ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

১০ লেখক-কবির জবানিতে বিজয়ের ৪০ বছর

জীবন ও সাহিত্যে আমাদের অর্জন

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০
জীবন ও সাহিত্যে আমাদের অর্জন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছরের প্রাক্কালে দেশের বিশিষ্ট দশ কবি ও লেখকের কাছে বাংলানিউজের ছিল তিনটি জিজ্ঞাসা : ১. আপনার লেখায় মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে এসেছে?  ২.আমাদের সমগ্র সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব কী? ৩. স্বাধীনতার চল্লিশ বছরে আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি কী?

এ বিষয়ে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু নিবিড় মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন বরেণ্য বুদ্ধিজীবী-লেখক কবীর চৌধুরী, চিন্তাবিদ-প্রাবন্ধিক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান,  প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ যতীন সরকার, কবি মোহাম্মদ রফিক, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত ও কবি আলতাফ হোসেন। গ্রন্থনা করেছেন : ফেরদৌস মাহমুদ


‘গত ১০-১৫ বছরে আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বেশ বড় একটি জায়গা দখল করে আছে’: কবীর চৌধুরী

Kabir_Choudhuryআমার লেখালেখিতে বহু জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মূলে রয়েছে তরুণ সমাজের সংগ্রাম ও স্বপ্ন। এ বিজয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিত্বের চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের চেতনা, গণতন্ত্রের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলে এসব চেতনার কথাই আমার মনে জাগে। আমার মনে হয় আমরা অর্জন করেছি অনেক কিন্তু আরও অর্জন করার কথা ছিল।

আমাদের সাহিত্যে কবিতা, গল্প, নাটক সর্বত্রই মুক্তিযুদ্ধের বিষয় খুবই ভালোভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে সেলিনা হোসেন তার লেখায় চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধকে। এছাড়া চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন তার ‘অবেলায় অসময়ে’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিককার চিত্রকে তুলে ধরেছেন। এ বইটি আমি সম্প্রতি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের এখানকার অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে। নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ এসেছে। এছাড়া সৈয়দ শামসুল হকের নাটকেও আমরা দেখতে পাই এ প্রসঙ্গ। কবিতায় শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। গত ১০-১৫ বছরে আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বেশ বড় একটি জায়গা দখল করে আছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় চল্লিশ বছর হলো। আমরা মনে হয় এ সময়ের মধ্যে অনেকখানিই এগিয়েছি। তবে আমরা হয়তো আরও এগোতে পারতাম। তা সম্ভব হয়নি, কারণ আমাদের রাজনীতির একটা বড় অংশজুড়ে এমন শাসকরা রয়েছে, যারা আসলে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তিকেই শক্তিশালী করেছে।

জিয়াউর রহমান একসময় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা নিয়েছিলেন অনেকটা বাধ্য হয়ে। তিনি দেশের অনেক ক্ষতি করেছিলেন, তিনি নির্বিচারে দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছিলেন। জিয়ার মতো ইভিল স্টার যদি আমাদের রাষ্ট্রে না থাকত তবে আমাদের দেশটা আরও এগিয়ে যেত।


‘পরিমাণের দিকে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক’: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমার লেখা মূলত প্রবন্ধ। এরপরও আমি বেশ কিছু গল্প লিখেছি, উপন্যাসও লিখেছি। ওগুলির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে Dr_Sijarul_Islam_Choudhuryএসেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের জন্য একটা বিপ্লবের স্বপ্ন, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজ-রাষ্ট্রের পরিবর্তন আনা। সমাজ-রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হোক, এটাই আমরা চেয়েছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গল্প-কবিতা-উপন্যাস বা প্রবন্ধে নানাভাবে এসেছে। কিন্তু এ নিয়ে বড় আকারের কোনো লেখা হয়নি। মহাকাব্যিক ধরনের কোনো কিছু রচিত হয়নি। আসলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ আমাদের লেখকদের ওইরকম ছিল না। তাছাড়া আমাদের লেখকদের নানাভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহাকাব্যিক ধরনের কিছু লিখতে যে গবেষণা প্রয়োজন, যে সময় দেওয়া প্রয়োজন, তা আসলে তারা দিতে পারেননি। পরিমাণের দিকে বিচার করলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তা প্রায়  চল্লিশ বছর হয়ে গেল। এ নিয়ে মূল্যায়ন করতে বললে, সংক্ষেপে বলব, মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে যে বিজয়টা আমরা চেয়েছিলাম তা আসলে অর্জিত হয়নি। আমরা চেয়েছিলাম সকল মানুষের মুক্তি, বৈষম্যহীন একটা সমাজ। একটা সময়ের পর দেখা গেছে, সমাজ বৈষম্যহীন হয়নি। এতে কোনো কোনো মানুষ লাভবান হয়েছেন কিন্তু বৈষম্যটা বেড়ে গেছে।



