিক করে সে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবে। কুড়মি এসে ডাকলেও সাড়া দেবে না।
    কিন্তু নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই পপীপের। বারান্দায় বা দরজায় যে কোনো মৃদু শব্দ উঠলেই ছ্যাঁৎ করে উঠছে তার বুক- এই বুঝি কুড়মি এল!
    অবশেষে পাখা হাতে বাতাস করার উছিলায় কুড়মি যখন পপীপের ঘরে আসে তখন যেন ঘরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।

২০. বিদায়ী প্রণাম
যাও বীর! যুদ্ধেক্ষেত্রে যাও! ফিরে এসো জয়ী হয়ে। এই দেহ এই মন তোমারই সম্পত্তি। জয়ী হয়ে ফিরে এসো। জয়মাল্য হয়ে এই দুই মৃণাল বাহু জড়িয়ে ধরবে তোমার কণ্ঠদেশ। জয়ী হয়ে ফিরে এসো। এই দেহ লীলায়িত পারিতোষিক হবে তোমার। এমন মিলনের প্রতিশ্রুতি এই দেহ তোমাকে দিচ্ছে, যা নেই বাৎসায়নের অভিধানে। তোমার কপালে দিয়েছি এই মাটি আর সিঁদুরের টিপ। এই নারী আর এই মৃত্তিকা তোমারই জয়ের অপোয় থাকবে উন্মুখ। জয়ী হয়ে ফিরে এসো! মৃত্তিকা-মা তোমাকে পুরস্কৃত করবে। পুরস্কৃত করবে সিঁদুরধারিণী।
    যুদ্ধে জয় আছে। পরাজয়ও আছে। পরাজিত হতে পারে আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু তোমাকে জীবন্ত রেখে পরাজয়ের গ্লানি যেন প্রবেশ করতে না পারে আমাদের মৃত্তিকায়! তাতেও হবে আমাদের অয় গৌরব।

পপীপকে বিদায়ী প্রণাম করে এই কথা বলে কুরমি।
যোজন যোজন দূরে মল্লকে প্রণাম করে প্রায় একই কথা বলে ঊর্ণাবতী।

২১. ভীম-রামপাল বাকযুদ্ধ
যুদ্ধেক্ষেত্রে মুখোমুখি দুই বাহিনী। দুই দল অবস্থান নিয়েছে মাঝখানে দুই ক্রোশ জমি ফাঁকা রেখে। যুদ্ধ হবে সেখানেই। দুই দলের খোল-গুপ্তচররা ব্যস্ত অন্য দলের সমর-শক্তি পরিমাপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ। পারে না সঠিক পরিসংখ্যান জানাতে। পারবে কী করে? দুই দলের এমন সৈন্য সমাবেশ আগে কি কোনোদিন দেখেছে বরেন্দির মাটি? হস্তী-রথ-অশ্বের সংখ্যায় অনেক এগিয়ে আছে রামপালের বাহিনী। কিন্তু সৈন্য সংখ্যা দুই দলেরই অনেক। হতে পারে পপীপের সৈন্যরা অস্ত্রে-বর্মে-পরিচ্ছদে তেমন সুসজ্জিত নয়। কিন্তু তাদের অবয়বে রয়েছে এমন এক সংকল্পের উন্মাদনা, যা কোনোদিন ভাড়াটে সৈন্যের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
    রামপালের যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। চতুরঙ্গ বাহিনী ছাড়াও তার রয়েছে অস্ত্র সরবরাহকারীর দল, রয়েছে শঙ্খ-ভেরী বাদকের দল, রয়েছে পাচকের দল, ধ্বজাবাহীর দল, চিকিৎসক দল, আহত সৈন্যদের জন্য শুশ্রƒষাকারীর দল, নিহতদের শব দাহকারীর দল, স্তুতিপাঠ করে যোদ্ধাদের মনোবলবৃদ্ধিকারী সূতদের দল। গুপ্তচরদের মুখে এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে ভীমও মনে মনে রামপালের যুদ্ধপ্রস্তুতির প্রশংসা করতে বাধ্য হয়।
    মুখোমুখি দুই পক্ষেই বেজে চলেছে যুদ্ধ-উন্মাদনার মাদল-ধামসা-ঢোল। এত তীব্র কোলাহলের মধ্যে আকাশের যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর একটি কাক-পক্ষীও দৃষ্টিগোচর হয় না। পদাতিক যোদ্ধা-রথ-হস্তী-অশ্বের পায়ের দাপাদাপিতে ক্রোশের পর ক্রোশ জুড়ে উড়ছে ধূলি এবং কাঁকড়।
    হঠাৎ থেমে যায় রামপালের সৈন্যদলের মাদল-ঢোলের শব্দ। চার অশ্বারোহী এগিয়ে আসতে থাকে পপীপের সৈন্যদলের অবস্থানের দিকে। তাদের মাথার ওপর উঁচু করে তুলে ধরা সাদা কাপড় পতপত করে উড়ছে। তাদের আসতে দেখে নিজেদের যুদ্ধবাদন বন্ধের নির্দেশ দেয় ভীম। রামপালের চার অশ্বারোহী এসে অভিবাদন জানায় পপীপকে। বলে- আমাদের রাজা মহামান্য রামপাল যুদ্ধ শুরুর পূর্বে শেষবারের মতো আলোচনায় বসতে চান মাননীয় ভীমের সাথে।
    এ কী কোনো চাল! ভীমের সেনাপতিরা সন্দিগ্ধ নয়নে তাকায় পরস্পরের দিকে।
    রামপালের বার্তাবাহকরা বলে- আলোচনা হবে দুইপরে অবস্থানের ঠিক মধ্যবিন্দুতে। উন্মুক্ত মাঠের মধ্যে। সেটি এমন একটি স্থান যেখানে সুদতম ধনুর্ধরের তীরও পৌঁছাতে পারবে না কাউকে আঘাত করার জন্য।   দুই পে অংশ নেবেন চারজন করে আলোচক। একদিকে থাকবেন রামপাল এবং তার তিন সঙ্গী। ভীমের সঙ্গেও থাকবে তিনজন সঙ্গী। তাদের কারো হাতে কোনো অস্ত্র থাকবে না।   উন্মুক্ত স্থানে আলোচনা হবে। দুই পরে সকলেই দেখতে পারে সেখানে কী ঘটছে।
    উগ্র বলে- আর্যদের সকল পদক্ষেপই কুটিলতায় ভরা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো-না-কোনো কূটচাল রয়েছে বটি! ভীম তোমার উচিত হবে না ফাঁদে পা দেওয়া।
    ভীম হাসে- সকলের দৃষ্টির সামনে যখন সূর্যদেবের আলোর নিচে প্রকাশ্য আলোচনার প্রস্তাব এসেছে, সেখানে যোগ না দিলে ভূমিপুত্রদের অপমান হবে।
    বার্তাবাহকদের দিকে ভীম বলে- রামপালকে গিয়ে জানাও, আমি এই আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম। তোমরা নিজেদের শিবিরে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অস্ত্র ও বর্ম ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় আলোচনাস্থলের দিকে যাত্রা শুরু করব।
    ভীমকে অভিবাদন জানিয়ে ফেরার পথ ধরে চার বার্তাবাহক।
    ভীম এবার সহচরদের দিকে তাকিয়ে বলে- প্রধান সেনাপতি হরিবর্মা! আমার অবর্তমানে এই সৈন্যদলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার আপনার হাতে থাকবে। আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন। সবচেয়ে দ্রুতগামী একদল অশ্বারোহী সৈন্য প্রস্তুত রাখুন।   যদি মনে হয়, রামপাল ছলনা করে আমাদের নিরস্ত্র অবস্থায় ডেকে নিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বাহিনীকে অগ্রসরের নির্দেশ দেবেন। আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গে যাবেন পদ্মনাভ, আর যাবে মল্ল এবং ঠাণ্ডামাথার উগ্র।
    ভীম তিন সঙ্গীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর এগুতেই দেখা যায় রামপাল আসছে। তার সঙ্গে আরো তিন সঙ্গী। তাদেরকে নিরস্ত্রই মনে হচ্ছে। তবে রামপালের তিনসঙ্গীর একজন আবার তার মাথার ওপর রাজছত্র ধরে আছে।
    যুদ্ধেক্ষেত্রর ঠিক মধ্যবিন্দুতে পৌঁছে দাঁড়িয়ে পড়ে ভীম। অপো করতে থাকে রামপালের এসে পৌঁছানোর জন্য। রামপাল এগিয়ে আসছে। রাজকীয় পরিচ্ছদে আবৃত রামপালের দেহ। মনে মনে হাসে ভীম। এই যুদ্ধেক্ষেত্রও রাজবেশ! তারপরেই মনে হয়, রামপাল তো আর প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেবে না। সে মানব-ব্যূহের মধ্যে অবস্থান নিয়ে হাতির পিঠে চড়ে যুদ্ধেক্ষেত্রে আসবে শুধুমাত্র সৈন্যদের উৎসাহ জোগাতে।
