ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব, অধ্যায় ৮-১২

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১১
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব, অধ্যায় ৮-১২

০৮. দেদ্দাপুরের বৃত্তান্ত

পপীপকে পাশে নিয়ে টিলার ওপরে বসে মল্ল। রাত নেমেছে বরেন্দিজুড়ে।

ওদের গায়ে যে বাতাস এসে বাড়ি খাচ্ছে সেটাকে একটু ভেজা ভেজা মনে হয়। মনে হচ্ছে শোনিত নদীর জল মেখে বইছে বাতাস। দূরে দূরে অন্ধকার কোথাও একটু বেশি গাঢ়। সেসব জায়গাতে ঝোপগুলো বেশি ঘন। অনেক দূরে কিছু আলো দেখা যাচ্ছে। দেদ্দাপুরের কথা, বিশেষ করে মায়ের কথা জানার জন্য ভেতরে ভেতরে আকুল হয়ে উঠেছে পপীপ। মল্লকে আগেই জিজ্ঞেস করেছে সেকথা। মল্ল তাকে আশ্বস্ত করেছে- আগে টুকুন জিরিয়ে নে। খাওয়া সারা হোক। তারপর তোকে সব কথা জানাব।

এখন বিশ্রাম এবং খাওয়ার পরে এই টিলার ওপর বসে আর তর সইছে না পপীপের। কাকা বলো আমার মা কোথায়? দেদ্দাপুরের সব মানুষ চলে গেছে কোথায়? গ্রামটা এমন খাঁ খাঁ হয়ে গেল কেন?

উত্তর দেবার আগে কিছুক্ষণ চুপ করে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে মল্ল। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে বলবার কথাগুলো। একবার মনে হলো কথা শুরু করবে। কিন্তু শুরু করে না। তার পরিবর্তে  সস্নেহে হাত বুলায় পপীপের পিঠে। অপো করে পপীপ। কিন্তু মল্লকাকা তার পিঠে হাত বুলিয়েই চলছে। যখন মনে হলো ভেতরের উদগ্রীবতাকে আর ধরে রাখতে পারছে না পপীপ, যখন মনে হলো পপীপ এবার কেঁদে পা জড়িয়ে ধরে মল্লকে বলবে- ‘কাকা বলো আমাকে! আর দেরি সহ্য করতে পারছি না!’ তখন কথা বলতে শুরু করে মল্ল- এই যে যেখানে আমরা বসে আছি, তার সামনে আছে একটা ছোট বন। সেই বনের শেষে একটা ছোট জলের ছরা আর খাল। সেই পর্যন্তই বরেন্দির সীমানা। তার ঠিক পরেই যে জায়গাটি আছে, তার নাম কোটাটবী।

সেটি মোদের বরেন্দি লয়?
পাল রাজাদের আমলে সেটি ছিল পুণ্ড্র-বরেন্দির সামন্ত রাজ্য। সেই সময় মোট এগারোটি সামন্ত রাজ্য ছিল জানিস বোধহয়?
না কাকা জানি না।

কোটাটবী ছাড়াও বালবলভী, অপরমন্দার, কুজ্ববটী, তৈলকম্প, উচ্ছাল, ঢেক্করীয়, কজঙ্গলমণ্ডল, নিদ্রাবল, পদুম্ববা, আর কৌশাম্বী ছিল পুণ্ড্র-বরেন্দির সামন্ত রাজ্য। দিব্যোকের নেতৃত্বে আমরা গৌড়ের রাজত্ব জয় করার পরে কেউ কেউ চেয়েছিল এই সামন্ত রাজ্যগুলিও অধিকার করে নেওয়া হোক। কিন্তু দিব্যোক বাদ সাধল। তার কথা- মোরা মোদের বরেন্দি ফিরে পেয়েছি। মোরা মোদের জাতির লিজেদের জীবন ফিরে পেয়েছি। অন্য মাটি মোদের প্রয়োজন নেই। বরেন্দি ফিরে পাওয়ার যুদ্ধ ছিল ন্যায়যুদ্ধ। কিন্তু অন্য মাটি, অন্য ভূমি নিজেদের অধিকারে আনার জন্য যুদ্ধযাত্রা করলে সেটা হবে অন্যায্য। তাই আর কোনো অভিযান চালানো হলো না। আর সেটাই হলো আমাদের কাল। এখন এই সামন্ত রাজ্যগুলোন হয়েছে রামপালের ঘাটি। আগে সেগুলোর শাসনকর্তা ছিল সব ভট্টবামনের লোক। এখন তাদের সরিয়ে বসানো হয়েছে রামপালের লিজের লোককে। আর রামপালের প্রধান সহায় তার মাতুল মথন দেব। আমরা রাজপ্রাসাদ হস্তগত করার পরে সেই বিজয়ের আনন্দেই ছিলাম বুঁদ হয়ে। সেই সুযোগে রামপাল পালিয়ে গেল। পালানোর সময় নিয়ে গেল রাজ-কোষাগারের সমস্ত অর্থ-সম্পদ, মণি-মানিক্য। সেই অর্থ ছড়িয়ে সে এখন দিনের পর দিন বাড়িয়ে চলেছে লিজের সমরশক্তি।

একটু থামে মল্ল। পপীপ অধৈর্য হয়ে বলে- দেদ্দাপুরের কী হলো?
তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তোলে মল্ল- বলছি রে বাপ! এই যে বললামÑ গৌড়ের সব সামন্ত রাজ্যগুলো এখন রামপালের বড় ঘাটি। ঐ যে কোটাটবী- ঐ যে দূরের আলোটুকুন দেখছিস- ঐ কোটাটবী থেকে দেদ্দাপুর বড়জোর আধাবেলার পথ। আর যদি ঘোড়ায় চড়ে আসে তাহলে তো সময় লাগে তার চার ভাগের এক ভাগ। কোটাটবী থেকে রামপালের লোকেরা মাঝে মাঝেই এসে আক্রমণ চালাতে শুরু করল দেদ্দাপুরে। ঝটিকা আক্রমণ চালায়, মেরে ফেলে দুই-একজন গাঁওবাসীকে, লুণ্ঠণ করে নিয়ে যায় মানুষের গরু-ছাগল, আগুন লাগিয়ে দেয় একটা-দুইটা ঝুপড়িতে। কতদিন আর গাঁয়ের মানুষ সইতে পারে এই রকম অরতি জীবন। তারা দিব্যোকের কাছে নালিশ জানাল। দিব্যোকের হাতে উপায় ছিল তিনটি। একটা উপায়, আক্রমণ চালিয়ে কোটাটবী বরেন্দির মধ্যে নিয়ে নেওয়া। তাতে তার প্রথম থেকেই আপত্তি। আরেকটা উপায় ছিল দেদ্দাপুরে একটা বড়-সড় সৈন্যদল রেখে দেওয়া। কিন্তু তখন তো কৈবর্তদের প্রশিক্ষিত কোনো সেনাদলই নেই। তাই সেই কাজও করা সম্ভব হলো না। দিব্যোক শেষ পথটাই গ্রহণ করল। গাঁয়ের লোকদের বরেন্দির অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। সেই অনুসারে দেদ্দাপুর পরিত্যক্ত হলো। গাঁয়ের মানুষ বরেন্দির যেখানে যেখানে থাকতে চাইল সেখানে তাদের জমি দেওয়া হলো, চাষের বলদ দেওয়া হলো, বসবাসের জন্য ঘর তুলে দেওয়া হলো।

মাথায় হাত দিয়ে হতাশায় বুঁজে যাওয়া গলায় পপীপ বলে- হায়! আমার মা এই বিস্তীর্ণ বরেন্দির কোন কোণে যে পড়ে আছে!
তার মাথায় আবার সান্ত্বনার হাত রাখে মল্ল- নিরাশ হোস নে বাপ! বেঁচে থাকলে তোর মায়ের সাথে তোর দেখা হবেই হবে।
কেমন করে?

তোদের গাঁয়ের যে কোনো একজন লোকের সাথে দেখা হলেই তো খোঁজ পাওয়া শুরু হবে। যে কোনো একজনকে পেলেই আমরা একটা সূত্র পেয়ে যাব।
মনে মনে মাথা নাড়ে পপীপ। হ্যাঁ এই পদ্ধতিতে কাজ হবে।
মল্ল আবার কথার খেই ধরে- তুই তাহলে এই ভাবে সন্ধান করা শুরু কর। যে কোনো গ্রামে যে কোনো জনপদে তোদের দেদ্দাপুরের একজন লোকের দেখা পেলেই বাকি সবার সন্ধানও একে একে পাওয়া যাবে। আর আমি তো সীমান্তের সবগুলি ঘাটিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। আমিও সন্ধান করতে থাকব। কোনো সূত্র পেলেই তোকে জানাব।
তুমি কীভাবে সংবাদ দেবে আমাকে? তুমি জানবে কীভাবে আমি কোথায় আছি?
হুম। কিছুণ ভাবল মল্ল- এটা একটা সমস্যা বটে। তুই হয়তো নির্দিষ্ট পথ ধরে চলবি। কিন্তু আমার তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই।
তাহলে?
কী তাহলে?
এখন তাহলে কী করা যায়?
হেসে ফেলে মল্ল- সেটা তুই-ই ভেবে বের কর। এখন তুই পূর্ণ যুবক। বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে। তার ওপরে গাদা গাদা শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করেছিস। আমার চাইতে তোর জ্ঞানগম্যি এখন অনেক বেশি। তুই-ই বল কী করা যায়!
কিছুণ চিন্তা করে পপীপ বলল- আমি বরং তোমার সাথেই থাকি। তোমার সাথেই চলাফেরা করি। তোমার কাজে তোমাকে সাহায্য করতে থাকি। আর যেখানে যেখাকে আমরা যাব, সেখানে গিয়ে দেদ্দাপুরের লোকের খোঁজও করব।
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মল্লর চোখ। পপীপ মুহূর্তে বুঝে গেল ঠিক এইরকমটাই চাইছিল মল্ল, কিন্তু নিজের মুখ ফুটে বলতে পারছিল না।
সেটাই সবচেয়ে ভালো। খুশির সাথে বলে ওঠে মল্ল- এখন আসলে তোর মতো যুবককে খুব দরকার ভীমের। চল্ এখানকার কাজ সেরে দুই-একদিনের মধ্যেই তোকে ভীমের কাছে নিয়ে যাব। ঘোড়ায় চড়তে পারিস?
মাথা নাড়ল পপীপ- না। কে শেখাবে আমাকে ঘোড়ার চড়া। আর রামশর্মার ক্রীতদাস ঘোড়া পাবেই বা কোথায়!
ঠিক কথাই বলেছিস। তবে চিন্তার কিছু নেই। দুই দিনেই শিখে যাবি। এখন যা। অনেক রাত হয়েছে। তোর জন্য শয্যা পেতে দেওয়া হয়েছে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়।

