প্রকৃতিপুত্র
ভাবতে গেলে তুমিই একদিন
আমাদের হারানো শেকড়, হারানো চুল, বয়সভেদে
ছোট হয়ে আসা পরিত্যক্ত পোশাকের ধরন, ছায়াভিত্তিক
ঘাসের আকৃতি, বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা মাঠ—
আলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ধানক্ষেতে পড়ে যাবার স্মৃতি—
একদিন ডেওয়া ফলের ঘ্রাণের মতো ফিরিয়ে দিতে পারো
যখন সাঁকোর কম্পন দেখে বুঝে নিতাম
মাছেদের হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি, স্রোতের প্রবাহ দেখে মনে হতো
ভেসে যাচ্ছে সম্রাট দারায়ুস কিংবা স্কাইলাক্সের অধিকৃত রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ
আর যত্রতত্র অশ্বদৌড় দেখে মনে পড়ত
সেই সকল ক্রীতদাস ব্যবস্থার প্রবর্তক, যাদের
ঐসব দুরন্ত অশ্বের লেজে জুড়ে দিয়ে
ঘোরানো হচ্ছে কাঁটাঝোপ, বনবাদাড়, তপ্ত মরুভূমি—
একদিন আলোছায়ার নক্ষত্রের মতো
তুমিই তার ভালমন্দ, উঁচুনিচু শিখিয়ে নিতে পারো
যখন মাথার ওপর সুস্নিগ্ধ মেঘের পরিচ্ছদ দেখে
মনে হতো প্রাগৈতিহাসিক কুশলীরাজ কিংবা প্রাচীন গ্রিসিয়
স্থাপত্যপ্রেমিক কোনো রাজরাজড়ার মহান কীর্তির কথা—
কিংবা মনে পড়ে যেত-- গাছে গাছে বিবিধ কূজন আর বর্ণালি ফলের
আস্ফালন দেখে ইবনে বতুতার চোখে অপ্সরী ও গন্ধর্বের পরম সংসার; আর
অতল সুখের এই পলিধৌত সুশীল রাজ্যের মতো স্বর্গীয় মাতৃভূমির কথা
ভাবতে গেলে একদিন তুমিই তার আগাপাছতলা দেখে ফেলেছিলে
আজ আবার পুনরুদ্ধারিত গৌরবের মতো
তারই কিছু গ্রহণ বর্জন সুখ স্মৃতি অনায়াসে তুলে ধরতে পারো জানি
মৃত গলা প্রবীণ হৃদয়
মেলা থেকে কোমরের ব্যথা নিয়ে ফিরে আসছে গানবাজনার দল
মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকা ভোরবেলার রোদ
গৃহবন্দী মানুষের স্যুটকেসগুলো ভাঙছে, আর
গানবাজনার তদ্বিরগুলো ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে
অবশেষে মেলার বৃত্তান্ত বলে খিলখিল করে হাসছে
ব্যক্তিগত বৃত্তগুলোয় বড় হচ্ছে অগুনতি সঙ্গীতের মুখ
ডাক এলে আমড়া বা সজনে তলায় মেলার প্রস্তুতি চলে দীর্ঘদিন
ইতিহাসহীন প্রাচীন দুঃখের সাথে
মৃত গলা প্রবীণ হৃদয়— অহেতুক এক আত্মীয়তায় বাঁধা
একজন সুখের প্রাচীর ধরে রাত্রি পোহালে
আর জন দুঃখের ভেসাল ছেড়ে
অজস্র গোপন দহনের নিঃসঙ্গ খালুই ভরে দেয়
উচ্ছৃঙ্খল ঘড়ি
ঘুমন্ত মায়েদের মধ্যে বড় হচ্ছে শিশুদের হাত-পা-মগজ
জীবিত মায়েদের মধ্যে বড় হচ্ছে স্বপ্নের হাত-পা-মগজ
বুনো কালো হাতির দাঁত থেকে গড়ে উঠেছে এই অনন্য রাজবাড়ি
যার প্রতিটি কক্ষের নিচে— কৃষি সমাবেশে
শেখানো হচ্ছে উপাসনার নানান পদ্ধতি, আর কোথাও
জানলা ভেঙে উপচেপড়া মেঘে, সাঁতারের সমূহ কলা
প্রকাণ্ড কাঠবিড়ালি তার লেজ থেকে ছুড়ে মারছে
মানুষের শিকারের গূঢ় অভিলাষ। আর ঘুমন্ত পাতাদের ওপর
উড়ে উড়ে নিশ্চিন্ত করছে পাখিদের ভবিষ্যৎ জীবন
সূর্যের সুখ্যাতি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে প্রকা- হাতির পাল
তাদের হারানো দাঁত ও নির্বিঘ্ন বাঁচার দাবিতে
কলাপাতায় মোড়ানো হচ্ছে ভবিষ্য যুদ্ধের সাহস
কচি সবুজ আকাশের দিকে মানুষের দৃষ্টি পড়ে আছে
উড়ন্ত আকাশ কেটে কেটে নির্মিত হচ্ছে চাঁদমুখ
সভ্যতার উচ্ছৃঙ্খল ঘড়ি
ঘুঙুর খেলা
কিছু সময় বদলে দিয়ে
উড়ে যাবার সময় হয়েছে ঘুঙুরের?
ছোটবেলায় ঘুঙুরনাচ নাচতে গিয়ে— একবার দু’বার
শরীরছেঁড়া মৃদু রক্তে— ভেসে গেছে ঘুঙুরের মুখ
আর তাকে মানিয়ে নিয়েছে— উচ্ছ্বাসের দুরন্ত প্রকার
মা বেঁধে দিতেন কোমরে ঘুঙুর
আর কোরবানির ষাঁড়ের পশুকে সংসারের পিতা
তারপর সবাই খুলে নিতেন
উভয় নৃত্যের একই রকম হাসি দেখবার পর
ঘুঙুর খেলা— একদার সাংসারিক সত্যে আমরা যাপন করেছি
ঘুঙুরের পরনে ছিল পিতলের আভা—
উচ্চতা যথারীতি, আর
গোলগাল চেহারায়— নাভির ওপর দীর্ঘ ফাঁড়া দাগ
অভিনেতা তীর্থঙ্কর
তীর্থঙ্কর মজুমদার আমাদের বাড়ির ছেলে
তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেহারাটা দর্জিখানায় সেলাই হচ্ছে
চিবুকের প্রশ্রয় থেকে একগুচ্ছ চুল নাভির ওপর দোল খাচ্ছে
সকাল থেকে একটি কাঠকয়লার বাস এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে আঙিনায়
তাতে বসন্তকাল, কোকিলের ডাক
সারাদিন চড়ে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত
তীর্থঙ্কর, অভিনয়ের প্রাক-ভূমিকায়
তার গোফের ওপর বসিয়ে দিল নার্সারি।
ফুটে থাকা দু’চারটি ফুলে আবশ্যক পারফিউমের কাজটি অন্তত হয়ে গেল
আর এখন তাতে ফল ধরবে— যা পেড়ে খেতে
তীর্থঙ্করের সস্নেহ আশীর্বাদ প্রয়োজন পড়বে তোমাদের
বুকের ওপর আগাছার চারা
চল্লিশ বছর ধরে বুকের ওপর আগাছা রোপণ করেছি
কেউ শিস দিলে
বাড়িভর্তি লোক জড়ো হয়
মায়ের মতো বকুনি দিয়ে বলে--
গ্রাম ছেড়ে কেউ পালাতে পারে না খোকা
খুশি হয়ে, বুকের ওপর আগাছা থেকে
আমি তাদের গোলাপ ফুল ছিঁড়ে নিতে বলি
সারারাত্রি পেঁচা ডাকে, ডাহুক ডেকে গলা ছিঁড়ে রক্ত তুলে আনে--
সরষে ফুলে রাঁধা কই মাছ
আমি তাদের খেয়ে যেতে বলি
আমার মতো যারা মানব দেহ মাটি করে
ঝাড় বংশে বৃদ্ধি করছে আগাছার চারা
তাদের নামে তৈরি হবে গ্রামে গ্রামে দাতব্য ইস্কুল?
একবার, নদীতীরে
মনে পড়ে বকুলফুল তুলতে এসে
সাদা সাদা নখগুলো ধরতে দিয়েছিলে--
বকের হাড়ের মতো সাদা আর বিশ্বাসের সুগন্ধের মতো
বাস্তবতা থেকে মেঘগুলো যথেষ্ট আড়ালে
এখনো শেয়ালের পশমের মতো কোমল আর
ঝরঝরে তোমার মন। স্লিপিং পিল, টুথব্রাশ
অভ্যাসবশত কাছে কাছে রাখো। বাহুডোরে
মায়ের ঝোলানো তাবিজ, গলায় পিতলের লকেট
এখনো অবিকল আছে। তবু সুদর্শন গৃহশিক্ষককে ঘিরে
তোমার নামে যে কলঙ্ক রটানো আছে
তোমার ধার্মিক বাবা, বাজার থেকে কিনে আনা দেশি মোরগের
সুস্বাদু ব্যঞ্জন রেঁধে তা ভুলিয়ে দিতে চান
আমি ভাবি— বাড়িভর্তি এইরকম বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জায়
জোছনারাত বেছে নেবার প্রসঙ্গ— বাতুলতা নয় কি?
তোমার জমানো ডাকটিকিটগুলো প্রাপককে ফিরিয়ে দিতে গেলে
দীর্ঘদিন লেগে যেতে পারে— আমি বরং
শীতল পাটিতে ছড়িয়ে নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জমাট স্পর্শ থেকে
তোমার আমার সম্পর্কের পরম্পরাগুলো সুনির্ণয় করি—
আজকাল নদীতীর ধরে হাঁটতে গেলে ইলশেমাছ
গায়ে উঠে আসে। পরিচিত মানুষের মতো কাশবন— আর
সাম্প্রতিক দুঃখের মতো চির তরুণ মেঘ। দেখে দেখে একবার
এই নদীতীরে, তুমি-আমি কান্না ধুয়েছিলাম, মনে পড়ে?
ওবাযেদ আকাশ
কবি ও সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১৪৪৫, এপ্রিল ০৪, ২০১২