‘কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেভাবে কাজ হয়েছে ওই তুলনায় কালজয়ী উপন্যাস হয়তো লেখা হয়নি’: আনিসুজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ নিয়ে তো আমি লিখেছি বিভিন্ন সময়ে। ১৯৭১ নিয়ে ‘আমার Prof_Anisuzzamanএকাত্তর’ নামে একটি বই রয়েছে। এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে’ নামে আমার লেখা আছে।
আমাদের সমগ্র সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলেও দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-নাটকে নানানভাবেই উঠে এসেছে এ প্রসঙ্গ।

কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেভাবে কাজ হয়েছে ওই তুলনায় কালজয়ী উপন্যাস হয়তো লেখা হয়নি। তবে হুমায়ূন আহমেদ, সেলিনা হোসেন এদের বেশ কিছু ভালো উপন্যাস রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব কবিতা লেখা হয়েছে, সেদিকে তাকালে দেখা যায়, কবিতায় যুদ্ধ, আগ্নেয়াস্ত্র, বেয়নেট, ট্যাঙ্ক বা আরও কিছু শব্দের ব্যবহার হয়েছে, যা এর আগে ব্যবহৃত হয়নি।

এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, অসহযোগ আন্দোলন, অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনযুদ্ধ-- যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের লেখায় নানাভাবে ধরা পড়েছে। আমি মনে করি এখানে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর মতো কোনো কিছু লেখা হয়নি বলে আসলে আক্ষেপের কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের এখানে যা লেখা হয়েছে তা একেবারে ফেলনা কিছু নয়।

 



‘স্বাধীন বাংলাদেশের ঘাড়ে পাকিস্তানের ভূত এসে ভর করেছে’: যতীন সরকার

আমি বিভিন্ন কলামে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছি। বিশেষ করে আমার ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’ বইতে এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি Jatin_Sarkarলিখেছি। বইটি ২০০৫ সালে ‘প্রথম আলো’ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। ওই বইতে আমি ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান পেরিয়ে কীভাবে বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল সে প্রসঙ্গ এনেছি। বইটি শেষ করেছি ১৯৭১ সালের বিজয় দিবসের প্রসঙ্গে এসেছে।

আমাদের সমগ্র সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব দু ভাবে এসেছে। একটি পরোক্ষভাবে, অপরটা প্রত্যক্ষভাবে। এই প্রভাবের ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের কথাও বলতে হয়। ভাষা আন্দোলন তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছে। এক্ষেত্রের সাহিত্যের বিশাল অবদান রয়েছে। ১৯৬৯ সালে এ পটভূমি তৈরির ধারা আরও বেগবান হয়েছে। সে সময় বিভিন্ন সংকলনে, ছোটকাগজে সেই ধারার সাহিত্যের প্রকাশ বেশ শক্তভাবেই ঘটেছে।

মুক্তিযুদ্ধের পরের সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রে যেসব বাধাবিঘœ এসেছে, সেসব উঠে এসেছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর নির্মলেন্দু গুণসহ অনেকেই কবিতায়, গল্পে বিশেষ করে প্রবন্ধে সেগুলির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। এ নিয়ে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, আমাদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত অনেক ফসলই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের ঘাড়ে পাকিস্তানের ভূত এসে ভর করেছে। পাকিস্তানের ভাবধারাগুলো বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। এরপরও এ দেশের তরুণ প্রজন্ম যে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এটা হলো আমাদের আশার জায়গা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এদের হাত দিয়েই বাংলাদেশের ওপর থেকে পাকিস্তানের ভূত দূর হবে।



