ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব, অধ্যায় ১৩-১৭

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১১
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব, অধ্যায় ১৩-১৭

১৩. খবর আসছে প্রতিনিয়ত

সেগুলির সিংহভাগই আবার অমঙ্গল-বার্তা।
    মথন দেব, তার দুইপুত্র কাহ্নুর দেব-সুবর্ণ দেব, তার ভ্রাতুষ্পুত্র শিবরাজ দেব, তার জামাতা দেবরতি তো আগে থেকেই রামপালের সকল কাজের সঙ্গী।

শোনা যাচ্ছে এখন তাদের জোট ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হচ্ছে। রামপাল স্বর্ণ-রৌপ্য দুই হাতে বিলিয়ে চলেছে মিত্র ক্রয়ের জন্য। সামন্ত বা মহাসামন্তরা যা দাবি করছে, সেই দাবিই মেনে নিচ্ছে রামপাল। নিজের সমস্ত সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে হলেও সে জনক-ভূ বরেন্দিকে পুনরাধিকার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে তো জানে, বরেন্দিকে পুনরায় হস্তগত করতে পারলে এর চাইতে অনেক গুণ বেশি সম্পদ অর্জন করা যাবে এক বছরেই। তাই টাকার বস্তা হাতে নিয়ে ছুটছে রামপাল। বরেন্দির রাজকোষ থেকে সে সব সম্পদ চুরি করে পালিয়েছিল। সেগুলি অকাতরে কাজে লাগাচ্ছে বরেন্দি পুনরাধিকারের যুদ্ধে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার মায়ের সঞ্চিত সকল সম্পদ। প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে মাতুল মথন দেব। একে একে রামপালের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মগধের ভীমযশা, কোটাটবীর বীরগুণ, দণ্ডভুক্তির অধীশ্বর জয়সিংহ, অপরমন্দারের লক্ষ্মীশূর, কুজবটীর শূরপাল এবং নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ। পূর্বে বরেন্দির সামন্তরাজ্য ছিল, এমন এগারোটি রাজ্যের সকল সামন্ত রাজাই যোগ দিয়েছে রামপালের সাথে। তাদের প্রত্যেককে রামপাল দিয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা, একশত জন রাষ্ট্রকূটবংশীয়া সুন্দরী তরুণী, এবং সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার পরে দশ বৎসর কর দেওয়া থেকে অব্যাহতির প্রতিশ্রুতি।

এসব সংবাদ শুনে ভীমের পরামর্শক পদ্মনাভ এবং সেনাপতি হরিবর্মার কপালের কুঞ্চন বেড়ে চলে। তারা নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির পরামর্শ দেন অবিরত। হরিবর্মা মনে করিয়ে দেন যে, শক্তিশালী অশ্বারোহী বাহিনী না থাকলে যুদ্ধে জয়লাভ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। বরেন্দিতে ঘোড়া পাওয়া যায় না। পার্শ্ববর্তী কোচ রাজার সাথে ভীমের কথা হয়েছিল। তিনি পাঁচ সহস্র অশ্ব বিক্রয় করবেন। সেই পরিমাণ অর্থও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি অশ্ব প্রদানে নিজের অপারগতা জানিয়ে ভীমের প্রদত্ত অর্থ ফেরত পাঠিয়েছেন। মল্ল জানিয়েছিল যে সে দেখেছে অনেক দূরের দেশ থেকে তুরুক জাতির মানুষরা আসে ঘোড়া বিক্রি করতে। তাদের ঘোড়াগুলি খুবই বলিষ্ঠ এবং সুদেহী। তারা আসে সমুদ্রপথে অনেক বড় নৌযান নিয়ে। কিন্তু তাদের দেখা পেতে হলে যেতে হবে তাম্রলিপ্ত বন্দরে। সেটি আবার বৈরিরাজ্য সমতটের ওপারে। তাই তুরুক জাতির বৈশ্যদের সাথে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। তখন সেনাপতি উগ্র পরামর্শ দেয় অশ্বারোহী বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য গঠন করা হোক মহিষারোহী বাহিনী। প্রথমে প্রস্তাবটিকে হাস্যকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত এটিকেই একমাত্র কার্যকর সমাধান বলে গণ্য করতে হয়েছে। বরেন্দির বনাঞ্চলে প্রচুর বুনো মহিষ পাওয়া যায়। সেগুলি বিশালদেহী এবং দ্রুতগামীও বটে। সেগুলিকে ধরে এনে পোষ মানিয়ে যুদ্ধের উপযুক্ত করে তৈরি করতে পারলে আগ্রাসনকারীদের অগ্রগতি রোধ করে দেওয়া পুরোপুরিই সম্ভব হবে। সেই মহিষারোহী বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেনাপতি উগ্রকেই।

    মনমতো অশ্বারোহী বাহিনী গড়তে না পেরে মনে মনে মুষড়ে পড়েন সেনাপতি হরিবর্মা। মনে মনে আশংকিত হন পদ্মনাভও। তিনি ভীমকে বোঝান যে, সৈন্যদল গড়তে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া উচিত। মহাভারত থেকে ভীষ্মের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি ভীমকে মনে করিয়ে দেন যে, রাজ্যের অঙ্গ হচ্ছে সাতটি। এগুলোর যে কোনো একটিও দুর্বল হলে রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সাত অঙ্গ হচ্ছেÑ রাজা, অমাত্য, সুহৃৎ, রাজকোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও সৈন্য।

পদ্মনাভ বলে চলেনÑ আমাদের বরেন্দ্রীতে রাজা আছেন কি না বোঝা যায় না। রাজকোষ তো প্রথমাবধি শূন্য, দুর্গের কোনো চিহ্নই নেই এই রাজ্যে। এখন সৈন্যদলকে যদি দুর্বল করে রাখা হয় তাহলে বিপদে সহায় হবে কে?

ভীম হেসে বলে- বিদ্বান পদ্মনাভ, আপনার যত শ্রদ্ধাই থাকুক ভীষ্মের প্রতি, আমি কিন্তু তার প্রতিটি বাক্য অকাট্য বলে মেনে নিতে সম্মত নই। তিনি রাজ্যের সাতটি অঙ্গের কথা বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বা ভিত্তির কথাই উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। সেই ভিত্তি হচ্ছে প্রজাপুঞ্জ। অথবা সাধারণ জন। তারা যদি রাজা বা নেতার সহায় হোন, তাহলে অবশিষ্ট সকল অঙ্গের ঘাটতি পূর্ণ করা কোনো সমস্যাই নয়। আমাদের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে প্রতিরা-বাঁধের কথাই ধরুন। প্রজাপুঞ্জ বিনা পারিশ্রমিকে মাসের পর মাস কাজ করে নির্মাণ করছে সেই দুর্ভেদ্য প্রতিরা-ব্যবস্থা। আর কোথাও আপনি দেখতে পাবেন এমন উদাহরণ!

হ্যাঁ। এমন ঘটনা অশ্রুতপূর্বই বটে। মেনে নেন পদ্মনাভ। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেনÑ কিন্তু সুশিতি বিশাল সৈন্যদলের বিরুদ্ধে আপনার এই বিপুল জনসমর্থন তেমন ফলদায়ক হবে না নেতা। তারজন্য আপনারও থাকতে হবে অনুরূপ প্রশিক্ষিত সেনাদল।

একথার উত্তরে চুপ করে থাকে ভীম। কিছুণ নিজেও আর কোনো কথা না বলে ভীমের প্রতিক্রিয়া ল করেন পদ্মনাভ। তারপরে বলেনÑ তাছাড়া আমাদের প্রজাদের মধ্যে কৈবর্ত ছাড়াও একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ রয়েছেন যারা অন্য জাতির। যেমন কোল, ভিল, শবর, রাজবংশী। রামপালের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে এইসব জাতির মানুষদের আমরা পাশে পাব কি না, পেলেও তারা কোন ধরনের সহযোগিতা করবেনÑ ইত্যাদি সম্বন্ধে আমাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। তাদের নেতা বা   মোড়ল-মণ্ডলের সাথে আমাদের অবিলম্বে আলোচনা শুরু করা উচিত বলেই আমি মনে করি।