০৯. মাতৃভূমিকে দুচোখ মেলে দেখা

সত্যি সত্যিই ঘোড়ায় চড়া শিখতে দুই দিনের বেশি লাগেনি। পপীপ খেয়াল করেছে, আসল কাজটা হচ্ছে ঘোড়ার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক তৈরি করে নেওয়া। যে মুহূর্তে ঘোড়া বন্ধুরূপে মেনে নেবে কোনো লোককে, তখন তাকে পিঠে নিতে কোনো আপত্তি থাকবে না তার। পপীপের একটা পুরো দিন লাগল মল্লর ঘোড়াটার সাথে সখ্য স্থাপনে। পরের দিন তাকে পিঠে তুলে নিল ঘোড়া। ঘোড়ার বিভিন্ন রকম চলনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগল আরো একটা দিন। ঘোড়া যখন পিঠে আরোহী নিয়ে হেঁটে চলে তখন তার দোলা এক রকম, যখন দুলকি চালে ছোটে তখন দোলা আরেক রকম, আর যখন মুখে ফেনা তুলে তীব্র গতিতে ছুটে চলে তখন তার দোলা আরেক রকম। অনেক সময় ঘোড়া জোরে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লে অসাবধান আরোহী ছিটকে পড়ে কয়েক হাত দূরে। পপীপ নিজেও এমন আঘাত পেয়েছে একবার-দুইবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মল্লর সঙ্গীরা তো পপীপের এই কৃতিত্বে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এত তাড়াতাড়ি পপীপ ঘোড়া চালানো শিখে ফেলল, আর এমন ভঙ্গিতে সে এখন ঘোড়া চালায়  যে মনে হয় সে মায়ের পেট থেকে পড়েই ঘোড়া চালানো শুরু করেছে।
কিছুটা অস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণও শুরু হয়েছে তার। মল্ল বলেছে, সবসময় সশস্ত্র অবস্থাতেই চলাফেরা করতে হবে তাদের। শুধু নিজের নিরাপত্তার জন্যই নয়, তাদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখলে সাধারণ কৈবর্তদের মনেও এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয়। তারা অনুভব করে, তাদের রার জন্য ভীমের সঙ্গীরা সদা প্রস্তুত এবং সদা তৎপর।

ঘোড়া এত তাড়াতাড়ি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে ভাবতে পারেনি পপীপ। নিজের পা এবং গো-শকট ছাড়া অন্য কোনো বাহনের অভিজ্ঞতা পপীপের ছিল না। কয়জন কৈবর্ত বা ভূমিপুত্রেরই বা থাকে! কিন্তু ঘোড়ায় উঠলে পথের দূরত্ব যে এতটা কমে যায়, তখন আর অগম্যকেও অগম্য বলে মনে হয় না, এই অভিজ্ঞতা পপীপকে অভিভূত করে ফেলে। বাসুখুড়ো বলেছিল, অনেক আগে, শত শত বছর আগে আর্যরা যে এদেশে এসে আমাদের মতোই ভূমিপুত্রদের যুদ্ধে পরাজিত করে এই দেশকে নিজেদের কুক্ষিগত করে নিতে পেরেছিল, তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তাদের ঘোড়া এবং ঘোড়ায় টানা রথ। আমাদের গঙ্গাতীরের মানুষের ঘোড়া ছিল না। আমাদের ছিল মোষ এবং গরু। আমাদেরকে ওরা হারিয়ে দিয়েছিল গতি দিয়ে।

যুদ্ধে এবং সকল কাজেই গতি যে কত বড় ব্যবধান তৈরি করে দেয়, তা পপীপ এই প্রথম উপলধ্বি করতে পারে ঘোড়ার চড়ার পরে। এখন সে প্রত্যুষে ঘোড়া ছুটিয়ে পুরো একটি ভুক্তি(প্রশাসনিক প্রদেশ) পেরিয়ে যেতে পারে দুপুরের মধ্যেই। একটু ফাঁক পেলেই সে ঘোড়া নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। মল্ল তাকে বাধা দেয় না। সে বলে যে নিজে ঘাটির কাজে ব্যস্ত থাকে বলে সে ঘোড়া নিয়ে তেমন বেরুতে পারে না। আর ঘোড়া এমন একটা জীব যে বেশিক্ষণ বিশ্রাম পছন্দ করে না। তাকে ছোটাতে হবে। ছুটতে দিতে হবে। নইলে তার পেশির শক্তি কমে যায়। তাই পপীপ সময়ে-অসময়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়ার সুযোগ পায় ঘন ঘন।

আজ আবার বেরিয়ে পড়েছে পপীপ। কোনো লক্ষ্য স্থির নেই। প্রথমত ঘোড়া ছোটানোর আনন্দ। তার সাথে নিজের বরেন্দিকে আরো ভালোভাবে চিনে নেওয়া।

দুইটি টিলা, একটা ছোট অঘন বন, একটা কৈবর্ত গ্রাম পেরিয়ে একটা সমতল উপত্যকায় এসে পৌঁছায় পপীপ। এখান থেকে সামনে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কৈবর্ত গ্রামের মতো নয়। এখান থেকেই গ্রামের যে বিন্যাস লক্ষ্য করতে পারছে সে তাতে বুঝতে পারছে এটি কোনোক্রমেই কোনো কৈবর্ত বা অন্য কোনো ভূমিপুত্রদের গ্রাম হতে পারে না। আর্য ব্রাক্ষ্মণ-কায়স্থ-বৈশ্যরা যেসব গ্রামে বাস করে সেগুলিকে সবাই দেবগ্রাম নামে ডাকে। সেই গ্রামের অন্য নাম তো অবশ্যই আছে। কিন্তু সব আর্যগ্রামই ভূমিপুত্রদের কাছে পরিচিত দেবগ্রাম নামে।
কোনো দেবগ্রামে কখনো ঢোকা হয়নি পপীপের। দিব্যোক রাজা হবার আগে সে প্রশ্নই উঠত না। কৈবর্ত বা স্থানীয় ভূমিপুত্রদের কোনো দেবগ্রামে ঢুকে পড়া ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। সে অপরাধে কারো কারো প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হয়েছে। তাদের প্রবেশাধিকার ছিল গ্রামের উপান্তে চণ্ডাল বা ভূমিদাসের ঘর পর্যন্ত। কখনো কোনো দেবগ্রামের নালা পরিষ্কার কিংবা অন্য কোনো অচ্ছ্যুৎ কাজের জন্য ডাক পড়ত কৈবর্তদের। গ্রামের মধ্যে তখন ঢুকতে দিতে হতো ভূমিপুত্রকে। কিন্তু তখনো দেবগ্রামের মানুষ এমনভাবে ভূমিপুত্রের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলত যেন এই লোকটি কোনো মানুষ নয়, বরং কোনো চণ্ডালের শব।

পপীপের মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে যায়। আজ সে দেবগ্রাম দেখবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দেখবে তাকে বীরদর্পে গ্রামের মধ্যে ঢুকতে দেখলে কী প্রতিক্রিয়া হয় বেদগর্বী লোকগুলোর।
গ্রামের মুখে এসে ঘোড়া থামায় পপীপ। ঘোড়াটিকে বেঁধে রাখে একটা গাছের ডালের সাথে। পিঠে চাপড় দিয়ে আশ্বস্ত করে ঘোড়াকে। এই চাপড় একটা ইঙ্গিত। ঘোড়া বুঝতে পারে, তার মনিব তাকে ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে না। বরং কিছুণের জন্য বিরাম দিচ্ছে তাকে। ঘোড়া বুঝতে পারে পপীপের ইঙ্গিত। সে মুখ ডুবিয়ে দেয় মাটির সাথে লেগে থাকা ঘাসের মধ্যে। তখন পপীপ পা বাড়ায় গ্রামের প্রবেশপথের দিকে।
গ্রামে ততক্ষণে সাড়া পড়ে গেছে। ঘোড়ায় চড়ে এসেছে একজন কৈবর্ত। তার হাতে আবার রয়েছে অস্ত্র। গ্রামের মানুষের চোখে একই সঙ্গে আতঙ্ক এবং ঘৃণাও। নারীরা শিশুদের নিয়ে ঢুকে পড়েছে ঘরের মধ্যে। পুরুষরা তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছে না পপীপের আগমনের হেতু। তাই কিছুটা বিভ্রান্তও দেখাচ্ছে তাদের।

প্রথমেই সরাসরি গ্রামে না ঢুকে গ্রামের চারপাশ ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেয় পপীপ। একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলেই বোঝা যায় কৈবর্ত গ্রামগুলির সাথে বেদীদের দেবগ্রামের পার্থক্য। পরিচ্ছন্ন গোবাট, পুষ্করনি, মাঠ। পুরো গ্রামকে চক্রাকারে ঘুরে আসা যায় এমন পায়ে চলা পথ। মাঠে চড়ছে সবৎসা গাভি। সেগুলোর কোনো-কোনোটির গলায় ঘুণ্টি। ঘাড় নাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে টুং টাং সুর বেজে উঠছে। গাভিগুলো দেখে লক্ষ্মীর আখ্যান মনে পড়ে যায় পপীপের। ব্রাক্ষ্মণরা বলে লক্ষ্মী নাকি বাস করে গরুর গোবরে ও গোচনায়। আখ্যানের কথা মনে করে একা একাই হাসতে থাকে পপীপ-

