ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সাহিত্য একসময় শিল্প ছিল, এখন কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে : নরমান মেইলা

অনুবাদ : বিদ্যুত খোশনবীশ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০১০
সাহিত্য একসময় শিল্প ছিল, এখন কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে : নরমান মেইলা

নরমান কিংসলে মেইলারের (Norman Kingsley Mailer) জন্ম  আমেরিকার নিউ জার্সিতে, ৩১ জানুয়ারি ১৯২৩-এ। পরিবারের সাথে নিউ ইয়র্কে এসে তিনি প্রথমে Boys` High School এবং পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিমানচালনবিদ্যা অধ্যয়ন করেন।

১৯৪৩-এ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি অংশ নেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। এই যুদ্ধের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করেই ১৯৪৮ সালে রচনা করেন তার প্রথম উপন্যাস The Naked and the Dead, যা ‘যুদ্ধকালীন একশটি শ্রেষ্ঠ ইংরেজি উপন্যাস’- এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

নরমান মেইলার ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। Truman Capote, Joan Didion এবং Tome Wolfe-এর সাথে তাঁকেও বিবেচনা করা হয় সৃজনশীল নন-ফিকশনের জনক হিসেবে। তিনি দু বার পুলিটজার পুরস্কার আর একবার ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। Armies of the Night (1968) এবং The Executioner`s Song (1979) তার পুলিটজার জেতা বই দুটি নন-ফিকশন বা সত্য ঘটনার ভিত্তিতে রচিত। উপন্যাসের পাশাপাশি প্রথাবিরোধী প্রবন্ধ লেখার জন্যও তিনি বিখ্যাত। তিনি The White Negro (1957) প্রবন্ধে আমেরিকান সমাজে সহিংসতা, উন্মাদনা, যৌনতা, অপরাধ ও বিভ্রান্তি নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন।  

তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে : The Presidential Papers (1963), An American Dream (1965), Why Are We in Vietnam? (1967), Of a Fire on the Moon (1970), Marilyn (1973), The Fight (1975), Ancient Evenings (1983), Harlot`s Ghost (1991), Oswald`s Tale (1995)| The Castle in the Forest (2007) লেখা তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ।

আমেরিকান সাহিত্যের দিকপাল নরমান মেইলার Acute Renal Failure-জনিত কারণে ২০০৭ সালে ১০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

Andrew O` Hagan-এর নেওয়া মেইলারের এ সাক্ষাৎকারটি প্যারিস রিভিউ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। সে সময় মেইলার ছিলেন ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সমুদ্র-তীরবর্তী শহর কেপ কড-এ। সাক্ষাৎকারটির অনুবাদ কিছুটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।

প্যারিস রিভিউ : আপনি কতদিন আগে এখানে এসেছিলেন?

মেইলার : আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখন আমার বয়স উনিশ। একটি মেয়ের সাথে আমার মন দেয়া-নেওয়া চলছিল। পরে তাকে বিয়ে করেছিলাম। সে আমার প্রথম স্ত্রী বেট্রিস সিলভারম্যান। আমরা স্থির করেছিলাম উইক-এন্ডে কোথাও হাওয়া খেতে যাব এবং আগে থেকেই Cape Cod-এর চূড়ায় এই শহরটির কথা বেট্রিসের জানা ছিল। সময়টা ঠিক মনে নেই, ১৯৪২ কিংবা ’৪৩ হবে। প্রথম দেখাতেই আমি এই শহরটির প্রেমে পড়ে যাই।

প্যারিস রিভিউ : আর তখন থেকেই আপনি The Naked and the Dead লেখা শুরু করলেন?

মেইলার : ’৪৬-এর মে মাসে আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে দিই এবং জুন মাসেই এখানটায় চলে আসি। জুনে বা জুলাইয়ের গোড়ার দিকে বইটি লেখায় হাত দিই। মনে আছে, সৈকতে ভাড়া করা একটি কুঁড়েঘরে লেখার কাজ শুরু করেছিলাম। কোনও বই লেখার প্রস্তুতি নিতে সাধারণত আমার সপ্তাদুয়েক সময় লাগে।

প্যারিস রিভিউ : এ বিষয়ে কোন নোট করেছিলেন?

মেইলার : লেখা শুরুর আগে আমি প্রচুর নোট করি। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাড়তি পড়াশোনা এবং তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করার অভ্যাসও আমার আছে। এখন একটা উপন্যাস শেষ করতে বছরের অর্ধেকটাই পার হয়ে যায়। কিন্তু The Naked and the Dead শেষ করতে মাত্র কয়েক সপ্তাহ লেগেছিল। তার কারণও ছিল, তখন আমি যুবক, চিন্তা ও যুদ্ধের চেতনায় পরিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে, তখন আমাকে কোনও গবেষণাই করতে হয়নি, মগজেই সব ছিল। সেই গ্রীষ্মে আমি প্রায় দু’শ পৃষ্ঠা লিখেছিলাম।

প্যারিস রিভিউ : আপনি জানতেন উপন্যাসটি ভালো হচ্ছে?