একথায় সায় দেয় ভীম। বলেÑ যদিও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এইসব জাতির মানুষ কখনোই আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে না, তবুও আপনার এই যুক্তি ঠিক যে তাদের সাথে আমাদের আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসা প্রয়োজন। তবে আমার নিশ্চিত বিশ্বাসÑ তারা আমাদের শুধু যে সমর্থন করবে তাই-ই নয়, বরং তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে রামপালের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করবে। কারণ তাদের স্বার্থ এবং কৈবর্তদের স্বার্থ তো এক এবং অভিন্ন।

বিষণ্ণ একটুকরা হাসি ফোটে পদ্মনাভের ঠোঁটেÑ আমরা যেভাবে ভাবছি, তারাও যে সেভাবেই চিন্তা করছে, এমন নিশ্চয়তা আমরা পাচ্ছি কোথায়! বরং আমার কাছে যে সংবাদ রয়েছে, তা উদ্বেগজনকই।

ভ্রু কুঁচকে তাকায় ভীম- কেমন?
পদ্মনাভ বলেন- আমি বিশেষ করে রাজবংশীদের কথা বলতে চাই। আমার ধারণা, তারা নিজেদেরকে কৈবর্তদের সাথে এক করে ভাবে না বলেই আমি জেনেছি।

এবার পরিপূর্ণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পদ্মনাভের দিকে তাকায় ভীম। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসেÑ তাই কোনোদিন হতে পারে? না। এ আমি বিশ্বাস করি না।

পদ্মনাভের ঠোঁটের কোণে আবার সেই বিষণ্ণ হাসি- তাহলে আমরা কাল সকালেই যাই না কেন রাজবংশী নেতাদের সাথে কথা বলতে!

    ঠিক আছে। ভীম সায় দেয়- আমরা কাল সকালেই যাব।

    এই সময় মল্লকে দেখা যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। ঢুকবে কিনা ভাবছে। তাকে দেখামাত্র আহ্বান জানায় ভীমÑ এসো মল্ল! কোনো সমস্যা?

    মল্ল কথা বলার আগে একবার পদ্মনাভের দিকে তাকায়। তারপর বলেÑ পঞ্চনগরী থেকে সংবাদ এসেছে। সেখানে তো বারবার গুপ্তঘাতকের আক্রমণ হচ্ছে এ সংবাদ রাজা তো আগে থেকেই জানেন। আমাদের প্রতিরোধী সৈন্যরা তাদের কোনো আক্রমণই প্রতিহত করতে পারেনি এ পর্যন্ত। কারণ তারা এমন আচমকা উদয় হয়, আর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে নগরবাসীর তি করে আবার প্রহেলিকার মতোই মিলিয়ে যায়। এতই দ্রুত তারা চলে যায় যে আমাদের সৈন্যরা একদিনও তাদের পশ্চাদ্ধাবন করার সুযোগ পায়নি। তারা সংবাদ পেয়ে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে অশ্বপৃষ্ঠে গুপ্তঘাতকদের তাড়া করতে যায় বটে। কিন্তু নগরপ্রান্তে পৌঁছে তারা আক্রমণকারীদের সামান্যতম চিহ্ন পর্যন্ত খুঁজে পায় না। তারা যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। আর গতরাত্রিতে তারা সরাসরি আক্রমণ করেছে আমাদের প্রতিরোধী সৈন্যদের শিবিরেই। অল্প কয়েকজন মাত্র সৈন্য ছিল আমাদের। তারা প্রায় সকলকেই হত্যা করেছে। তারপর যথারীতি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। পঞ্চনগরীর অধিবাসীরা এখন ভীত-সন্ত্রস্থ। অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে মানুষ পঞ্চনগরী ছেড়ে পালাতে শুরু করবে।
    কী ব্যবস্থা নিতে চাও?

    মল্ল বলে- অবিলম্বে সেই রাস্তাটি খুঁজে বের করতে হবে, যে পথ দিয়ে আক্রমণকারীরা আসে।
    ভীমের কপালে কুঞ্চন। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলে এমন হয় তার। তাই কথা না বলে অপো করে মল্ল। কিছুণ পরে ভীম জিজ্ঞেস করেÑ পঞ্চনগরী থেকে সীমান্ত কত দূরে?

    মনে মনে পথ-গণনা করে মল্ল। বলে- ঘোড়া খুব জোরে ছুটিয়ে এলেও তা অন্তত আধাবেলার পথ। সেই জন্যই তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এতটা দূরত্ব ওরা এত নিঃশব্দে কীভাবে পেরিয়ে আসে? আবার কীভাবেই বা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যায়!

    ভীম জিজ্ঞেস করে- তোমার কি মনে হয় না...
    মল্ল কেড়ে নেয় তার মুখের কথাÑ হ্যাঁ। আমার মনে হয় ওরা আমাদের মাটিতেই কোনো গুপ্ত আশ্রয়ে বাস করছে। আমাদের সৈন্যরা পঞ্চনগরীর আশপাশের সকল বনভূমি, পাহাড়ি গুহা, টিলার আড়ালÑ সবকিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে। কিন্তু কোথাও কোনো গোপন আশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি নগরীর মধ্যেও সকল সন্দেহজনক স্থানে অনুসন্ধান করা হয়েছে। তাদের পাওয়া যায়নি।
    ভীম এবার একটু হাসে। জিজ্ঞেস করে- পঞ্চনগরী থেকে জগদ্দল বৌদ্ধবিহারের দূরত্ব কতটুকু?

    খুব সামান্য। বলেই উত্তেজনায় ফেটে পড়ে মল্ল- হায় ঠাকুর! আক্রমণকারী গুপ্তঘাতকের দল তো জগদ্দল বৌদ্ধবিহারেই আছে! একথা একবারও আমাদের কারো মনে হয়নি কেন! হায় রে আমরা এতই অযোগ্য! আমাদের এই অযোগ্যতার দরুণ কত যে তি হয়ে গেল!
    ভীম এগিয়ে আসে। সান্ত্বনার হাত রাখে মল্লর কাঁধে- নিজেকে শুধু শুধু দোষী আর অযোগ্য ভেবো না মল্ল। কেইবা সন্দেহ করবে যে একটি শ্রদ্ধার জায়গা এবং ধর্মীয় পীঠস্থান ব্যবহৃত হচ্ছে শত্রু র আশ্রয়স্থলরূপে! অনুশোচনায় সময় নষ্ট না করে যাও, যত শীঘ্র পারো প্রতিবিধান করো এই দুষ্কর্মের।

১৪. মহাবিহার অবরোধ

মধ্যরাতে চার পাশ ধেকে  ঘিরে ফেলা হলো জগদ্দল মহাবিহার।
    দ্বিতলের দুই-তিনটি প্রকোষ্ঠে আলো দেখা যাচ্ছে। সেসব প্রকোষ্ঠে থাকেন সত্যিকারের বুদ্ধশিক্ষা নিয়ে পাঠরত অধ্যাপকরা। কিন্তু নিচের কোনো প্রকোষ্ঠের আলো বাইরে আসতে পারছে না। কারণ সেইসব করে ভেতরে তখন চলছে পঞ্চ ম-কারের সাধনা। মুদ্রা, মাংস, মদ্য, মৎস্য এবং মৈথুনের ছড়াছড়ি। কোনো কে মেঝেতে জ্যামিতিক নকশা এঁকে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সাধকরা মিলিত হচ্ছে সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে। কোনো প্রকোষ্ঠে চলছে যুগলনৃত্য। কোনো প্রকোষ্ঠে পাঠ হচ্ছে এমন সব তান্ত্রিক মন্ত্রের যা যতখানি তান্ত্রিক, তার চাইতে বেশি আদিরসাত্মক। সকল পন্থারই শেষফল একই। যথেচ্ছ নারীসম্ভোগ। এদের কাছে মৈথুন হচ্ছে নির্বাণের প্রাথমিক পর্যায়। এদের শাস্ত্রে নারীর যৌনাঙ্গের নাম হচ্ছে প্রজ্ঞা, যা সকল সুখের আধার। আর পুরুষ এখানে আদর্শ, যার আরেক নাম বজ্র। যদিও বজ্র বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষাঙ্গকেই বোঝানো হয়। প্রজ্ঞা ও আদর্শ, তথা নারী ও পুরুষের মৈথুনে অনন্ত পুলকের উপলধ্বি ঘটে, যাতে অন্য সকল মানসিক ক্রিয়া কিছুণের জন্য হলেও হারিয়ে যায়, চারদিকের বাহ্যজগৎ অবলুপ্ত হয় এক সর্বব্যাপী একত্বের মধ্যে। এটাই সেই মহাসুখ, যার আরেক নাম নির্বাণ, এবং এটাই বোধিচিত্তের যথার্থ প্রকাশ।

