ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রশ্নের শক্তি : আরজ আলী মাতুব্বর [শেষ পর্ব ]

আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, জাবি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১২
প্রশ্নের শক্তি : আরজ আলী মাতুব্বর [শেষ পর্ব ]

প্রশ্নের শক্তি : আরজ আলী মাতুব্বর [পর্ব-১], [পর্ব-২]

দেবতা ফেরেশতা রাক্ষস শয়তান

ইতিহাস বলে, বিদ্যমান যতগুলো ধর্ম আছে সেগুলোর চাইতে অনেক বেশি সংখ্যক ধর্ম মানুষ পার হয়ে এসেছেন। যত ধর্ম জীবিত আছে তার থেকে মৃত ধর্মের সংখ্যা অনেক বেশি।

এসব ধর্ম নিয়ে যদি আমরা ঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করি তাহলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের পক্ষে ঐ ধর্মের কাল ও স্থানকে উদ্ধার করা সম্ভব। আরজ আলী সাধ্যমতো বর্তমান-অতীত, জীবিত-মৃত ধর্ম ও বিশ্বাস অনুসন্ধান করেছেন তার কাল-স্থান ধরে এবং সেইসঙ্গে অঙ্গীভূত মিথগুলোকে পরীক্ষা করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর এসব আলোচনা আছে সৃষ্টিরহস্য, সত্যের সন্ধান ছাড়াও অনুমান গ্রন্থে।          

তিনি খ্রীষ্টপূর্বকালের বিভিন্ন ধর্ম ও তার চেহারা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “সেকালে দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে আসতেন পৃথিবীতে বলতে গেলে ঘনঘনই। আর বিভিন্ন দেশে তাদের সংখ্যাও ছিল অগণ্য। আরবের— লাত-মানাত, কেনানে বাহু ইত্যাদি নানারকম ছিলেন দেবতা। আবার বিভিন্ন দেশের কতক দেবতারা ছিলেন একই ধাঁচের। যেমন মিশরে— আসিরিস, আইসিস, হোরাস; ব্যাবিলনে— আলু, বেল, ঈয়া; ভারতে— ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ইত্যাদি। যে যুগে সমগ্র পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বোধহয় যে এককোটিও ছিলো না, সে যুগে নাকি হিন্দুদের দেব-দেবীর সংখ্যা ছিলো প্রায় তেত্রিশ কোটি। ভারতীয় দেব-দেবীরা তো ঘাঁটিই করেছিলেন হিমালয় পর্বতের কোনো কোনো অঞ্চলে। ...মুনিঋষি ও দেবদেবীগণ প্রায় একইকালে বর্তমান ছিলেন এবং প্রায় একইকালে ঘটেছে তাঁদের তিরোভাব। এযুগে দেখা যায় না ওঁদের কাউকে। ওঁরা সকলেই এখন কালের কোলে ঘুমিয়ে আছেন। ”  

বঙ্কিমচন্দ্র তেত্রিশ কোটি দেবতার সংখ্যা নিয়ে রীতিমতো ঠাট্টাই করেছেন। তিনি অনেক গণনা করেও দেবতার সংখ্যা শত অতিক্রম করতে পারেননি।  

আবার বলেছেন, “পবিত্র বাইবেল পাঠে বোঝা যায় যে, ‘জাভে’ নামক ঈশ্বরটির ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি মহাদেশ ও চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদির অধিবাসীদের জন্য যেনো কোনো মাথাব্যথা নেই, তিনি যেনো শুধু ইহুদী জাতি তথা বনি-ইস্রায়েলদের সমাজ ও ঘরসংসার নিয়েই ব্যস্ত। ”  

আরজ আলী এটি লেখার কয়েক দশক আগে এরকম একটি প্রশ্ন রোকেয়াও তুলেছিলেন। রোকেয়া ধর্মগ্রন্থের অবতরণের স্থান এবং তার পুরুষকেন্দ্রিকতা দুই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন।  

ঈশ্বর সম্পর্কে বর্তমানে আমরা যে ধরনের ধারণায় অভ্যস্ত ঈশ্বর সে রূপে পৌঁছেছেন বহু হাজার বছরে ধর্ম সম্পর্কিত বিশ্বাসের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। একক ঈশ্বরের উদ্ভব খণ্ড খণ্ড দেবতাদের উদ্ভবের অনেক পরের ঘটনা। আরজ আলী বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন এভাবে, “আদিম মানবদের ঈশ্বরকল্পনা ছিল না, কল্পনা ছিল দেবতার। যে তাপ ও আলো দান করে, সে একজন দেবতা; যে খাদ্য দান করে, সে একজন দেবতা; যে বৃষ্টি দান করে, সে একজন দেবতা; ...পরমেশ্বর বা একেশ্বর কল্পনার পূর্বে যাঁহারা ছিলেন দেবতা, একেশ্বর কল্পনার পরে তাঁহারাই বনিয়াছেন স্বর্গীয় দূত। ”   

