ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শাহনামার হাজার বছর

আহমেদ জুয়েল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১০
শাহনামার হাজার বছর

ইরানের প্রাচীন তুস শহরের যে এলাকায় কবি বাস করতেন, সেখানে পানির অভাব ছিল খুব। জনসাধারণের পানির সেই অভাব দূর করার জন্য তার ইচ্ছা ছিল সেখানে একটি খাল কাটার।

কিন্তু পয়সার অভাবে তা করতে পারছিলেন না। ঠিক সে সময় গজনির সুলতান মাহমুদ কবিকে মহাকাব্য রচনার অনুরোধ করলেন। আর প্রতিশ্রুতি দিলেন মহাকাব্যের প্রতিটি শ্লোকের জন্য তিনি কবিকে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেবেন। সুলতানের প্রতিশ্রুতি শুনে কবির মন আনন্দে ভরে উঠল। তিনি ভাবলেন, মহাকাব্য রচনা শেষে সুলতানের কাছ থেকে একসঙ্গে মুদ্রাগুলো নেবেন, যাতে ওই তা খরচ করে পানির জন্য খাল কাটা যায়। তিনি লিখতে বসলেন। কেটে গেল মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। অবশেষে দীর্ঘ ত্রিশ বছরে ৬০ হাজার শ্লোক লিখে তিনি শেষ করলেন তার মহাকাব্য রচনার কাজ।

এবার পাওনা বুঝে নেওয়ার পালা। সুলতান মাহমুদ কবিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রাই দিতে চাইলেন। কিন্তু রাজদরবারের হিংসুটে কয়েকজন কবি ও উজির সুলতানকে পরামর্শ দিলেন, কবিকে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা দিলেই যথেষ্ট হবে।

সুলতান তার সভাসদদের ঈর্ষা বুঝতে না পেরে কবিকে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রাই দিলেন। কিন্তু কবি দুঃখে, ক্ষোভে সেই রৌপ্যমুদ্রাগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে দিতে দিতে তুসে ফিরে গেলেন। এর কিছুদিন পর কুহেস্তানের রাজা নসরুদ্দিনের কাছ থেকে সুলতান মাহমুদ একটি পত্র পেলেন। পত্রে তিনি কবির খুব প্রশংসা করেছেন। সুলতান পত্র পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি অনুভব করলেন, কবিকে ওয়াদামত স্বর্ণমুদ্রা না দিয়ে তিনি ভুল করেছেন। রাজসভার অন্যান্য কবি এবং উজির নাজিরও যে কবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল একথাও বুঝতে বাকি থাকলো না তার। তিনি প্রধানমন্ত্রী ময়মন্দিকে বরখাস্ত করে কবিকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন। দূতের মাধ্যমে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন কবির গ্রামের বাড়ি তুসে। কিন্তু হায়! তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দূত যখন স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে কবির বাড়িতে পৌঁছলেন তখন কবির লাশ দাফনের জন্য গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

স্কুল পাঠ্যে এমনই এক গল্প পড়েছিলাম। কোন ক্লাশে ঠিক মনে নেই। তবে শিক্ষক পড়িয়েছিলেন রূপকথার মতোই। তিনি আমাদের বোঝাতে পারেননি হাজার বছর আগে ইরান দেশে সত্যিই এক মহাকবি ছিলেন, তিনিই লিখেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাকাব্য ‘শাহনামা’। শিক্ষক না বললেও ছোট বেলায় সেই গল্প পড়ার পর থেকে দূর দেশের সেই মহাকবিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তারপর বড় হয়ে সেই ভালোবাসার টানে তাকে কিছুটা জেনেছি, কিছুটা পড়েছি। তিনি আর কেউ নন হাজার বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে টিকে থাকা পৃথিবী বিখ্যাত ‘শাহনামা’ মহাকাব্যের মহাকবি ফেরদৌসি।