মেইলার : কখনো মনে হতো ওটা একটা ভয়ঙ্কর জিনিস হচ্ছে আবার কখনো ভাবতাম আমি আসলে জানিই না কীভাবে লিখতে হয়। তখন আমার লেখা খুব একটা শৈল্পিক ছিল না, তবে ভালো লেখার কলাকৌশল সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই জানা ছিল। আপনার হয়তো মনে আছে, গত রাতে আমরা থিওডর ড্রিজার  সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। দুজনেই কমবেশি একমত হয়েছিলাম যে, রচনাশৈলীতে ড্রিজারের তেমন কোনও পারঙ্গমতা ছিল না, তবে তার এমন কিছু গুণ ছিল যা রচনাশৈলীর চেয়েও উৎকৃষ্ট। ওই সময় আমি যাদের লেখা পড়তাম ড্রিজার তাদের একজন। যখন আমার লেখাগুলোর সাহিত্যমান দুর্বল বলে মনে হতো, তখন আমি নিজেকে এই বলে সান্ত¡না দিতাম যে, স্বয়ং ড্রিজারের লেখাতেও যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্য নেই।

আমার মনে হয়, একমাত্র প্রুস্তই শিল্পনৈপুণ্যের সঙ্গে কর্মটি সাধন করতে পেরেছিলেন। প্রকৃত অর্থেই সাহিত্য উপাদান ও শৈলীর সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সাধারণত, যদি আপনার রচনাশৈলী চমৎকার হয় তবে সাহিত্য উপাদানগুলো হবে অধিকতর দুর্বোধ্য বা অস্বাভাবিক। যেমনটা হয়েছে হেনরি জেমস ও হেমিংওয়ের  ক্ষেত্রে। তবে এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছে জোলার ক্ষেত্রে। তার রচনাশৈলী ছিল যুক্তিসঙ্গতভাবে শোভন, যা বড় গলায় উল্লেখ করার মতো কিছু নয় কিন্তু তার উপাদানগুলো এককথায় মারাত্মক।

নিজের কাজ সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হলো, আমি রচনাশৈলীকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ An American Dream। কিন্তু The Executioner`s song-এ এই দিকটি কার্যত অনুপস্থিত, কারণ এর উপাদানগুলো অপূর্ব। An American Dream পুরোপুরিই আমার নিজস্ব কল্পনা। বলতে পারেন, রাঁধুনীর কাজটা আমিই করেছি।

প্যারিস রিভিউ : আপনার ক্ষেত্রে একটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক হতে পারে যে, আপনার লেখার বিষয়বস্তুগুলো কোনও না কোনও রহস্যকে উন্মোচন করতে চায়, যা আগে স্পষ্ট ছিল না।

মেইলার : আমি হাসছি, কারণ আপনি বিষয়টিকে একটি সুন্দর কাঠামো দিয়েছেন। The Executioner`s Song লেখার সময় আমার উদ্দেশ্য এতোটা সম্মানজনক ছিল না। উপন্যাস লিখতে গিয়ে বারোক-রীতি অনুসরণ করায় মূলত আমি সমালোচিত হবার পথেই পা বাড়িয়েছিলাম এবং হয়েছিলামও তাই। আপনি কি মনে করেন এই বারোক-রীতি খুব সহজ? মোটেই তা নয়। এটি এমন একটি বিষয় যেখানে আপনাকে পৌঁছতে হবে। এর জন্য বছরের পর বছর চর্চা করা প্রয়োজন। আপনারা সবসময় সারল্যের গুণ ও শক্তি নিয়ে কথা বলেন। সারল্যের মধ্যে একেবারেই কিছু নেই এবং আমি এই বই দিয়ে তা প্রমাণ করতে পারি। এর কারণ, সম্ভবত একটি সরল বই লেখার মতো যথার্থ উপাদান আমার আছে এবং আমি একটি সরল বই লিখতে পারি। তাই আমি সেভাবেই অগ্রসর হয়েছি। এই বইয়ে আমার গর্বের মূল উপাদানই হলো গ্যারি গিলমোরের চিঠি। আমি অরে অরে চিঠিটির দুই-তৃতীয়াংশ উদ্ধৃত করেছি। এ পর্যন্ত আমার কোনও লেখাই এ চিঠির চাইতে উৎকৃষ্ট হতে পারেনি। কারণ চিঠিটিই তাকে জীবন দিয়েছে এবং হঠাৎই দেখবেন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে এই মানুষটিই ছিল শক্তির আধার। সে হয়তো অকর্মণ্য ছিল। কারণ তাকে এভাবেই ডাকা হতো; কিংবা সে বীভৎস কায়দায় দুজন লোককে হত্যাও করতে পারত। কিন্তু তার একটা হৃদয় এবং নিজস্ব সাহিত্যরীতি ছিল, যা তার ওই চিঠিতে সুস্পষ্ট রূপ পেয়েছে।