দেবতা, নরবলি, জন্মান্তর, ভূত, শপথ, জাদু, ইন্দ্রজাল, শুভাশুভ লগ্ন, ভাগ্য, সতীদাহ, ভবিষ্যৎ গণনা, প্লাবন ও পুনঃসৃষ্টি, প্রলয় সম্পর্কে বিভিন্ন মত: বৈদিক মত, মিশরীয় মত, ইরানীয় মত, ইহুদী মত, খ্রিষ্টীয়, মুসলিম, চৈনিক, বৌদ্ধ, চার্বাকীয় ও তার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক মত এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা সৃষ্টি রহস্য গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।  

অনুমান গ্রন্থে আরজ আলী রাবণ চরিত্রটি নিয়ে অনেকখানি আলোচনা করেছেন। সাধারণভাবে রাবণ বলতে একটি রাক্ষসের চিত্রকল্প তৈরি হয় যেমন অসুর বললে মনে হয় ভয়াবহ, মানব বিরোধী কোন অপশক্তি। কিন্তু প্রচলিত মিথগুলি খুঁটিয়ে দেখলে এবং অধিপতি বিশ্বাসকে অতিক্রম করে সেসব পরীক্ষা করলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় দেখা সম্ভব যে, রাবণ বা অসুর এবং রাম বা দুর্গার চেহারা প্রচলিত নির্মাণের সম্পূর্ণ বিপরীত। আরও অনেক মিথ-এর মতো এসব চরিত্র নির্মাণের পেছনেও মানুষের রক্তাক্ত ইতিহাস আছে। সমাজের অধিপতি শ্রেণীর ধারণার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই নায়ক বা খলনায়ক নির্মিত হয়েছে। যাকে প্রচলিত বিশ্বাস অভিহিত করছে খলনায়ক হিসেবে, জনগণের দিক থেকে ইতিহাসের বিশ্লেষণ করলে তাকে হয়তো তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই সনাক্ত করা যাবে। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এর সহজ উদাহরণ আছে। ব্রিটিশ বিরোধী ফকির, সন্ন্যাসী কিংবা অনুশীলন ইত্যাদি সবাই ব্রিটিশ ইতিহাসে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত; ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত দুষ্কৃতকারী হিসেবে। সকল পর্বেই এরকম বিপরীত সত্য দেখা যাবে। প্রতিষ্ঠিতকে প্রশ্ন না করে আসল ঘটনার কাছে তাই পৌঁছানো সম্ভব হয় না।     

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012April/Sannyasi_1327336257_3-1120120407140541.jpgরামায়ণে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা ও বক্তব্যগুলো পরীক্ষা করেছেন আরজ আলী সেভাবেই। বিশ্লেষণ করে তিনি রাবণকে পেয়েছেন এক অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ হিসেবে, তবে অনার্যহেতু রামের বৈরী। তিনি বলেছেন, “হয়তো আর্য-ঋষি বাল্মীকি— আর্যপ্রীতি ও অনার্যবিদ্বেষ বশত শ্রীরামকে প্রদীপ্ত ও রাবণকে হীনপ্রভ করার মানসে একের প্রোজ্জ্বল ও অন্যের মসিময় চিত্র অংকিত করেছেন নিপুণ হস্তে রামায়ণের পাতায়। ”  

হনুমান চরিত্রটিও তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন হনুমান কোন একক ব্যক্তি বা প্রাণী নয় এটি আসলে গোত্রের নাম। ফেরাউন ইসলাম ধর্মে একটি খুবই খারাপ নাম, ঈশ্বরদ্রোহী-মানুষের শত্রু। আরজ আলী বলেছেন ফেরাউন হচ্ছে মিশররাজদের উপাধি। তিনি তৎকালীন সৃজনশীল কাজ ও বিশাল নির্মাণের নমুনা দেখে অনেক ফেরাউনের বিশাল অবদানের বিষয়টি সামনে এনেছেন। মুসার মিশর থেকে বিতাড়িত হয়ে যাবার পথ অনুসন্ধান করে তিনি বুঝতে চেয়েছেন মুসার সমুদ্র পার হবার মিথ এবং দেখিয়েছেন পথ, সময় বর্ণনায় অসঙ্গতি। “অধুনা কোন কোন গবেষক বলেন যে, হজরত মুসা ‘তিমছাহ হ্রদ’ পার হইয়াছিলেন। ”তিনি পানি শুকিয়ে যাবার ঘটনা ব্যাখ্যা করে জোয়ার ভাটার সঙ্গে সেই কাহিনীর সম্পর্ক পেয়েছেন।  
 
“শয়তানের জবানবন্দী” নামে আরজ আলীর একটি দীর্ঘ লেখা আছে, যেখানে তিনি শয়তানকে ঘিরে যে বিশ্বাস সেগুলো নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য অনেক কিছুর মতো শয়তান সম্পর্কেও ধর্মীয় বয়ানে মেলা স্ববিরোধিতা আছে। আর শয়তান শুধু এক ইসলাম ধর্মের বিষয় নয়। তবে সেমিটিক ধর্মগুলোতে শয়তানের কাহিনী অভিন্ন। এই শয়তান বস্তুত: আল্লাহর বিপরীত শক্তি; সকল ‘খারাপ— এর কেন্দ্রীয় শক্তি। আসলে চিন্তার জগত যত সমৃদ্ধ হচ্ছে ধর্মের ব্যাখ্যাও নতুন নতুন রূপ পাচ্ছে। কারও কারও কাছে এখন শয়তান একটি রূপক, এটি আসলে নফস-এর বিষয়। ধর্মগ্রন্থের কাহিনী অনুযায়ী শয়তান হলো অভিশপ্ত ফেরেশতা, যে আগে আল্লাহর খুব প্রিয় ফেরেশতা ছিল। অভিশপ্ত হবার কারণ শুধু আল্লাহর একটি আদেশ অমান্য করা, আদমকে সালাম না করা। অবাধ্য, কিন্তু প্রবল শক্তিধর এই শয়তান অমর। আরজ আলী তাই প্রশ্ন তোলেন : “জন্ম-মৃত্যুর ঠোকাঠুকিতেও বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ টিকিয়া আছে প্রায় তিনশ’ কোটি। আর মানুষের চেয়ে দশগুণ বৃদ্ধি পাইয়া অমর শয়তানের সংখ্যা কত?”  অর্থাৎ মানুষ মরণশীল এবং শয়তান অমর হবার কারণে মানুষের মাথাপিছু শয়তানের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন প্রতি মানুষপিছু শয়তানের সংখ্যা বহু বহু গুণ বেশি। সেই হিসেবে পাপের পরিমাণ আগের তুলনায় সেই পরিমাণ, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবার কথা। কিন্তু দেখা যায় বহু অঞ্চলে পুরনো প্রথাগত অপরাধই অনেক কমে গেছে। শয়তানের ভূমিকা বা প্রভাব তার সংখ্যা অনুযায়ী বৃদ্ধি পেলে মানুষ আরও আগেই ধ্বংস হয়ে যাবার কথা।

এই ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে ধর্মপ্রচারকদের আগমন হার নিয়ে। তাদের আগমনের কারণ শয়তানের প্রভাবকে খর্বকরণ। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে তাদের আগমন হার অনেক কমে যায়। অর্থাৎ যখন শয়তানের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন নবীদের আগমন একেবারে বন্ধ হয়ে গেল কী কারণে? আরজ আলী বলেন, ‘‘বাইবেলের বিবরণমতে হযরত আদম হইতে হযরত ঈসার জন্ম পর্যন্ত সময় ৪০০৪ বৎসরে প্রতি বৎসর গড়ে নবী জন্মিয়াছিলেন প্রায় ৩১ জন! ...কিন্তু হযরত ঈসা নবী জন্মিবার পর নবীদের জন্মহার কমিয়া ৫৭০ বৎসরে জন্মিলেন মাত্র একজন, অতঃপর কেয়ামত পর্যন্ত নাকি একেবারেই বন্ধ। ...হয়ত পাপীর সংখ্যা বা পাপের পরিমাণ আগের চেয়ে হ্রাস পাইয়াছে, নতুবা এ যুগের পাপীদের উপর বীতস্পৃহ হইয়া আল্লাহ তাঁহার হেদায়েত বন্ধ করিয়াছেন। ”  

এর একটা ব্যাখ্যা আরজ আলীর আছে। তিনি বলেছেন, “উত্তরোত্তর জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের গুরুবাদিতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কমতে থাকে দেবতাগণের মহিমা। অবশেষে বুদ্ধ (জ্ঞানী) দেব যখন আবির্ভূত হয়ে প্রচার করলেন দেব-দেবীর স্তবস্তুতি ও পূজা-অর্চনার অসারতা-অযৌক্তিকতা, তখন থেকেই দেবতাদের পাত্তা গোটাতে হলো চিরতরে। যদিও ভারতীয় দেবতাদের ঔপনিবেশিক স্বর্গধামটি আর্য ভারত থেকে বেশি দূরে নয়, তথাপি আর কোনো দেবদেবীর ভারতের ভূমিতে পদার্পণের কথা শুনা যায় না, বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পরে। কেননা এ যুগে তাঁদের ভক্ত মুনি-ঋষি মেলে না। অভিন্ন কারণেই যীশুখ্রিষ্টের আবির্ভাবের পরে পশ্চিমাঞ্চলেও দেবতাদের আনাগোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ”

ধর্ম, বিজ্ঞান এবং কুসংস্কার          

কুসংস্কার আরজ আলী মাতুব্বরের মনোযোগের অন্যতম, কিংবা বলা যায় অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। সমাজে এর দাপট-এর বিরুদ্ধেই তিনি যুদ্ধে নেমেছিলেন। ধর্ম আর কুসংস্কারকে সমার্থক হিসেবে ঘোষণা না করে, কুসংস্কার সম্পর্কে পাইকারি কিংবা অনির্দিষ্ট কথা না বলে তিনি এটিকে সুনির্দিষ্ট করেছেন, বলেছেন: “কুসংস্কার কি, অল্প কথায় ইহার উত্তর হইল, যুক্তিহীন বিশ্বাস বা অসার যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মতবাদে বিশ্বাস; এক কথায় অন্ধবিশ্বাস। যেখানে কোনো বিষয় বা ঘটনা সত্য কি মিথ্যা, তাহা যাচাই করিবার মতো জ্ঞানের অভাব, সেখানেই কুসংস্কারের বাসা। ”  

অর্থাৎ যখন মানুষ চিন্তার সমস্ত ক্ষমতা নিষ্ক্রিয় করে রাখে এবং নিজের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অন্য কারও কাছে সমর্পণ করে তখন কুসংস্কারের জায়গা তৈরি হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা শুধু নয় মতাদর্শিক ক্ষমতাও এই আধিপত্য তৈরি করতে সক্ষম। আরজ আলী বলেন, “বর্তমান কালেও কোনো কোনো মহলে দেখা যায়, সত্য-মিথ্যার বিচার নাই, গুরুবাক্য শিরোধার্য। ”  

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বললে অনেকেই তাকে ধর্মের সমালোচনা হিসেবে গণ্য করেন। আরজ আলী বিষয়টি পরিষ্কার করেন এইভাবে যে—“যদি কেহ কুসংস্কার ত্যাগ করিতে অনিচ্ছুক হন এবং বলিতে চাহেন যে, কুসংস্কার ত্যাগ করিলে ধর্ম থাকিবে না, তাহা হইলে মনে আসিতে পারে যে, ধর্মরাজ্যে কুসংস্কার ভিন্ন আর কিছুই নাই? এ প্রসঙ্গে কেহ যেন মনে না করেন যে, আমরা ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছি। আমাদের অভিযান শুধু অসত্য বা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। ”  
আরজ আলীর দেয়া কুসংস্কারের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতাদর্শিক কাঠামো, বিশ্বব্যাংকীয় অর্থশাস্ত্র এবং যাকে বিজ্ঞান বলা হয় তারও অনেক কিছুকে কুসংস্কার বলতে হবে। কারণ বর্তমান বিশ্বে যুক্তি, বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিকতা ছাড়া এর অনেক কিছু গ্রহণ ও তার চিরস্থায়ীত্বে বিশ্বাস স্থাপন করবার প্রবণতা কিংবা পরিকল্পিত চেষ্টা প্রবল প্রতাপে বিজ্ঞান, আধুনিকতা আর যুক্তিশীলতার নামেই জারী আছে।  