“একদিন লক্ষ্মী মনোহর বেশে গাভিদের নিকটে এলে তারা জিজ্ঞসা করল, দেবী তুমি কে? তোমার রূপের তুলনা নেই।
লক্ষ্মী বললেন, আমি লোককান্তা শ্রী। আমি দৈত্যদের ত্যাগ করেছি, সেজন্য তারা বিনষ্ট হয়েছে। আমার আশ্রয়ে দেবতারা চিরকাল সুখ ভোগ করছেন। গো-গণ, আমি তোমাদের দেহে নিত্য বাস করতে ইচ্ছা করি। তোমরা শ্রীযুক্তা হও!
গাভিরা বলল, তুমি অস্থিরা, তুমি চপলা, বহুলোকের অনুরক্তা, আমরা তোমাকে চাই না। আমরা সকলেই কান্তিমতী। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই।
লক্ষ্মী বললেন, অনাহুত হয়ে যে আসে তার অপমান লাভ হয়- এই প্রবাদ সত্য। মনুষ্য-দেব-দানব-গন্ধর্বাদি উগ্রতপস্যা দ্বারা আমার সেবা করেন; ত্রিলোকে কেউ আমার অপমান করে না। অতএব তোমরাও আমাকে গ্রহণ করো! তোমরা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি সকলের নিকট অবজ্ঞাত হবো। অতএব তোমরা প্রসণ্ণ হও! আমি তোমাদের শরণাগত। তোমাদের দেহের কোনো স্থানই কুৎসিত নয়। আমি তোমাদের অধোদেশেও বাস করতে সম্মত আছি।
তখন গাভিরা মন্ত্রণা করে বলল, কল্যাণী যশস্বিনী, তোমার সম্মানরা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তুমি আমাদের পুরীষ ও মূত্রে অবস্থান করো।
লক্ষ্মী তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমাদের মঙ্গল হোক! আমি সম্মানিতা হয়েছি। ”
হাসতে হাসতেই সবৎসা গাভি থেকে এবার গ্রামের দিকে দৃষ্টি দেয় পপীপ। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে গ্রামের বেশিরভাগ ঘরই খড়ের ছাউনি আর মাটির দেয়ালে তৈরি। দেয়ালে জালিকাটা। এই ধরনের জালিকাটা ঘরকেই বোধহয় এরা বলে জালক।
এবার গ্রামের ভেতরে ঢোকার জন্য এগিয়ে যায় পপীপ। গ্রামে ঢোকার মুখেই চোখে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ। তাদের জোড়করে নমস্কার জানায় পপীপ। তারপর শ্লোক আউড়ে বলে
    দেবান ভাবতানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
    পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরম্ অবাপস্যথ। ।
(তোমরা দেবতাদের ভাবনা করো সেই দেবতারাও তোমাদের ভাবনা করুন! পরস্পর ভাবনা করে দেবতা ও তোমরা উভয় সম্প্রদায় পরম শ্রেয়ঃ প্রাপ্ত হও!)
মুখ দেখে মনে হয় রীতিমতো ধাক্কা খেয়েছে দেবগ্রামের মানুষগুলো। একজন কৈবর্ত যুবকের মুখ থেকে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় শ্লোক শুনে তারা বিস্মিত। তবে শ্লোকের মাধ্যমে পপীপ তাদের কুশল কামনা করেছে এটা বুঝতে পেরে তাদের মুখ থেকে ভীতির চিহ্ন অনেকখানি মুছে গেছে। একজন এতক্ষণে প্রতিনমস্কার করে পপীপকে। তারপর আহ্বান জানায়- আসুন!
তাদের সাথে গ্রামের আটচালা মণ্ডপে এসে দাঁড়ায় পপীপ।
মণ্ডপের মধ্যে প্রবেশের সময় ইতস্তত করে পপীপ। একজন সৌম্য চেহারার প্রৌঢ় আবার আহ্বান জানায়- আসুন!
ভেতরে আসন পাতা। বেশ পুরনো সব আসন। কোনো-কোনোটা জরাজীর্ণ। বেছে বেছে ভালো আসনগুলোকে একদিকে বিছানো হলো। তারপর পপীপকে বসতে অনুরোধ জানালে পপীপ পদ্মসনে বসে একটি আসনে। গ্রামের মানুষরাও বসে পড়ে যে যার মতো। কিন্তু কেউ কোনো পথা বলে না। অস্বস্তিকর নীরবতা। পপীপ নিজেই কথা শুরু করে- কেমন আছেন আপনারা?
নির্দোষ প্রশ্ন। যে কোনো দুই ব্যক্তির মধ্যে বাক্যালাপ শুরুর সময় বহুল ব্যবহৃত হয় এই প্রশ্নটি। কিন্তু এমন একটি সাধারণ প্রশ্নেও উত্তরের পরিবর্তে এক-অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে থাকে
দেবগ্রামের প্রৌঢ়রা। আর তখন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই পপীপ লক্ষ্য করে যে, এখানে কোনো যুবক উপস্থিত নেই। তার মনে পড়ে গ্রামের কোথাও সে কোনো যুবককে দেখতে পায়নি। কারণটা কী? গ্রামের সব যুবক একসাথে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে কেন? প্রশ্নটা না করে পারে না সে। এই প্রশ্ন শুনে আরো ভীতির চিহ্ন ফুটে ওঠে গ্রামপ্রৌঢ়দের মুখে। একজন করজোড়ে বলে- বিশ্বাস করুন! আমাদের গ্রামের কোনো যুবককে আমরা লুকিয়ে রাখিনি। সম পুরুষরা সবাই গেছে প্রতিরা বাঁধের জন্য শ্রম দিতে। আপনি দয়া করে আপনার সেনাধ্যকে বলবেন যে এই গ্রামের সকলেই রাজা ভীমের সকল কর্মকাণ্ডে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে যাবে। দয়া করে আমাদের অবিশ্বাস করবেন না!
এবার আরো অবাক হয়ে যায় পপীপ। জিজ্ঞেস করেÑ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না আপনাদের কথা। কোন বিষয়ে কথা বলছেন আপনারা?
আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে দেখা যায় গ্রামপ্রৌঢ়দের। তারাও পপীপের এমন আচরণে একটু ধাঁধায় পড়ে গেছে। একজন জিজ্ঞেস করে- আপনি কি রাজা ভীমের সেনাদলের সদস্য নন?
সে নিজে কি ভীমের সেনাদলের সদস্য? হ্যাঁ, একথা সত্য যে সে কৈবর্তদের যুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে অংশ নেবার জন্যই কামরূপ থেকে পালিয়ে এখানে এসেছে। ভীমের অন্যতম প্রধান সেনাপতি মল্লর সঙ্গেই রয়েছে। তবে এখনো তো সে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দায়িত্বে যোগ দিতে পারেনি। মল্ল তাকে কয়েকদিন পরে গৌড়ে নিয়ে যাবে। সেখানে ভীমের সঙ্গে তার দেখা হবে, আলোচনা হবে। তারপরে বোঝা যাবে কৈবর্তদের স্বাধীনতা রার সংগ্রামে তাকে কোন ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু এত কথা তো এখানে বলা যাবে না। সে তাই শেষ পর্যন্ত হ্যাঁ-বাচকভাবেই ঘাড় দোলায়- হ্যাঁ আমি ভীমের সেনাদলেই আছি।
তাহলে আপনি নিশ্চয়ই দেখতে এসেছেন যে প্রতিরা বাঁধের কাজে বিষ্টি দিতে না গিয়ে এই গ্রামের কোনো যুবক লুকিয়ে আছে কি না?
এবার সরাসরি না বলে পপীপ- না আমি সেকাজে আসিনি। আমি এই অঞ্চলে এসেছি সদ্য। তাই ঘুরে-ফিরে দেখার জন্য এখানে এসেছি। আপনাদের সাথে পরিচিত হবার জন্য এখানে এসেছি। তাছাড়া আমি ইতোপূর্বে কখনো কোনো দেবগ্রামের ভেতরে ঢুকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাইনি। আপনারা তো জানেনই, পূর্বে এমন কোনো সুযোগও ছিল না। আপনারা বৌদ্ধ পাল-সম্রাটের রাজত্বেও মনুর শাসন প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিলেন। মনুর বিধানে আমরা অস্পৃশ্য, অসুর। তাই আপনাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারার অধিকার আমাদের ছিল না।
মাথা নীচু করে বসে থাকে বৃদ্ধ কয়েকজন। পপীপ এবার মাথা গোণে। মোট আটজন। সে কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নেয় এবার। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে- আমি শুধু কৌতূহলবশেই এখানে এসেছি। সেই সঙ্গে জানতে এসেছি পরিবর্তিত পোপটে আপনারা কেমন আছেন। জানতে এসেছি আপনাদের ওপর আমার স্বজাতিরা প্রতিহিংসাবশত কোনো অত্যাচার চালাচ্ছে কি না?
তড়বড় করে একজন বলে- না না আমাদের কোনো অসুবিধা নাই। আমাদের ওপর কোনো অত্যাচার হয়নি।
পপীপ হাসে- না হলেই ভালো। তবে যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে জানালে আমি তার প্রতিবিধানের চেষ্টা করতে পারি।
আবার পরস্পর চোখের ভাষায় কথা বিনিময় করে গ্রামপ্রৌঢ়রা। একজন বলে- না না। সত্যি কোনো অত্যাচার নেই। অত্যাচার কিছুটা হয়েছিল বটে। তবে সে অনেক আগে। সেই যখন মহারাজ মহীপাল নিহত হলেন। তখন আমরাও বিহ্বল। আর সদ্যবিজয়ী কৈবর্তরাও কিছুটা উশৃঙ্খল। তবে রাজা দিব্যোক খুব তাড়াতাড়ি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। নিরাপত্তা দান করেছিলেন আমাদের সকলকে। এখন সে রকম কোনো সমস্যা নেই।
একজন উঠে গেল ভেতরে। বোধহয় নিজের বাড়ির দিকে। ফিরেও এল তাড়াতাড়ি। তার হাতে মাটির থালায় কিছু ফল। মাটির পাত্রেই জল। পপীপের সামনে ফলের থালা এবং জলপাত্র নামিয়ে রেখে বিনীত ভঙ্গিতে বলে- আপনি অতিথি। দয়া করে এই সেবাটুকু গ্রহণ করুন!
মনে মনে হাসে পপীপ। আবার তিক্ততার সঙ্গে ভাবে, এই রকম পারস্পরিক শ্রদ্ধার জীবন যদি আগে থাকত, তাহলে কোনো রক্তপাতই হতো না। কৈবর্তসহ এই মাটির আদিসন্তানরা এইভাবে সর্বস্ব হারিয়ে হিংস্র হয়েও উঠত না।
সে একটা ফল তুলে নেয় থালা থেকে। বলে- যদি সবকিছু স্বাভাবিকই থাকবে, তাহলে আমাকে দেখে আপনারা আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিলেন কেন?
একজন মৃদু হেসে বলেÑ রাজার লোক দেখলে কে না আড়ষ্ট হবে বলুন! ভাবছিলাম আবার কোন রাজাদেশ বহন করে যে এসেছেন আপনি!
ঠিক একই রকম অবস্থা ছিল কৈবর্তদের। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। শতাব্দের পরে শতাব্দ। গ্রামসীমানায় রাজপুরুষের আগমনের অর্থই ছিল কৈবর্তদের জন্য আরো সর্বনাশের আগমন; নতুন কোনো হিংস্র নির্দেশ। জানেন, রাজপুরুষদের সেই ঢোলের শব্দ সকল কৈবর্ত ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের অংশ হিসাবে এখনো শুনতে পায়। এখনো তারা ঘুমের মধ্যে চমকে উঠে বসে সেই দুঃস্বপ্ন দেখে! ঘুমের মধ্যেই তারা কেঁদে ওঠে সন্তান হারানোর বেদনায়, স্বামী হারানোর বেদনায়, জন্মমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার বেদনায়। সেই নিদারুণ কষ্টের কথা আপনারা বুঝতে পারবেন না। পারবে শুধু তারাই যারা এই মাটির সন্তান।

কিছুণের জন্য নৈঃশব্দ নেমে আসে। হাতের ফলটি পপীপের হাতেই রয়ে গেছে। একটা কামড়ও দেয়নি সে ফলটিতে। নিজেকে সামলাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে এবার। কান্না উঠে আসতে চাইছে বুক ঠেলে। মৃদু মৃদু কাঁপছে সে ভেতরের আবেগের সাথে যুদ্ধ করতে করতে। গ্রামবৃদ্ধরা অবনত মস্তকে বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলার সাহস করে উঠতে পারছে না।

অবশেষে নিজেকে সামলাতে পারে পপীপ। তখন লজ্জাও পায় একটু। নিশ্চয়ই তার আচরণে মনে মনে ভয় পেয়ে গেছে এই মানুষগুলো। সে উঠে দাঁড়ায়। হাত জোড় করে বলেÑ আমাকে মা করবেন। এভাবে নিজেকে আবেগের কাছে মুক্ত করে দেওয়া আমার উচিত হয়নি।
প্রৌঢ়দের একজন বলে- নিশ্চয়ই উচিত হয়েছে। চিরকাল কি আর মানুষ আবেগকে চেপে রাখতে পারে? আর আমরা তো সত্যিই অপরাধী। নিজেরা না করি, আমাদের স্বজাতিরা তো অমানবিক অন্যায়গুলো করেছে। বছরের পর বছর ধরে করেছে। তার জন্য যত প্রায়শ্চিত্ত করতে হোক, আমরা করব। করতেই হবে। তবে যুবক, একটি কথা মনে রাখবেন। আমরাও এই মাটিকে আমাদের জন্মমাটি বলেই মনে করি। সত্যি সত্যি এই বরেন্দ্রীই আমাদের দেশ। সেই কত শত বৎসর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যাবর্ত থেকে অথবা অন্য কোনো ভূমি থেকে এসেছিলেন এই ভূমিতে। সেই অতীতের কথা মুছে গেছে আমাদের মন থেকে অনেক আগেই। এই ভূমি ছাড়া আমরাও তো আর অন্য কোনো ভূমিকে চিনি না। এই ভূমি ছাড়া আমরাও তো অন্য কোনো ভূমিকে নিজের মাতৃভূমি বলে কল্পনা করতে পারি না। এটাই আমাদের জন্মমাটি। আমাদেরও এখানেই বাস করতে হবে আমৃত্যু। মৃত্যুর পরে আমাদের দেহ এই দেশেরই কাঠের চিতায় জ্বলে জ্বলে মিশে যাবে এই দেশেরই বাতাসের সাথে। এখন দেখতে হবে, এই বসবাসটা সংঘাতময় থাকবে, নাকি শান্তিপূর্ণ হবে। আপনি যদি কোনোভাবে সুযোগ পান, শুধু এই কথাটা জানাবেন রাজা ভীমকে। জানাবেন আমরাও এই মাটিরই সন্তান। এছাড়া আমাদের অন্য পরিচয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মনের মধ্যে ধাক্কা লাগে পপীপের। এভাবে তো কোনোদিন চিন্তা করা হয়নি!