সুদীর্ঘ সময় ধরে আমার মধ্যে এক মৌলিক ধারণা জন্ম নিয়েছে, তা হলো বাস্তবতা এক রহস্যময় পর্বত। আমরা ঔপন্যাসিকরা সেই পর্বতে আরোহণের চেষ্টা করছি। আমরা পবর্তারোহী আর প্রশ্ন হলো, আমরা কোন পথ দিয়ে তাতে আরোহণ করছি? ভিন্ন ভিন্ন পথে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। কোনও কোনও পথ দাবি করে  অন্তরের জটিল ও দুরূহ পদ্ধতি আর অন্যরা সারল্য। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, বাস্তবতার জগতে এটি এক ধরনের আগ্রাসন। তাই খুব সাদামাটাভাবেই আমি বইটি রচনা করেছি। হয়তো বইটি আমাকে এই ধারণা

দিয়েছিল যে, আমিও হেমিংওয়ের হাতে কড়ি পরাতে পারি। কিন্তু বইটা যখন লেখা হলো, দেখলাম আমি আর হেমিংওয়ে এক নই। আমি হেমিংওয়ের প্রশংসা করি তার সৃষ্ট চরিত্রটির জন্য, ওই মানুষটির জন্য নয়। আমার ধারণা তাঁর সাথে কখনো দেখা হলে সেটা হতো আমার জন্য ছোটখাট একটি বিপর্যয়। তারপরও অন্যেরা যা পারেননি তিনি আমাকে তাই দেখিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি, ইংরেজি বাক্যগঠনের সুপ্ত শক্তিটা ঠিক কোথায়।

প্যারিস রিভিউ : হেমিংওয়ে সম্পর্কে আরো কিছুণ কথা বলি। তিনি দেখিয়েছিলেন কোন বাক্যে আবেগ-অনুভূতির কথা উল্লেখ না করেই আবেগ সৃষ্টি করা যায়, এটা কি সম্ভব?
 
মেইলার : হ্যাঁ, তিনি এটা পেরেছিলেন যা তার আগে বা পরে কেউ পারেনি। কিন্তু তিনি নিজেই একটি ফাঁদ। যদি আপনি সতর্ক না থাকেন তবে আপনার লেখাটাও ঠিক তার মতোই হয়ে যাবে। হেমিংওয়ের মতো কিছু লেখা বিপজ্জনক, তবে যে কারো জন্যে সেটা মাইলফলকও বটে। আমি এমন কোনও তরুণ ঔপন্যাসিকের ওপর আস্থা রাখতে রাজি নই যে তারুণ্যে হেমিংওয়েকে অনুসরণ করে না। অবশ্য আমি শুধু পুরুষ ঔপন্যাসিকদের কথাই বলছি।

প্যারিস রিভিউ : যখন হেমিংওয়ের আত্মহত্যার সংবাদ পেলেন তখন কোথায় ছিলেন, মনে করতে পারেন কি?

মেইলার : বেশ ভালোভাবেই মনে করতে পারছি। আমি তখন জিম ক্যাম্পবেলের সাথে মেক্সিকোতে। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম। সত্যি বলতে, ওই ধাক্কা আমি কখনই কাটিয়ে ওঠতে পারিনি। ওটা ছিল একটি সতর্কবার্তা। তিনি যেন বলছিলেন: হে ঔপন্যাসিকরা, মন দিয়ে শোনো, যে মুহূর্ত থেকে তুমি একজন ঔপন্যাসিক সে মুহূর্ত থেকে তুমি এক চরম বিপজ্জনক মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা শুরু করেছো, এটি তোমাকে আঘাত করতে পারে।

প্যারিস রিভিউ : তা হলে কি বলা যায় না, সাহিত্যচর্চা আত্মঘাতী?

মেইলার : সাহিত্য একজন সাহিত্যিককে গভীরভাবে ব্যবহার করতে পারে। একটি বই লেখার পর সাহিত্যিকের নিজের বলতে তেমন কিছুই আর থাকে না। এ কারণেই লেখকরা যদি মনে করেন তাদের অন্যায়ভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে তবে তারা সহজেই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। আমরা মনে করি, বই লিখতে গিয়ে আমরা নিজেদের একবার হত্যা করেছি আর সমালোচকরা তুচ্ছ কারণে আবার আমাদের হত্যা করতে চাচ্ছেন। গ্যারি গিলমোর একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘পৃথিবীতে ন্যায় বলে কিছু নেই। ’ আমি এই মন্তব্যকে বার বার ব্যবহার করেছি। যদি আপনি একটি ভালো উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তবে আপনি হয়ে যাবেন একজন অভিযাত্রিক। আপনি এমন কিছুর দিকে ছুটতে থাকবেন যার সীমা আপনার জানা নেই, প্রকৃত অর্থে যার কোনও সীমাই নেই। সেখানে আছে ভয় ও উত্তেজনার সংমিশ্রণ যা আপনাকে সামনে নিয়ে যাবে। আমার মতে, যদি সফলতার কোনও সম্ভাবনা না-ই থাকে তবে উপন্যাস লেখা মূল্যহীন। আপনি ব্যর্থ হবেন। কারণ আপনার মানসিক সীমাবদ্ধতার সাথে এটি এক ধরনের জুয়া খেলা। যেন আপনি এক সদস্যের সেনাবাহিনীর একমাত্র সেনাপতি, যে কানাগলির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