    কাছাকাছি এসে পৌঁছানোর পরে ভীম এবং রামপাল মুখোমুখি দাঁড়ায়। কেউ কাউকে অভিবাদন করে না। রামপাল আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের পরিচয় জানায়- আমি রামপাল। পরম সৌগত রাজ-চক্রবর্তী  মহারাজাধিরাজ দ্বিতীয় মহীপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা, এবং তার অবর্তমানে পাল-সাম্রাজ্যের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী।
    এরপর সঙ্গী তিনজনকে পরিচয় করিয়ে দেয় রামপাল- আমার দক্ষিণ পাশে রয়েছেন আমার পূজ্য মাতুল ব্রাক্ষ্মণশ্রেষ্ঠ নরপতি মথন দেব। বাম পাশে রয়েছেন তদীয় পুত্র, আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতি বীরশ্রেষ্ঠ কাহ্নুর দেব। আর আমার মাথার ওপরে রাজছত্র ধরে আছেন আমাদের বংশানুক্রমিক অঙ্গরক(দেহরী) দলের প্রধান নারায়ণ বর্মা।
    এবার নিজের ও সঙ্গীদের পরিচয় দেয় ভীম- আমি ভীম। এই বরেন্দির একজন ভূমিপুত্র। বরেন্দির সকল ভূমিপুত্র একত্রিত হয়ে আমাকে তাদের নেতা ও সেবক নির্বাচিত করেছেন। আমার ডান পাশে রয়েছেন বিদ্বানশ্রেষ্ঠ সুপরামর্শক পদ্মনাভ। তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কৈবর্তজাতির অন্যতম গর্বপুরুষ মল্ল। আর বাম পাশে রয়েছেন যুদ্ধবিশারদ উগ্র।
    এবার পরস্পর পরস্পরের সাথে অভিবাদন বিনিময় করে।
    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনার সূত্রপাত করে রামপাল। বলে- ভীম! আমি তোমাকে শেষবারের মতো সুযোগ দিতে চাই বলেই এই আলোচনায় আহ্বান জানিয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই মানবে একথা যে বরেন্দ্রী আমার পিতৃ-পিতামহের রাজ্য। পালসম্রাটদের জনক-ভু। এই মহান আর্য-ভূখণ্ড তোমরা জোর করে নিজেদের অধিকারে রেখেছ। বিনা রক্তপাতে তুমি যদি বরেন্দ্রী আমার হাতে প্রত্যর্পণ করো, তাহলে আমি তোমাকে মা করে দেবো। সেইসঙ্গে তোমাকে উপযুক্ত পুরস্কারেও ভূষিত করব। আমি তোমাকে আমার কোনো একটি সামন্ত রাজ্য দান করব। সেইসঙ্গে তোমাকে দেওয়া হবে স্বর্ণ-রৌপ্য-প্রাসাদ-সুন্দরী রমণী। তোমার সহযোগীদের অপরাধও মা করা হবে। তাদেরকে যথোচিত পদ দান করতেও আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। শুধু আমি চাই, আর্য-ভূখণ্ড আর্য অধিকারে ফিরে আসুক।
    ভীম মৃদু হাসে। বলে- এই বরেন্দি কীভাবে আর্য-ভূখণ্ড হতে পারে? সবাই তো জানে আর্যদের বাসস্থান হচ্ছে আর্যাবর্ত। তুমি কি আর্যাবর্তের ভূগোল ভুলে গেছ রামপাল? তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি আমি। পতঞ্জলি আর্যাবর্তের পরিষ্কার সীমানির্দেশ করে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রাগ্ আদর্শাৎ প্রত্যক্ কালকবনাদ্ দেক্ষিণন হিমবন্তম্ উত্তরেণ পারিযাত্রম্। ’ অর্থাৎ আদর্শের পূর্ব, কালকবনের পশ্চিম, হিমালয়ের দক্ষিণ, এবং পারিযাত্রের উত্তর- এই চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন ভূমিই আর্যাবর্ত। তাহলে বরেন্দি কীভাবে আর্যদের বাসভূমি হয়?
    এমন উত্তর আশা করেনি রামপাল বা তার সঙ্গীরা কেউ। ভীমের কথার উত্তরে কী বলবে ভেবে না পেয়ে সরাসরি উত্তপ্ত কণ্ঠে রামপাল বলেÑ মনে রেখো ভীম, আমি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও জাতিতে ত্রিয়। আমি পাণ্ডববীরশ্রেষ্ঠ অর্জুনের বংশধর। সেই অর্জুন, যিনি শত-সহস্র ম্লেচ্ছ-যবন-অসুর রাজাকে বধ করে সারা পৃথিবীর অধীশ্বর বানিয়েছিলেন তার ভ্রাতা ধর্মপুত্র যুধিষ্টিরকে। সেই অর্জুন, যার তুল্য বীর পৃথিবীতে অতীতে জন্মগ্রহণ করেনি, আর ভবিষ্যতেও জন্মগ্রহণ করবে না। সেই ত্রিয় শোনিত বইছে আমার শিরা-উপশিরায়। সেই ত্রিয় শোনিতের ঝলকানিতে তোমরা ভেসে যাবে তৃণবৎ।
    ভীমের ঠোঁটের হাসি একটুও ম্লান হয়নি। বলে- আমি ভূমিপুত্র একলব্যের বংশধর। সেই একলব্য, যার কথা মহাভারতে লেখা রয়েছে। পড়েছ নিশ্চয়ই। তবু আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। মহাভারতকার লিখছেন- ‘একলব্য দ্রোণের কাছে এলেন, কিন্তু নীচুজাতি বলে দ্রোণ তাকে নিলেন না। একলব্য দ্রোণের পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করে বনে চলে গেলেন এবং দ্রোণের একটি মৃন্ময়ী মূর্তিকে আচার্য কল্পনা করে নিজের চেষ্টায় অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করতে লাগলেন।
    একদিন কুরুপাণ্ডবগণ মৃগয়ায় গেলেন। তাদের একজন অনুচর মৃগয়ার উপকরণ এবং কুকুর নিয়ে পিছনে পিছনে গেল। কুকুর ঘুরতে ঘুরতে একলব্যের কাছে উপস্থিত হলো এবং তার কৃষ্ণবর্ণ মলিন দেহ, মৃগচর্ম পরিধান ও মাথায় জটা দেখে চিৎকার করতে লাগল। একলব্য একসঙ্গে সাতটি বান ছুঁড়ে তার মুখের মধ্যে পুরে দিলেন, কুকুর তাই নিয়ে রাজকুমারদের কাছে গেল। তারা বিস্মিত হয়ে একলব্যের কাছে এলেন এবং তার কথা দ্রোণাচার্যকে জানালেন। অর্জুন দ্রোণকে গোপনে বললেন, আপনি আমাকে বলেছিলেন যে আপনার কোনোও শিষ্য আমার চাইতে শ্রেষ্ঠ হবে না। কিন্তু একলব্য আমাকে অতিক্রম করল কেন? দ্রোণ অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে একলব্যের কাছে গেলেন। একলব্য দ্রোণকে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়িয়ে রইলেন। দ্রোণ বললেন, বীর তুমি যদি আমার শিষ্যই হও তবে গুরুদণিা দাও। একলব্য আনন্দিত হয়ে বললেন, ভগবান, কী দেবো আজ্ঞা করুন। গুরুকে অদেয় আমার কিছুই নাই। দ্রোণ বললেন, তোমার দণি অঙ্গুষ্ঠ আমাকে দাও! এই বাক্য শুনে একলব্য প্রফুলমুখে অকাতরচিত্তে অঙ্গুষ্ঠ ছেদন করে দ্রোণকে দিলেন। অর্জুন সন্তুষ্ট হলেন। ’
    পুরো উদ্ধৃতি শেষ করে ভীম বলেÑ বুঝতে পেরেছ তো রামপাল, তোমার বংশের পূর্বপুরুষ অর্জুন আমার পূর্বপুরুষ একলব্যের সাথে যুদ্ধে জেতেনি; ছলনায় জিতেছে। ন্যায়যুদ্ধে কখনো কোনো আর্য কোনো ভূমিপুত্রকে পরাজিত করতে পেরেছে এমন কোনো উদাহরণ নেই রামপাল। তুমিও পারবে না।
    ভীমের যুক্তিজালে এমনভাবে ধরাশায়ী হতে হবে, একথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি রামপাল। সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করে বলেÑ আমি মহান বুদ্ধের অনুসারি। অকারণ রক্তপাত আমার ধর্মে নিষিদ্ধ বলেই আমি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তোমার মতো নীচজাতির লোকের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার বিবেচনাবোধ তোমার মতোই নীচ। বেশ, তবে যুদ্ধই হোক! তোমাদের রক্তস্নানে শুদ্ধ করেই আমি আমার জনক-ভূ বরেন্দ্রীর পবিত্রতা ফিরিয়ে আনব!
    সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে রামপাল ইঙ্গিত করে আলোচনাস্থল ত্যাগ করার। কিন্তু মথন দেব নড়ে না। রামপালকে মনে করিয়ে দেয় যে যুদ্ধ শুরুর যুদ্ধের নিয়মাবলি স্থির করতে হবে।
    রামপাল তিক্তস্বরে বলে- আপনিই পাঠ করে শোনান যুদ্ধের নিয়মাবলি। যদি ওরা মেনে চলতে সম্মত হয়, তাহলে সেই নিয়মাবলি মেনেই যুদ্ধ হবে।
    মথন দেবের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- যেহেতু এটি মুখোমুখি যুদ্ধ, তাই যুদ্ধের কিছু নিয়ম-নীতি মেনে যুদ্ধ করাই প্রকৃত বীরপুরুষদের রীতি। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি কিছু নিয়মের প্রস্তাব করতে পারি।
    উগ্র বলেÑ আমাদের শুনতে আপত্তি নেই। তবে মেনে নেবো কি না, তা নির্ভর করবে ভীমের সিদ্ধান্তের ওপর।
    মথন দেব মাথা ঝাঁকিয়ে পড়তে শুরু করে- নিশাকালে কোনো যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ হবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
    ভীম মাথা ঝাঁকায়- বলে যাও!
    মথন দেব পড়তে থাকে- যারা সৈন্যদল থেকে বেরিয়ে আসবে, তাদের হত্যা করা হবে না।
    অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত, অস্ত্রহীন বা বর্মহীন লোককে হত্যা করা হবে না।
    যারা আহতদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিতে আসবে, তাদের ওপর অস্ত্রনিক্ষেপ করা হবে না।
    যারা ঢোল-মাদল বাজায় তাদের আঘাত করা হবে না।
    যারা মৃতদেহ সৎকারের কাজ করবে তাদের প্রতি অস্ত্রনিক্ষেপ করা হবে না।
    দ্বৈরথের জন্য যাকে আহ্বান করা হবে, সে যুদ্ধে যোগদান করবে। দ্বৈরথের সময় রথীর সঙ্গে রথী, গজারোহীর সঙ্গে গজারোহী, অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহী, এবং পদাতিকের সঙ্গে পদাতিক যুদ্ধ করবে।
    যুদ্ধ করতে করতে কেউ যদি অস্ত্রত্যাগ করে যুদ্ধের প্রতি বিমুখতা প্রদর্শন করে, তাকে হত্যা করা চলবে না।

    নিয়মাবলি পাঠ শেষে পালাক্রমে রামপাল এবং ভীমের ওপর ঘুরতে থাকে মথন দেবের দৃষ্টি। ভীম কিছুণ চিন্তা করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে- আমি মেনে নিলাম। আমাদের সৈন্যদের জানিয়ে দেওয়া হবে এই নিয়মাবলি।
    রামপাল কোনো কথা বলছে না দেখে উগ্র জিজ্ঞেস করে- রামপাল কি নিয়মাবলি মেনে নিতে সম্মত নন? নিয়মাবলির প্রস্তাবগুলি সবই কিন্তু এসেছে আপনাদের দিক থেকেই!
    রামপাল একবার ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উগ্রর দিকে। বলে- মেনে নিলাম। তারপর ছত্রধরের জন্য অপেক্ষা না করেই হাঁটতে থাকে নিজের সৈন্যদলের দিকে।

২২. ভীমের প্রার্থনা
পিতৃগণ আমরা আজ তোমাদের সেই হাতের স্পর্শ কামনা করি-
    যে হাত মাটির বুক খুঁড়ে সবুজ শস্যশিশুদের পৃথিবীতে এনেছে, আবার জোড়করে স্তব করেছে মৃত্তিকার; যে হাত বনের বুক থেকে ছিনিয়ে এনেছে বাসের বসত আর চাষের মাটি; যে হাত বনের শিকার এনে তুলে দিয়েছে শিশুদের মুখের গরাস; যে হাত প্রাচীর তুলে ঘরের নিরাপত্তা দিয়েছে উত্তরপুরুষকে আবার তার জন্য অবারিত করে দিয়েছে দিগন্তের অধিকার; যে হাত রক্তাক্ত হয়েছে হলকর্ষণে; যে হাত রুধিরাক্ত হয়েছে মাটির অন্ধকার রহস্য উন্মোচন করে লৌহ-আকরিক নিষ্কাশনে; যে হাত হাতুড়ির ঘাতে-প্রতিঘাতে কাঁচা লোহাকে দিয়েছে কাস্তের স্বরূপ; যে হাত সুরা দিয়েছে কৌমের নারী-শিশু-বৃদ্ধদের; যে হাত শিশুদের মাথার চুলে আর কৃষ্ণকালো পৃষ্ঠত্বককে অশেষ স্নেহ বিলিয়েছে স্পর্শের জাদু দিয়ে; যে হাত শৃঙ্খলিত হয়েছে, কিন্তু শৃঙ্খল ভাঙার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হয়নি কোনোদিন; যে হাত অতীতের দিকে আঙুল তুলে মনে করিয়ে দিয়েছে সাম্যের কথা; যে হাত ভবিষ্যতের দিকে আঙুল তুলে বলেছে মুক্তির কথা!