শাহনামা
রাজানুকূল্যে মহাকাব্য রচনার পর তা রাজার নামেই উৎসর্গ করার রেওয়াজ থাকলেও ফেরদৌসি তা করেননি। চাটুকারিতা কিংবা তোষামোদি তিনি ঘৃণা করতেন। হাজার বছর আগে রাজকবি হিসেবে এমন বোধ সম্ভবত তারই ছিল। নিজের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। অভিজাত ছিলেন মনে প্রাণে। সেই আভিজাত্য আর আত্মবিশ্বাস থেকেই তিনি শাহনামার ভূমিকায় লিখেছিলেন- ‘যদি পৃথিবীতে ফেরদৌসীর জন্ম না হতো, তবে তরুতে উদ্গত হতো না বদান্যতার কিশলয়৷ যদি এই কাহিনীর দিকে আমি দৃষ্টিপাত না করতাম, তবে তা মিথ্যাবাদীদের দ্বারা অন্যপথে পরিচালিত হতো। ’ তিনি আরও লিখেছিলেন- ‘দুনিয়া যতদিন থাকবে ও তাতে অবস্থান করবেন নরপতিগণ, আমার বাণী তাদের কাছে গিয়ে পৌঁছবে ৷ তারা বলবেন, তুস নগরের অধিবাসী অভিজাত ফেরদৌসি তার মহাকাব্য ‘শাহনামা’ সুলতান মাহমুদের নামে উৎসর্গ করেননি ৷ জেনে রাখ, নবী ও আলীর নামেই উৎসর্গ করেছি এই ‘নামা’। বহু অর্থময় বাণীর মুক্তা আমি এতে গ্রথিত করেছি ৷’

আধুনিক যুগের আগে পৃথিবীব্যাপী আখ্যানকাব্য রচনার একটি ধারা তৈরি হয়েছিল। সেই ধারার উৎসবিন্দু ফেরদৌসির শাহনামা। বিশেষত লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, সোহরাব-রুস্তমসহ অনেক কাহিনীকাব্যের উপাদান শাহনামা থেকেই নেওয়া।

দশম খ্রিস্টাব্দে পারস্যের রচিত ফেরদৌসীর এই শাহনামা বা `বুক অব কিংস` নামের এই মহাকব্য আজ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ কবিতা বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে শাহনামা কেবল দীর্ঘ কবিতাই নয়, পারস্যের ইতিহাস ঐতিহ্য, প্রকৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিকতার একটি দলিলও বটে।

শাহনামার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মহাকবি নিজেই বলছেন- ‘এই কাহিনীতে আমি ত্রিশ হাজার শ্লোকের পানপাত্র আবর্তিত করেছি। এতে আছে রণক্ষেত্রের রীতি-নীতি। তীরধনুক, প্রহরণ, তরবারি, বর্ম, অনুত্রাচ ও শিরস্ত্রাণের কথা। আছে অরণ্য ও সমুদ্র, আছে মরুভূমি ও বহতা নদী, নেকড়ে, সিংহ, হস্তী ও বাঘের কথা। এছাড়া দৈত্য, আজদাহা ও নক্রের রূপকথাও এতে স্থান পেয়েছে। ’

শাহনামায় আছে মোট ষাট হাজার শ্লোক। এত শ্লোক লিখতে তার কাগজ লেগেছে মোট দুই হাজার চুরাশি পৃষ্ঠা! নয় খণ্ডে বিভক্ত এই মহাকাব্য রচনা করতে তিনি ব্যয় করেছিলেন ত্রিশ বছর!

ফেরদৌসি বেঁচে থাকতে সাধারণ মানুষ তার শাহনামা পড়ার সুযোগ পায়নি। আর তাই তখন তা জনপ্রিয়ও হয়নি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যত দিন গেছে শাহনামার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে হাজার বছর। একটু কমেনি শাহনামার আবেদন। বরং তা নিয়ে বেড়েছে গবেষণা, পড়াশোনা। গত এক শ’ বছরের মধ্যে তা বাংলা, উর্দু, হিন্দি, চীনা, জাপানিজ, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ান, ফরাসি, গ্রিক, জার্মান ও ইংরেজিসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধশত ভাষায় অনূবাদ করা হয়েছে। আরবি ভাষায় শাহনামার প্রথম অনুবাদ হয় ১২২৪ সালে। মুনীর উদ্দীন ইউসূফের শাহনামার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। এছাড়া বাংলায় শাহনামার অংবিশেষ অনুবাদ করেছেন অনেকেই।

ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দুই মহাকবি হলেন হোমার এবং ভার্জিল৷ কিন্তু তাদের দু’জনের মহাকাব্য জোড়া দিলেও শাহনামার অর্ধেক হবে না। কারণ হোমারের ইলিয়াদ এবং ওদিসিতে আছে সর্বমোট ১৫ হাজার শ্লোক। ভার্জিলের ইনিদ-এ আছে ১০ হাজার শ্লোক৷ আকারের দিক থেকে শাহনামা আজও বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাব্য। নাসখ লিপিতে ফেরদৌসির নিজ হাতে লেখা শাহনামার পাণ্ডুলিপির নিদর্শন আজও তেহরানের গুলিস্তাঁ প্রাসাদের লাইব্রেরিতে শোভা পাচেছ৷

ফেরদৌসি
মহাকবি ফেরদৌসীর জন্ম ৯৩৫ সালে খোরাসান প্রদেশের তুস শহরের পাজ নামের একটি গ্রামে। তার বাবা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস শহরের রাজার বিখ্যাত গোলাপবাগান দেখাশোনা করতেন। ছোট বেলায় ফেরদৌসি সেই বাগানে ঘুরে বেড়াতেন। প্রকৃতির বিচিত্রতায় তিনি ভাবনামুখর হয়ে উঠতেন। বড় হয়ে সেই ভাবনাগুলোকেই তিনি লিখতে শুরু করেন কবিতার ছন্দে। তখন গজনীর সুলতান ছিলেন মাহমুদ ৷ তিনি ছিলেন পারস্য, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলের শাসক। তিনি ছিলেন ইতিহাস-অনুরাগী ৷ পারস্যের রাজা-বাদশাহদের সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনার জন্যে তিনি উপযুক্ত লোক খুঁজছিলেন ৷ এ সময় ফেরদৌসির কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পেয়ে তিনি তাকেই এ কাজের দায়িত্ব দেন। আর তখন থেকেই সত্যিকারভাবে শুরু হয় মহাকবি ফেরদৌসির মহাকাব্যিক যাত্রা।

ফেরদৌসীর জন্মনাম আবুল কাশেম। সুলতান মাহমুদ পরিচয়ের প্রথম দিন তার কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়ে উচ্চারণ করেন- ‘এয় ফেরদৌসী তু দরবারে মা’ রা’ ফেরদৌস কারদি’। অর্থাৎ, ‘হে ফেরদৌসি ! তুমি আজ আমার দরবারকে সেরা বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছে। ’ সেই থেকেই আবুল কাশেম হয়ে যান ফেরদৌসী। তিনি ইরানের জাতীয় কবি।
 
ফেরদৌসির জন্মস্থান তুস
ইরানের সবচেয়ে প্রাচীন শহর তুস। সেখানকার ঐতিহাসিক রূপকথার মধ্যেও শহরটির বর্ণনা পাওয়া যায়। ইতিহাসেও খোরাসান প্রদেশের এই শহরটির অস্তিত্ব ছিল ৷ প্রাচীন গ্রিকের অধীনে থাকার সময় শহরটির নাম ছিল সুসিয়া। যিশুখ্রিস্ট্রের জন্মের ৩৩০ বছর আগে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট শহরটি দখল করেন। ৮০৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফা হারুন আল রশিদ এই শহরেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৩৮৮ সালে তৈমুর লং এর ছেলে মীরানশাহ শহরটিতে হামলা চালান ৷ ধ্বংস করে দেয় সব স্থাপনা। নির্বিচারে হত্যা করা হয় নীরিহ মানুষকে। এরপর শহরটি আর দাঁড়াতে পারেনি ৷ ১৯৩৪ সালে তার জন্মের হাজার বছর উপলক্ষে শহরটিতে তার সমাধি চিহ্নিত করে সৌধ নির্মাণ করা হয়।

শুধু ফেরদৌসি নন, রসায়নবিদ্যার জনক, বহুশাস্ত্রবিদ জাবির ইবনে হাইয়্যান (রসায়নবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ, প্রকৌশলী, ভূতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, পদার্থবিদ ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসক), আসাদি তুসি (ইরানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কবি), নিজাম আল মুলক (পারস্যের পণ্ডিত, সেলজুক সম্রাটের  উজির), ইমাম আল গাজ্জালি (ইসলামি তাত্ত্বিক, আইনবিদ, দার্শনিক, মনস্তত্ত্ববিদ এবং সুফি), নাসির আল দিন আর তুসি (জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, রসায়নবিদ, গণিতবিদ, দার্শনিক, চিকিৎসক ও পদার্থবিদ) তাঁরা সবাই তুসের সন্তান।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ০০৩০, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।