প্যারিস রিভিউ : এবার বয়স নিয়ে কথাবলি। বার্ধক্য লেখকসত্তার অহঙ্কারকে কীভাবে প্রভাবিত করে? ফেলে আসা বছরগুলোই শ্রেষ্ঠ-- কারো অহঙ্কারের জন্য এমন ধারণার চাইতে তিকর হয়তো আর কিছুই নেই।

মেইলার : যদি এমন হয় যে, আপনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন এবং আপনার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতার অভাব আছে, তবে বলব বিপদেই আছেন। বস্তুনিষ্ঠতা মানুষকে বার্ধক্যেও বলিষ্ঠ রাখে। যদি আপনি মনে করেন, আগের যে কোনও সময়ের তুলনায় অল্প কিছু কাজ আপনার হাতে আছে এবং আপনার কৃতকর্ম ভারসাম্যপূর্ণ, এটাই পারে আপনাকে স্থায়িত্ব দিতে। তবেই আপনি বুঝতে পারবেন লেখক হিসেবে আপনার আর কী করার আছে এবং কী নেই। আপনি কেন আগের চাইতে বেশি প্রাজ্ঞ হচ্ছেন না-- এমন চিন্তা করার কোনও যুক্তি নেই। কারণ এখন আপনি বৃদ্ধ। আপনার এখন উচিত নিজের জীবন থেকে মানবচরিত্র সম্পর্কে শিা নেওয়া। আপনি কি এখনও আগের মতো কলম চালাতে পারেন? উত্তর যদি হয় না, তবে আপনি প্রায় মূল্যহীন।

প্যারিস রিভিউ : কেন?   

মেইলার : কারণ খুব সোজা-- ব্রেইন ডেমেজ। মস্তিষ্ক য়িষ্ণু। জানেন তো, কেন পুরনো গাড়ি নতুন গাড়ির মতো চলে না? এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আপনি তো আর গাড়িকে লাথি-ঘুষি দিয়ে বলবেন না যে, তুই আমার সাথে প্রতারণা করেছিস! সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি গাড়ির প্রতিটা শব্দের অর্থ বোঝেন।

প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মনে করেন শিল্পচর্চার জন্যে আমেরিকা একটি উৎকৃষ্ট জায়গা?
 
মেইলার : আমি যখন তরুণ তখন আমেরিকা ছিল লেখকদের জন্য এক অসাধারণ জায়গা। তার কারণ, আমেরিকায় অনেক ভালো লেখক ছিলেন আর আমাদের অধিকাংশ সাহিত্যই তখন পর্যন্ত লিখিত হয়নি। ১৮ ও ১৯ শতকের অধিকাংশ প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক ছিলেন ইংরেজ, যারা অন্যদের ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু অন্যদের ছাড়িয়ে যাবার জন্য আমাদের কী ছিল?

মেলভিল ও হথর্নের মতো গুটিকয়েক ভালো লেখক। তালিকাটা খুব সংপ্তি কিন্তু আমাদের জন্য ময়দান ছিল উন্মুক্ত। অথচ আমরা এখন সমালোচিত, বিপদগ্রস্ত। আমাদের চলচ্চিত্রগুলোও বাজে ছিল, শুধুই আনন্দদায়ক। মানবজীবন সম্পর্কে ওগুলো থেকে কিছুই শেখার ছিল না। কারণ আমি মনে করি সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এই পৃথিবীতে এসেছি।

এখনকার ছেলেমেয়েরা তো টেলিভিশন নিয়েই মেতে আছে। এই যন্ত্রটির এমন একটি উপাদান আছে যা চিন্তাশীল পাঠাভ্যাসের জন্য অত্যন্ত তিকারক। তা হলো বিজ্ঞাপন। হয়তো আপনি নাটক কিংবা সিনেমা দেখছেন, দেখবেন প্রতি সাত কিংবা দশ মিনিট পর পর বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে, যা আপনার মনোযোগ নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। বাচ্চারা এভাবেই টিভি দেখে দেখে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি মনে করি, বিলুপ্তপ্রায় কুটিরশিল্পের আমিও একজন রুগ্ন কারিগর। সাহিত্য একসময় শিল্প ছিল, এখন কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে, যার নিয়তি বিলুপ্তি। তাই আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, ঔপন্যাসিকদের জন্যে আমেরিকা একসময় ছিল চমৎকার আবাসভূমি কিন্তু এখন আর সেরকম নেই।

প্যারিস রিভিউ : আপনি কি মিল্টন ও প্যারাডাইস লস্টের সাথে একমত যে, কোনও কোনও সময় শয়তানও যথার্থ কথা বলে?

মেইলার : হ্যাঁ। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যে এক ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব চলছে, যার প্রভাব আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পড়েছে। কিন্তু মানুষ এ ধরনের চিন্তাকে এখন ঘৃণা করে। কারণ এটা প্রযুক্তির যুগ, মধ্যযুগ সম্পর্কে তারা বিতৃষ্ণ, কান্ত। অথচ মধ্যযুগে আমরা ঈশ্বরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছি, অশ্রুসিক্ত হয়েছি আর প্রার্থনা করেছি-- হে প্রভু, আমাদের দিকে ফিরে তাকাও, আমাদের রা করো, শয়তানকে বিতাড়িত করো। যাই হোক, তারপর থেকেই আমরা আলোকিত হয়েছি, ভলতেয়ারকে পেয়েছি। গত কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ হিসেবে আমাদের অহঙ্কারকে আরো তীব্র করেছি। তাই এখন আমরা তৃতীয় এক শক্তি। এক প্রান্তে ঈশ্বর, অন্য প্রান্তে শয়তান। মাঝের বিশাল কেন্দ্র মানুষের দখলে। আর পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই বেঁচে আছে ঈশ্বর কিংবা শয়তানকে বিশ্বাস না করেই।

প্যারিস রিভিউ : আপনি কি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন?

মেইলার : অবশ্যই বিশ্বাস করি। কিন্তু ঈশ্বরকে আমি জেহভার মতো বিধানদাতা মনে করি না। আমি মনে করি, ধর্ম যাজকরাই এমন ধারণার সৃষ্টি করেছেন যে, মানুষ যদি মহাশক্তির উপাসনা না করে তবে পরকালে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। মূলত এর মাধ্যমেই তারা নিজেরা মতাবান হয়েছেন। তাই এই ধারণার প্রতি আমার কোনও বিশ্বাস নেই। আমি ঈশ্বরকে স্রষ্টা হিসেবেই মানি। তাঁর সম্পর্কে আমার বিশ্বাস, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং চলমান ঘটনাপ্রবাহের ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

প্যারিস রিভিউ : অর্থাৎ আপনার ঈশ্বর নিজেই অস্তিত্ববাদী?

মেইলার : ঠিক তাই। তিনি জানেন না ঘটনা কোন দিকে মোড় নেবে কিংবা তিনি ব্যর্থ না সফল হবেন। তিনি শয়তানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। চাইলে আপনি তাকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক ঈশ্বরও বলতে পারেন। এরকম বহু ঈশ্বর এই মহাবিশ্বে রয়েছেন। অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের অনুভূতিও ভিন্ন। তাদের কেউ কেউ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত আবার কেউ এতোটাই ভিন্ন যে অস্তিত্ব নিয়ে তাদের কোনও দুঃশ্চিন্তা নেই। আমরা যদি কারো মর্যাদা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করি তবে তা হবে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বিশ্লেষণ, অবৈধ বিশ্লেষণ। কারণ আমি মনে করি, শয়তানকে সম্ভবত ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবেই পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্বের পরম শক্তি মানবিক বোধসম্পন্ন এই ভুঁইফোড় ঈশ্বরকে পছন্দ করেননি।

প্যারিস রিভিউ : বহু আমেরিকান এখন এমন ধারণা পোষণ করে যে, ঈশ্বর ও শয়তান তাদের স্ব স্ব কর্মে নিয়োজিত।

মেইলার : আমিও তাই মনে করি। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি না যে, কেউ শয়তানের খপ্পরে পড়লেই চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু তারপরও আপনি কি কখনো বলতে পারবেন যে, ণিকের জন্যে হলেও নিজেকে কখনো পাপী মনে করেননি।

প্যারিস রিভিউ : কিছুটা আধ্যাত্মিক কথা।

মেইলার : না। কিছুটা অশুভ। আর এটাই যথার্থ উত্তর।

প্যারিস রিভিউ : আমার যদি ভুল না হয়, The Castle in the Forest-এ আপনি বলতে চেয়েছেন যে, হিটলারকে শুধু হিটলারই বলা যায়, অন্য কিছু নয়। তাহলে তো বিষয়টি রহস্যাবৃতই রয়ে গেল। কারণ হিটলারের চিন্তা-চেতনাতেও তো শয়তানের অস্তিত্ব ছিল। এই বই সম্পর্কে আমার যুক্তি হলো, নিজস্ব চিন্তা ও জীবনব্যবস্থায় মানুষের ত্রাস সৃষ্টি করার মতাকে কোনও ঔপন্যাসিকই অবজ্ঞা করতে পারেন না।

মেইলার : আপনি এটা নিয়ে বিতর্ক করতে পারেন। হিটলার একজনই, তার সম্পর্কে অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই। স্টালিনও দানব ছিল কিন্তু বোধগম্য প্রকৃতির। আমরা তার জীবনী পড়ে দেখতে পারি, বলশেভিক আন্দোলন নিয়ে পড়াশোনা করতে পারি, আমরা রাশিয়ার বর্তমান অবস্থা যাচাই করতে পারি, আমরা রুশ বিপ্লবের  ভয়ানক প্রতিক্রিয়াও প্রত্য করতে পারি। আমরা স্টালিনকে ধাপে ধাপে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে পারি এবং মানবিক উপায়েই তাকে বুঝতে পারি। তিনি হয়তো মহাপাপীদের একজন কিন্তু তারপরও তিনি মানুষ ছিলেন। স্টালিনকে ব্যাখ্যা করার জন্য শয়তানকে টেনে আনবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হিটলার একেবারেই ভিন্ন। স্টালিনের মতো হিটলার দৃঢ়চেতা ছিল না। সে ছিল ভিরু, কাপুরুষ। হিটলার অব্যাখ্যেয়। অবশ্য, আপনি যদি মনে করেন, হিটলারের শয়তানের আজ্ঞাবহ হবার কারণ জার্মানদের চরিত্রের গভীরে নিহিত, তবে সেটা ভিন্ন কথা।

আমি এর চেয়েও বেশি দূর যাব। আমি আমার পরবর্তী বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জানি না শেষ করতে পারবো কিনা, কিন্তু যদি পারি তবে সে বইয়ে হিটলার আবির্ভূত হবে শয়তানের আজ্ঞাবহ হিসেবে। The Castle-এর শেষ ভাগে সে হবে মানুষের মাঝে শয়তান কর্তৃক রোপিত হাজারো বীজের একটি। শয়তানও ঈশ্বরের মতো অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু ইতিহাসকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। ঈশ্বর ও শয়তান একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। মানুষও তাদের এবং নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ঈশ্বর যেভাবে একজন যিশু সৃষ্টি করেছেন, শয়তান সেভাবে একজন হিটলার সৃষ্টি করে না। শয়তান প্রয়োগবাদী, সে লাখ লাখ গুপ্ত হিটলার সৃষ্টি করে আর আমরা যে হিটলারের কথা বলছি সে তাদেরই দৃশ্যমান রূপ। কেন? কারণ জার্মানির স্বতন্ত্র দৃশ্যপট, যা হিটলারের আবির্ভাবের আগে অনুপস্থিত ছিল। এটাই আমার পরবর্তী বইয়ের বিষয়বস্তু।

প্যারিস রিভিউ : আমরা এমন মানুষের বিশ্বে বাস করছি যারা বিশ্বাস করে তাদের বিরুদ্ধশক্তিই হলো শয়তানের শক্তি।

মেইলার : হ্যাঁ।

প্যারিস রিভিউ : শয়তান, শয়তানের অশক্তি, শয়তানের সাম্রাজ্য-- আমরা তো এসব নিয়েই আছি।

মেইলার : আমার মূল প্রচেষ্টাই হলো সব রুটিতে সমান মাখন লাগানো হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। আমেরিকায় কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। ইসলামে কি অশুভ শক্তি আছে? হ্যাঁ। একপ কি অন্য পরে চেয়ে বেশি অশুভ? কে জানে সেটা।
আমরা উভয়ই প্রচ- অশুভ, আমরা উভয়ই প্রচ- শুভ। আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসও তাই বলে-- আমরা এ দুয়ের মিশ্রণ, গভীর মিশ্রণ। নাস্তিকরা বলে থাকেন, স্রষ্টাকে বিশ্বাস না করেও তারা সুখী। কিন্তু দার্শনিকভাবে তারা সুখী হতে পারেন না, কারণ আমরা কীভাবে অস্তিত্ব পেলাম এ প্রশ্নের উত্তর তাদের জানা নেই। নাস্তিক্যবাদী হয়ে মানবচরিত্রের জটিলতার ব্যাখ্যা দেওয়া খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাসী হলে, আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি তার খুব ভালো ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব, আমাদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। ঠিক পিতার মতো, একজন পিতা যেমন চান তার সন্তানরা তার চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় হোক, ঈশ্বরও ঠিক তাই চান। মায়ের বেলায়ও তাই। সে অর্থে আমরা ঈশ্বরের অগ্রদূত।

প্যারিস রিভিউ : আপনি পুনর্জন্মে  বিশ্বাস করেন। আবার কি নরমান হয়েই ফিরে আসবেন?

মেইলার : আমি অপো করছি, তাই না? বলা চলে, আমি এখন ওয়েটিং রুমে। আমাকে ডাকা হবে, আমি ভেতরে যাব। সেখানে যে দেবদূত থাকবেন তিনি বলবেন, মিস্টার মেইলার, আমরা আপনার অপোতেই ছিলাম। আপনি পুনর্জন্মের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আমি বলব, ধন্যবাদ। আমি আসলে পরকালে থেকে যেতে চাই না। ওই দেবদূত বলবেন, থেকে যাওয়াটা খুব জরুরি নয়। আপনি কোনও রূপে ফিরে যেতে চান? আমি বলব, একজন কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাথলেট হয়ে। তখন দেবদূত বলবেন, সবাই তাই হতে চায়; ঠিক আছে দেখা যাক আপনার জন্য কী নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বিশাল খাতা খুলবেন, দেখবেন এবং বলবেন আপনাকে একটি তেলাপোকা হিসেবে ফেরত পাঠানো হবে। তবে সুসংবাদ হলো, আপনার এলাকায় আপনিই হবেন সবচেয়ে দ্রুতগতির তেলাপোকা।

প্যারিস রিভিউ : মন্দ বলেননি।

মেইলার : পুনর্জন্ম হলো ঈশ্বরের প্রজ্ঞা ও ন্যায়বোধের উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমি আবারো বলছি, ঈশ্বর বিধানদাতা নন। তিনি স্রষ্টা এবং বিচারক।

প্যারিস রিভিউ : সহিংস কোনও স্বপ্ন দেখেন?
 
মেইলার : না। আমি এ ধরনের স্বপ্ন সাহিত্যে প্রয়োগ করি।
 
প্যারিস রিভিউ : মানুষের সহিংসতা আপনাকে উদ্বিগ্ন করে এবং সহিংসতা আপনার খ্যাতির সাথেও সম্পর্কিত।

মেইলার : খ্যাতি বিপজ্জনক।

প্যারিস রিভিউ : আপনার সাহিত্যকর্মে সবসময় সহিংসতা থাকে।

মেইলার : সহিংসতার প্রতি আগ্রহ অবৈধ কিছু নয়। ঔপন্যাসিকদের জন্য সহিংসতা একটি বিচরণত্রে। উনিশ শতকের বিখ্যাত ঔপন্যাসিকরা কাজ করেছেন প্রেম, বিরহ, হতাশা, সততা ও কিছুটা দুর্নীতি নিয়ে। তাঁরা কাজ করেছেন বিভিন্ন সামাজিক শক্তির সম্মিলিত বিমূর্ত শক্তি নিয়ে, যা একজন ব্যক্তির ইচ্ছাকে পরাস্ত করতে পারে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে আসুন, দেখবেন হেমিংওয়ে সহিংসতার প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়েছেন। কারণ যুদ্ধে তাঁর দেহ ত-বিত হয়েছিল। সহিংসতাই ছিল তাঁর সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রবিন্দু। হেমিংওয়ে সহিংসতাকে সাহিত্যে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা আমাকেও অভিভূত করে কিন্তু আমি তাতে তৃপ্ত নই।

প্যারিস রিভিউ : আপনার The White Negro প্রবন্ধ সম্পর্কে এখনো কি আগের অবস্থানেই আছেন?

মেইলার : হ্যাঁ। সংখ্যা যাই হোক কিছু মানুষ বিশেষ করে যুবকরা যৌন তৎপরতাকেই প্রেম মনে করে। এটাকে ভুল বলবারই বা কী আছে। যৌনতা আমাদের গভীর প্রকাশ। তবে অনেক কৃষ্ণাঙ্গ অভিযোগ করে বলেন, আমি নাকি শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যৌন তৎপরতা বেশি অনুসন্ধান করেছি।
 
প্যারিস রিভিউ : কীভাবে একজন ঔপন্যাসিক বাস্তব ঘটনা বা উপাদানগুলোকে উপন্যাসে প্রতিস্থাপন করেন? বাস্তবকে শিল্পে রূপান্তর করলে কী ঘটে?

মেইলার : বাস্তব ও কল্পনার (Facts and Ficfion) মধ্যে একটি মজার সম্পর্ক আছে। বিষয়টা ঠিক পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারব না। যদি আপনার সংগ্রহে কিছু সত্য তথ্য থাকে তবে সমস্যা হলো ওগুলোর অধিকাংশই পরিশুদ্ধ নয়। ওগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত। অধিকাংশ  ক্ষেত্রেই মিথ্যা-সত্য। তাই যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও গল্পের সমাপ্তি ঘটে বাস্তবতার সাথে প্রতারণার মধ্য দিয়ে।