    পপীপ কাছ থেকে এর আগে কোনো বৌদ্ধ মহাবিহার দেখেনি। আজ মহাবিহারের বিস্তার এবং বিশালতা দেখে সে অবাক হয়ে যায়। এ তো রীতিমতো একটি নগর! এটি যদি একটি বিদ্যাপীঠই হয়ে থাকে, তাহলে এর চারপাশ এই রকম প্রাকারবেষ্টিত কেন? বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে শিক্ষার্থীরা পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া আর কিছুই তো শিখবে না। গৌতম বুদ্ধ কি এই রকম কোনো মহাবিহার চেয়েছিলেন তার শিষ্যদের জন্য? মনে হয় না। যিনি নিজেকে রাজপ্রাসাদের আঙিনা থেকে মুক্ত করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পৃথিবীজুড়ে, তিনি কীভাবে এই রকম বদ্ধ প্রকোষ্ঠ অনুমোদন করবেন তার পরবর্তী প্রজন্মের শিষ্য-অনুসারীদের জন্য! আর ধর্ম তো মানুষের জন্য। সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে না গেলে কীভাবেই বা প্রচারিত হবে বুদ্ধের বাণী! তবে মনের মধ্যে কৌতূহল বাড়তে থাকে পপীপের। কী হয় এইসব মহাবিহারের অভ্যন্তরে, তা ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখার এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি বলেই মল্লর সাথে এই অভিযানে যোগ দিয়েছে পপীপ।

    মহাবিহারের চারপাশে মল্লর লোকেরা এমনভাবে অবস্থান নিয়েছে যেন তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে একটি মাছিও বিহার থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে বা ঢুকতে না পারে। মূল দরোজার সামনে নিজে রয়েছে মল্ল। চারভাগে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র সৈনিকরা অবস্থান নিয়েছে চারটি দরোজার সামনে। প্রত্যেক উপদলের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ এবং সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক অশ্বারোহী যোদ্ধা। এই অশ্বারোহী দল প্রাকারের পাশ দিয়ে অনবরত প্রদণি করতে থাকবে মহাবিহারের চতুঃসীমা।

    তকের ডাক ভেসে আসে। বোঝা যায়, শেষ হয়ে আসছে রাত্রি। আর কিছুণের মধ্যেই প্রত্যুষের কোমল আলো ফুটে উঠবে বরেন্দির আকাশে। বরেন্দির মানুষ যে মুহূর্তে অন্য আলোর সাহায্য ছাড়াই দেখতে পায় নিজের হাতের কররেখা, তখনই শুরু হয় তাদের প্রত্যুষ।
    ধৈর্য ধরে অপো করছে কৈবর্তযোদ্ধারা। যেন আগে-ভাগে শোরগোল তুলে নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না মহাবিহারবাসীদের। তাদের কোনো তাড়াহুড়া নেই।

    প্রত্যুষের ঠিক আগের মুহূর্তে খুলে যায় মহাবিহারের প্রধান দরোজা। হলুদে ছোপানো বস্ত্র পরিহিত মুণ্ডিতমস্তক শিার্থীর দল বেরিয়ে আসে একসারিতে। তারা প্রদণি করবে মহাবিহারের সামনে রতি পবিত্র চৈত্য। এই চৈত্য-প্রদণি দিয়েই শুরু হয় তাদের প্রতিদিনের কার্যক্রম।
    তারা বাইরে বেরিয়েই থমকে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র যোদ্ধার দল। প্রত্যুষের আলো-আঁধারিতে তাদের আরো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। শিার্থীরা কিছুণ ইতস্তত করে। তারপর এগুতে চায় চৈত্যের দিকে। কিন্তু বাধা আসে। বাধা দেয় মল্লর সৈন্যরা। জানিয়ে দেয়, মহাবিহার থেকে কেউ বাইরে যেতে পারবে না। শিার্থীর দল ফিরে যায় আবার মহাবিহারে। কিছুণ পরেই ভেতর থেকে শোর-গোলের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। অকস্মাৎ সুপ্তি থেকে যেন একসঙ্গে জেগে উঠেছে সমগ্র মহাবিহার। মল্লর দুইজন লোক এগিয়ে যায় দরোজার দিকে। দ্বাররীদের জানায় অধ্যকে সংবাদ দিতে। তিনি যেন দয়া করে বাইরে আসেন। রাজা ভীমের নির্দেশ নিয়ে এসেছে তারা। সেটি জানাতে হবে অধ্যক্ষকে।
    কিছুণ পরে তিন সঙ্গীসহ বাইরে বেরিয়ে আসেন মহাবিহারের অধ্য শ্রীলবিভূতি বিরুদ। তখন সূর্য প্রায় উঠে এসেছে বরেন্দির আকাশে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবকিছু। অধ্য বিরুদকে দেখে নিরতিশয় হতাশ হয়ে যায় পপীপ। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাবাহকের এ কী অবয়ব! হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ পুরোহিতদের সঙ্গে কোনোই পার্থক্য নেই। দিব্যি তেলে-জলে ভোগী চেহারা। শরীরময় ঘি-চকচকে চর্বির প্রাবল্য। ঘৃত-ব্যঞ্জন খেয়ে খেয়ে আর নর-নারীদের সেবা গ্রহণ করে করে থলথলে একটি শরীরের অধিকারী হয়েছেন বিরুদ। পরনে বহুমূল্যবান হলুদ বস্ত্র। পায়ে পাদুকা। মুণ্ডিত মস্তক ইতোমধ্যেই ঘেমে উঠেছে। চকচক করছে প্রভাতী সূর্যের আলোর প্রতিফলন ঘটায়। এইটুকু শারীরিক পরিশ্রমেই হাঁসফাস করছেন অধ্য। অবশ্য শারীরিক পরিশ্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে মানসিক পীড়ন এবং ভীতিও। তবে মহাবিহারের একজন অধ্যরে প্রতি মনের মধ্যে যতটুকু শ্রদ্ধাবোধ ছিল পপীপের, এই অধ্য বিরুদকে দেখামাত্র তা উবে যায়। তার মনে পড়ে মহামানব গৌতম তার শিষ্য ভিক্ষুদের জন্য কোন ধরনের জীবনাচরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

    বুদ্ধের নির্দেশ ছিল ভিক্ষুরা তাদের পরিধেয় বসন মৃতের পরিত্যক্ত বস্ত্র থেকে সংগ্রহ করবে। তারা দিনে একবারের বেশি দুইবার খাদ্যগ্রহণ করবে না, কারণ এতে শরীরের অভ্যন্তরে খাদ্যের সঞ্চয় হয়। কোনো বিশেষ খাদ্য সম্পর্কে ভিক্ষুরা কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারবে না। তাদের চীবর(পরিচ্ছদ) হবে মাত্র তিন টুকরা কাপড়, হলুদ রঙে ছোপানো। ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র সবকিছুই সংঘের। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে বসবাসকারী প্রতিটি ভিক্ষুকে অমাবস্যা এবং পুর্ণিমার দিনে একত্র হতে হবে। সভাপতি বা সংঘের নির্বাচনের পরে পাতিমোরে নিয়মাবলী আবৃত্তি করা হবে, এবং যদি কারো কোনো বিচ্যুতি ঘটে থাকে, তা সর্বসমে স্বীকার করতে হবে।

    পপীপের মনে পড়ে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতিতে(সম্মেলনে) পূর্বদেশীয় ভিুদের দশটি পাপের জন্য অভিযুক্ত ও ভর্ৎসনা করা হয়েছিল। সেগুলি ছিল-
    সিঙ্গিলোণকপ্প। শৃঙ্গের মধ্যে লবণ পরিবহন।
    দ্বঙ্গুলকপ্প। যখন দুটি আঙ্গুলের ছায়া পড়ে, অর্থাৎ মধ্যাহ্ন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরে ভোজন।
    গামন্তরকপ্প। একই দিনে বাড়তি ভোজনের উদ্দেশ্যে অন্য গ্রামে গমন।
    আবাসকপ্প। একই সীমার মধ্যে একাধিক উপোসথ অনুষ্ঠান।
    অনুমতিকপ্প। কোনো কাজ করার পরে তার অনুমোদন প্রদান করা।
    আচিঞকপ্প। কোনো ঘটে যাওয়া অঘটনকে উদাহরণ রূপে গ্রহণ করা।
    অমথিতকপ্প। ভোজনের পরে ঘোল সেবন করা।
    জলোগিম-পাতুম। গ্যাঁজানো তাল বা খেজুরের রস(তাড়ি) খাওয়া।
    অদসকম-নিসিদনম। পাড়বিহীন কম্বল ব্যবহার করা।
    জাতরূপরজতম। স্বর্ণ ও রৌপ্য গ্রহণ করা।