মাতৃগণ আমরা আজ তোমাদের সেই হাতের স্পর্শ কামনা করি-
    যে হাত আমাদের শৈশবকে রা করেছে আর কৈশোরকে দিয়েছে সুরা; যে হাত ঝিনুকে ঝিনুকে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে প্রাণের স্পন্দন; যে হাত আমাদের হাসি দেখে টেনে নিয়েছে বুকে, আমাদের কান্না শুনে টেনে নিয়েছে বুকে; যে হাত চিরকাল নিভিয়ে এসেছে কৌমপুরুষদের পেটের আগুন; যে হাত তিথি ও পরবে দুয়ারে-আঙিনায় আল্পনা এঁকে স্বাগত জানিয়েছে ওলান ঠাকুরকে; যে হাত সন্তান ও কৌমের মঙ্গলকামনায় বারবার জোড়কর হয়েছে মাতৃদেবীদের উদ্দেশ্যে; যে হাত শুশ্রুষা হয়েছে, হয়েছে আশ্রয় আর অনন্ত কান্তিহরণী; যে হাত অনন্তকালব্যাপী অন্নযোগানি; যে হাত শত্রু হস্তে নিহত পুত্রের শব বুকে নিতে নিতেও আরেক পুত্রকে পাঠিয়েছে যুদ্ধেক্ষেত্রে; যে হাত কৌমের জীবনকে শ্রীময়ী করেছে চিরকাল; যে হাত ঝড়ের মুখে কৌমের করঞ্জদীপকে ঘিরে রেখে দূর করেছে অন্ধকারের ভীতি; যে হাত নিজের বুক ফেঁড়ে হৃৎপিণ্ড তুলে দিয়েছে সন্তানের মুক্তি-কামনায়; যে হাত অগ্নিশয্যাকে বারংবার পরিণত করেছে পুষ্পশয্যায়!
হে আমার বরেন্দির মাটি ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া রাতের বাতাস!
    তুমি তো ধারণ করে আছ আমাদের পূর্বপুরুষের সকল নিঃশ্বাস। আমাদের সকল পিতৃ-মাতৃগণের শেষ নিঃশ্বাস মিশে আছে তোমার শরীরে। তুমিই তো সেই নিঃশ্বাসগুলি নিয়ে প্রবেশ করো আমাদের বুকের ভেতরে, দিয়ে যাও বরাভয়, তাদের আশীর্বাদ! হে বায়ুদেবতা তুমি আমাদের বুকের মধ্যে পিতৃগণের সাহসের বরাভয় সঞ্চারিত করো অবিরাম! আমার সাথীদের জানাও, তাদের পিতৃপুরুষ কোনোদিন কাপুরুষ ছিল না। আমার সাথীরা জানুক, তাদের পিতৃপুরুষ ন্যায়যুদ্ধে পরাজিত হয়নিতো কোনোদিন! আমাদের মাতৃগণের সকল সরব-নীরব প্রার্থনা ধারণ করেছ তুমিই হে বায়ুদেব! তুমি তো জানো গর্ভকালে কী প্রার্থনা জানাতেন তারা দেবতার কাছে। তুমি তো জানোই হে বায়ুদেব, আমাদের মাতৃগণ চাইতেন না কোনো দাসের গর্ভধারিণী হতে! তুমি আমার সাথীদের কাছে বলো তাদের পিতৃ-মাতৃগণের প্রতিজ্ঞা-প্রার্থনার কথা!
হে আমার বরেন্দির মাটি!
    তোমাকে শৃঙ্খলমুক্ত রাখার জন্য যে সন্তানরা একত্রিত হয়েছে, মাতা তুমি তাদের পায়ে দাও লৌহস্তম্ভের দৃঢ়তা, শত্রু র সহস্র আঘাতও যেন তাদের টলাতে না পারে একচুলও! তোমার সন্তানের জয় মাগো তোমারই তো জয়, তাদের পরাজয়ে মাগো তোমারই অপমান। সেই অপমান নিয়ে যেন তোমার এই সন্তানকে তোমার বুকে বিচরণ করতে না হয়! হে আমার মৃত্তিকা-মাতৃদেবী! যে তোমাকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করে, তোমার বুক থেকে পায় মাগো ফসল-আশিস; যে তোমাকে স্তব করে, তোমার বুকে সে পায় মাগো রাতের বিরাম আর দিনের কর্মস্পৃহা; তোমাকে যে নিজমাতা জ্ঞানে ভালোবাসে, তোমার ভূগোল থেকে পায় মাগো নিরাপত্তার বিভব। যারা তোমাকে মা বলে জানে না, সেই দস্যুদলের প্রতিরোধে সাথীরা আমার আজ এখানে সবাই। তাদের অন্তরে তুমি বিরাজিত থেকো গো মা সকল প্রহর!   
হে সুপ্তিময় রাত্রি!
    আমার সাথীদের দাও বিশ্রামের অকণ্টকিত সুখ। তাদের নিদ্রার ভেতর যেন কেউ বুনতে না পারে দুঃস্বপ্নের বীজ! ঘুমের ঔষধি পেয়ে তারা যেন পরবর্তী প্রত্যুষে জেগে উঠতে পারে কান্তিমুক্ত সিংহের মতো। তাদের হাতের অস্ত্র যেন ঝলসে দিতে পারে সকালের সূর্যের চোখ!        

২৩. একটি অন্যায় যুদ্ধের বিবরণ
রাত তখনো খুব বেশি হয়নি। নিজের তাঁবুতে বসে আছে পপীপ। সামনে ভূর্জপত্র, খাগের লেখনি, ভুষাকালির পাত্র। মমত্বময় দৃষ্টিতে লেখার উপকরণগুলির দিকে তাকিয়ে আছে পপীপ। ভীমের ঠিক বাম পাশের তাঁবুতে বসে ভাবছে আগামী প্রত্যুষের কথা। আগামীকাল সূর্যোদয় থেকে শুরু হবে যুদ্ধ। গর্বে বুক ফুলে উঠছে তার। বিকালে ভীম তাকে পাঠিয়েছিল পূর্বদিকে অবস্থান নেওয়া সৈন্যদের কাছে। রামপালের সাথে ভীমের কথোপকথনের বিবরণ আর যুদ্ধের নিয়মাবলি জানিয়ে দেওয়ার জন্য। খুব রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করেছে সৈন্যরা ভীমের যুক্তির কাছে রামপালের নাকাল হওয়ার বিবরণ। সৈন্যরা এমনিতেই ভীমকে শ্রদ্ধা করে দেবতার মতো। তার বুদ্ধিমত্তার বিবরণ শুনে তারা একেবারে অভিভূত। বলেছেÑ হ্যাঁ। ভীম একটা নেতার মতোন নেতা বটি! এমন নেতার জন্যে জীবন দিয়েও সুখ!
    নিজের স্বজাতি হলেও কৈবর্তদের এখনো যেন পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি পপীপ। কাল সকাল থেকে যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধে কার যে কখন মৃত্যু আসবে কোন পথে কেউ জানে না। কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত মনে হয়নি কাউকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বরেন্দির এই প্রান্তে তারা যেন বনভোজনে এসেছে। গল্প করছে, হই-চই করছে, কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কারো অস্ত্রে একটু জং ধরার রং চোখে পড়লে হাসতে হাসতে বলছে, আরিব্বাপরে তোর তরবারিতে তো মরচের বিষ লেগে আছে রে। যাকে মারবি, সে ব্যাটা যদি তখনকার মতো বেঁচেও যায়, তাহলেও এই মরচের বিষে বেচারা পচা ঘা হয়ে নির্ঘাৎ মারা যাবে!
    এমনভাবে সে কথাটা বলে, যেন মরে যাওয়ার চেয়ে আঘাতপ্রাপ্ত লোকটার শরীরে পচা ঘা হওয়াই বেশি বিপজ্জনক।
    তার কথা শোনামাত্র হো হো হাসির এমন শব্দ ওঠে যে তাঁবু উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
    রাতের খাবার নিয়ে এসেছে রাঁধুনি। তাকে নিয়েও রসিকতার অন্ত নেই। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছেÑ ওরে ও রান্ধুয়া, আমাকে আর এক হাতা ভাত দে। পেটে খিদে নিয়ে মরে গেলে শেষে দুঃখ থেকে যাবে।
    আবার হাসি।
    পপীপ তাদের জানায় যে রাতে বেশিণ জেগে থাকতে নিষেধ করেছে ভীম। ভালো করে ঘুমিয়ে নিলে শরীরটা ঝরঝরে হবে। সকালে যুদ্ধের সময় সবাই তরতাজা থাকবে। একজন জিজ্ঞেস করে পপীপকে- যুদ্ধ কি খুব সকালে শুরু হবে? এক্কেবারে সূয্যিদেব উঁকি দেবারও আগে?