১০. অন্যরকম আলোও আছে আমাদের পৃথিবীতে

মল্ল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। বলে- হচ্ছে তো। বিশাল একটি প্রতিরা বাঁধ তৈরি হচ্ছে। পদুম্না থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে সেই ত্রিস্রোতার সঙ্গমস্থলে। আমাদের পুণ্ড্র-বরেন্দি-গৌড়ের পূর্ব-উত্তর সীমান্ত জুড়ে। ভীম খুব ভালো সেনাপতি বুঝলি! কৈবর্ত জাতির সৌভাগ্য যে এমন নেতা পেয়েছে। সে বলে যে শুধু বরেন্দির মানুষ নয়, বরেন্দির মাটি বরেন্দির জল বরেন্দির বন- সবকিছুকেই কাজে লাগাতে হবে বরেন্দির শত্রু র বিপক্ষে সেই চিন্তা থেকেই এই প্রতিরক্ষা ব্যূহ। মাটির প্রাচীর। এটি শুধু প্রাচীরই হবে না, হবে সৈন্য চলাচলের পথও। এতখানি প্রশস্ত হচ্ছে প্রাচীরটা যাতে তার ওপর দিয়ে পাশাপশি ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে পারে চারজন সৈন্য। আর প্রাচীরের জন্য মাটি নেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র পূর্ব পাশ থেকে। এর ফলে সেখানে একটি বড় খাল তৈরি হয়ে যাচ্ছে। খুব বড় খাল, যেটাকে নদীই বলা যাবে প্রায়। ভীম নামও দিয়ে রেখেছে সেই নদীর। সুবিল নদী। এই প্রতিরা প্রাচীরের কাজ শেষ হলে সমতটের ব্রাক্ষ্মণ রাজত্বের মধ্য দিয়ে আমাদের পুণ্ড্রবর্ধনের ওপর আক্রমণ পরিচালনার কোনো সুযোগ আর রামপালের থাকবে না।

শুনতে খুব ভালো লাগছে পপীপের। তবু দেবগ্রামে শোনা সেই কথাটি না বলে পারে না- শুনলাম দেবগ্রামগুলো থেকে আর্য যুবকদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিষ্টি(বিনামূল্যে শ্রম) দিতে বাধ্য করা হচ্ছে সেই প্রতিরোধ প্রাচীরের কাজে।
চকিতে তার দিকে তাকায় মল্ল। জিজ্ঞেস করে- একথা কোথায় শুনলি?
অশ্ব ছুটিয়ে একটি দেবগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কোনো যুবক বা তরুণকে চোখে না পড়ায় প্রশ্ন করেছিলাম। তারা এই তথ্য জানিয়েছে।
মাথা নাড়ে মল্লÑ কথাটা সত্যি। তবে শুধু তাদেরকে একা খাটানো হচ্ছে না। এতবড় কাজ। কৈবর্ত নারী-পুরুষ দলে দলে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে যাচ্ছে মাসের পর মাস। বর্ষার আগেই প্রাচীরের কাজ শেষ করতে হলে আরো বেশি শ্রমকর্মী প্রয়োজন। সেই কারণে শুধু আর্যদের নয়, অন্য গোত্রেরও সকল সম পুরুষকে আহ্বান জানানো হয়েছে স্বেচ্ছাশ্রম প্রদানের জন্য। এ যাবত কোনো কর্মীকেই এক কার্ষাপণও প্রদান করতে হয়নি। বরেন্দিকে ভালোবেসে সকলেই যেখানে নিজে থেকে এসে কাজ করে যাচ্ছে। আর সেটাকে বিষ্টি বলছে দেবগ্রামের মানুষরা?
হ্যাঁ। তাই তো বলছে। আর বলবে না-ই বা কেন? বিনা মূল্যে শ্রম দিতে হলে তাকে তো বিষ্টিই বলে তাই না?
মল্ল উত্তেজিত হয়ে ওঠে- না, কখনোই না। বিষ্টি আর স্বেচ্ছাশ্রমÑ কখনোই এক জিনিস নয়। দেশকে যে ভালোবাসে, সে কখনো এই শ্রমদানকে বিষ্টি বলতে পারবে না!
মনের গভীরে পপীপ জানে কথাটা সত্য। তাই আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু মল্ল বলেই চলে- ওরা যদি বিষ্টি বলে, বলুক। ওদের অনেক যুবক তো পালিয়ে গিয়ে রামপালের সৈন্যদলে যোগ দিয়েছে। এখনো দিচ্ছে। যারা বরেন্দিতে থাকবে, তাদের কাছ থেকে বরেন্দি তো কিছু-না-কিছু প্রাপ্য গ্রহণ করবেই। শুধু ভূমিপুত্ররাই শ্রম-ঘাম-রক্ত ঢেলে যাবে, আর অন্যেরা বসে বসে দেখবে, তা তো হতে পারে না।

মল্ল এবং পপীপ পাশাপাশি অশ্বপৃষ্ঠে বসে গল্প করতে করতে এগিয়ে চলেছে। রাজধানী গৌড়ে যাচ্ছে ওরা। মল্ল এখানকার প্রতিরা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য এখানে এসেছিল। সে কাজ তার শেষ হয়েছে। এখন তার ঘরে ফেরার পালা। ঘরের কথায় পপীপ হেসেছিল। মল্লর মতো মানুষের আবার ঘর হয় নাকি! ঘর এবং মল্ল- এই দুটো শব্দ তো আসলে পরস্পরের বিপরীত দ্যোতনা এনে দেয়। ঘর হচ্ছে স্থায়ীত্ব, স্থবিরতা, গার্হস্থ্য, স্বস্তিময় জীবনের প্রতীক। মল্ল ঠিক উল্টো। মল্ল মানেই উদ্দামতা, অস্থিরতা, রোমাঞ্চ। সেই মল্ল ঘরে ফেরার কথা বললে শুধু পপীপ কেন, মল্লকে চেনে এমন যে কেউ হেসে উঠবে। কিন্তু পপীপ আশ্চর্য হয়ে ল করে, ঘরে ফেরার জন্য মল্লর মধ্যে একধরনের তাড়া কাজ করছে। নিজের মনোভাবকে কোনোদিন গোপন করতে শেখেনি মল্ল। এখন যে সে ঘরে ফিরতে উদগ্রীব, এই মনোভঙ্গিটিকেও লুকানোর কোনো চেষ্টাই সে করছে না। মনে মনে আশ্চর্য হলেও এ ব্যাপারে কোনো কথা বলে না পপীপ। তবে মল্লর মনোভঙ্গি বুঝে চেষ্টা করে নিজের গতিবেগ বাড়িয়ে দিতে। সে ঘোড়ায় চড়তে খুব একটা পারদর্শী হতে পারেনি। এবরোথেবরো পথে খুব জোরে ঘোড়া ছোটালে নিজের ভারসাম্য রা করতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা সে নিজেকেও দিতে পারে না। মল্ল এটা বোঝে। তার অভিজ্ঞ দৃষ্টি ঠিকই বুঝে নিয়েছে যে পপীপ খুব দ্রুত ঘোড়া চালাতে শিখলেও যাকে বলে সুদ অশ্বারোহী, তা হতে এখনো অনেক সময় লাগবে। পপীপকে জোরে ঘোড়া ছোটাতে বললে বিপদ হতে পারে। তাই সে মাঝারি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে। কিন্তু পপীপ হঠাৎ গতিবেগ বাড়িয়ে দেওয়ায় তাকেও গতি বাড়াতে হয়। সে কিছুণের মধ্যেই চলে আসে পপীপের পাশে। বলে- এত জোরে ছুটতে হবে না। গতি কমিয়ে দে। চারপাশ দেখতে দেখতে আর গল্প করতে করতে যাই।
পপীপ এবার তার কথা মেনে নেয়। ভীমের কথা জানতে চায়। রামপালকে প্রতিহত করে কীভাবে স্থায়ী প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা যায়, সেকথা জানতে চায়। মল্ল বলে যে সেসব পরে হবে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা এই পথে সম্ভব নয়। এবং তা বিধেয়-ও নয়। বরং তারা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলুক।
পপীপ চলতে চলতে দুচোখ ভরে বরেন্দিকে দেখে। সবই তার কাছে নতুন লাগে। বরেন্দিতে তার নাড়ি পোঁতা থাকলেও যে তো আসলে বরেন্দির কিছুই চেনে না। এককথায় বলতে গেলে বরেন্দি তার কাছে একটা স্বপ্নের নাম। মল্ল চলতে চলতে জিজ্ঞেস করেÑ তুই সন্ধ্যাকর নন্দীকে চিনিস?
পপীপ তো এই নামে কাউকে চেনে না।
মল্ল প্রশ্নটা সংশোধন করে- মানে আমি জানতে চাইছি তুই কি তার নাম শুনেছিস?
পপীপ এবারও এদিক-ওদিক মাথা নাড়ে। না, সে সন্ধ্যাকর নন্দীর নাম শোনেনি। কে সে?
একে তো ঘোড়ার পায়ের ঘায়ে ধূলি উড়ছেই, তার ওপর বরেন্দির থাকবন্দি মাটির সোপান বেয়ে মাঝে মাঝেই উঠে আসছে ঘূর্ণি বাতাস। ফলে এত কাছে থেকেও মাঝে মাঝে তারা একে অপরকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। ধুলো এসে আড়াল করে দিচ্ছে পরস্পরের মুখ। কিন্তু সন্ধ্যাকর নন্দীর পরিচয় জানতে চাওয়ায় মল্লর মুখে এমন এক তিক্ত হাসি ফুটে ওঠে যে ধুলোর ঘূর্ণিও তাকে আড়াল করতে পারে না। অনেকণ সে পপীপের প্রশ্নের উত্তর দেয় না। একমনে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকণ পরে, পপীপ যখন মনে মনে অস্থির হয়ে আবার প্রশ্নটা করতে যাবে, সেই সময় মল্ল বলে- সন্ধ্যাকর নন্দী হচ্ছে কবি। এই যুগের সবচাইতে প্রতিভাবান কবি। বিদ্যোৎ-সমাজ তাকে ‘কলিকালের বাল্মিকী’ বলে ডাকে।
এত বড় একজন কবি! পপীপ মনে মনে সন্ধ্যাকর নন্দীকে প্রণাম জানায়। তার কবিতা পাঠের জন্য মনের মধ্যে একটি তাড়াও অনুভব করে। আর মল্ল যখন নাম নিয়েছে, তখন বুঝতেই হবে, তিনি সত্যিকারের প্রতিভাবান কবি। মল্ল কি তাকে সংগ্রহ করে দিতে পারবে তার কাব্য? কিন্তু সে প্রশ্নটি উচ্চারণ করার আগেই মল্ল বলে- সন্ধ্যাকর নন্দীর সঙ্গেই তোর যুদ্ধ পপীপ। যেমন ভীমের যুদ্ধ রামপালের সাথে, তেমনি তোর যুদ্ধ সন্ধ্যাকর নন্দীর সাথে। রামপালের পাশে যেমন সন্ধ্যাকর নন্দী আছে, তোকে সেইভাবে দাঁড়াতে হবে ভীমের পাশে। আর্যদস্যুদের যেমন প্রধান লেখনী-সহায় সন্ধ্যাকর নন্দী, তেমনি কৈবর্তজাতির লেখনী-সহায় হতে হবে পপীপকে।
হতবাক হয়ে যায় পপীপ। এতটাই অবাক হয়েছিল যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল প্রায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেÑ এ আবার কেমন যুদ্ধ মল্লকাকা?
মল্ল বলেÑ কৈবর্ত জাতি এই প্রথম একজন কবিকে পেয়েছে পপীপ। সে তুই। সন্ধ্যাকর নন্দী কাব্যরচনা করে কৈবর্তজাতির মুক্তিদাতা দিব্যোকের নামের সাথে যেসব কুৎসিত বিশেষণ যোগ করে দিচ্ছে, তার প্রতিবিধান করার মতা আমাদের কারো নেই। পুরো কৈবর্তজাতি তাই নিজেদের একজন কবির আগমনের জন্য অপো করে আছে। তুই সেই কবি পপীপ। সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্যে দিব্যোক আর কৈবর্তজাতি সম্বন্ধে যেসব কুৎসিত কথা আছে, সেগুলোর যথাযোগ্য উত্তর দিয়ে কাব্য রচনা করতে হবে তোকে। তোকেই করতে হবে পপীপ। কারণ আমাদের আর কেউ নেই।
পপীপ ঘাবড়ে যায়- এত বড় দায়িত্ব! আমি কি পারব মল্লকাকা?
তোকে পারতেই হবে পপীপ। ভীম যদি হেরে যায় রামপালের কাছে, তাতে যতটা তি হবে এই মাটির সন্তানদের, তার চাইতে অনেক বেশি তি হয়ে যাবে যদি তুই সন্ধ্যাকর নন্দীর কাছে হেরে যাস। কারণ, সন্ধ্যাকর নন্দীর কাব্য হাজার বছর পরেও এদেশের ভূমিপুত্রদের ছোট করে রাখবে মানুষের কাছে।
পপীপ কোনো উত্তর দিতে পারে না। মল্লও আর কোনো কথা বলে না। দুজনেই নিজের নিজের ভাবনায় ডুবে গিয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এভাবেই। মনে হয় এমন দুই অশ্বারোহী যাচ্ছে, যারা পাশাপাশি যাচ্ছে বটে, কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। অনেক, অনেকটা সময় পড়ে, রাজধানীর একেবারে উপকণ্ঠে এসে মল্ল স্বগতোক্তি করে- হায়রে অর! হায়রে অরের শক্তি! তোর সাথে যুদ্ধ করবে এমন ব্রক্ষ্মাস্ত্র আছে কার কাছে!