    পপীপ দুঃখের সাথে মাথা নাড়ে। ঐগুলিকে যদি পাপ ধরা হয়, তাহলে এখনকার বৌদ্ধ আচার্যদের কার্যকলাপকে কী বলা যাবে! তার সামনে দাঁড়ানো আচার্য বিরুদকে তার দুর্বৃত্ত বলে মনে হতে থাকে।
    মল্ল অবশ্য অধ্য বিরুদকে যথাযথ ভক্তিভরেই অভিবাদন জানায়। তারপর বলেÑ আমরা জেনেছি, রামপালের পাঠানো একদল গুপ্তঘাতক আপনার মহাবিহারে আশ্রয় নিয়েছে। তারা এই বিহারে আত্মগোপন করে পঞ্চনগরীর শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের ওপর গুপ্ত আক্রমণ চালাচ্ছে, তাদের ধন-সম্পদের তিসাধন করছে, এমনকি অনেককে হত্যাও করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, আপনি, আচার্য বিরুদ, এই মাতৃভূমিবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজে জড়িত নন। সম্ভবত সেই দুর্বৃত্তের দল আপনার অজান্তেই এই বিহারে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাই আপনার কাছে অনুমতি প্রার্থনা করছি, আমাদের মহাবিহারে প্রবেশ করে অনুসন্ধানের অনুমতি দান করুন। আমরা অন্য কারো কোনো তি করব না। শুধু দুর্বৃত্তদলকে বন্দি করে নিয়ে চলে যাব। আমরা আপনার সহযোগিতা কামনা করছি!
    বিরুদের গা থেকে ঘাম চুইয়ে পড়ার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। তবু লোকটা ভেঙে পড়ে না। রীতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেÑ কিন্তু ত্রিশরণ না নেওয়া কোনো ব্যক্তি তো আমাদের বিহারে প্রবেশ করতে পারে না। এই রীতি তো আপনি জানেন সেনাপতি!
    মল্ল রাগ করে না। হাসিমুখেই বলেÑ তাহলে আপনিই সেই দুর্বৃত্তদের আপনার বিহার থেকে বের করে আমাদের হাতে তুলে দিন!
    বিরুদ পিছু হটতে অসম্মতÑ এমন কেউ আমাদের বিহারে অবস্থান করছে না। যারা এখানে আছেন, তারা সকলেই সম্মানীত অধ্যাপক, ভিু এবং শিার্থী। কেউ আপনাদের ভুল তথ্য দিয়েছে সেনাপতি।
    এবার স্বমূর্তি ধারণ করে মল্লÑ আপনার মিথ্যাভাষণ আমি আর কানে তুলতে চাই না। আপনি ভেতরে যান। আমরা বাইরেই অপো করছি। ভেতরে গিয়ে আপনি আপনার অন্যান্য অধ্যাপকদের সাথে পরামর্শ করুন। আমি আপনাদের দ্বিপ্রহর পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে যদি আপনি রামপালের পাঠানো গুপ্তঘাতকদের আমার হাতে প্রত্যর্পণ না করেন, তাহলে আপনার বা এই মহাবিহারের ভাগ্যে যা ঘটবে, তার জন্য আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না। সেইসঙ্গে মনে রাখবেন, আমাদের এই অবরোধ সর্বাত্মক। কোনো কাক-পীকেও ভেতরে প্রবেশ করতে বা নিষ্ক্রান্ত হতে দেওয়া হবে না।
    বিরুদের তিন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে মল্ল বলে- আপনারা সাক্ষ্য রইলেন। আমি আপনাদের অধ্যকে যথোচিত সম্মান দেখিয়েছি এবং পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি। এরপরে যা ঘটবে, তার দায়-দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের অধ্যরে ওপর বর্তাবে!
    বিরুদসহ চারজন আবার মহাবিহারের অভ্যন্তরে চলে যায়।

    নিজের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে মল্ল আদেশ করে- প্রহরীদের জন্য প্রয়োজনীয় চালা নির্মাণের ব্যবস্থা করো। আমাদের সম্ভবত বেশ কয়েকটা দিন এই ভাবেই কাটাতে হবে। পঞ্চনগরীতে লোক পাঠাও। সেখানকার মোড়লকে বলতে হবে আমাদের সকল সৈনিকের জন্য তিনবেলা খাদ্য-পানীয় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। প্রয়োজনীয় চাল-ডাল-আনাজ সবকিছু রাজকীয় গোলাঘর থেকে সংগ্রহ করে নিতে বলবে।
    পপীপ অবাক হয় কিছুটা। বলে- অধ্যক্ষ তো কেবলমাত্র ভেতরে গেলেন। তারা কী সিদ্ধান্ত দেয় তা না জেনেই এত আয়োজন করার কি কোনো প্রয়োজন আছে?
    হাসে মল্লÑ তুই এখনো ছেলেমানুষ। এই মহাবিহার চলে রামপালের চোরাপথে পাঠানো অর্থে। বিরুদের মতা নেই রামপালের লোককে আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার।
    তাহলে?
    তাদের বাধ্য করার জন্যই তো এই অবরোধ। আমি এইটুকু জানি যে, মহাবিহারের মধ্যে কোনো ভাঁড়ার ঘর থাকে না। প্রতিদিনের খাদ্য-পানীয় জল এমনকি স্নানের জলও প্রতিদিন সংগ্রহ করতে হয়। আমরা তো কউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেব না। দেখি ব্যাটারা না খেয়ে কদ্দিন থাকতে পারে!
    পপীপ হেসে বলেÑ তাহলেই হয়েছে। যেভাবে চর্ব্য-চোষ্য খেয়ে খেয়ে মহান আচার্যবৃন্দ ভোগী শুয়োরের মতো দেহ বানিয়েছেন, খাদ্য বন্ধ হলে এইসব মহান ব্যক্তি একটি দিনও টিকতে পারবেন বলে মনে হয় না।
    হেসে ফেলে মল্লওÑ তোর ধারণা সঠিক। তবে কি না রামপালের লোকেরা রয়েছে তো ভেতরে। তারা এত সহজে আচার্যদের দরোজা আত্মসমর্পণ করতে দেবে না। সেক্ষেত্রে তিনটি দিনের অন্তত প্রয়োজন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