প্যারিস রিভিউ : চমৎকার। আরেকটু ভেঙ্গে বলুন।
 
মেইলার : ঠিক আছে। যে কোনও ইতিহাস, যদি শুধু নিখাদ সত্য দিয়ে রচিত হয়, তবে তা ভুলে পরিপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর হতে বাধ্য। একমাত্র মানব মনই পারে ঘটনার মধ্যে নিহিত সত্যকে আবিষ্কার করতে। যা ঘটে গেছে সেটিই একমাত্র বাস্তবতা নয়, মানুষ তার সংকীর্ণ মনে যা লালন করে তাও বাস্তবতা। ঘটনার পেছনে এগুলোও সম্ভাব্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। কোনও বই পড়ে যদি বলেন, হ্যাঁ, ঘটনাটি এভাবেই ঘটতে পারত, তবে আপনার মন সমৃদ্ধ। The Executioner`s Song নিয়ে আমার অনুভূতি ছিল-- এ বইয়ের জন্য আমার সংগৃহীত তথ্যগুলো বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কাটছাঁট এবং পরিশুদ্ধ করলে আমি যা পাব তাই হবে সাহিত্য। সাহিত্য হবে, কারণ তার স্পন্দন থাকবে। নির্ভেজাল সত্য ও সাহিত্যের মধ্যে এটাই পার্থক্য। আপনার বলা সত্য কথাগুলো পাঠকের হৃদয়ে স্পন্দন সৃষ্টি করতে পারলে সেটাই হবে সাহিত্য। সাহিত্য কোনও কেচ্ছাকাহিনী নয়, কিংবদন্তি কিংবা অসত্য ভাষণও নয়। সাহিত্য যেমন সত্য, তেমনি কল্পনাও।

প্যারিস রিভিউ : আপনি যখন The Armies of the Night লিখেন তখন কি মনে হয়েছিল এটি একটি উপন্যাস?

মেইলার : ‘ইতিহাসকে সাহিত্য, সাহিত্যকে ইতিহাস’ করার মতো কাজ আমি খুব একটা করিনি। আমি মনে করি, The Armies of the Night যথার্থ অর্থে সৃজনশীল সাহিত্য নয়। এটি আত্মজীবনীমূলক রচনা, সৃজনশীল সাহিত্যের সাথে যার খুব একটা মিল নেই।

প্যারিস রিভিউ : পুলিৎজার পুরস্কার জেতা আপনার দুটো বই-ই বাস্তব ঘটনার ভিত্তিতে রচিত। আপনি কি এর জন্য বিব্রত বোধ করেন না?

মেইলার : অনেকে বিনীতভাবে বলেন, মেইলার নিঃসন্দেহে একজন ভালো নন-ফিকশন লেখক, তবে তিনি পুরোপুরি ঔপন্যাসিক নন। হ্যাঁ, এতে বিরক্ত হই। কারণ এ ধরনের কথা যিনি বলেন তিনি আমার পুরো সাহিত্যকর্মের সাথে পরিচত নন। এমন কাউকে আমি পাইনি, যে আমার Harlot`s Ghost এবং Ancient Evenings পড়ে এগুলোকে নন-ফিকশন বলেছেন। যারা আমাকে নন-ফিকশন লেখক বলেন তারা এই বই দুটির সাথে পরিচিত নন। তারা শুধু ওই বইগুলোই পড়েছেন যেগুলো কিছুটা নন-ফিকশন। তারপরও আমি স্বীকার করি আমার জন্য এটি একটি সমস্যা। কিন্তু আমি খুশি, কারণ উপন্যাসের চেয়ে নন-ফিকশন লেখা সহজ, কাহিনীর পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না।

প্যারিস রিভিউ : ঠিক আছে। কিন্তু শুধু সহজ বলেই কি আপনি নন-ফিকশন লিখেছিলেন?
মেইলার : না, তা নয়। আমি নন-ফিকশন লেখার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। উদাহরণ স্বরূপ, Marilyn-এর কথা বলতে পারি। আমার এজেন্ট স্কট মেরিডিথ একবার প্রস্তাব দিলেন, মেরিলিন মনরোকে নিয়ে পঁচিশ হাজার শব্দের বই লিখে দিলে মোটা অংকের অর্থ পাওয়া যাবে। তিনি অংকটাও বলেছিলেন।

প্যারিস রিভিউ : চিরস্থায়ী শত্রু কে? অহঙ্কার?

মেইলার : অহঙ্কার আপনাকে ধ্বংস করতে সম। ট্রুম্যানের (Truman Capot) দিকে তাকান। তার  চিন্তাটা এমন ছিল যে, যদি আমি স্বীকৃতি না পাই তবে সমাজে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে যাবে। তাই খুব সতর্ক হয়ে অহঙ্কারকে প্রশ্রয় দিতে হবে। অহঙ্কার আমাদের সত্তার শুভ অংশকে হত্যা করতে পারে। অহঙ্কার পরিত্যাগ করা শিখতে হবে। অহঙ্কারকে ইতিহাসে নিপে করতে হবে।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৫১৫, অক্টোবর ১৭, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।