১১. সত্যিকারের ঘর

এমন অবিশ্বাস্য অপরূপ সৌন্দর্যের হঠাৎ মুখোমুখি হলে মানুষ বাকহারা হয়ে পড়বেই। পপীপও বাকহারা হয়। মানুষের মধ্যে কোথাও একটা সৌন্দর্যের কাছে নতজানু হওয়ার প্রবণতা থেকেই যায়। আর সেই সৌন্দর্য যদি একাধারে হয় শ্বাসরুদ্ধকর এবং স্নিগ্ধ, তখন সেই সৌন্দর্য একই সঙ্গে সুদূরের এবং কাছের বলে মনে হয় মানুষের কাছে। নিজের অজান্তেই মানুষ তখন সেই সৌন্দর্যের দাসত্ব বরণ করে নেয়।
পপীপ এখন বুঝতে পারছে মল্লকাকা কেন তার ঘরে ফেরার জন্য মনে মনে উতলা হয়ে থাকে। দ্বারে করাঘাত করামাত্র যে শ্রীময়ী মূর্তি কপাট উন্মুক্ত করে সামনে দাঁড়ায়, তাকে দেখামাত্র পপীপ সৌন্দর্যের সেই অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়। ঊর্ণাবতী যে অপূর্ব সুন্দরী, সেই কৈশোরেও তা অনুভব করতে পারত পপীপ। কিন্তু সেই সময়ের ঊর্ণাবতীকে সুন্দরী বললে আজকের ঊর্ণাবতীকে কী বলে অভিহিত করবে পপীপ! সৌন্দর্যের সাথে পবিত্রতা মিশে গেলে যেমন অবয়ব পায় মানুষ, ঊর্ণাবতী আজ তার সাক্ষাৎ উদাহরণ।
দরজা খোলার সাথে সাথে মল্ল- ‘এই দ্যাখো কাকে সঙ্গে এনেছি’ বলে ঊর্ণাবতীর মনোযোগ পপীপের দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেও ঊর্ণাবতী একবার মাত্র ভ্রক্ষেপ করে পপীপের দিকে। তার চোখে পরিচিতের দৃষ্টি ফুটে উঠেছে কি না সেটাও অনুভব করার সুযোগ পায় না পপীপ। ঊর্ণাবতী চট করে দরজার পাশ থেকে দুইটি আসন তুলে বিছিয়ে দেয় মেঝেতে। পপীপকে একবার শুধু বসার ইঙ্গিত করে বলে- ‘অতিথি নারায়ণ। আমি অবশ্যই যথাযোগ্য সেবা করব অতিথির। তার আগে দয়া করে আমার পূজাটুকু সেরে নিতে দিন!’
মল্ল কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু ঊর্ণাবতী সেকথা মুখে আনার অবকাশটুকুও না দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। মল্ল একটু বিব্রত চোখে তাকায় পপীপের দিকে। ইঙ্গিত করে আসনে বসার। নিজেও বসে পড়ে আরেকটি আসনে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে আসে ঊর্ণাবতী। তার হাতে জলপাত্র। মল্লর সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। মল্ল অস্বস্তি বোধ করে পপীপের সামনে। তবু এগিয়ে দেয় দুই পা। বোধহয় জানে যে বাধা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। ঊর্ণাবতী পরম যত্নে জল ঢালে মল্লর পায়ে। এক হাতে জলপাত্র নিয়ে জল ঢালছে, আরেক হাতে প্রালন করছে মল্লর ধূলিধূসরিত দুই পা। পা ধোয়া শেষ করার পরে, পপীপ বিস্ফারিত দুই চোখে দেখে, ঊর্ণাবতী এবার নিজের চুল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে মল্লর পা দুটি। তারপর মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করে মল্লকে। মল্ল আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত ছোঁয়ায় তার মাথায়। কিন্তু ঊর্ণাবতী গড় করেই থাকে মল্লর পায়ের ওপর। পল-অনুপল কেটে যেতে থাকে। সাধারণ প্রণামে যতটুকু সময় লাগে, তারচেয়ে অনেক বেশি সময় নেয় ঊর্ণাবতী। কিন্তু সেই বেশিরও তো একটা মাত্রা থাকে! মল্লকে রীতিমতো বিব্রত দেখাচ্ছে। কিন্তু ঊর্ণাবতী তার পায়ে কপাল ঠেকিয়ে গড় করে আছে তো আছেই। আবার তার মাথা এবং পিঠ স্পর্শ করে মল্ল। প্রণাম শেষ করার ইঙ্গিত। কিন্তু একই ভাবে নিজের কপালকে মল্লর পায়ের ওপর বিছিয়ে রাখে ঊর্ণাবতী। অনেক অনেকণ পরে ঊর্ণাবতী যখন মাথা তোলে, দেখা যায় তার চোখের জলে আবার ভিজে গেছে মল্লর দুই পায়ের পাতা। মল্ল এবার পরিহাসের ছলে বলে ওঠেÑ তাই তো ভাবছিলাম পায়ে সুড়সুড়ি লাগছে কেন আবার!
বলে নিজেই হেসে ওঠে মল্ল। হাসে পপীপও। চোখের জল মুছতে মুছতে হাসে ঊর্ণাবতীও।
এতণে পপীপের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় ঊর্ণাবতী। তাকে নমস্কার করার জন্য দুই হাত জড়োও করে। কিন্তু তারপরেই তার চোখ থেকে উধাও হয়ে যায় অচেনার দূরত্ব। খুশি এবং স্নেহের হাসিতে ঝিকিয়ে ওঠে মুক্তাসদৃশ দুই পাটি দাঁত- পপীপ! পপীপ! কেমন আছিস বাছা! কতদিন পরে তোর দেখা পেলাম!
এবার উঠে দাঁড়ায় পপীপ। এগিয়ে এসে প্রণাম করে ঊর্ণাবতীকে। তারপর দাঁড়ায় তার পাশেই। ঊর্ণাবতী সস্নেহ আঙুল বোলায় পপীপের চিবুকে। বলে- তোকে দেখে কী যে ভালো লাগছে!
পপীপ বলে- আমারও খুব ভালো লাগছে গুরুমা!
মল্ল এগিয়ে আসেÑ এতণ তো ফিরেও তাকাচ্ছিলে না ওর দিকে! ছেলেটার সামনে যা কাণ্ড করলে, আমার তো লজ্জাই লাগছিল।
মল্লর কথাতে কোনো ভাবান্তর নেই ঊর্ণাবতীর। বলে- আমার দেবতার পূজা তো আমাকে করতেই হবে। দেবতার তো পূজা পাওয়া বা না-পাওয়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু যে পূজার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে, তাকে কেন বঞ্চিত করবে তার পূজার অধিকার থেকে?
আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে! এখন ছেলেটাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে চলো! কিছু খেতে-টেতে দাও।

বিশ্রাম এবং খাদ্যগ্রহণের পরে আবার তারা তিনজন একত্রিত হয়। মল্ল জিজ্ঞেস করে- আমি তো পপীপকে প্রথমে দেখে চিনতেই পারিনি। যা দশাসই জোয়ান হয়েছে! কিন্তু তুমি একবার দেখেই চিনলে কীভাবে?
মুখ টিপে হাসে ঊর্ণাবতী- তোমরা পুরুষরা কি আর ভালো করে দেখতে জানো? তোমরা তো শুধু স্থূল অবয়বটুকুই দেখতে পাও। তাই সেটার কোনো পরিবর্তন হলেই চেনা মানুষই অচেনা হয়ে যায় তোমাদের কাছে। নারীদের দেখার চোখ অনেক সূত্র। তারা সজ্ঞানে যেমন দেখে, অজ্ঞানেও তেমনই দেখে। চেতনে যতটা দেখে, অবচেতনে তার চাইতে অনেক বেশি দেখে। চেতন মন অবয়বকেই বেশি মনে রাখে। কিন্তু অবচেতন মনের স্মরণশক্তি অনেক বেশি।   হয়তো তার কথা বলার ভঙ্গি, হয়তো হাসলে তার কোনো একটি চক্ষু বেশি কুঞ্চিত হয়, হয়তো তার ঠোঁট একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বেঁকে যায়, হয়তো তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি এমন যা সচরাচর অন্যদের সঙ্গে মেলে না- এইসব জিনিস মেয়েরা অনেক বেশি মনে রাখতে পারে।
তা পপীপের কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে, যা দেখে তুমি এত বছর পরেও তাকে এক নিমেষে চিনে ফেললে?
এবার ঠোঁটের হাসিটি প্রশস্ত হয়ে ওঠে ঊর্ণাবতীর। বলে- আমি পপীপকে চিনতে পেরেছি তোমার আচরণ দেখে। পৃথিবীতে আমি ছাড়া পপীপই যে তোমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়, সেকথা তো আমি জানি। তাছাড়া তুমি অন্তত ঘরে ফেরার সময় কোনোদিন কাউকে সঙ্গে আনো না। আনলেও তার স্থান হয় বড়জোর অতিথিনিবাসে। ঘরে তুমি আনতে পারো একমাত্র তোমার মানস-সন্তানকে। সে হলো পপীপ। আর তোমার সমস্ত অবয়বে যে খুশির চিহ্ন ফুটে বেরুচ্ছিল, তা একমাত্র পপীপকে খুঁজে পাওয়া ছাড়া আর কোন কারণে এত প্রকট হতে পারে!
শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই দুচোখ ভিজে আসে পপীপের।
মনে মনে নিজের হারিয়ে যাওয়া মায়ের কাছে মা প্রার্থনা করে বলে- আমি কোনোদিন তোমাকে খুঁজে পাব কি না জানি না মা! কিন্তু যদি পাই, তুমি আমাকে আমার মল্ল কাকা আর ঊর্ণাবতী গুরুমার মতো ভালোবাসা দিও মা!
পপীপের এই ভাবান্তর দৃষ্টি এড়ায়নি ঊর্ণাবতীর। সে কাছে এসে মাথায় আদরের হাত বুলায়। বলে- মায়ের কথা মনে পড়ছে পপীপ? তোর মাকে খুঁজতে যাসনি?
গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার সেই গ্রামই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গুরুমা। মাকে এখন কোথায় পাব?
বুঝতে পারছি। কিন্তু তাই বলে তুই মন খারাপ করে বসে থাকিস না। এখন বরেন্দি মুক্ত হয়েছে। তুই-ও মুক্ত হয়ে নিজের মাটিতে ফিরতে পেরেছিস। যদি তোর মা বেঁচে থাকে, তাহলে তার সাথে তোর দেখা হবেই হবে বাবা!
এক শান্ত স্বরে এত দৃঢ়তা থাকতে পারে, আগে কখনো শোনেনি পপীপ। তার মন অকেশে মেনে নেয় ঊর্ণাবতীর আশ্বাস। সে আবার মুহূর্তের মধ্যে আগের হাসি-খুশি ভাবটি ফেরত পায়।
মল্ল বলেÑ ঊর্ণাবতী তুমি আমাদের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখিয়েছ পপীপকে?
তাই তো! ছেলেকে তো পুরো বাড়িটা দেখানো হয়নি এখনো।
পপীপ হাসেÑ পরে দেখলেও হবে। বাড়ি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।
মল্ল হা হা করে ওঠেÑ সে কী কথা! যে মল্লর জীবন ছিল ‘যেখানেই রাত, সেখানেই কাত’ সেই মল্লর একটা অট্টালিকা হয়েছে। সেই অট্টালিকা তোকে দেখাতে না পারলে তোর কাছে আমি গর্ব প্রকাশ করব কী করে! যা যা! ঊর্ণাবতী ওকে দেখিয়ে আনো তো বাড়িটা। আমি ততণে কিছুক্ষণ নাকটা ডেকে নিই।
তোমার ঘুম পেয়েছে সেকথা বললেই তো হয় মল্লকাকা। আমরা নাহয় অন্য ঘরে গিয়ে কথা বলতাম!
আচ্ছা তাই যা! আমাকে একটু ঘুমাতে দে দেখি!
হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে পপীপ। কিন্তু এবার সত্যিই তার পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগে মনে। একেবারে রাজধানীর বুকে এমন একটি অট্টালিকা এখন মল্লর। বরেন্দি মুক্ত না হলে এমন চিন্তাও কি কোনোদিন সম্ভব ছিল কোনো কৈবর্তের মনে?
পপীপের মনের কথা যেন নিমেষে পাঠ করে ফেলতে পারে ঊর্ণাবতী। বলে- এই রকম অট্টালিকা মল্ল কি কোনোদিন তৈরি করতে পারে পপীপ? এমন মানসিকতার মানুষই তো সে নয়। নিজের জন্য একটি বাড়ি প্রয়োজন, এই চিন্তাই তো তার মাথায় আসবে না।
ঠিক। পপীপ বলে ওঠে- এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটা তো মল্ল নামের সাথেই বেমানান।
গর্বের হাসি হাসে ঊর্ণাবতী- ঠিক বলেছিস। মল্ল এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ভাববার মতো মানুষই নয়। এমনকি যখন আমাকে সে মুক্ত করে আনল কামরূপের অভিশপ্ত জীবন থেকে, তখনো সে কোনো বাড়ির কথা ভাবেনি। কিন্তু রাজা ভীম তাকে বাধ্য করেছে এই বাড়িটা গ্রহণ করতে।
এতণে একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল।
ঊর্ণাবতী আবার বলেÑ আগের যুগের, মানে পাল-সম্রাটের কোনো অমাত্যের বাসগৃহ ছিল হয়তো এটি। মহীপালের মৃত্যুর পরে পালিয়েছে তারা। সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে ভীম জোর করে উঠতে বাধ্য করল মল্লকে। তবু কী মল্ল স্বীকৃত হয় এটি গ্রহণ করতে! ভীম রাজা হয়ে হাতজোড় করে তাকে বলল যে, যাদেরকে তার সবসময় প্রয়োজন হয়, সেইসব পরামর্শক যদি রাজধানীতে না থাকে, তাহলে সে বরেন্দি পরিচালনা করবে কীভাবে! সমস্যায় পড়লে সে কোথায় খুঁজতে যাবে মল্লকে, কোথায় খুঁজতে যাবে উগ্রকে? একমাত্র তখনই মল্ল সম্মত হলো আমাকে নিয়ে এই বাড়িতে উঠতে।

পুরো বাড়ি ঘুরে দেখা হয়ে গেল। ঊর্ণাবতী আগে যেখানে ছিল, সেই কামরূপের কোষ্ঠকের তুলনায় এই বাড়িকে রীতিমতো শ্রীহীনই বলা চলে। বিশেষ করে বাড়িতে আসবাবপত্র বলতে গেলে প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু ঊর্ণাবতী এমন রাজেন্দ্রানীর ভঙ্গিতে পপীপকে সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়, তাতে এই বাড়ি নিয়ে তার যে প্রচ্ছন্ন একটি গর্ব রয়েছে তা বেশ পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। আসবাব না থাকাতেই যেন এই বাড়ি সবচেয়ে বেশি ঐশ্বর্যময় হয়েছে। ঊর্ণাবতীর অবয়বের সাথে যেমন যোগ হয়েছে অপরূপ এক পবিত্রতার ছাপ, সেই একই রকম পবিত্র আভা ছড়িয়ে রয়েছে বাড়িটির সবগুলি কক্ষে কিন্তু মনে মনে কোনো একটি জিনিসের অভাব বোধ করে পপীপ। ঠিক কী জিনিস, তা অবশ্য মনে পড়তে চায় না। কিন্তু ঊর্ণাবতীর সাথে অবিচ্ছেদ্য কোনো একটি জিনিস অবশ্যই ছিল। পপীপের মনে নেই। কিন্তু মনে মনে পুরো বাড়িতেই জিনিসটি খুঁজেছে সে। দেখলেই তার মনে পড়ে যেত। অবশেষে চকিতে তার মনে পড়ে জিনিসটার কথা। গৃহদেবতা! ঊর্ণাবতীর ঘরের কুলুঙ্গিতে সবসময় থাকত গৃহদেবতার বিগ্র্রহ। দিনে অন্তত দুইবার ধূপ-ধুনো জ্বেলে গৃহদেবতার পূজা করত ঊর্ণাবতী। কিন্তু তেমন কোনো মূর্তি তো চোখে পড়ে না এই বাড়িতে! কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসে পপীপ- গুরুমা! তোমার গৃহদেবতা কোথায়? কোনটা তোমার পূজার ঘর?
একটু থমকে যায় ঊর্ণাবতী। তারপর ধীরকণ্ঠে বলেÑ বোকা ছেলেই রয়ে গেছিস তুই এখনো। আরে জলজ্যান্ত দেবতা সশরীরে উপস্থিত থাকলে পুতুল নিয়ে পূজা পূজা খেলতে যায় কেউ!
পপীপ আমতা আমতা করে- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমার দেবতা তো আমার সামনেই আছে। মল্লই আমার দেবতা!
তাহলে তুমি তোমার নিজের ধর্মও ত্যাগ করেছ? তোমাদের হিন্দু ধর্ম? আর্য ধর্ম?
ওটা আবার একটা ধর্ম হলো! যে ধর্ম শাস্ত্রের বিধান দিয়ে আমাকে দেবদাসী বানিয়েছিল, সেটি কোনো মানুষের পালনীয় ধর্ম হতে পারে রে পপীপ? তুই এখন বড় হয়েছিস। লেখাপড়া শিখেছিস। তুই জানিস, দেবদাসী আসলে কী। তুই তাহলে বল, যে ধর্ম আমাকে দেবদাসী বানিয়েছে, আমি সেই ধর্ম পালন করব, নাকি যে ধর্ম আমাকে দেবদাসীর কলুষিত জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছে, আমি নেই ধর্ম পালন করব। তুই নিজে হলে কী করতি?
তাহলে তুমি কি এখন আমাদের, মানে কৈবর্তদের ধর্ম পালন করছ?
না। আমার কোনো ধর্মপালনের প্রয়োজন নেই। আমার ধর্ম হচ্ছে আমার দেবতা, আমার মুক্তিদাতা, আমার প্রেমাষ্পদ, আমার রক মল্লর সেবা করা। তার কাজে পাশে পাশে থাকা। সে যে যুদ্ধ করছে, সেই একই যুদ্ধে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা।
তুমিও যুদ্ধ করছ!
হ্যাঁ করছি তো। একে যদি যুদ্ধ বলা যায়, তাহলে আমি অবশ্যই যুদ্ধ করছি।
কী করছ তুমি?
ঊর্ণাবতী নয়, ঊত্তর ভেসে আসে মল্লর কণ্ঠ থেকে- তোর গুরুমা এই বাড়ির বাইরের অংশে টোল খুলেছে। সকাল হলেই দেখতে পাবি, কৈবর্তদের নেংটিপরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে।
মল্লর কণ্ঠে একই সঙ্গে জীবনসঙ্গিনীর কাজ নিয়ে গর্ব, আর জীবনসঙ্গিনীর প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ঝরে পড়ে।