‘মুক্তিযুদ্ধ আমার সমস্ত লেখালেখির ক্ষেত্রেই বিশাল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে’: মোহাম্মদ রফিক

ব্যক্তিগতভাবে আমার লেখালেখির শুরু ষাটের দশকে। তখন দেশের একরকমের অবস্থা ছিল। কিন্তু পরে মুক্তিযুদ্ধ আমার চিন্তার Mohammad_Rafiqক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। আমার কাছে আধুনিকতার মানেই নতুন হয়ে ধরা দেয়। যে আধুনিকতা কোনো ধার করা আধুনিকতা নয়, আমাদের নিজস্ব আধুনিকতা।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি বিশেষ দু-একটা কবিতা লিখেছি, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমার সমস্ত লেখালেখির ক্ষেত্রেই বিশাল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

তবে এটাও ঠিক সমস্ত লেখকের মধ্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে এ দেশের সাহিত্যিকরা  যেভাবে দেখেছেন, তা প্রত্যেকেই তার নিজস্ব সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। ফলে দেখা প্রায়, প্রত্যেক সাহিত্যিকের লেখাতেই কমবেশি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স প্রায় চল্লিশ হতে চলল। তবে আমি বলব, এটা কোনো বেশি সময় নয়। আমরা এ মুহূর্তে অনেক কিছুই করতে পারছি, যা পাকিস্তান আমলে সম্ভব হয়নি। আমরা যারা পাকিস্তান আমলে ছিলাম তার বুঝি স্বাধীনতার স্বাদ। স্বাধীন দেশ আমাদের ব্যক্তির মুক্তি অর্জনের স্বাদ দিয়েছে। বর্তমানে দেশে হয়ত অনেক রাজনৈতিক সংকট রয়েছে, তবু বলব এর মধ্য দিয়েই আমরা জাতিগতভাবে একটা দিশা পেয়ে যাব। দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আমি আজ বাঙালিত্বের গর্ব অনুভব করতে পারছি।


‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লেখায় যেভাবে এসেছে সেটি সমগ্র সাহিত্যে একটি অবস্থান তৈরি করেছে’: সেলিনা হোসেন

আমি বিভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করেছি। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে দেখিয়েছি, একজন গ্রামীণ Selina_Hossainনারীর স্বাধীনতার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু নিজের যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি ছিল না। কারণ তার ছেলেটি ছিল প্রতিবন্ধী। স্বামীও মারা গিয়েছিল।

একদিন দুজন মুক্তিযোদ্ধা পাক-ক্যাম্প আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের হঠাৎ গোলা-বারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা পালানোর চেষ্টা করে। ওই সময় পাকসেনারা ওই দুজন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে তাড়া করে তাদের ধরার জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা তখন আশ্রয় নেয় সেই নারীর বাড়িতে। একসময় পাকসেনারা এসে হাজির হয় ওই নারীর বাড়ির সামনে এবং তারা দরজায় লাথি মারতে থাকে। তখন ওই নারী তার প্রতিবন্ধী ছেলেটির হাতে একটি রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে পাকসেনাদের সামনে পাঠিয়ে দেয়। পাকসেনারা ছেলেটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। এটা হচ্ছে আমার এ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে আমি দেখাতে চেয়েছি একজন নারী কীভাবে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে উৎসর্গ করে স্বাধীনতার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার অপর আরেকটি উপন্যাসের নাম ‘যুদ্ধ’। সেই উপন্যাস শুরু করেছি মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির উপাখ্যান দিয়ে। শেষ করেছি ১১ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ দিয়ে। সেই যুদ্ধে কর্নেল তাহের আহত হন। গল্পের শেষ হয়েছিল এভাবে : একজন মুক্তিযোদ্ধা তার পা হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। তার প্রেমিকা ছিল ওই গ্রামেরই একটি মেয়ে। কিন্তু সে মেয়েটি পাকসেনাদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার কারণে গর্ভবতী হয়। প্রেমিক ছেলেটি ফিরে এলে মেয়েটি তাকে বলে, স্বাধীনতার জন্য তুমি দিয়েছ পা আর আমি দিয়েছি জরায়ু। এভাবেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, এবার স্বাধীন দেশে আমাদের সংসার শুরু করব।