১৫. আত্মসমর্পণ এবং বিচার

ঠিক তিন দিন পরেই খুলে গেল জগদ্দল মহাবিহারের প্রধান দ্বার।
    এবার আর আচার্য বিরুদ নিজে আসার সাহস পাননি। কিংবা এমনও হতে পারে যে তিন দিনের খাদ্যাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অধ্য। মহাবিহারের অন্য তিন অধ্যাপক এগিয়ে এলেন। তারা করজোড়ে মল্লর সামনে দাঁড়িয়ে বললেনÑ আমরা আর পারছি না। আত্মসমর্পণ করছি। দয়া করে অবরোধ সরিয়ে নিন!
    মল্ল কঠোর দৃষ্টিতে কিছুণ তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। সেই দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যান তিন অধ্যাপক। মল্ল দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলেÑ অনেক সহ্য করেছি তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতা। নিজের জন্মমাটির সাথেও তোমরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারো। তোমরা আবার ধর্মনেতা! কোন ধর্ম বলে যে নিজের জন্মভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা যায়? আর নয়। ফিরে যাও তোমরা। তোমাদের সঙ্গীদের গিয়ে বলো যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে হবে তোমাদের। আর সেই সাথে চিহ্নিত করে দিতে হবে রামপালের পাঠানো দুর্বৃত্তদলকে। যাও! আমার এই ঘোষণা জানিয়ে দাও মহাবিহারের সকলকে। তারপর একজন একজন করে বেরিয়ে আসবে প্রধান দরজা দিয়ে। যাও! দ্বার খোলা থাকবে মহাবিহারের। আমরা যখন আদেশ করব, তখন একে একে বেরিয়ে আসবে সুশৃঙ্খলভাবে।
    তাই হবে সেনাপতি! মল্লকে অভিবাদন জানিয়ে মহাবিহারের ভেতরে ঢুকে পড়ে তিন অধ্যাপক।
    সৈন্যদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয় মল্ল। যদিও বিহারের অধ্যাপকরা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, তবু সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা দ্বার খোলা পেয়ে হঠাৎ একযোগে ধেয়ে এসে আক্রমণ চালাতে পারে আমাদের ওপর। আবার শিার্থী বা অধ্যাপকদের ছদ্মবেশ ধারণ করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে প্রহরার ফাঁক গলিয়ে। তাই আমাদের কোনো রকম ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। প্রধান দ্বারের দুই পাশে মোট ছয়জনকে দাঁড়াতে হবে পাশাপাশি। তাদের মধ্যে দুইজনের দায়িত্ব হবে দরজা দিয়ে যে বেরিয়ে আসবে, তৎণাৎ শক্ত রজ্জুতে তার দুই হাত বেঁধে ফেলা। অন্য চারজন থাকবে উন্মুক্ত তরবারি হাতে প্রস্তুত অবস্থায়। এই চারজনের পরের সারিতে থাকবে আরো চারজন সশস্ত্র সৈনিক। আর যাকে বেঁধে ফেলা হবে, তাকে গ্রহণ করবে পরের সারির দুইজন। তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের অস্থায়ী চালাঘরের কাছে। সেই চালাঘর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে একশত জন সৈন্য। বাকি সৈন্যরা দুই সারিতে দাঁড়াবে মহাবিহারের দরজা থেকে চালাঘরের বন্দিশালা পর্যন্ত।
    একজন আপত্তির সুরে বলেÑ কিন্তু একজন একজন করে এইভাবে বাঁধতে গেলে সময় তো অনেক লেগে যাবে!
    তার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায় মল্ল। বুকে কাঁপন ধরানো গমগমে কণ্ঠে বলেÑ তাতে তোমার কোনো অসুবিধা আছে? বা তুমি কি মনে করো তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হতে পারে?
    প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে কিছুণ অপো করে মল্ল। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর আসে না। তখন মল্ল বলেÑ তাহলে পরিকল্পনামতো যে যার নির্দিষ্ট জায়গাতে দাঁড়িয়ে পড়ো!
    সৈন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে যাওয়ার পরে তীèদৃষ্টিতে আরেকবার খুঁটিয়ে দেখে মল্ল সব ঠিকমতো হয়েছে কি না। তারপর বিহারের দরজার সামনে গিয়ে হাঁক দেয়Ñ আমার আদেশমতো একজন একজন করে বেরিয়ে এসো!

    সত্যিই অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু কাজটি সুষ্ঠুভাবে সমাধা করতে পারায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মল্ল। এখন এই বন্দিদের নিয়ে কী করা হবে? পপীপ জানত না যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই আছে। সবাইকে বন্দি করার পরে খাদ্য এবং পানীয় দেওয়া হলো। ইতোমধ্যে অনেকগুলি মহিষের গাড়ি এসে পড়েছে। সেগুলিতে তোলা হলো মহাবিহারের অধ্য, অধ্যাপক, শিার্থী এবং অন্যান্য কর্মচারিদের। উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্যের প্রহরাধীনে মহিষের গাড়ি ওদের নিয়ে যাবে প্রতিরা বাঁধের কাছে। সেখানে তাদের স্বেচ্ছাশ্রম দিতে হবে বাঁধের কাজে। এটাই ওদের শাস্তি। আর রামপালের গুপ্তঘাতক দলের চল্লিশজন সদস্যকে পঞ্চনগরীতে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে উন্মুক্ত স্থানে তাদের বিচারসভা বসবে। ঐ দুর্বৃত্তদের দ্বারা তিগ্রস্ত নাগরিকবৃন্দ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে। এবং বিচার পরিচালনাও করবে নাগরিকবৃন্দই। ঐ দুর্বৃত্তরা এতদিন ধরে নরহত্যা, লুঠতরাজ, গৃহে অগ্নিসংযোগ, জনমনে ত্রাসসৃষ্টির মতো অপরাধ করেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। উন্মুক্ত স্থানেই বিচারকদের নির্দেশ অনুসারে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে সৈন্যরা। তারপর তাদের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হবে শৃগাল-কুকুরের খাদ্যে পরিণত হবার জন্য।
    এতগুলো মানুষকে এইভাবে মেরে ফেলা হবে!
    পপীপের উদ্বেগ যেন স্পর্শই করে না মল্লকে। সে বলে- ভুললে চলবে না বাছা, আমরা এখন যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি!

১৬. রাজবংশী-কৈবর্ত সংলাপ

একের পর এক উদ্বেগজনক সংবাদ আসছে।
    যাদের সাথে কৈবর্তদের দীর্ঘমেয়াদী মৈত্রীচুক্তি রয়েছে এমন অনেক রাজাও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রামপালের অর্থ-সম্পদ-সুন্দরী নারী এবং আরো অনেক পারিতোষিকের প্রলোভনের কাছে। এমনকি পার্বত্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপবর্ধন পর্যন্ত যোগ দিয়েছে রামপালের সাথে। হায় রে অর্থলালসা! হায় রে নারীলোভ! রক্তের বন্ধন পর্যন্ত শিথিল হয়ে যাচ্ছে অর্থের প্রলোভনের কাছে!  এক ভূমিপুত্রকে আরেক ভূমিপুত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রকূটবংশীয়া স্বর্গবেশ্যাতুল্যা নারীসংসর্গের মাদকতা।
    পদ্মনাভ প্রতিনিয়ত তাড়া দিচ্ছেন। যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিবেশী রাজ্যগুলির সাথে আলোচনায় বসা প্রয়োজন। তার চেয়েও শীঘ্র আলোচনায় বসতে হবে এই বরেন্দির কোল-ভিল-শবর-পুলিন্দা-রাজবংশীদের সাথে। তাদের কাছ থেকে একাত্মতার প্রতিশ্রুতি না পাওয়া গেলে সমূহ বিপদ। আঠারো সামন্ত-মহাসামন্তের সাথে একার শক্তিতে কৈবর্তরা পেরে উঠবে- এমনটি অসম্ভব না হলেও দুরূহ তো বটেই। নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হলে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও অন্যান্য জাতি-গোত্রকে দলে ভেড়াতেই হবে। একমাত্র তাহলেই নিশ্চিত করা সম্ভব বরেন্দির নিরাপত্তা।
    ভীমকে তখন উদ্যোগ নিতেই হয় আলোচনার হয়। দেখা যায় পদ্মনাভের ধারণাই সঠিক। যাদের সমর্থন এবং সক্রিয় সহযোগিতার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল ভীম, তাদের মধ্যে অনেক রকমের দোদুল্যমানতা দেখা দিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোচ-শবর-ভিল জাতির মোড়লরা সম্মত হয়েছে মাতৃভূমি রায় কৈবর্তদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল কৈবর্তদের পরে বরেন্দির সবচাইতে বড় ভূমিপুত্র-জাতি রাজবংশীদের নিয়ে। তাদের নেতা বাসুদেবের কথা শুনলে আঁতকে উঠতে হয়।
    রাজার সঙ্গে দেখা করার সময় যেসব উপহার নিয়ে যেতে হয়, সেগুলি সবই সঙ্গে এনেছে বাসুদেব। তাদের নিজহাতে নির্মিত ঢল্লরিকা(ডুলি), বাঁশের তৈরি বিভিন্ন তৈজস, একশতটি তরবারি, একশতটি ঢাল, বল্লম পঞ্চাশটি, আর তাদের গ্রামগুলিতে যেসব ফল-ফলারি জন্মে, সেইসব ফলে পূর্ণ পঞ্চাশটি ঝুড়ি। ভীম খুব খুশি হয়ে গ্রহণ করেছে এইসব উপঢৌকন। খুবই সম্মানের সাথে বসতে দিয়েছে বাসুদেবকে। জল-টল খাওয়ার পরে কথাবার্তার শুরুতে নিয়মমতো কুশল জিজ্ঞসার পালা। ভীম জিজ্ঞেস করেÑ কেমন আছো কাকা?
    বাসুদেবের মুখ বিরস হয়ে ওঠে- মোরা কেমন আছি তা আর কীভাবে বলি? তাবে একখান শোলোক বলি, তাতেই বুঝতে পারবে মোরা কেমন আছি বটি। শোলোকটি হচ্ছে-
        আগোত আছিনু মল্যের মাও
        এলা গোবর ফেলাও আর ভাত খাঁও!
    বুঝতেই পারো এখন মোদের অবস্থা!
    ভীম একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েÑ কেন কাকা? তোমাদের কোনো বিপদ-আপদ হয়েছে? তোমাদের দিন কি চলছে না? আমাকে তো কেউ কিছু জানায়নি!
    বাসুদেব তাকে আশ্বস্ত করেÑ না না, এখন তো মোরা খারাপ নাই। কিন্তু আমি শোলোকে বলেছি মোদের আদিপুরুষদের কর্মফলের কথা। মোরা আছিলাম রাজার জাত। এখন কোথায় মোদের সেই রাজ্যপাট বটি?
    ভীম হাসেÑ কেন এই বরেন্দি কি তোমাদেরও দেশ নয়? এখন তো বরেন্দি সকল ভূমিপুত্রেরই রাজ্য কাকা!
    না না আমি সেকথা বলিনি। আমি বলি মোদের পিতা-পিতামোর কথা। সে কী আজকের কথা ভীম! তোমরা তো জানো না। মোরা রাজবংশীরা আদিতে ছিলাম আর্য ত্রিয়। সেই কালে মোদের বংশের রাজার নাম ছিল রাজবর্ধন। পরশুরামের নাম তো জানো?
    একটু চিন্তা করে ভীমÑ কোন পরশুরামের কথা বলছ কাকা?
    আরে সেই মহাভারতের পরশুরাম। সেই পরশুরাম যে পৃথিবী থেকে ত্রিয়দের নিশ্চিহ্ন করেছিল আঠারো বার।
    হ্যাঁ শুনেছি।
    তো পরশুরামের ভয়ে, আর লিজের বংশরার উদ্দেশ্যে রাজা রাজবর্ধন পালিয়ে এসে ছদ্মবেশে বাস করতে লাগল ব্রক্ষ্মপুত্র-ত্রিস্রোতা-করতোয়ার তীরে। ক্রমে ক্রমে মোরা ভুলে গেলাম লিজেদের জাতির পরিচয়। ত্রিয় হয়ে গেল অসুর-বংশ।
    তা এতদিনে কে তোমাদের সেই পুরনো কথা মনে করিয়ে দিল কাকা?
    কথায় পেয়েছে বাসুদেবকে। সেই কথার তোড়ে সে বলে ফেলে- কে আবার? মনে করিয়ে দিল ঐ মথন দেব। রামপালের মামা। তার মায়ের লিজের ভাই বটি।
    তার সঙ্গীদের মুখ পাংশু হয়ে উঠতে দেখে নিজের ভুল বুঝতে পারে বাসুদেব। ভয়ে ভয়ে তাকায় ভীমের দিকে। ভীমের মুখ থমথম করছে। কিন্তু শান্ত কণ্ঠেই প্রশ্ন করেÑ মথন দেব এসেছিল তোমাদের কাছে?
    এবার বাসুদেবের মুখও পাংশু। সে ঢোক গিলে উত্তর দেয়Ñ না না তিনি আসেননি বটি। আমাকেই ডেকে পাঠিয়েছিল। আমিই গিয়েছিলাম। না গিয়ে উপায় কী বল বাবা ভীম! মথন দেবের লোক এসে বলল যে তোমাদের জাতির আদি কুল-ঠিকুজি খুঁজে পেয়েছে মথন দেব। লিজের শিকড় জানার ইচ্ছা কার না হয় বাপ তুই-ই বল! মোরা গেলাম। তখন মথন দেব জানাল এই এই বৃত্তান্ত। মোরাও দেখলাম ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে।
    আর কী বলেছে মথন দেব? রামপালের সাথে আমাদের যুদ্ধ বাধলে তোমাদের তার পে যোগ দিতে বলেছে?
    হ্যাঁ তা-ও বলেছে বটি। কিন্তু মোরা কোনো বচন দিই নি বাপ! বলেছি, মোদের লিজেদের মধ্যে আরো কথাবার্তা বলতে হবে।
    রামপালের পে যুদ্ধ করলে ওরা তোমাদের বিনিময়ে কী কী দিতে চেয়েছে?
    বুড়ো বাসুদেবকে আরো বুড়োটে দেখায়। কথা বলতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একবার মুখের কথা বেরিয়ে যাওয়ার পরে আর তো ফিরিয়ে আনা যায় না। তার সঙ্গীরা এরমধ্যেই ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। ভীমের মুখের দিকে তীèদৃষ্টিতে তাকায় বাসুদেব। সেই মুখে খোঁজে ক্রোধের রেখা। কিন্তু খুঁজে পায় না। বরং তার মনে হয় এক অব্যক্ত বেদনা ছেয়ে ফেলেছে ভীমের মুখমণ্ডলকে। বাসুদেবের নিজেরও একটু কষ্ট হয় সেই মুখ দেখে। বলেÑ কত কিছুই তো দিতে চায় মথন দেব। তবে মিথ্যে বলব না বাপ, মোদের চাওয়া হলো আদি জাতগর্ব ফিরে পাওয়া। মথন দেব বলেছে, আমরা যদি তাদের হয়ে যুদ্ধ করি, তাহলে রামপাল বরেন্দির রাজা হলে তারা শুদ্ধিযজ্ঞের আয়োজন করবে আমাদের জন্যে। ফিরিয়ে নেবে মোদের আর্যধর্মের মধ্যে।
    এতণে প্রথম কথা শোনা যায় পদ্মনাভেরÑ আপনারা আর্যধর্মে ফিরে যেতে চান?
    ইতস্তত করে বাসুদেব এবং সঙ্গীরা। তারপর বলে- লিজের জাতি-পরিচয় ফিরে পেতে কে না চায় বটি?
    পদ্মনাভ আবার বলেÑ কিন্তু আপনারা কি জানেন, আর্যধর্মে ফিরে গেলে আপনারা আর ত্রিয় বলে চিহ্নিত হতে পারবেন না। তখন আপনাদের বর্ণ হবেÑ শূদ্র।
    অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা দোলায় বাসুদেব। বলে- এমন একটা কথা বলছিল বটি কেউ কেউ।
    আমি নিশ্চিত করে বলছি আপনাকে। আর্যধর্মের বিধান এটাই।
    হতে পারে। হতে পারে। অস্বীকার করে না বাসুদেব এবং তার সঙ্গীরা।
    আর শূদ্রের অবস্থান কোথায় তা কি আপনাদের জানা আছে?Ñ কঠিন কণ্ঠে বলতে থাকেন পদ্মনাভÑ আমি বলছি শুনুন। মনুর বিধান মেনে চলে আর্যরা। সেই বিধানে বলা আছে শূদ্রের অবস্থান হবে সকলের নীচে। সে বিনাপ্রশ্নে সকলের সেবা করতে বাধ্য। বলা আছে শূদ্র কোনো ধন-সম্পদের অধিকারী হতে পারবে না। কোনো পূজা-পার্বনে অংশ নিতে পারবে না। সে কোনো দেবগ্রামে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারবে না। সে কোনোদিন কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে পারবে না। ধর্মগ্রন্থের পাঠও শুনতে পারবে না। যদি সে কোনো ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে, তবে শাস্তি হিসাবে তার জিহ্বায় তপ্ত লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। যদি সে কোনো ধর্মগ্রন্থপাঠ শুনে ফেলে, তবে তার কানে উত্তপ্ত ও গলিত সীসা ঢেলে দেওয়া হবে। শূদ্র কোনো ব্রাক্ষ্মণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে সেই অভিযোগ বিবেচনাতেই নেওয়া হবে না। কিন্তু কোনো উঁচুজাতির লোক শূদ্রের নামে অভিযোগ করলে কোনো বিচার ছাড়াই তাকে দণ্ডদান করতে হবে। তাছাড়া কোনো শূদ্র কখনো কোনো সুখাদ্য খেতে পারবে না। তাকে খেতে হবে বাসী, পচা, ব্রাক্ষ্মণদের উচ্ছিষ্ট খাদ্য। কোনো ব্রাক্ষ্মণ একজন শূদ্রকে হত্যা করলে তার কোনো শাস্তি হবে না। শুধু প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য সেই ব্রাক্ষ্মণ একটি বিড়াল, অথবা একটি নেউল, অথবা একটি চড়াইপাখি, অথবা একটি ব্যাঙ, অথবা একটি কুকুর, অথবা একটি গোসাপ, অথবা একটি প্যাঁচা, অথবা একটি কাক মারলেই সে ঐ শূদ্রহত্যার দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।
    বাসুদেবসহ তার সঙ্গীদের অবস্থা বড়ই করুণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখানেই ান্ত হন না পদ্মনাভ। তাদের মনে আরো ভয় ঢুকিয়ে দেবার জন্য মনুসংহিতা থেকে সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করেন-
        না স্বামীনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে
        নিসর্গজং হি তৎ তস্য কস্তস্মাৎ তদপোহতি। ।
    অর্থ হচ্ছেÑ ‘প্রভু কর্তৃক সকল দাস মুক্ত হলেও শূদ্র কখনোই দাসত্ব থেকে মুক্ত হয় না। দাসত্ব তার স্বভাবজাত; কে তাকে মুক্ত করতে পারে!’
    পদ্মনাভ একটানা কথা বলে এবার বিরতি দেন। সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। এমন নির্মম-নির্জলা  সত্যভাষণের মুখোমুখি হলে স্তব্ধ না হয়ে উপায়ই বা কী!
    এবার আবার কথা বলে ভীমÑ কাকা! এবার তোমরা লিজেরাই সাব্যস্ত করো কোনদিকে যাবে! এই মাটির সন্তান তোমরা। জন্মমাটি এখন তোমাদের কাছ থেকে বলি চায়। আমাদের কাছ থেকে বলি চায়। আমাদের জন্মমাটিকে ভিনদেশী আর্য দস্যুদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে হলে বলিদান আমাদের করতেই হবে। এখন তোমরা ঠিক করো, তোমরা কি স্বাধীন মাটির স্বাধীন সন্তান রূপে থাকবে, নাকি আর্য দস্যুদের দাস রূপে বংশপরম্পরায় জীবন কাটাবে!
    বাসুদেব এবং সঙ্গীরা নির্বাক। ভীম আবার বলেÑ রামপাল খুব শিগগিরই হয়তো হায়নার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার সর্বশক্তি নিয়ে মোদের এই বরেন্দির উপর। আমি জীবন থাকতে বরেন্দি মাকে আবার দস্যুর হাতে তুলে দেবো না কাকা! কিন্তু আমি একলা তো কিছুই করতে পারব না। আমার শক্তি বলো, সাহস বলো, সহায় বলোÑ সবকিছু তোমরাই। তবে তোমরা লিজেরা লিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নাও। আমি তোমাদের ওপর জোর করব না।
    বাসুদেব সেই একই কথা বলে, যে কথা সে বলেছে মথন দেবকে- তারা চিন্তা-ভাবনা করার জন্য একটু সময় চায়। কিন্তু তার তিন সঙ্গী মুখ থেকে ছিনিয়ে নেয় তার কথাÑ না! মোরা আর কিছুতেই দাস হবো না! মোদের মোড়ল বাসুকাকা যদি মথন দেবের সাথে যেতে চায়, যদি রামপালের সাথে যেতে চায় তো যাক। কিন্তু মোরা এই মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না! মাটি-মা মোদের এতবড় অধম্ম সইতে পারবে না!
    বাসুদেব একথায় একটু রেগে যায়। বলে- আমি কি কখনো বলেছি যে আমরা ভীমের সাথে নাই? আমি তো শুধু লিজেদের মধ্যে শলা করার জন্যে সময় চেয়েছিলাম। তা তোমরা যখন লিজেদের কথা বলেই দিলে, আমি তখন জাতির কাছ থেকে আলাদা হই কীভাবে? ভীম, আমরা বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম বাবা! মোদের এই ভুলের কথা মনে রাখিস না। রাজবংশীদের সকল পুরুষ তোর পাশে দাঁড়িয়ে এই মাটির জন্যে যুদ্ধ করবে বাবা!
    আনন্দে ভীমের চোখ অশ্র“সজল হয়ে উঠেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- তাহলে তোমাদের সকল পুরুষের জন্য অস্ত্রের প্রশিণ শুরু হোক কাকা! বেশি দেরি করা যাবে না।
    বাসুদেব বলেÑ আরে দেরি করতে তোকে বলছে কে? কাল থেকেই শুরু করে দে না!

১৭. প্রেমকথা

“যতদিন ঋত পৃথিবীতে বিরাজিত ছিল, ততদিন পৃথিবী শাপমুক্ত ছিলেন। ঋত যতকাল পৃথিবীর পরিচালক ছিল ততদিন ঋতই সকল মনুষ্যকে অন্ন দিয়েছে, গোধন দিয়েছে, জীবনের সর্ব উপকরণের নিশ্চয়তা দিয়েছে। ঋত ফসলের সুষম বণ্টন দিয়েছে। ঋত কখনো কঠোর হয়নি; একটি ত্রে ছাড়া। পৃথিবীতে মনুষ্যজাতি তখন ‘আমার’ বলত না। তারা বলত ‘আমাদের’। কেননা ঋত কঠোর ছিল। ঘোষণা দিয়েছিলÑ ‘আমাদের বদলে যে আমার বলে; আমি তাকে হত্যা করি!’ পৃথিবীর মানুষ এবং অন্তরীরে অধিবাসীরা ঋতের শাসনে সুখি ছিলেন। ঋত ততদিন স্বয়ম্ভূ ছিলেন, যতদিন ইন্দ্র না এল। ইন্দ্র ঋতকে ধ্বংস করল, এবং পৃথিবীতে বৈষম্যের অভিশাপ এল।
    ঋত বিতাড়িত হয়ে আশ্রয়ের জন্য পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত বিচরণশীল। তখন কৈবর্তজাতি তাকে বললÑ তুমি আমাদের হৃদয়মধ্যে আসন গ্রহণ করো! আমরা তোমাকে আমাদের বরেন্দিতে অধিষ্ঠিত করব!’ কিন্তু বরেন্দি ইন্দ্রবংশের দস্যু-তস্করদের পদলুণ্ঠিত। সেখানে ঋতের সিংহাসন সংস্থাপন করবে কে?
    ঋত বললÑ ওলান ঠাকুরের আশীর্বাদে একদিন এই বরেন্দিতে জন্ম নেবে একজন দিব্যোক। সে দস্যুবিতারণ করবে। তখন বরেন্দিতে অধিষ্ঠিত হবো আমি! তখন আবার মনুষ্যজাতি মুক্ত হবে বৈষম্যের অভিশাপ থেকে। মানুষ আবার নিরোগ মহৎ হবে।
    সেই প্রতিশ্র“ত দিব্যোক আবির্ভূত হলেন। এবং কৈবর্ত-বরেন্দি আরোগ্য হলো।
    সেই মহান ঋতের বন্দনার জন্যই এই কবির ধরাধামে আগমন!
    সেই মহান দিব্যোকের নামে মিথ্যা কুৎসা-মোচনের নিমিত্তেই এই অম কবির লেখনী-ধারণ!”

    এই ভনিতাটুকু পাঠ করে পপীপের দিকে মুগ্ধ স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকায় ঊর্ণাবতী। মুখে বলেÑ অপূর্ব!
    পপীপ একটু কুণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করে- সত্যি কি সুন্দর হয়েছে গুরুমা? নাকি তুমি আমাকে স্নেহ করো ভালোবাসো বলেই আমার কাব্যপ্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছ?
    না পপীপ! আমি মোটেই তোর প্রশংসা করছি না। আমি তো তোর প্রশংসার নামে প্রশংসা করছি আমার নিজের এবং মল্লর।
    পপীপকে একটু হতভম্ব দেখায়- বুঝলাম না তোমার কথা।
    তুই তো মল্ল এবং আমার মানস-সন্তান। তোর কীর্তি মানে তো আমাদেরই কীর্তি।
    এবার উঠে এসে ঊর্ণাবতীর পায়ের ধুলো মাথায় নেয় পপীপ- সত্যি গুরুমা। তোমরা না থাকলে পপীপ নামের কোনো কবির অস্তিত্বই থাকত না পৃথিবীতে। অস্তিত্ব তো দূরের কথা, আমার মধ্যে কবিত্বশক্তির জন্মই হতো না।
    ওকথা বলতে নেই। কেউ কি কাউকে কবিতে পরিণত করতে পারে? কবি জন্ম নেয় কবি হয়েই। আমরা তো নিমিত্তমাত্র। আমরা না থাকলেও অসুবিধা হতো না। অন্য কাউকে খুঁজে নিতেন ঈশ্বর নিমিত্তরূপে। আমাদের সৌভাগ্য যে ঈশ্বর আমাদের বেছে নিয়েছেন তোর নিমিত্তরূপে!
    তারপরেই উঠে দাঁড়ায় ঊর্ণাবতী। বলে- তুই লেখ পপীপ! তোকে বিরক্ত করা এখন আমার উচিত হচ্ছে না। যে মহান ব্রতে তুই নিয়োজিত রয়েছিস, তাতে বিঘœ সৃষ্টি করা পাপ। তোর শ্লোকরচনার ওপর নির্ভর করছে মহান ভূমিপুত্রদের অনেকখানি ভবিষ্যৎ।
    পপীপ তাকে বাধা দেয়- না তুমি যেও না গুরুমা। আরেকবার ভেবে বলো আমার কাব্য কি সত্যিই সুন্দর হচ্ছে?
    অবশ্যই সুন্দর হচ্ছে! জোর দিয়ে বলে ঊর্ণাবতী।
    পপীপের সংশয় তবু দূর হয় না- আমি কি পারব সন্ধ্যাকর নন্দীর মতো শক্তিমান কবির যোগ্য প্রত্যুত্তর রচনা করতে?
    অবশ্যই পারবি! সন্ধ্যাকর নন্দীদের মতো অপরের অন্নভুক কবিরা কাব্যরচনা করে তাদের প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য। আর তুই কাব্যরচনা করছিস তোর জাতির প্রতি কর্তব্য হিসাবে। পরান্নভোগী কবিরা কি কোনোদিন তোদের মতো যোদ্ধাকবিদের সমতুল্য হতে পারে?
    কিন্তু একটি দিকে আমি খুবই পিছিয়ে রয়েছি গুরুমা। সন্ধ্যাকর নন্দীরা তাদের কাব্য রচনা করে সংস্কৃত ভাষায়। তাদের পাঠক এবং শ্রোতা সংস্কৃত ভাষা বোঝে। আমি কাব্যরচনা করছি ভূমিপুত্রদের জন্য। অথচ এই আমাকেও লিখতে হচ্ছে সংস্কৃত ভাষাতেই। আমাদের জাতির মানুষ কীভাবে পাঠ করবে এই কাব্য? কীভাবে জানবে যে তাদের জন্যই রচিত হয়েছে এই কাব্য? আর আমারও তো সংস্কৃত ভাষায় কাব্যরচনা না করে কোনো উপায় নেই। কারণ আমাদের ভাষার তো কোনো লিখিত রূপ নেই।
    ঊর্ণাবতীকে একটুও চিন্তিত দেখায় না। বলে- এখন হয়তো তোর কাব্য সকলে আস্বাদন করতে পারবে না। কিন্তু একদিন তো অবশ্যই এই ভূমিপুত্রদের নিজেদের অর হবেই। তখন অন্যেরা তোর কাব্য অনুবাদ করে নেবে নিজেদের ভাষায়। তখন সবাই জানবে, এই মহান ভূমিপুত্রদের মধ্য থেকে একদিন আবির্ভাব ঘটেছিল এক মহান কবির। সে তার জাতিকর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালন করে গেছে পরিপূর্ণ সততা এবং অপূর্ব কাব্যদতার সমন্বয়ে।
    তুমি আমাদের ভূমিপুত্রদের মহান বলছ গুরুমা! তোমাদের আর্য জাতি...
    আর্য জাতি তার নারীদের কী চোখে দেখে তা থেকেই বোঝা যায় সেই জাতির বর্বরতা। দেখিস নি আর্য জাতি আর তাদের হিন্দু ধর্ম আমাকে কোথায় নামিয়েছিল?
    এই প্রসঙ্গে কোনো কথা মুখে আনা তো দূরের কথা, মনেও আনতে চায় না পপীপ। তার মনে হয় সেকথা মনে আনলেও ঊর্ণামাকে ছোট করা হয়। তবু কথার পিঠে সে বলে- সে তো একটা দুর্ঘটনাও হতে পারে মা!
    না। মোটেও দুর্ঘটনা নয়। শত শত বৎসর ধরে এই-ই চলে আসছে। অযুত নারীকে ভোগ করতে হচ্ছে নারীজন্মের লাঞ্ছনা। তুই তো মহাভারত পাঠ করেছিস। মনে নেই সেখানে নারীজাতিকে কোন দৃষ্টিতে বিচার করা হয়েছে? মনে নেই ভীষ্ম তার মৃত্যুশয্যায় শুয়েও নারীজাতি সম্পর্কে কী বলছে। বলছে নিজেই। কিন্তু বলাচ্ছে আরেক নারী পঞ্চচূড়ার নামে। বলা হচ্ছেÑ “নারীদের এই দোষ যে তারা সদবংশীয়া রূপবতী ও সধবা হলেও সদাচার লঙ্ঘন করে। তাদের চেয়ে পাপিষ্ঠা কেউ নাই, তারা সকল দোষের মূল। ধনবান রূপবান ও বশীভূত পতির জন্য তারা প্রতীা করতে পারে না। যে পুরুষ কাছে গিয়ে কিঞ্চিৎ চাটুবাক্য বলে তাকেই কামনা করে। উপযাচক পুরুষের অভাবে এবং পরিজনদের ভয়েই নারীরা পতির বশে থাকে। তাদের অগম্য কেউ নেই। পুরুষের বয়স বা রূপ তারা বিবেচনা করে না। রূপযৌবনবতী সুবেশা স্বৈরিণীকে দেখলে কুলস্ত্রীরাও সেইরূপ হতে ইচ্ছা করে। পুরুষ না পেলে তারা পরস্পরের সাহায্যে কামনা পূরণ করে। সুরূপ পুরুষ দেখলেই তাদের ইন্দ্রিয় বিকার হয়। যম পবন মৃত্যু পাতাল বড়বানল ক্ষুরধারা বিষ সর্প ও অগ্নি- এই সমস্তই একাধারে নারীতে বর্তমান। ”
    মনে রাখিস পপীপ, আর্যসমাজের সর্বত্র এই ধারণা বিরাজমান।
    অন্যদিকে তাকিয়ে দ্যাখ, কৈবর্তসমাজে নারী কত সম্মানের আসন পেয়েছে। ভূমিপুত্ররা ধর্ষণ নামক শব্দটির সাথেই পরিচিত নয়। এখানে ব্যভিচার নেই। আছে শুধু প্রেম।
    ‘প্রেম’ শব্দটি উচ্চারণ করে কিছুণ আত্মগত বসে থাকে ঊর্ণাবতী। স্বগতকণ্ঠে বলে- প্রেম! আমার সৌভাগ্য যে তুমি আছ! তা নইলে মল্ল কীভাবে এল আমার জীবনে! তুমি না থাকলে আমাকেও অযুত হতভাগ্য নারীর মতো পচে মরতে হতো সেই নরকেই!
    যুক্তকরে প্রণাম জানায় ঊর্ণাবতী। কাকে যে প্রণাম জানায়? প্রেমকে? নাকি মল্লকে? নাকি দুজনকেই? তারপর পপীপের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধস্বরে বলেÑ প্রেমকে কোনোদিন অবজ্ঞা করিস না বাবা! আর কবির পক্ষে প্রেমকে অবজ্ঞা করা তো মহাপাপ!
    তখন পপীপের চোখের সামনে থেকে মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় রাজধানী গৌড়, এই সুদৃশ্য অট্টালিকা, ঊর্ণাবতীর পবিত্র সৌন্দর্য, নিজের দায়িত্বের কথা, খাগের কলম, আর ভূর্জপত্র। মৃত্যুপুরীর মতো মালভূমির পাশে একটি ছায়াময় গ্রাম তার মনের পটে ভেসে ওঠে। আর ভেসে ওঠে একজন পলিরঙা তরুণীর মুখ। কুরমি! কুরমি!

 [চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৬৫০, জানুয়ারি ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।