১২. ভীমের দর্শন

এতদিন পপীপের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে মল্লর চাইতে সুদর্শন এবং সুদেহী পুরুষ পৃথিবীতে আর একজনও নেই। কিন্তু ভীমকে একবার দেখামাত্র সে তার ধারণা পাল্টাতে বাধ্য হয়। বরেন্দির লাল মাটির সাথে নদীপাড়ের কালো পলি মিশিয়ে দিলে যেমন বর্ণ ধারণ করে, সেই রকম গায়ের রং ভীমের। যারা মহাভারত পড়েছে, তারা ভীম নামটি শোনার সাথে সাথে তাদের মানসপটে ভেসে উঠবে বিশালদেহী এবং দানবাকৃতির একটি মানুষের অবয়ব। আবার ভীমের সাথে ভীষণ-এরও একটি সাযুজ্য সকলেই মনে মনে কল্পনা করে নেয়। কিন্তু কৈবর্ত নেতা ভীমের অবয়বের সাথে একেবারেই মিলবে না তাদের কল্পনা। ভীম দীর্ঘদেহী শালপ্রাংশু। কিন্তু দানবাকৃতির মোটেই নয়। শরীরের পেশিগুলি সুপুষ্ট, কিন্তু মোটেই ফোলা ফোলা নয়। যখন সে উঠে দাঁড়ায়, তখন সকলকে ছাড়িয়ে যায় তার মাথা। তবু তাকে মোটেই ঢ্যাঙ্গা মনে হয় না। তার সমস্ত শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সোঁদামাটির সৌরভ। বরেন্দির অমাবস্যা রাতের মতো কালো কুঞ্চিত একমাথা চুল। ঠোঁটের হাসিতে অন্তরঙ্গতা আর বরাভয়ের বিচ্ছুরণ। আর তার কাছে গেলে টের পাওয়া যায়, তার শরীর থেকে ফুটে বেরুচ্ছে শক্তি এবং আভিজাত্যের জ্যোতি। একবার দেখামাত্র মনে মনে ভীমের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় পপীপ। তার মন বলেÑ হ্যাঁ এই হচ্ছে নেতা! যাকে দেখে মনে সাহস আসে, যার হাসি দেখে অভয়মন্ত্র বেজে ওঠে প্রাণে, যার সংস্পর্শে এলে নিজের মধ্যেও জ্বলে ওঠে মৃত্তিকাপ্রেমের শুদ্ধ অগ্নিমন্ত্র।
    কিন্তু তাকে কি রাজা বলা যায়? আর এই নাকি রাজপ্রাসাদ! আর এই নাকি রাজপ্রাসাদের প্রধান সভাক! কোথায় তার জৌলুষ! কোথায় তার মনোহারিণী চাকচিক্য? কোথায় তার দম্ভ এবং আভিজাত্যের প্রতীক রাজমুকুট? কোথায় তার মতার নিরংকুশ প্রতীক রাজসিংহাসন?
    একটা কাঠের তেপায়ার ওপর বসে আছে ভীম। বসে আর থাকছে কই! প্রায় প্রতিমুহূর্তেই উঠে দাঁড়াচ্ছে। কখনো কারো সাথে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে করে কোনো এক কোণের দিকে, কখনো তেপায়ার সামনে দাঁড়িয়েই সেরে নিচ্ছে কথা, কখনো কাউকে স্বাগত জানাতে নিজেই চলে আসছে দ্বারপ্রান্তে, কখনো কাউকে কথা বলতে বলতে বা পরামর্শ দিতে দিতে নিজেই পৌঁছে দিচেছ বহির্গমনের দ্বার পর্যন্ত। অতিথি-দর্শনার্থীদের জন্য একই ধরনের তেপায়া বিছানো রয়েছে। কিন্তু স্বয়ং রাজাই যেখানে বসছে না, সেখানে অন্যেরা আর বসে থাকে কীভাবে! তাই বেশিরভাগ তেপায়াই খালি। আর সভাকে উপস্থিত সকলেই নিজ নিজ পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে।
    দ্বাররী একজন আছে বটে। কিন্তু সে বোধহয় নামেই দ্বাররী। কারণ কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে কোনো বাধাই দিচ্ছে না সে। কারো দিকে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে শত্রু  না মিত্র তা বোঝার চেষ্টা পর্যন্ত করছে না। করবেই বা কীভাবে! সেই অবসর পেলে তো করবে। একসঙ্গে যত মানুষ আসছে বা যাচ্ছে, সে কয়জনের প্রতি দৃকপাত করবে! এসব বুঝেই হয়তোবা সে হাল ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বাররী নামের অলংকার হয়ে।
    পপীপ অবাক হয়ে দেখছিল। কোনো রাজাকে সে চাক্ষুষ করেনি বটে, কিন্তু বিভিন্ন পুরাণ এবং কাব্য পাঠ করে রাজা এবং রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধে তার মনে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা নিমেষে মিলিয়ে যায় রাজা ভীমের সামনে এসে। মল্লর পাশে দাঁড়িয়ে সে নীরবে পর্যবেক্ষণ করছিল ভীমের প্রতিটি নড়াচড়া। মল্ল নিজেও কোনো কথা বলেনি। জানে, ভীমের লক্ষ্যভেদী দৃষ্টি তাদের ঠিকই দেখতে পেয়েছে। সময় হলে ঠিকই তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করবে।
    ভীমের কথা শুনছে, আর মনে মনে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে পপীপ। এই বরেন্দি-গৌড়-পুণ্ড্রবর্ধনের প্রতিটি ধূলিকণাই কি ভীমের পরিচিত? তা নাহলে সে অবলীলায় দেশের সকল প্রান্ত— থেকে আসা প্রতিটি সমস্যার এমন তাৎক্ষণিক সমাধান দিচ্ছে কীভাবে? আবার একই সাথে দূরে থেকে বা কাছে থেকে আসা সাক্ষাৎপ্রার্থীকে উপযুক্ত আপ্যায়নের দায়িত্বও দিয়ে দিচ্ছে সহচর-অনুচরদের।
    সভাকে ভিড় কমে এলে মল্ল আর পপীপের দিকে তাকায় ভীম। রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা নোয়ায় পপীপ- মহামহিম মহারাজ ভীমকে অভিবাদন জানাচ্ছি।
    হো হো করে হেসে ওঠে ভীম। কাছে এসে জড়িয়ে ধরে পপীপকে। বলে- এখানে তুমি মহারাজা কোথায় দেখলে? রাজাই বা দেখলে কোথায়? এখানে আছি আমি। আমি ভীম। বাবা-জ্যাঠার পথ ধরে কৈবর্তরা আমাকে বসিয়ে দিয়েছে তাদের নেতার আসনে। এখানে কোনো রাজা নেই বন্ধু! আমরা সবাই এই মৃত্তিকার সন্তান। এক-একজন এক-একটা দায়িত্ব পালন করছি এইমাত্র।
    মল্ল পরিচয় করিয়ে দিতে যায়- এই হচ্ছে পপীপ!
    হাতটা আলগা করেছিল ভীম। পপীপের পরিচয় শোনামাত্র আবার তাকে সবলে বুকের সাথে চেপে ধরে ভীম। মুখে বলে- অবশেষে এলে ভাই! আমরা যে বছরের পর বছর তোমার অপো করছি। কয়েকদিন আগে মল্ল যখন দেদ্দাপুর সীমান্ত থেকে সংবাদ পাঠাল যে তুমি এসেছ, সেদিন থেকে আমার ধৈর্য আর বাঁধ মানতে চাইছে না। অবশেষে তুমি এলে ভাই! তোমার মাটিই তোমাকে ডেকে এনেছে। তোমার মাটিই তোমাকে দিয়ে তার ঋণ শোধ করিয়ে নেবে। তুমি যে এই মাটির যোগ্য সন্তান ভাই।
    মল্লর দিতে ফিরে ভীম বলে- চলো আমরা আমার নিজের কে যাই। সেখানে মন খুলে কথা বলা যাবে। কেউ খুব অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া সেখানে আমাদের বিরক্ত করবে না।
    ভীমের শয়নকে এসে আরেক বার অবাক হওয়ার  কথা। কিন্তু ইতোমধ্যে যেহেতু ভীমকে চিনে ফেলেছে পপীপ, তাই তেমন অবাক হয় না সে। পালকশয্যা যে থাকবে না, থাকবে না কোনো জৌলুষের ছোঁয়া- এ ব্যাপারে আগেই নিশ্চিত ছিল পপীপ। কিন্তু একটু অবাক তাকে হতেই হয়, যখন দেখে ঘরে একটা চারপাই আর দুই-তিনটি আসন ছাড়া আর কিছুই নেই। আর অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে দেয়ালের তাকগুলিতে। তার বিস্মিত দৃষ্টি দেখে হাসে ভীম। বলে- কৈবর্তের সবচেয়ে শক্তির দিক কী তা কি জানো কবি? সেটা হচ্ছে কৈবর্তের জীবনে বাহুল্যের কোনো স্থান নেই।
    আসন পেতে নিয়ে তাদের বসতে ইঙ্গিত করে একটি তাকের দিকে এগিয়ে যায় ভীম। তাক থেকে নামিয়ে আনে কয়েকটি ভূর্জপত্র। তাতে খাগের লেখনী দিয়ে লেখা কবিতা। সেগুলোর ওপর একবার দৃষ্টি বুলায় ভীম। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে তিক্ত একটি হাসির রেখা। সে নিঃশব্দে ভূর্জপত্রগুলি এগিয়ে দেয় পপীপের দিকে।
    পপীপ পড়তে থাকে-
        শ্রীঘনায় নমঃ সদা
        শ্রী শ্রয়তি যস্য কণ্ঠং কৃষ্ণং তং বিভ্রতং ভুজেনাগাং
        দধতং কং দাম জটালম্বং শশিখণ্ডমণ্ডনং বন্দে। ।
    “শ্রী বুদ্ধকে নমস্কার!
    শশিখণ্ডমণ্ডিত নীলকণ্ঠ শোভাময় শেষনাগবিভূষিতভুজ কপালমাল জটাবলম্বী মহেশ্বরকে বন্দনা করি।
    কণ্ঠালিঙ্গলক্ষ্মী গোবর্দ্ধনধৃতবাহু, বালরজ্জুনিবদ্ধজটাজালসমন্বিতশির বাদ্যবেণু ও ময়ূরপুচ্ছশোভিত বাসুদেবকে কন্দনা করি।
    বলীবর্দ্দদমনপাদ মেঘে-সূর্যে অদ্রব অজেয় হিমালয় হইতে উদ্ভূত গৌরীসহ বিরাজিত মহেশ্বর আপনাদের শুভবিধান করুন!Ñ যিনি প্রথমে কামদেবকে ভস্মীভূত করিয়া অকল্যাণ সাধন করতঃ সুরসেনা কার্তিকেয়ের জন্মদানে পশ্চাৎ উপকার করিয়াছিলেন।
    যে সূর্য পদ্মসমূহকে বিকশিত করিয়া লক্ষ্মীকে প্রকাশ করেন এবং চন্দ্র কৃষ্ণপে ক্রমশঃ আলোকাভাবে ীণ হইয়া অমাবস্যা দিবসে যে সূর্যে যাইয়া প্রবেশ করেন, সেই সূর্য আপনাদের ঐশ্বর্য বিস্তার করুন!
    যে জলপতি সমুদ্র হইতে লক্ষ্মী প্রকাশিত হইয়াছিলেন, প্রলয় সময়ে বাসুদেব সমগ্র লোক উদরসাৎ করিয়া যে সমুদ্রে প্রবেশ করেন, সেই সমুদ্র আপনাদিগের ঐশ্বর্য বর্দ্ধিত করুন!”
    
    অপূর্ব! নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে মনের মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়ে যায় পপীপের। সংস্কৃত ছন্দগুলির মধ্যে আয়ত্ত-দূরুহতম ছন্দ আর্যা। শব্দ এবং অলংকারের ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব না থাকলে সহজে কোনো কবি এই ছন্দে কাব্য লিখতে চান না। এই কয়েকটি শ্লোক পাঠ করেই কবির অসাধারণত্ব টের পাওয়া যায়। এমন শ্লোক রচনার স্বপ্ন দেখে প্রত্যেক কবিই।
    পপীপের চোখে কবির প্রতি মুগ্ধতা ল করে ভীম মৃদু হাসে। মুখে বলে সত্যিই অসাধারণ তাই না! আমি সংস্কৃত তেমন ভালো জানি না। কিন্তু এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি এই শ্লোকগুলির রচয়িতা ‘কুমারসম্ভব’-এর কবির সাথে তুলনীয়।
    পপীপ এবার প্রশংসার চোখে তাকায় ভীমের দিকে। উচ্চাঙ্গের কাব্যরসের আস্বাদন করতে পারে যে লোক, তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকাতেই হয়। ভীমের প্রতি শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায় পপীপের। এবার যখন ভীম কথা বলে, তার কণ্ঠস্বরে তীব্র তিক্ততা প্রকাশ পায়- এমন একজন কবি যখন আমাদের পিতৃগণকে পাষণ্ডরূপে চিহ্নিত করেন, তখন আমাদের সকল অর্জন বৃথা হয়ে যায় পপীপ!
    বুঝতে পারলাম না। মল্লকাকা অবশ্য বলছিল বটে যে সন্ধ্যাকর নন্দী কৈবর্তদের মুনষ্যেতর প্রাণীরূপে চিহ্নিত করছেন তার কাব্যে। আমি অবশ্য সেগুলি এখনো পাঠ করিনি।
    ভীম মাথা নাড়ে। বলে- নিচের ভূর্জপত্রগুলি দেখো!
    সমান মুগ্ধতা এবং প্রত্যাশা নিয়ে পরের শ্লোকগুলি পড়তে শুরু করে পপীপ। কিন্তু কিছুণের মধ্যেই তার মুখ-চোখ লাল হতে শুরু করে, মাথা দিয়ে আগুনের ভাপ বেরুতে থাকে, এমনকি ক্রোধে সমস্ত দেহ কাঁপতে থাকে।
    কাব্যের পরবর্তী শ্লোকগুলি কৈবর্ত জাতি এবং দিব্যোকের কুৎসায় পরিপূর্ণ। কৈবর্ত জাতি দৈত্য, অসুর, মৎস্য-হন্তারক। আর দিব্যোক ছিলেন ‘অতি কুৎসিত নৃপ’ এবং ‘উপধিব্রতিনা’(ছলনাময়)। “মারীচ যেমন রামচন্দ্রকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তেমনই উপধিব্রতিনা দিব্যোকের দ্বারা মহীপাল অপহৃত এবং নিহত হয়েছিলেন। ”
    কোনো কবি এতটা মিথ্যাচার করতে পারেন! তাহলে কবিকে যে ‘সত্যদ্রষ্টা’ বলা হয়ে থাকে সে কি নিতান্তই ভুল অভিধা? কবির পপাত থাকতেই পারে। কিন্তু নিজের পপাতিত্বের কারণে সত্যভাষণে পরাক্সমুখ হন না বলেই তো কবির অভিধা ‘সত্যদ্রষ্টা’। সন্ধ্যাকর নন্দী এই সত্যটা ভুলে গেছেন বলেই তিনি শক্তিমান কবি হয়েও পপীপের চোখে এখন আর সত্যদ্রষ্টা নন।
    পপীপ চোখ তুলে দেখতে পায় ভীমের চোখে টলটল করছে অশ্রু। এই অশ্রু যে তারই মতো তীব্র ক্রোধ এবং ক্ষোভ থেকে উদ্গত তা বুঝতে সময় লাগে না পপীপের। সে উঠে দাঁড়ায়। তীব্রকণ্ঠে বলে- আমি প্রতিজ্ঞা করছি! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী যত শক্তিমানই হোন না কেন, আমি তাকে পরাজিত করবই! আমি আমার জীবনপাত করব সত্য প্রতিষ্ঠা করে কাব্যরচনাতে।
    আরেকবার পপীপকে আলিঙ্গন করে ভীম। উল্লসিত কণ্ঠে বলে- আমি জানতাম ভাই! আমি জানতাম সখা! যে জাতির মহান রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তোমার-আমার দেহের শিরায় শিরায়, সেই রক্ত আমাকে আগেই জানিয়েছিল যে তুমি এই একক যুদ্ধে এগিয়ে আসবেই।
    কোথায় পাওয়া গেল এই শ্লোকগুলি? সন্ধ্যাকর নন্দী নিঃসন্দেহে বরেন্দিতে থাকেন না। তাহলে এখানে কোত্থেকে এল তার রচিত পংক্তিমালা?
    সন্ধ্যাকর নন্দী তার প্রভু রামপালের সাথে তারই আশ্রয়ে থাকেন। রামপাল যেখানে যায়, কবিতে সঙ্গে নিয়ে যায়। আমাদের বরেন্দির চারপাশ ঘিরে যতগুলি কৈবর্ত-বৈরি রাজ্য রয়েছে, রামপাল সবগুলি রাজ্যের রাজা-অমাত্যকে নিজের দলে ভেড়ানোর জন্য সোনা-রূপা-অর্থ-অলংকার নিয়ে সেসব রাজ্যে যায়। সেখানে তাদের আলোচনা হয়, আর্থিক লেন-দেন হয়, তারপরে সেই রাজ্যের বিশিষ্টজনদের নিয়ে শুরু হয় কাব্যপাঠের অনুষ্ঠান। সেখানে সন্ধ্যাকর নন্দী পাঠ করেন তার শ্লোকসমূহ। রামপাল পূর্বাহ্নেই আখরিয়াদের দিয়ে ভূর্জপত্রে তৈরি করে রাখে এইসব শ্লোকের একাধিক প্রতিলিপি। পরদিন তারা সেই স্থান ত্যাগ করে বটে, কিন্তু রয়ে যায় এইসব শ্লোক। আর্য-কথকরা হট্ট-সমাবেশগুলিতে পাঠ করে শোনায় এইসব শ্লোক। যারা সত্য ঘটনা জানে না, তারা সকলেই এই শ্লোক শুনে দিব্যোককে ঘৃণা করতে শুরু করে। আর সাথে সাথে কৈবর্ত-বিরোধিতায় একত্রিত হয়। আমি গুপ্তচরদের মাধ্যমে জেনেছি, এইসব শোকের অনুলিপি গোপনে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে গৌড়-বরেন্দি-পুণ্ড্রবর্ধনের বড় বড় সকল মন্দিরে এবং  মহাবিহারগুলিতে। এইভাবে সন্ধ্যাকর নন্দীর কবিত্বশক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে কৈবর্ত জাতির বিপক্ষে আমি তোমার কাছে করজোড়ে মিনতি করছি ভাই, তুমি এমন শ্লোক রচনা করবে, যা থেকে এখনকার এবং  ভবিষ্যতের মানুষ জানতে পারবে সত্যি সত্যি কেমন ছিলেন দিব্যোক, আর কী ঘটেছিল বরেন্দিতে।
    পপীপ নিজের পূর্বপ্রতিজ্ঞা আবার উচ্চারণ করে- বরেন্দি-মাতার ঋণ পরিশোধের জন্য আমি আমার সমস্ত মেধা নিয়োজিত করব!
    ভীমকে একটু আশ্বস্ত দেখায়। বলে- তাহলে তুমি কোথায় অবস্থান করতে চাও বলো? যদি রাজধানীতে থাকতে চাও, তাহলে তোমার জন্য বাসগৃহের ব্যবস্থা করব আমরা। বরেন্দির অন্যত্র অবস্থান করতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করা হবে। তবে আমি চাই তুমি এমন জায়গাতে অবস্থান করে কাব্যরচনা করবে, যেখানে থাকলে যুদ্ধ এবং অন্যান্য গোলযোগ তোমাকে স্পর্শ করবে না।
    পপীপকে একটু বিমূঢ দেখায়- সমস্ত বরেন্দি আত্মরার যুদ্ধে নিয়োজিত, আর আমি সেই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকব!
    ভীম তাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে- যুদ্ধ কী আর শুধু একভাবে হয় পপীপ! তোমাকে যে কাজটি করতে হবে, সেটা কি যুদ্ধেক্ষেত্রের সৈনিকের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ? তোমার কাজটিও তো যুদ্ধই। বরং যে কোনো একজন সৈনিকের চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ধরো, আমি যদি যুদ্ধেক্ষেত্রে না যাই, তাহলে আমার অস্ত্রটি নিয়ে আরেকজন কৈবর্ত ঠিকই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তোমার কাজটি তো তুমি ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না বন্ধু। তাই প্রত্য যুদ্ধে নামিয়ে আমরা যদি তোমাকে হারাই, তাহলে কৈবর্তজাতির যে তি হবে তা অপূরণীয়। এত বড় ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না পপীপ।
    পপীপ জানে একজন রাজার সাথে তর্কে প্রবৃত্ত হওয়া সমস্ত ভব্যতার বিরোধী। কিন্তু কিছুতেই সে যুদ্ধত্রে থেকে দূরে থাকতে সম্মত নয়। সে বলে- আপনার সিদ্ধান্তের পরে যে কোনো কথা বলাই ধৃষ্টতা। তবু আমাকে বলতে হচ্ছে। আমার এই ধৃষ্টতা মা করবেন রাজা! আমার একটি যুক্তি শুধু বিবেচনায় নেবার জন্য আমি শেষবারের জন্য আপনাকে অনুরোধ জানাচ্ছি। যে কবি যুদ্ধত্রে থেকে দূরে থাকে, সে কীভাবে যুদ্ধ এবং যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাব্যরচনা করতে পারে? তার কাছে যুদ্ধ নিজের স্বরূপে কোনোদিনই ধরা দেবে না। ফলে সেই কাব্য হবে অম এবং ব্যর্থ। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি সম্মুখ সমর এড়িয়ে চলব। তবে কৈবর্তজাতির এই অস্তিত্বের যুদ্ধ থেকে আমাকে দূরে থাকতে বলবেন না। আর আমি ভালো তত্ত্বাবধায়কের অধীনেই থাকব। তিনি আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন।
    কিছুণ চিন্তা করে ভীম। জিজ্ঞেস করে- তুমি কার তত্ত্বাবধানে থাকতে চাও?
    মল্লর দিকে তাকিয়ে হাসে পপীপ- মল্লকাকার সঙ্গে থাকলে আমি যে নিরাপত্তার নিশ্চিত আশ্বাস পাই, কোনো অবোধ বালক তার পিতার আশ্রয়ে থেকেও অতখানি নিরাপদ বোধ করে না।

    ভীম আর দ্বিমত করে না- ঠিক আছে মেনে নিলাম তোমার ইচ্ছা।

    ফেরার সময় মল্ল বলে- তুই ভীমের কথায় সম্মত হয়ে যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাইলে আমি ভীষণ মর্মাহত হতাম রে পপীপ! বোধহয় ঊর্ণাবতীও সেটি পছন্দ করত না।
    আমি জানি মল্লকাকা।  

 [চলবে]

বাংলাদেশ সময় ১৫০০, জানুয়ারি ২২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।