এছাড়া আমার ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাসটি লেখা ১৯৪৭ থেকে ৭৫ পর্যন্ত পটভূমিতে। এ উপন্যাসের একটি বড় অংশ হচ্ছে ঢাকার গেরিলা যুদ্ধ। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে সেই দিনে এসে। আমার আরেকটি উপন্যাস হচ্ছে ‘দিনের রশিতে গিটঠু’। এই উপন্যাসে আমি যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের নিয়ে কাহিনী তৈরি করেছি।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছোটদের জন্যও উপন্যাস লিখেছি, নাম ‘গল্পটি শেষ হয় না’। এই উপন্যাসে আমি কসবার কুল্লাপাথার এলাকার যুদ্ধ নিয়ে কাহিনী তৈরি করেছি। এছাড়া আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক ছোটগল্প লিখেছি।

আমি মনে করি, এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লেখায় যেভাবে এসেছে সেটি সমগ্র সাহিত্যে একটি অবস্থান  তৈরি করতে পেরেছে।

স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের প্রসঙ্গে বলব, এ সময়ের মধ্যে আমাদের অনেক অর্জন আছে, আমাদের ব্যর্থতাও আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং মৌলবাদীদের উত্থান একটি বড় ব্যর্থতা। তবে সামগ্রিকভাবে আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছি বলেই আমার মনে হয়।


‘লেখা হয়েছে প্রচুর গল্প-উপন্যাস’: রাহাত খান

মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বাঙালি গণতন্ত্রের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত Rahat_Khanকরে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার বহু লেখা রয়েছে। এর মধ্যে উপন্যাস হচ্ছে ‘এই বাংলায়’ ও ‘হে মাতৃবঙ্গ’।
আমাদের সমগ্র সাহিত্যের দিকে তাকালেও দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতন, ’৬৯-এর আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। লেখা হয়েছে প্রচুর গল্প-উপন্যাস।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে চল্লিশ বছর হয়ে গেল। আমর কী পেয়েছি আর কী পাইনি এই বিচার যদি করতে যাই, তাহলে বলব আমরা যতই পাব আমাদের চাহিদা ততই বাড়বে। বাংলাদেশ হওয়ার পর আমাদের যেমন অনেক অর্জন আছে, তেমনি আছে অনেক ব্যর্থতাও। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক হলো নানাভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে।

আর অর্জনের কথা যদি বলি, তবে বলব আমরা আলাদা একটা রাষ্ট্র পেয়েছি। একসময় বাঙালিরা চাইলেই যা করতে পারত না এখন তা করতে পারছে। বাংলাদেশ উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে সব রাষ্ট্রেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।


‘আমাদের সমগ্র সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এসেছে’: মুহম্মদ নূরুল হুদা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমার জীবনের অনুষঙ্গ হয়েই আমার লেখাতে এসেছে। আমার জন্ম ১৯৪৭ সালে। ’৪৭ থেকে ’৭১ এই ২৪ Md_Nurul_Hudaবছরে আমি বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়েই দেখেছি এ দেশের বিভিন্ন সংগ্রামকে। ফলে আমার লেখায় যা কিছু বলেছি তা এ জাতি কীভাবে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তা নিয়েই।

আমার প্রথম কবিতার বইয়ে পুরো জাতির, পুরো দেশের মানুষের সংগ্রাম সমুদ্রের তরঙ্গ হয়ে এসেছে। আমার ‘আমরা তামাটে জাতি’ কবিতায় বাঙালি জাতির সংগ্রামকে কবিতামন্ডিত করে আনার চেষ্টা করেছি। স্লোগান হিসেবে নয়, কবিতার চিত্রকল্পে রূপকের মধ্য দিয়েই আমি এখানকার মানুষের বক্তব্যকে কবিতায় আনতে চেয়েছি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাস, হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে যোগ রেখে চলমান জীবনকে আমি কবিতার মধ্যে প্রকাশ করেছি।