    পপীপ উত্তর দিয়েছে- তা-ও হতে পারে। কেন? খুব সকালে যুদ্ধ শুরু হলে তোমার কোনো  অসুবিধা আছে কী?
    লোকটা মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছে- খুব সক্কালে যুদ্ধ শুরু হলে আমার একটু অসুবিধাই হবে রে পপীপ। আমার আবার একটু বেলা না উঠলে বাহ্যি হয় না বটি।
    এবার যে হাসির হররা ছোটে তাতে বোধহয় চমকে ওঠে ঝিমুতে থাকা পুরো সৈন্যশিবির।

নিজের তাঁবুতে ফিরে এসে এইসব কথাই ভাবছে পপীপ। গর্বে ফুলে উঠছে তার বুক। এই হচ্ছে তার স্বজাতি ভূমিপুত্ররা। যাদের কাছে জীবন-মৃত্যু যেন পায়ের ভৃত্য। এমন জাতির মধ্যে জন্মাতে পারাও সৌভাগ্যের ব্যাপার। ঠোঁটে হাসি নিয়েই খাগের লেখনি হাতে তুলে নেয় সে। পাট করে বিছিয়ে নেয় ভূর্জপত্র। আগে যতগুলি শ্লোক লেখা হয়েছে, সেগুলি সে রেখে এসেছে কুরমির কাছে। সে জানে কুরমি সেগুলি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদের মতোই আগলে রাখবে। তবু বারংবার পপীপ মনে করিয়ে দিয়েছে কুরমিকে যে ওগুলি এখন জাতির সম্পদ। সে যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে এলে বাকি অংশটুকু লিখে সম্পূর্ণ  করবে কাব্যটি। আর যদি ফিরে না আসে তাহলে কুরমিকে চোখের মণির মতো রা করতে হবে এই শ্লোকগুলিকে। কতদিন? যতদিন না আবার মুক্ত হবে এই মাটি। যতদিন এমন লোককে পাওয়া না যায়, যার হাতে তুলে দিলে ভূমিপুত্রদের হাতে ফিরে যাবে ভূমিপুত্রদের এই গৌরব-কাহিনী।
    নিস্তব্ধ হয়ে গেছে ভীমের শিবির। ভীম নিজেও বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সৈন্যরা সকলেই ঘুমাচ্ছে। কারণ রাত্রিকালে যুদ্ধ করা হবে না। যুদ্ধের নিয়মাবলির প্রথম রীতিই এটি। এই জায়গাটি অনেকটা মালভূমির মতোই। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো জনবসতি নেই, কোনো গ্রাম নেই। মাটি ন্যাড়া, শক্ত, কাঁকড়ময়। বড় বৃ তেমন চোখে পড়ে না। ছোট ছোট ঝোপ বলতে আছে কিছু কাঁটাগাছ আর তাদের পেটের নিচে কিছু মুথাঘাস। যুদ্ধক্ষেত্ররূপে এই জায়গা নির্বাচন প্রসঙ্গে ভীম বলেছে, এখানে যুদ্ধ হলে ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ এখানে কোনো ফসল ফলে না। তাছাড়া দিগন্তবিস্তৃত হওয়ায়, এবং কোনো বৃক্ষ বা টিলার আড়াল না থাকায় এখানে অনেক দূর থেকে শত্রু র গতিবিধি বুঝতে পারা যাবে। আরেকটি কারণও বলেছে ভীম। সকাল থেকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে আকাশ-বাতাস-মাটি সবকিছুই তেতে ওঠে। খুব গরম অনুভূত হয়। আমাদের ভূমিপুত্র-যোদ্ধারা এমন গরম সহ্য করতে অভ্যস্ত। কিন্তু রামপাল এবং তার যোদ্ধারা এই গরমে হাঁসফাঁস করবে। তাদের শক্তি অর্ধেক ব্যয়িত হয়ে যাবে এই প্রচণ্ড গরমের সাথে যুদ্ধ করতে করতেই। প্রকৃতি ও জলবায়ুর এই সুবিধাটিকে কাজে লাগানোর জন্যই এই স্থানকে বেছে নেওয়া। মনে মনে ভীমের দূরদৃষ্টির প্রশংসা করেছে পপীপ।
    পপীপের হাতের লেখনি তখনো ভূর্জপত্রের বুকে একটি আঁচড়ও কাটতে পারেনি। আজ হঠাৎ তার কুরমির কথা মনে পড়ছে। রোজই মনে পড়ে। কিন্তু এখন একটু বেশি মনে পড়ছে। হয়তো সে মনে মনে চাইছে তারা যখন গৌরবময় যুদ্ধে লিপ্ত হবে, সেই সময় কুরমি তাকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখুক। কিন্তু তা কী সম্ভব! নিজের অসম্ভব কল্পনায় পপীপ নিজেও একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
    লেখনি হাত থেকে নামিয়ে রেখে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে শয্যায়। আজ পপীপের ওপর ভর করেছে এক মধুর আলস্য। আজ আর শ্লোক রচনা করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তারচেয়ে শুয়ে শুয়ে কুরমির কথা ভাবতে ভালো লাগছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে চোখ বন্ধ করে পপীপ।

চোখ বন্ধ রেখেও পপীপ টের পায় হঠাৎ করেই বাইরের অন্ধকার রাত আলোয় আলোময় হয়ে গেছে। হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পপীপ। বুঝতে পারে না কী ঘটেছে। সে কি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল? টেরই পায়নি কখন সূর্য উঠে এসেছে মাথার ওপর? কিন্তু তাহলে তো এতণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু তার সঙ্গীরা তাকে ডাকবে না- এমনটি তো হতেই পারে না। এরপর কানে আসতে থাকে প্রচণ্ড মরণচিৎকার, ক্রুদ্ধ হাঁক-ডাক, ঘোড়ার মুহুর্মুহু হ্রেসারব আর খুরের শব্দ।
    চোখ ডলতে ডলতে তাঁবুর বাইরে এসে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তাতে মুহূর্তে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো কষ্টে আক্রান্ত হয় পপীপ। যুদ্ধেক্ষেত্রের পূর্ব পাশ জুড়ে ভূমিপুত্রযোদ্ধাদের শিবির স্থাপন করা হয়েছে অর্ধচন্দ্রের আকৃতিতে। ভীমের ইচ্ছা সকালে যুদ্ধ শুরুর সময় তার বাহিনী অর্ধচন্দ্রাকৃতিব্যূহ রচনা করে শত্রু কে প্রতিরোধ করবে। প্রত্যুষে ব্যূহ রচনায় সুবিধা হবে মনে করে এভাবেই শিবির স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
    সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতির শিবিরের দুই অগ্রবর্তী সূচিমুখের তাঁবুগুলি ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁবুগুলিতে। ঘুমের মধ্যেই আগুনে পুড়ে মরছে ভূমিপুত্রসেনারা। যারা বিহ্বল ঘুমমাখা চোখে বেরিয়ে আসছে তাঁবু থেকে, তাদের মুণ্ড মুহূর্তে ধর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে রামপালের সৈন্যরা।
    এমন বীভৎস দৃশ্য দেখে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে পপীপ। পরণেই তার মনে পড়ে ভীমের কথা। ভীমকে এই সংবাদ জানানো প্রয়োজন। কিন্তু ভীম তার তাঁবুর বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধে জ্বলছে দুই চোখ। আবার নিজের সাথীদের এইভাবে মৃত্যুবরণ করতে দেখে ক্ষণে ক্ষণে বেদনায় সজল হয়েও উঠছে দুই চোখ। চিৎকার করে বলছে ভীম- হায় আমি কী বোকা! আমাকে পিতৃব্য দিব্যোক আর পিতা রুদোক বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, সাপ-হায়েনা আর পালরাজা-অমাত্যদের বিশ্বাস করতে নেই। আমি সেই কথা মনে রাখিনি। বীরের ধর্ম পালন করে ন্যায়যুদ্ধ করবে রামপাল এমনটাই আশা করেছিলাম। হায় আমি শৃগালের কাছে সততা প্রত্যাশা করেছিলাম!
    পপীপ কাছে গিয়ে দেখতে পায় মল্ল এবং উগ্র এসে দাঁড়িয়েছে ভীমের পাশে। তারা ইতোমধ্যেই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পেরেছে। তারা চিৎকার করে তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুমন্ত সৈন্যদের ডেকে তুলছে। হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বলছে। পপীপ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায়, ভীমকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে রামপালের কয়েক সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য। তাদের সামনের সারির লোকদের হাতে জ্বলন্ত মশাল। সেই মশালের আলো পড়েছে তাদের চোখে-মুখে। মনে হচ্ছে মানুষ নয়, হাজার হাজার পিশাচ ছুটে আসছে ভীমের দিকে। কয়েক সহস্র অশ্বারোহীর পেছনে ছুটে আসছে আরো কয়েক সহস্র পদাতিক। তারা আসছে ভীমকে সহচরদেরসহ পৃথিবী থেকে নির্মূল করার উন্মত্ত বাসনা নিয়ে। মল্ল দেখতে পায়, আগুয়ান অশ্বারোহীদের একেবারে মাঝখানে রয়েছে কাহ্নুর দেব। সেই-ই তাহলে এই মধ্যরাত্রির বর্বর-কাপুরুষোচিত আক্রমণের হোতা। মল্ল মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যুদ্ধে হার-জিত যাই হোক ঐ বর্বর নরপিশাচকে যমালয়ে না পাঠিয়ে আমি মরব না!
    ভীমের দুই পাশে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকশত ভূমিপুত্রযোদ্ধা। ভীম চিৎকার করে বলে- বল্লম তুলে নাও হাতে সবাই। স্থির নিষ্কম্প হাতে বল্লম ধরে লক্ষ্য স্থির করো ছুটে আসা ঘোড়াগুলোর সামনের দুই পায়ের মাঝখানে ঠিক হৃৎপিণ্ডের সোজাসুজি।
    অযুত শত্রু র বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে পারছে ভীমের মাত্র কয়েকশত যোদ্ধা। পপীপ সর্বশক্তিতে হাতে বল্লম ধরে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে ছুটে আসা অশ্বারোহীর দিকে। ঘোড়াগুলো ছুটে আসছে। ওরা কেউ-ই প্রতিরোধ আশা করছে না। যেভাবে দুই ধারের ভূমিপুত্রযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই একইভাবে ভীম এবং তার সহচরদেরও হত্যা করা যাবে ভেবে তারা নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসছে। পপীপ একদৃষ্টিতে ল্য নিবদ্ধ করে তার দিকে ছুটে আসা ঘোড়াটির সামনের দুই পায়ের মাঝখানের বুকের দিকে। কোনো পড়ন্ত ফল যেভাবে চাকুর ডগায় গেঁথে যায়, ঠিক সেইভাবে তার বল্লমের ডগায় এসে বুক পেতে দেয় ঘোড়াটি। পপীপকে কিছুই করতে হয় না। ঘোড়াটি নিজেই যেন নিজের বুকে গেঁথে নেয় বল্লমের ফলা। তারপরেই যেন নরক ভেঙে পড়ে পপীপদের চারপাশে।
    তার প্রায় গায়ের উপরেই পড়েছে ঘোড়াটি। অশ্বারোহী ছিঠকে পড়েছে শক্তমাটিতে। মট করে একটা শব্দ হয়। বোধহয় ঘাড় ভেঙে গেছে লোকটার। তার দিকে তাকিয়ে আর সময় নষ্ট করে না পপীপ। তরবারি হাতে মুখোমুখি হয় কাছে এসে পড়া পদাতিক সৈন্যটির। লোকটা ছুটে আসছে নিজের অস্ত্র বাগিয়ে। পপীপও সাঁত করে এগিয়ে একেবারে কাছে ভিড়ে যায় লোকটার। এত দ্রুত অঙ্গ-সঞ্চালন করবে পপীপ তা ভাবতে পারেনি লোকটা। তার বুকের ডানপাশটিকে একেবারে অরতি পেয়ে যায় পপীপ। নির্দ্বিধায় হাতের তরবারি আমূল ঢুকিয়ে দেয় লোকটার ডানবুকের মধ্যে। তারপর আর সচেতনভাবে কিছু করার কথা মনে থাকে না পপীপের। খাগের লেখনির কথা ভুলে গিয়ে অস্ত্রহাতে শত্রু নিধনে মত্ত হয়ে পড়ে কবি।
    মল্ল তার খড়্গ চালাচ্ছে এমন তীব্র শক্তির সাথে যে যার সাথেই সংঘর্ষ ঘটছে সেই খড়্গের, সেখান থেকেই ছুটছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। চারজন-পাঁচজন করে শত্রু সৈন্য একসাথে ঘিরে ধরছে তাকে। কিন্তু মল্ল যেন আজ অজেয়। চারজন শত্রু কে মেরে ফেলতে তার যেন চারটি নিমেষেরও প্রয়োজন হচ্ছে না। তার সমস্ত শরীর শত্রু সৈন্যের রক্তে রঞ্জিত। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মহাকাল রক্ত মেখে নেমে এসেছে এই যুদ্ধেক্ষেত্রে।
    ঊগ্র সবসময় চেষ্টা করছে ভীমের পাশে থাকতে। চেষ্টা করছে নিজের দেহকে ভীমের বর্মরূপে ব্যবহার করতে। শত্রু র অস্ত্র যাতে ভীমের শরীরকে স্পর্শ করতে না পারে, সেইজন্য একহাতে তরবারি, আরেকহাতে বর্ম নিয়ে ঠেকিয়ে চলেছে শত্রু সৈন্যদের। কিন্তু ভীমের যেন কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দুইহাতে দুই তরবারি চালিয়ে যাচ্ছে। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি পড়লে যেমন শব্দ হয়, ভীমের তরবারির আঘাতে শত্রু সৈন্যের মুণ্ড মাটিতে গড়িয়ে পড়ে সেই রকম শব্দ হচ্ছে।
    মল্ল হঠাৎ ছুটে আসে পপীপের কাছে। পপীপ তখন যুদ্ধ করছে বিশালদেহী এক আর্যসৈন্যের সাথে। মল্ল চরম অবহেলায় একবার তার হাতের খড়্গ উপর-নিচ করে। বিশালদেহী লোকটা যেন দুই টুকরা হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। মল্ল হ্যাঁচকা টানে পপীপকে সরিয়ে নিয়ে আসে একটা তাঁবুর আড়ালে। সেখান থেকে কাহ্নুর দেবকে দেখিয়ে বলে- ঐ দ্যাখ! ঐ যে শত শত দেহরীর মাঝখানে সবচেয়ে উঁচু ঘোড়ায় চেপে সৈন্যদের পরিচালনা করছে যে লোকটা, সে হচ্ছে কাহ্নুর দেব। বীরের ধর্ম ভুলে আমাদেরকে ঘুমের মধ্যে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ঐ শুয়োর-সন্তানের। কেননা সেই-ই হচ্ছে রামপালের প্রধান সেনাপতি। আমি যাচ্ছি কাহ্নুরকে নরকে পাঠাতে। তুই এখানে না থেকে ভীমের কাছাকাছি চলে যা। আর বেশিণ যুদ্ধ চলবে না। বাস্তবতা হচ্ছে বেশিণ যুদ্ধ চালানোর মতো যোদ্ধা আমাদের নেই। ঘুমের মধ্যেই প্রায় সকলকে হত্যা করেছে নরপশুর দল। তুই ভীমের পাশে থাকিস। অন্তত তুই বেঁচে থাকতে যেন ভীমের গায়ে কোনো অস্ত্র আঘাত না করতে পারে!
    কথা শেষ করেই কাহ্নুর দেবকে ল করে ছোটে মল্ল। পপীপ ভীমের কাছে যাওয়ার কথা ভুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে এক অলৌকিক যোদ্ধাকে। খড়্গ এখন পিঠের সাথে ঝুলিয়ে নিয়েছে মল্ল। তার দুই হাতে দুইটি ছোট আকারের তরবারি। সে এঁকেবেঁকে ছুটছে কাহ্নুর দেবের ঘোড়া ল করে। প্রথমে এভাবে তার ছুটে যাওয়াকে লই করেনি শত্রু পক্ষের কেউ। কিন্তু অনেক কাছে চলে যাওয়ার পরে কাহ্নুর দেবকে বেষ্টন করে রাখা দেহরীদলের চারজনের দৃষ্টি পড়েছে মল্লর উপর। তারাও তীব্রগতিতে ছুটে আসা মল্লর মনোভাব বুঝতে পারেনি। ইতস্তত করছে কী করবে। আবার এত এত সৈন্যের প্রতিরোধ ভেদ করে লোকটা কীভাবে এতদূর এল ভেবে পাচ্ছে না তারা। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবনার অবকাশ যুদ্ধেক্ষেত্র নেই। সেই ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে হলো তাদের জীবন দিয়ে। তারা মল্লকে থামানোর উদ্যোগ করার আগেই ঝলসে ওঠে মল্লর দুই হাতের তরবারি। মুহূর্তে ধরাশায়ী হয় তারা। আর মল্ল পেয়ে যায় কাহ্নুর দেবের কাছে পৌঁছে যাওয়ার খোলা পথ। কাহ্নুর দেব হাতে একটি তরবারি ধরে রেখেছে বটে, কিন্তু এটিকে তার ব্যবহার করতে হবে এমনটি একবারও ভাবেনি। হঠাৎ মল্ল তার সামনে যমদূতের মতো উপস্থিত হয়ে পড়ায় সে এতই অবাক হয়ে যায় যে তার নিজের হাতে যে অস্ত্র আছে, সেটি তার মনেই থাকে না। মল্ল তার দিকে তাকিয়ে বীভৎস একটা হাসি হাসে। তারপর সাঁই করে একহাতের তরবারি চালায় কাহ্নুর দেবের পেট লক্ষ্য করে। পেট ফুটো হয়ে ঢুকে যায় তরবারি, আর কাহ্নুর দেব ঘোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। তার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে মল্ল বলে- কাপুরুষ! রাতের অন্ধকারে আমার সঙ্গীদের হত্যা করেছিস তুই। ভেবেছিস পার পেয়ে যাবি! যদি আজ এই যুদ্ধেক্ষেত্র তোর পরিবারকে পেতাম তাহলে নরকে পাঠাতাম সবাইকে। আজ তুই একাই যা নরকে!
কথা শেষ হতে না হতেই মল্লর তরবারি পুরোপুরি ঢুকে যায় কাহ্নুর দেবের বুকে। তাকে মৃত্যুযন্ত্রণায় গলাকাটা মুরগির মতো ঝটপটাতে দেখে খুশিতে অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছা করে মল্লর। সে হাসার জন্য ঠোঁট ফাঁকও করতে যায়। কিন্তু চারপাশ থেকে ইতোমধ্যে তার বুকে-পেটে ঢুকে পড়ে কয়েকটি ধারালো অস্ত্র। মুহূর্তে তীক্ষ্ণ-তীব্র একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে মল্লর সমস্ত স্নায়ু বেয়ে। সে উবু হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। তার দেহের ওপর তখনো উপর্যুপরি অস্ত্রাঘাত করা হচ্ছে। কিন্তু সেসবের আঘাতে আর কোনো কষ্টই টের পাচ্ছে না মল্ল। কারণ তার মনে হচ্ছে ঊর্ণাবতী মাটিতে বসে নরম কোমল কোলের উপর তুলে নিয়েছে তার মাথাটি।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অসম যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ভীম এবং ভীমের পরে কোনো যোদ্ধা আর বেঁচে নেই। ভীম, উগ্র আর পপীপের দেহে এত তীর বিঁধেছে যে তাদের মাটিতে পড়ে থাকা দেহকে তিনটি বিশাল সজারু বলে মনে হচ্ছে।
    বিজয়ী রামপাল যুদ্ধত্রে পরিদর্শনে এসেছে প্রিয় হাতি বাদল-এর পিঠে চড়ে। মাহুত তাকে নিয়ে এসেছে ভীমের ভুতলশায়ী দেহের কাছে। ভীমের মৃতদেহ নিজ চোখে দেখার আগে পূর্ণ বিজয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছে না রামপাল।
    ভীমের শরবিদ্ধ দেহের পাশে এসে বাদলকে দাঁড় করায় মাহুত। রামপাল নামে না হাতির পিঠ থেকে। একজন সৈন্যকে আদেশ করে ভীমের উবু হয়ে পড়ে থাকা দেহটিকে চিৎ করে দিতে। সৈন্যটি রাজার আদেশ পালন করে। রামপাল আদেশ করে, ভীমের একেবারে মুখের কাছে মশাল নিয়ে যেতে। যাতে সে পরিষ্কারভাবে দেখতে পারে ভীমের মৃতমুখ।
    মশাল আনা হয়। রামপাল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ভীমের মুখের দিকে। হঠাৎ মনে হয়, মশালের তীব্র আলোয় একবার নড়ে উঠেছে ভীমের চোখের পাতা। অবিশ্বাসে দুই চোখ বড় বড় হয়ে যায় রামপাল এবং তার সঙ্গীদের। তারা ভালো করে নিশ্চিত হতে চায়, যা দেখেছে তা তাদের চোখের ভুল। না। তাদের চোখ ভুল দেখেনি। কারণ এবার আস্তে আস্তে পুরোপুরি খুলে যায় ভীমের দুই চোখের পাতা। রামপাল আশ্চর্য হয়ে বলে- তুই এখনো মরিসনি! এখনো বেঁচে আছিস!
    ভীমের মুখে ফুটে ওঠে এক টুকরো আশ্চর্য সুন্দর হাসি। তারপরেই সেই মুখে ফুটে ওঠে তীব্র ঘৃণা। খুব কষ্টে ঠোঁট নাড়াতে পারে ভীম। রামপালের দিকে তাকিয়ে বলেÑ তুই বলেছিলি না যে তুই অর্জুনের বংশধর?
    বিহ্বল রামপালের মুখ থেকে নিজের অজান্তেই উত্তরটা বেরিয়ে আসে- হ্যাঁ বলেছিলাম।
    ঠিকই বলেছিলি। তুই আসলেই অর্জুনের বংশধর।
    একথার পিঠে কী বলবে বুঝে পায় না রামপাল। ভীম আবার বলে- অর্জুন আসলে কে জানিস?
    পাণ্ডুর পুত্র।
    না। অনেক কষ্ট হলেও মাথা এদিক-ওদিক নাড়িয়ে অস্বীকৃতি জানায় ভীম- অর্জুন আসলে পাণ্ডুর বীর্যে জন্ম নেয়নি। তার মা কুন্তি নিজের মুখেই স্বীকার করেছে, অর্জুনের জন্ম হয়েছিল ইন্দ্রের বীর্যে। অর্জুন আসলে জারজ সন্তান।
    একথার কী উত্তর দেবে রামপাল! সে কাঁপতে থাকে ক্রোধে। ভীম সেই রকম কষ্ট করেই বলতে থাকেÑ জারজ অর্জুনের বংশধর তুই। তোদের জন্মের ঠিক নেই। তাই তোদের মুখের কথারও কোনো ঠিক নেই। তুই আসলেই অর্জুনের বংশধর। এই কথাটা জানানোর জন্যই এখনো বেঁচে রয়েছি আমি।
    ক্রোধে কাঁপছে রামপাল- না। তুই এখনো বেঁচে আছিস আমার হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে নরকে যাবি বলে!
    মাহুতকে ইঙ্গিত করতেই সে পরিচালনা করে বাদলকে। হাতিকে বহুবার এই কাজে ব্যবহার করেছে রামপাল। পায়ের নিচে কোনো মানবশরীরকে থেঁতলে যেতে দেখলে রামপালের মতো তার হাতিও আনন্দিত হয়। মাহুতের ইঙ্গিতমাত্র বাদলের বিশাল পায়ের নিচে থেঁতলে যায় ভীমের শরীর।
    ক্রোধে তখনো কাঁপছে রামপালের সমস্ত শরীর। মন এমন এক তিক্ততায় পরিপূর্ণ, যে তিক্ততা এর আগে কোনোদিন অনুভব করেনি সে। মনে হচ্ছে যুদ্ধে সে জয়ী হতে পারেনি। ল ল মানুষের সামনে তাকে হারিয়ে দিয়েছে ভীম। সেই অতিরিক্ত ক্রোধ আরো বিষ উগড়ে দেয় তার মুখ থেকে। সে নির্দেশ দেয়- ভীম বা কোনো কৈবর্তযোদ্ধার মৃতদেহ সৎকার করা যাবে না! ওগুলো এখানেই পড়ে থাকবে শৃগাল-কুকুর-শকুনের খাদ্য হবার জন্য!

২৪. অশেষ পর্বের সূচনা
সেই প্রতারণাপূর্ণ যুদ্ধের রাতের পরের সারাটি দিনও কেটে গেছে। এখন পরবর্তী রাত্রি নেমে এসেছে। রামপালের প্রহরীরা কাউকে ঘেঁষতে দেয়নি মৃতদেহগুলোর কাছে। প্রহরীদের নিজেদেরও অস্বস্তি হচ্ছে। মৃতদেহগুলোতে পচন শুরু হয়েছে। দুর্গন্ধে তিষ্টানো দায়। গন্ধ ভুলবার জন্য তারা আরো বেশি বেশি করে সোমরস পান করতে থাকে।

হঠাৎ মনে হয় একটি মশালের শিখা এগিয়ে আসছে এদিকে। প্রহরীরা চোখ কচলায়। তারা ভুল দেখছে না তো! তারপরে দেখা যায়, একটির পেছনে একটি- এইভাবে শত শত মশালের শিখা এগিয়ে আসছে এই দিকেই। একেবারে কাছে এসে পড়ায় প্রহরী বাধা দিতে এগিয়ে যায়- সাবধান! আর এগিয়ো না! রাজার নিষেধ আছে।
    কিন্তু মশালগুলো নিষ্কম্পভাবেই এগিয়ে আসতে থাকে। প্রহরীরা এবার কোষমুক্ত করে অস্ত্র- আর এগিয়ো না বলছি! তোমরা যেই হও, ফিরে যাও!
    কিন্তু মশালের এগিয়ে আসা বন্ধ হয় না। আক্রমণ করতে গিয়ে স্তম্ভিত প্রহরীরা দেখতে পায় মশাল নিয়ে এগিয়ে আসছে একের পর এক নারী। সকলের সামনে হেঁটে আসছে যে নারী, সে কী এই নরলোকের কোনো অধিবাসিনী নাকি স্বর্গলোক থেকে নেমে এসেছে এখানে! এত রূপবতী কোনো নারীকে তো কোনোদিন চোখে দেখেনি প্রহরীরা। তাদের অস্ত্রধরা হাত স্থানু হয়ে যায়। তারা সেই বিষাদের প্রতিমূর্তি অপরূপা নারীর দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। সেই সুন্দরীশ্রেষ্ঠা নারী প্রহরীদের দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র করে না। পেছনে শত শত নারীকে নিয়ে বধ্যভূমিতে প্রবেশ করে মশাল হাতে। তারা প্রতিটি ভূমিপুত্রের মৃতদেহের কাছে যায়, আর বিলাপের সুর তোলে আকাশে-বাতাসে। প্রহরীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সচকিত হয়ে দেখে চারদিক থেকে মানুষ আসছে ভূমিপুত্রদের এই বধ্যভূমির দিকে। আসছে নারী, আসছে বৃদ্ধ, আসছে প্রৌঢ়, আসছে শিশু। তারা বিলাপ করে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এগিয়ে আসছে। প্রহরীরা এমন পরিস্থিতে পড়ে সম্পূর্ণ হতবাক। তারা জানে না এখন তাদের কী করা উচিত। তাই কিছুই না করে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একপাশে। আর আসতে দেখে বিলাপরত মানুষের মিছিল।
    আসছে কৈবর্ত নারী-পুরুষ।
    আসছে ভিল নারী-পুরুষ।
    আসছে রাজবংশী নারী-পুরুষ।
    আসছে শবর নারী-পুরুষ।
    এমনকি আসছে আর্যবংশীয় শত শত নারী-পুরুষও।

    তারা বিলাপ করে চলেছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষাতে। কিন্তু সেই ভিন্ন ভিন্ন ভাষার কান্নাভেজা বিলাপ ধীরে ধীরে একটি অন্য সমন্বিত ভাষায় রূপ নিতে থাকে। সেই ভাষা কৈবর্ত বুঝতে পারছে। ভিল-শবর-রাজবংশীরাও বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে হিন্দু ধর্মীরাও, যারা এখন আর আর্য বলে নিজেদের পৃথক  করে রাখে না। যারা মনে করে শত শত বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ আর্যাবর্ত থেকে এসেছিলেন বটে; কিন্তু এখন আর্যাবর্ত তাদের অনেক অনেক অতীত জীবনের স্মৃতি। তারা মনে করে এই গৌড়-বরেন্দ্রী-পুণ্ড্রবর্ধনই তাদের পিতৃভূমি এবং মাতৃভূমি। তারা সবাই অনায়াসে বুঝতে পারে এই নতুন সমন্বয়ের ভাষা। কিন্তু কেউ জানে না এই ভাষার নাম কী!
    তারা জানবে অবশ্য আরো অনেক বছর পরে। যখন কবি ভুসুকু আর্তনাদ করবে- ‘আজি ভুসুকু বাঙালি ভইলা’ বলে। তখন সবাই জানবে এই ভাষার নাম বাংলাভাষা।

আর্তনাদ এবং বিলাপমুখর নারী-পুরুষ তাদের প্রিয়জনদের সৎকারের জন্য চিতা সাজায়। হাজার হাজার বীরকে তোলা হয় অভিন্ন চিতায়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সেই চিতা। তার ধোঁয়া আকাশে ঊর্ধ্বপানে উঠছে তো উঠছেই। উঠতে উঠতে একসময় বোধহয় সেই ধোঁয়া হিমালয়ের চাইতেও উঁচুতে উঠে এক জায়গায় কুণ্ডলি পাকাতে থাকে। কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে ধোঁয়া রূপ নেয় মুষ্টিবদ্ধ একটি হাতের, যে হাত আরো উঁচুতে উঠে চলেছে। মুষ্টিবদ্ধ সেই হাতের ঊর্ধ্বারোহণের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আকাশের সীমা কে দেখেছে কবে! সেই মুষ্টিবদ্ধ হাত এতই উঁচুতে ওঠে যে তাকে দেখা যায় আর্যাবর্ত থেকে, তামিল থেকে, সাগরপারের সিন্ধু-গান্ধার থেকে। সেই ধোঁয়ার ভাস্কর্য পৃথিবীকে জানাচ্ছেÑ আবার আমি আসব! হাজার বছর পরে হলেও আসব! এই জাতির মুক্তি হয়ে ফিরে আসব!     
        
[শেষ]
      
বাংলাদেশ সময় ১৭৫০, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।