বিজ্ঞান ও সভ্যতা নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বরের মনোযোগ ও আগ্রহ দেখে এরকম কারও মনে হতে পারে যে, তিনি বোধহয় এগুলোকে সরলরৈখিকভাবে বিবেচনা করছেন, বোধহয় কোন না কোন ভাবে বিজ্ঞানের বিকাশকেই মানুষের সকল মুক্তির পথ বলে বিবেচনা করছেন। কিন্তু তা যে ঠিক নয় সেটি স্পষ্ট হয় নিচের কয়েকটি বাক্য থেকে: “সভ্যতাবৃদ্ধির সাথে সাথে তাম্র ও লৌহ আবিষ্কারের পর তীর-ধনুকের উন্নতি হইয়াছিল অসাধারণ। কিন্তু উন্নতি হইলে কি হইবে, উহা দিয়া পশু-পাখি হত্যার বদলে আরম্ভ হইয়াছিল নরহত্যা এবং পশু-পাখির স্থলাভিষিক্ত হইয়াছিল রামানুজ লক্ষ্ণণ, লঙ্কেশ্বর রাবণ, ও নূরনবীর দৌহিত্র ইমাম হোসেনও। আধুনিক যুগে আবার তীর-ধনুকের চেহারা বদল হইয়া উহার তীরটি হইয়াছে গোল এবং ধনুটি হইয়াছে সোজা— সৃষ্টি হইয়াছে বন্দুক, কামান ইত্যাদি মারণাস্ত্রের। শেষমেষ পারমাণবিক বোমা। ”  

পারমাণবিক শক্তি মানুষের উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন, কিন্তু এই বিশাল শক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না। কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যদি জনগণের কাছে না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের এই বিশাল শক্তিই ধ্বংসের উপকরণ হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য পারমাণবিক শক্তি যেখানে মানুষের বহু সমস্যার সমাধানে সক্ষম সেখানে সেই শক্তি এখন মানব সমাজের অস্তিত্বের জন্যই একটা হুমকি।

জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আরজ আলী তাঁর ধারণা স্পষ্ট করেছেন এইভাবে: “বিশ্বব্যাপী বিরাজ করছে এক মহাশক্তি। সেই মহাশক্তিই আমাদের কাছে ভিন্ন ভিন্ন শক্তিরূপে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যা তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, চুম্বকশক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি প্রাণশক্তি। ...অন্যান্য শক্তির ন্যায় ‘প্রাণ’ শক্তিটিও মহাশক্তির কোটি কোটি বছরের আবর্তন, বিবর্তন ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল। ”     

অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজ ও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। তিনি বলেছেন, “সমাজদেহের অঙ্গবিশেষের অর্থাৎ শ্রেণীবিশেষের অতিমাত্রায় উত্থান ও পতন ডেকে আনে সমাজদেহের পঙ্গুতা ও অকর্মণ্যতা। ...‘সমাজতন্ত্র’ তথা ‘সাম্যবাদ’ হচ্ছে বিশ্বমানবের মঙ্গল বিধানের একমাত্র মাধ্যম। ” এই শর্ত পূরণ ছাড়া বিজ্ঞান ও ধর্মের ফলাফল তাঁর কাছে মনে হয়েছে অভিন্ন, অর্থহীন; ‘রকেট-রোবট ব্যবহার’ অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্ন ‘বিকাশ’ এবং ধর্মের আধিপত্য কিংবা  ‘স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শন, তাঁর বিবেচনায়, মানুষকে একই জায়গায় নিক্ষেপ করে। তিনি তাই বলেছেন, উপরের শর্ত পূরণ ছাড়া “শুধুমাত্র রকেট-রোবট ব্যবহার ও স্বর্গ নরকের স্বপ্ন দর্শনের দ্বারা সমাজ উন্নয়নের যে প্রচেষ্টা, তা ভেল্কি ছাড়া আর কিছু নয়। ”                
   
এক ধর্ম বহু ধর্ম : ধর্ম না সমাজ?

আরজ আলী বলেন, “আগুন আবিষ্কার থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তি আবিষ্কার পর্যন্ত অন্য কোন আবিষ্কারেই আঞ্চলিকতা নেই, কিন্তু ধর্ম ও রাষ্ট্র হচ্ছে আঞ্চলিকতায় ভরপুর। ”  

একদিকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, তার সমাজ ও সংস্কৃতির আদলে ধর্ম গড়ে উঠে, অন্যদিকে প্রকৃতপক্ষে সমাজ-রাষ্ট্রের অভিব্যক্তি হয়ে উঠে ধর্ম। ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা আসলে তাই সমাজ রাষ্ট্র নিয়েই আলোচনা। কেননা সমাজ-রাষ্ট্র বাদ দিয়ে ধর্মের অস্তিত্ব নেই। আমরা ইতিহাসে দেখি, মানুষের সমাজ জীবনের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের রূপও পরিবর্তিত হয়েছে। গোত্র জীবন থেকে মানুষ যখন রাষ্ট্র জীবনে প্রবেশ করেছে তখন ধর্মও গোত্রীয় পরিচয় থেকে রাষ্ট্রীয় বা বৈশ্বিক পরিচয়ে পরিচিত হয়েছে। যেসব জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রিক-সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছে তাদের ধর্মের প্রভাবও পড়েছে তত বেশি। মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মের ঈশ্বরের জ্ঞানও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেজন্যই আগের ঈশ্বরের চাইতে অনেক পরিণত দেখা যায় পরের ঈশ্বরের জ্ঞান। বহু ভাষা, বহু জাতি, বহু গোত্র যেভাবে বিলুপ্ত হয়েছে তেমনি বিলুপ্ত হয়েছে অনেক ধর্ম, অনেক ঈশ্বর, অনেক দেবতা ও অনেক নবী। এই কালে যে আর কোন ধর্মের উদ্ভব হয় না, কেউ চেষ্টা করলেও তা পাত্তা পায় না সেটাও মানুষের ক্রমবিবর্তিত সমাজেরই ‘ইচ্ছা’।

এক ধর্ম কখনোই আসলে এক ধর্ম নয়। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই বহু ধর্মের বাস। এটাও নির্ধারিত হয় সমাজেরই ইচ্ছা দিয়ে, তার তাগিদে। সমাজে মানুষের মধ্যেকার বৈষম্য, ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থান, নিপীড়ক ও নিপীড়িত এর সবেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ‘একই’ ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি, চর্চা ও ব্যাখ্যার মধ্যে। ‘একই’ আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা ‘একই’ নবী, দেবতা ভিন্নভিন্ন ভাবে গৃহিত হন ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানে। কখনো হয়ে যায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত। ১৯৭১ এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী নারকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আল্লাহ আর রসুলের নাম ব্যবহার করে; আবার নিপীড়িত অসংখ্য নারী পুরুষ বুক চিরে আর্তনাদ করেছে, জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সেই একই আল্লাহ আর রসুলের নামেই। পোপের যীশু বিশ্বব্যাপী যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, দেশে দেশে স্বৈরশাসন, নিপীড়ন ও বৈষম্যকে মহিমান্বিত করে তখন দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ে যীশুকে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে স্থাপন করে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব। এই বৈপরীত্য, এই লড়াই ধর্মের লড়াই নয় এটা সমাজের ভেতরে শ্রেণীসমূহের, বিভিন্ন বর্গসমূহের (লিঙ্গীয়, জাতিগত, বর্ণগত) সমাজের ভেতরকার ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির লড়াই। ধর্ম এসব ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা।  

আরজ আলী মাতুব্বরের প্রশ্নের যে শক্তি তা নিজে নিজে তৈরি হয়নি। সে শক্তি এসেছিল ‘পা ভাঁজ করে শোয়ার অবস্থা’ নিয়েও মহাবিশ্বকে, মানুষ ও জগতকে দেখার ক্ষমতা থেকে, সামাজিক কর্তৃত্ব এবং মতাদর্শিক আধিপত্যকে অস্বীকার করবার অব্যাহত লড়াই থেকে। আরজ আলী মাতুব্বর সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়েই সামনে লাঠি হাতে দাঁড়ানো দেখেছিলেন ধর্মকেই। তিনি যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন সেগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন মনে হলেও আদতে সেগুলো সমাজ ক্ষমতা কর্তৃত্ব অধিপতি সংস্কৃতি নিয়েই প্রশ্ন। কেননা একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট সমাজে ধর্মের অধিপতি অস্তিত্ব আসলে ঐ সময়ের ঐ সমাজের বিধিব্যবস্থা অনুশাসন আর প্রবল মতাদর্শিক অবস্থানেরই একটি সংগঠিত রূপ।



বি.দ্র :  আসন্ন পহেলা বৈশাখে  প্রকাশিতব্য রুদ্র সাইফুল সম্পাদিত ‘আরজ আলী মাতুব্বর : পাঠ ও মূল্যায়ন’-এর সৌজন্যে লেখাটি প্রকাশিত।

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012April/anu muhammad20120407140417.jpg

 

আনু মুহাম্মদ

 

 

 

 

 

বাংলাদেশ সময় : ১৩২৬, এপ্রিল ০৭, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।