আমি মনে করি আমাদের সমগ্র সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এসেছে। সেই প্রকাশ বিভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। যেমন- হুমায়ুন কবিরের একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘কুসুমিত ইস্পাত’। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ না হলে কবিতায় এভাবে শব্দকে আসলে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। কিংবা একটি কবিতার লাইন ‘হৃদয়ের চেয়ে মারাত্মক কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই’। এভাবে কবিতায় শব্দের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধ না হলে সম্ভব ছিল না।

আমরা যে বিজয়ের কথা বলি, এটা হচ্ছে ভৌগোলিক বিজয়, অর্থনৈতিক বিজয়, সাধারণ মানুষের সামগ্রিক বিজয়। আমাদের সামগ্রিক বিজয়ের জন্য যে জিনিসটা দরকার ছিল, সে ঐক্যটা প্রথম থেকেই এখানে ছিল না। আমাদের বিজয়ে ঐক্য হয়নি, ওই সময় একদল ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষে। যদিও পরে স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা ছিল তারা দেশকে অস্বীকার করতে পারেনি। অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না।

একাত্তরের বিজয় আমাদের উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সবাই মিলে আমরা বাঙালি জাতি। এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে সবচেয়ে বড় অবদান যার, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু এ দেশের নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশ। তার চাওয়া ছিল বাঙালির ঐক্য, বাঙালির জয়।


‘মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে ধারণ করার মতো মেধাবী লেখকের জন্ম এখানে হয়নি’: হরিপদ দত্ত

মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্ব ছিল বুর্জোয়াদের হাতে। এর ফলে মানুষের স্বপ্নটা প্রকৃতপক্ষে প্রতিফলিত হয়নি। এ বিজয় জনসাধারণের Haripad_Dattaস্বার্থরক্ষা করতে পারেনি। এ বিজয়ে নতুন এক ধনিক শ্রেণীর অভ্যুদয় ঘটেছে। এ প্রেক্ষাপটটি উঠে এসেছে আমার ‘অজগর’  উপন্যাসে। এ উপন্যাসে বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধটা বেশি করে এসেছে। উঠে এসেছে নকশালদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধ প্রসঙ্গ। এখানে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা কমিউনিস্টদের প্রপাগান্ডাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এ উপন্যাসটি লেখার সময় আমি যুদ্ধ আর বিজয়ের মধ্যে শূন্যতা দেখতে পেয়েছিলাম। মিথ্যা আবেগকে আমি মূল্য দেইনি।

এছাড়া আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গল্প লিখেছি। এগুলি বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধের ২০-৩০ বছর পরে লেখা। আমি বলতে চাই আমার মুক্তিযুদ্ধের গল্প যে-কারও চেয়ে ভিন্ন। গতানুগতিক যুদ্ধবিষয়ক বা কোনো নির্দিষ্ট স্লোগান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া গল্প আমি লিখিনি। আমি নানাভাবে লেখাতে বলতে চেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি।

আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব অবশ্যই আছে। নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’সহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আমাদের এখানে সমৃদ্ধ অনেক কবিতা লেখা হয়েছে, যেটা কথাসাহিত্যে নেই। বাংলাদেশের কবিরা যুদ্ধ শেষে প্রথম পাঁচ বছর যত কবিতা লিখেছেন সেটা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার।

কথাসাহিত্যে আমাদের খুব একটা ভালো কাজ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে ধারণ করার মতো মেধাবী লেখকের জন্ম এখানে হয়নি। ফলে গল্প-উপন্যাসে তেমন কাজ হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা এ বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়নি মূলত মেধা ও পরিশ্রমের অভাবে।

এখানে একেকজন লেখক মুক্তিযুদ্ধকে একেক অ্যাঙ্গেল থেকে দেখেছেন। তাছাড়া আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি বিষয়, এটা ধারণ করার মতো গদ্যশৈলী এখনো আবিষ্কার হয়নি। এ বিষয়ে কথাসাহিত্য লেখার জন্য যে আলাদা ভাষার প্রয়োজন ছিল তা আমাদের লেখকরা আবিষ্কার করতে পারেনি। তারা এখনো রবীন্দ্রনাথ, মানিক বা তারাশঙ্করের গদ্যের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে আমি আশা করি, ভবিষ্যতে কোনো তরুণ এ বিষয়ে বড় ধরনের কাজ করবেন।

মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছরে আমাদের প্রাপ্তির প্রসঙ্গ তুললে বলব, মুক্তিযুদ্ধের ফলে আমরা পেয়েছে বাঙালি শাসকশ্রেণী ও ধনিক শ্রেণী। একাত্তরে পাকসেনারা যে নির্যাতন করেছিল এ দেশের মানুষের ওপর, আমরা আসলে ওই খারাপ দিকগুলিই নিজেরা অর্জন করেছি। যে কারণে এখন দেখা যায় বাঙালি পুরুষই বাঙালি নারীদের ওপর নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে।

তাছাড়া আমি দেখতে পাচ্ছি একাত্তরে রক্ত দিয়ে যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তারা এখন স্বেচ্ছায় ক্রীতদাস হয়েছে। যখন তারা নিজের দেশের নাগরিকত্বকে প্রত্যাখ্যান করে অর্থের জন্য বিদেশি নাগরিকত্ব অর্জনের চেষ্টা শুরু করল তখন থেকেই এ ঘটনার শুরু।

হরিপদ দত্তেরও এমন পতন ঘটে,  আমাকেও আমেরিকায় যেতে হয়েছে। সেখানে আমি ৭-৮ বছর থেকেছি। আমি আমার নিজেকে দিয়েই সারা দেশের পতনটা টের পাচ্ছি। এই মহাপতনটাই হচ্ছে আমাদের বাস্তবতা। আমি মনে করি আমাদের বুর্জোয়াভঙ্গির রাজনৈতিক পটভূমির পরিবর্তন হওয়ার দরকার। আমাদের অর্থনীতি যেভাবে ভেঙে পড়েছে এ ভাঙনটা ঠেকানো দরকার।


‘সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব যতদিন এ দেশটি বেঁচে থাকবে ততদিন ধরে থাকবে’: আলতাফ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে-পরে প্রত্যক্ষভাবে যেভাবে এসেছে, যেমন, প্রথম কবিতার বই ‘সজল ভৈরবী’-তে, Altaf_Hossainপরের লেখায় সেভাবে আসেনি। কেন? স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে দিনে দিনে। কিন্তু  সে  অনুভূতিও পরোক্ষভাবে অনেক অনেকবার এসেছে নানা লেখায়। একাত্তরের যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মুক্তির অভূতপূর্ব আনন্দ সারাজীবনেও ভোলা সম্ভব নয়, লেখায় কি তা না এসে পারে, বলুন?

সমগ্র সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গেও আমার একই কথা। যতটা প্রভাব থাকার কথা, ততটা থাকেনি, মোহভঙ্গেরই কারণে নিশ্চয়। তারপরও বলব, সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব যতদিন এ দেশটি বেঁচে থাকবে ততদিন ধরে থাকবে।

আমাদের স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের অনুভূতির কথা বলতে গেলে আবেগে ভেসে যাবার মতো অবস্থা হয়। বলা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অনুভূতি সংক্ষেপে প্রকাশ করার মতো নয়। যে স্বপ্নটি দেখেছিলাম, তারই কথা মনে পড়ে। একদিন আমাদের দেশের লোকেরা সবাই খেতে-পরতে পারবে, অভাব থাকবে না। সম্পদের সমবণ্টনের ব্যাপারটি সম্ভব হবে। প্রচুর লেখা হবে, প্রচুর গান হবে, প্রচুর ছবি-চলচ্চিত্র হবে। আমাদেরই প্রভাবে অন্যান্য দেশও মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদেরই আদর্শ অনুসরণীয় হবে দেশে দেশে...। আর তো বলা যাচ্ছে না।


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৩৩০, ডিসেম্বর ১৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad