ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

আগুন পিপাসা

সৌমিত্র দেব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১২
আগুন পিপাসা

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012April/galpo 120120403182522.jpgসেলুলয়েডের ফিতের মতো ভোর। ঘন কুয়াশা ঢাকা আকাশ।

শান্ত এক ফালি রোদের রেখা রেললাইনের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। লাজুক রোদের আলোয় শিশিরভেজা নিসর্গের দিকে তাকিয়ে বারবার আনমনা হয়ে পড়ছিল আফ্রোদিতি। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জানালার কাচটা আগেই নামিয়ে দিয়েছিল। এখন আবার খানিকটা তুলে ধরলো। মনোযোগ দিলো সদ্য কেনা ‘পাক্ষিক জয়তী’ ম্যাগাজিনের পাতায়।

সেই সাত সকালে ভোরের ট্রেন ধরার জন্য কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছেছিল। ঠিক সময়েই ছেড়েছে আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস। তবে পৌনে একটার আগে শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছবে না। সে রকমটিই বলে দিয়েছেন বড় চাচা। এই দীর্ঘ সময়টুকু পত্রিকার পাতায়, রেললাইন সংলগ্ন নিসর্গে অথবা মনের গহনে ডুব দেয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে। শুনেছিল বাসে এখন সময় অনেক কম লাগে। তবু রেলভ্রমণ অনেক বেশি নিরাপদ। তাছাড়া ট্রেনের ঝিকঝিক ছন্দ তার খুব ভাল লাগে। ভাগ্যিস, সময়মতো ছেড়েছিল ট্রেন। অপেক্ষা খুব বিরক্তির একটা ব্যাপার। বন্ধু হোক আর যানবাহনই হোক, কারও জন্যই অপেক্ষা করতে ভাল লাগে না। আর স্টেশনে যা ভিখিরির উৎপাত! শুধু স্টেশনেই বা বলি কেন, রাজপথে-ফুটপাতে কোথায় নেই ওরা। শহরের সবখানেই এখন ছিন্নমূল মানুষের ভিড়! সবখানেই দারিদ্রের বীভৎস চেহারা। এসব ভাসমান মানুষের চাপে আমাদের দেশ ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।

জীবনে এই প্রথম সে একা একা বাড়ি যাচ্ছে। মনে পড়ছে বন্ধু রাজুর কথা। রাজু বলে, গ্রামের বাড়ি যাওয়া মানে হচ্ছে শেকড়ের কাছে ফেরা। কিন্তু শেকড় কাকে বলে সেটা সে ঠিক বোঝে না। আফ্রোদিতি বড় হয়েছে ঢাকায়। ওর জন্মের আগেই ধানমন্ডিতে বাড়ি করেছেন বাবা। সে হিসেবে ওটাই তো তার শেকড়। স্বাধীনতার পর যারা ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠে, ওর বাবা তাদেরই একজন। নাগরিক কোলাহলের মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে, আর তার সঙ্গেই যেন তিলোত্তমা হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর। স্কুলে লম্বা ছুটি পড়লে বাবা ওকে শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। সেটাই কি প্রকৃত শেকড়? সে জানে না। গ্রামের বাড়ির কথা মনে হলেই ভেসে ওঠে টুকরো কিছু ছবি। একটা বড় দিঘি, আমগাছ, জামগাছ, কাঁঠালগাছ, সুপারিবাগান। আর উর্বরা ধানি জমি। মোল্লাবাড়ির পুরনো মসজিদ। গ্রামের এক প্রান্তে বৈষ্ণবদের আখড়া। সেখানে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে মিলে লুকিয়ে গান শুনতে যেতো। মনে পড়ে শ্মশ্রু-গুল্ফ শোভিত দীর্ঘদেহী দাদাজানের কথা। সুবেহ সাদেকে দাদাজান সুললিত কন্ঠে কোরআন আবৃত্তি করতেন। সেই তেলোওয়াত শুনে কতদিন তার ঘুম ভেঙে গেছে। আবছা হয়ে গেছে ছবিগুলো, তবু মনে পড়ে দাদির কথা। বুড়ি তার ফোকলা দাঁতে পান চিবুতে চিবুতে কত যে কিচ্ছা শোনাতো। আফ্রোদিতির মনের পুকুরে সেসব ভেসে উঠছে আর ট্রেনের ঝাঁকুনিতে মৃদু আলোড়ন তুলে হারিয়ে যাচ্ছে।

অনেক দিন হয় বুড়ো-বুড়ি দু’জনেই মারা গেছে। তাদের কবরটা পর্যন্ত জেয়ারত করতে পারেনি সে। আজ থেকে দশ বছর আগে বড় চাচার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু সেবারে একদম ভাল লাগেনি তার। সমবয়সীদের সমমনা মনে হয়নি। বাড়ির নৈসর্গিক সৌন্দর্য অথবা চাচা-চাচীদের আন্তরিক আদর-যতœ কোন কিছুই বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি তাকে। সেখানে টিভি নেই, কেরাম বোর্ড নেই, গল্পের বই নেই। কি নিয়ে সে সময় কাটাবে? প্রতিটা মুহূর্ত অসহ্য ঠেকেছে। মনে হয়েছে ওটা একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। এই ক’বছরে তার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়েছে। কিন্তু বাড়িমুখো আর যাওয়া হয়নি। গ্রামের বাড়িটাই যে আসল শেকড় সেটা তাকে বুঝিয়েছে রাজু। ওর কারণেই সে আইনের ওপরে পড়াশোনা করেও আকৃষ্ট হয়েছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতি। শুনেছে গ্রামের বাড়িতেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেখানে তেমন কেউ আর এখন থাকেন না। সবাই শহরমুখী হয়ে পড়েছেন। ছোটচাচা উকিল হিসেবে মৌলভীবাজার শহরে খুব নাম করেছেন। শহরের কলিমাবাদ এলাকায় তার নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। আফ্রোদিতির বাপ-চাচারা মোট তিন ভাই। ওর বাবা ভাইদের মধ্যে মেজ। একমাত্র বড় চাচাই এখনও গ্রামের বাড়িতে থেকে সবকিছু দেখাশোনা করেন। স্কুল মাস্টার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। আর মেজ ভাই— আফ্রোদিতির বাবার কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি ব্যবসা করে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। একমাত্র বড় চাচাই ছোট ভাইদের খোঁজখবর নেন। তাদের বাড়িতে যাতায়াত করেন। সপ্তাহখানেক আগে একটা বিশেষ কাজে তিনি তাদের বাসায় এসেছিলেন। অনেকদিন পর বাড়িটা একবার ঘুরে আসার জন্য তিনি অনুরোধ করেন আফ্রোদিতিকে। বড় চাচার প্রস্তাবে এবার আর ‘না’ করতে পারেনি সে। তবে বাড়ি যাওয়ার পেছনে শুধু বড় চাচার আমন্ত্রণ নয়, তার নিজেরও একটা উদ্দেশ্য আছে। সে কারণে নিজের মতো করে এবার বাড়ি যাওয়ার একটা প্রোগ্রাম করেছে সে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী আজ একাই ভোরের ট্রেনে রওয়ানা দিয়েছে। শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে তাকে অভ্যর্থনা করে মৌলভীবাজারে নিয়ে যাবেন ছোট চাচা। সেখানে দু’দিন থাকার পর তাকে কমলগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বড় চাচা।

আখাউড়া ছেড়ে আসার পর থেকেই প্রকৃতি নজর কেড়ে নিলো। ছোট-ছোট পাহাড়, বনভূমি আর নিসর্গের সবুজ লাবণ্য দেখে সে চিনে নিলো সিলেট অঞ্চল। মধ্যাহ্নের মিঠা রোদ নিয়ে ট্রেন এসে থামলো শ্রীমঙ্গল স্টেশনে। যাত্রীদের তেমন ভিড় নেই। তবু নামার সময় অহেতুক হুড়োহুড়ি। প্লাটফর্মের একপ্রান্তে দেখা গেল সিগারেট টানতে-টানতে আসছেন ছোট চাচা। হাতের হালকা ব্যাগটাই তার হুকুমে চলে গেল ড্রাইভারের হাতে। রাজহাঁসের মতো শুভ্র গাড়ির পেছনের আসনে ছোট চাচার সঙ্গে চেপে বসলো সে। সড়ক ও জনপথ ভবনের সামনে দিয়ে বনবীথি এলাকা ঘুরে কলিমাবাদ এলাকায় ঢুকে তার মনে হলো, আহা! মৌলভীবজার শহর এত সুন্দর। পথের দু’পাশের তরুণ বৃক্ষরাজি যেন তাকে গার্ড অব অনার দিচ্ছে।

অনেক দিন পর ঢাকায় অতিথি পেয়ে জমে উঠলো ছোট চাচার বাড়ি। এ বাড়িতে আফ্রোদিতির বাবা বেশ ক’বার ঘুরে গেলেও সে এসেছে এই প্রথম। চাচাতো ভাই-বোন দু’জন। নাসির আর তহুরা। নাসির বড়। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে তার বেশ ঝোঁক। বন্ধুদের কাছে নাসির জামান নামে পরিচিত। ছোটবোন তহুরা বেশ শান্ত প্রকৃতির। তবে কথাবার্তায় বেশ পাকামো আছে। আলী আমজাদ গার্লস স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। চাচী সারাদিন শুধু রান্নাবান্না আর বকর-বকর করতে ভালবাসেন। বার কয়েক তার সঙ্গে চললো একই আলোচনার ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি। ছোট চাচা ঠিক তার উল্টো স্বভাবের। তার সঙ্গে কথা বলতে হয় মেপে মেপে। কিন্তু তিনি নিজে থেকে যদি কথা বলেন, তাহলে তাকে আর থামানো যায় না। এডভোকেট বলে কথা! বাপ-চাচাদের মধ্যে বড় চাচাকেই সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে আফ্রোদিতির। যে কোন আলোচনায় তিনি খুব আন্তরিক। জানেনও প্রচুর। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করেন। মফস্বলে বাস করেও যে কেউ এত কিছু সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন সেটা বড় চাচার সঙ্গে পরিচয় না হলে সে কিছুতেই জানতে পারতো না। রাজুর সঙ্গে যদি তার পরিচয় করিয়ে দেয়া যেতো তাহলে একটা দেখার মতো ব্যাপার হতো। দুই পণ্ডিতের আলোচনা আর কিছুতেই থামানো যেতো না।

বড় চাচাকে বাসায়ই পাওয়া গেল। তিনি এসেছেন দু’দিন পর ওকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যেতে।
এবারে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পেছনে ওর মূল উদ্দেশ্য হলো একটা টেলিফিল্ম তৈরির ভাবনা। কৃষক বিদ্রোহের পটভূমিতে বানানো হবে সেটা। রাজু বলেছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাস হচ্ছে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস। নিকট অতীতেও এদেশে হয়েছে সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ, ভানুবিলের কৃষক আন্দোলন, নানকার কৃষক আন্দোলন, টংক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনসহ অনেক কৃষক আন্দোলন। বড় চাচা বলেছেন ওদের এলাকায় ষাটের দশকে একটা বড় কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। একটা হাওরের জমি দখল নিয়ে কৃষক ও জমিদারের লাঠিয়ালদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়েছিল। সেই কাহিনী নিয়ে তৈরি হবে ওই টেলিফিল্ম। বড় চাচার কাছ থেকে পুরো কাহিনী শুনে চিত্রনাট্য তৈরিতে হাত দেবে। সম্ভাব্য লোকেশনগুলোও এবারেই ঠিক করে যাবে। রাতের খাওয়ার পর বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে গল্পের ঝাঁপি খোলেন বড় চাচা। পৌষের শীত। দূরে কোথাও কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এ বাড়িতে জেগে আছে চারজন মানুষ। একজন কথক, তিনজন শ্রোতা। বড় চাচার কণ্ঠ শুনতে-শুনতে ঘন বুনোনের কাহিনীর মধ্যে হারিয়ে যায় আফ্রোদিতি। এক সময় সে আর কিছুই শুনতে পায় না। তার চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্যপট ভেসে উঠতে থাকে। দৃশ্যের চরিত্ররা জীবন্ত। তারা কথা বলে।

২.
আফ্রোদিতির চোখের সামনে থেকে হঠাৎ দৃশ্যভাণ্ডার হারিয়ে গেল। চেতনা ফিরে এলে সে দেখতে পেলো বড় চাচা গল্প বলা বন্ধ করে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। অঘোর নিদ্রামগ্ন নাসির আর তহুরাকে দেখে তার হাসি পেলো। এত রাতে একমাত্র সেই তাহলে জেগেছিল। ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে পুরো এক গ্লাস জল ঢক-ঢক করে পান করলো সে। তারপর লাইটের সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পড়লো।

পরদিন ঘুম ভাঙলো বেশ দেরিতে। ছোট চাচী টের পাওয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে নিজের জন্য চা বানিয়ে আনলো। চাচীর সাথে দেখা হতেই তিনি বলেন, হুনলাম কাইল হারা রাইত উজাগরি করছো, এর লাগি আর ঘুম ভাঙ্গাইলাম না। ঢাকাইয়া পুরি তুমি, কুন সময় চেতি যাইবায়, গোস্বা করবায়, তার টিক আছে নি!

তার মুড সম্পর্কে চাচীর তো বেশ ভাল ধারণাই আছে! ভাবলো আফ্রোদিতি। ড্রইংরুমে নাসিরের বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। সবাই ঢাকার আপুকে দেখতে চায়। সে কিভাবে এত দর্শনীয় হলো তা নিজেই বুঝতে পারে না। তবে এটা জানে যে নাসির আর তহুরা তাকে খুব ভালবাসে। ছোটবেলা থেকে বড়দের মুখে দিতি আপুর প্রশংসা শুনে-শুনে ওরা এক তারকা ইমেজ তৈরি করেছে। আর সে কারণেই হয়তো দর্শনপ্রার্থী হয়েছে নাসিরের বন্ধুরা। ওরা সবাই সমবয়সী নয়। বিএ ক্লাসের সিনিয়র যেমন আছে, তেমনি আছে স্কুল লেভেলের জুনিয়রও। ছেলেদের সঙ্গে দু’জন মেয়েও আছে— মুক্তা আর নিনি। ছেলেদের মধ্যে আছে সুহেল, টিটো শামীম, খোকন, রাসেল, সঞ্জু, সুমন, রুম্মান, অমিত, মাদল ও তানভীর- মোট ১১ জন। সবাই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত। একটা ছোট জেলা শহরের প্রাণের এই প্রাচুর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল আফ্রোদিতি, ভেবেছিল এই ছেলেমেয়েরা তার খুব শক্ত সাক্ষাৎকার নেবে। এখন বুঝতে পারলো, আসলে ওকে কেন্দ্র করে সকলের মিলিত হওয়াটাই ওদের আগমনের মুখ্য উদ্দেশ্য। খুবই মামুলি কথাবাতা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চর্চার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আফ্রোদিতি ওদের রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিলো। ওরাও বললো, এবার বন্যার্তদের সাহায্যার্থে তারা নাকি বিভিন্ন এলাকায় দর্শনীর বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছে। খোলা ট্রাকের ওপর মঞ্চ বানিয়ে গান, কবিতা আবৃত্তি আর পথনাটক পরিবেশন করেছে।

দুপুরে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে এসে নিজেকে খুব ঝরঝরে মনে হলো আফ্রোদিতির। অবসর কাটাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে গান শুনছিল সিডি প্লেয়ারে। এমন সময় ছোট বোন তহুরার এক বেমক্কা প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এই বালিকাটিকে দেখে বোঝাই যায় না যে এত গাছপাকা হয়ে গেছে। বলে কিনা, দিতি আপু, তুমি কখনও প্রেম করেছো? এ প্রশ্নের কি জবাব দেবে দিতি, রাজধানী শহরে ছেলে-বন্ধুদের মধ্যে বড় হয়েছে। কৈশোর থেকেই প্রেমপত্র পেয়ে আর টিজিং শুনে অভ্যস্ত। কোন কোন প্রিয় মুখ যে তাকে কখনও স্বপ্ন দেখায় নি, তা নয়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার কাছে প্রেম-ট্রেম নিছক ছেলেমানুষি বা ন্যাকামি বলে মনে হয়েছে। শুধু একটি ছেলেকে দেখে একদিন তার বুকের ভেতর ঝড় উঠেছিল। তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ কেটে গেছে আফ্রোদিতির। জুটে গেছে অনেক বন্ধু। জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছিল, অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সবাই মিলে। এমন সময় কলাভবনের সামনে দিয়ে হেঁটে আসছিল ছেলেটি। মনে হলো কাউকে যেন খুঁজছে। এদিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় আফ্রোদিতির সঙ্গে। হৃৎপিণ্ডের গায়ে ঘন্টাধ্বনি যেন শুনতে পায় দিতি। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর হতে পারে! ক’দিন পর ছেলেটিকে সে আবার দেখতে পেলো মধুর ক্যান্টিনে। পশ্চিম দিকের এক টেবিলে ঘিরে ছেলেটি আরও ক’জন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে চা খাচ্ছে। পরদিন আবার তাকে দেখা গেল একই জায়গায়। দেখে-দেখে তৃষ্ণা আরও বেড়ে যায় দিতির। রোজ একটা বাজলেই সে ছুটে আসে মধুর ক্যান্টিনে ছেলেটিকে এক নজর দেখার আশায়।

খোঁজ নিয়ে জানতে পেলো, ছেলেটির নাম রাজু। ওদের চেয়ে কিছুটা সিনিয়র। মৃত্তিকা-বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র। রাজনীতি করে। তারপর থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রঐক্যের মিছিল আসছে শুনলেই সে দৌড়ে যেতো। দেখতো মিছিলে স্লোগান দিচ্ছে রাজু। ছাত্র সভাগুলোর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। যদি সেখানেও রাজুকে দেখা যায়! মধুর ক্যান্টিনে রাজুর পাশে বসা মেয়েদের দেখে খুব হিংসে হতো দিতির। ভাবতো, কেন সে আমার দিকে একবার তাকায় না। আমি ওর পাশে বসা মেয়েদের চেয়ে কম কিসে? শিক্ষা, রূপ- কী নেই আমার? তখনি মনে হতো, সে পিছিয়ে গেছে, দেউলে হয়ে গেছে ওদের কাছে। কারণ, সে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। রাজুর পাশে বসতে হলে তাকে রাজনীতি জানতে হবে। রাজনীতি সে কখনও করেনি, এমন নয়। কলেজ জীবনে একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে নামকাওয়াস্তে যুক্ত ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে ঘৃণা জন্মায়। কোন ভদ্র পরিবারের ছেলে যে রাজনীতি করে সেটা রাজুকে না দেখলে বিশ্বাস করতো না কিছুতেই। এখানে এসে জেনেছে ছাত্রীদের মিছিলে বর্বর হামলা চালানো হলেও এর বিচার নেই। প্রভাবশালী ছাত্রনেতারা সরাসরি চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত। অস্ত্রের ব্যবহার করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য কায়েমের জন্য। সেখানে সে রাজনীতির ভালো কোন দিক আছে জানবে?

একদিন আফ্রোদিতির সুযোগ হলো রাজুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার। মধুর ক্যান্টিনে নির্দিষ্ট আসনে সেদিন একা বসে ছিল রাজু, চেয়ার টেনে বললো আফ্রোদিতি, বসতে পারি? বসুন। অনুমতি পেয়েই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করলো আফ্রোদিতি। আপনি ছাত্র রাজনীতি করেন কেন? মৃদু হাসি ফুটে উঠলো রাজুর মুখে। দেশ ও জাতির প্রতি একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে আমার কিছু কর্তব্য আছে, তাই। কথাটা মেনে নিতে পারলো না দিতি। কিন্তু দেশ ও জাতির নামে চলছে চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাস। আমার তো মনে হয় আইন করে ছাত্র রাজনীতি তুলে দেয়া উচিত।

জবাবে গম্ভীর হয়ে গেল রাজু। তারপর ধীরে ধীরে বললো— আমি আপনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছি। মাথাব্যথা হলে যেমন কেউ মাথা কেটে ফেলে না, তেমনি নোংরামি থাকলেই ছাত্র রাজনীতি বাদ দেয়া যায় না। খুঁজে বের করতে হবে মাথাব্যথার কারণ কি। নোংরামির উৎস কি? ছাত্র রাজনীতি আমাদের গৌরব, কিন্তু কায়েমি স্বার্থবাদী মহল আজ ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করে তুলছে যাতে এর ক্ষতিকর দিক দেখিয়ে একে বন্ধ করে দেয়া যায়। তাহলেই তারা অবাধে লুটতরাজ চালাতে পারবে। পুরো দেশ হয়ে যাবে তাদের শোষণের প্রাইভেট লিমিটেড।

রাজুর এই বিশ্লেষণ শুনে সেদিনের মতো রণে ভঙ্গ দেয় আফ্রোদিতি। ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে প্রতিটি বাক্য তাকে ভাবিয়ে তোলে। আবার একদিন পাকড়াও করে রাজুকে। তারপর থেকে প্রায়ই তাদের দেখা হতো টিএসসিতে, কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির সিঁড়িতে, আজিজ সুপার মার্কেটের বইপাড়ায়। চেহারায় যেমন সুদর্শন, চিন্তার দিক থেকেও একেবারে অন্যরকম রাজু। তাকে মহান মুক্তি সংগ্রামে ছাত্রনেতাদের আত্মত্যাগের কথা শোনায়। ছাত্র রাজনীতি শুধু অস্ত্রবাজ, ধান্দাবাজ, আর চাঁদাবাজই তৈরি করে না, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এমন কিছু মানুষ যারা এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি সংগ্রামে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। আজাদ, মতিউর, কাদের, শাহাদাত, রুবেল, আসলাম, তাজুল— এসব নামের শহীদ ছাত্রনেতারা আফ্রোদিতির আপনজন হয়ে ওঠে। তাদের মতো একজন বীর হিসেবে সে রাজুকে তার মনের আসনে বসিয়ে দেয়। শুধু কিছু কথা বলি-বলি করেও আর বলতে পারে না।

একদিন শুনতে পায় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে দুই শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন আধিপত্য কায়েমের জন্য অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এর প্রতিবাদে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের জন্য আত্মনিবেদিত রাজু গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছে। গড়ে উঠেছে সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্য। প্রতি বছর তার মৃত্যুবার্ষিকীতে সে যে জায়গায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সেখানে একটা ফুলের তোড়া দেখা যায়। কেউ জানে না, আফ্রোদিতির না বলা কথাগুলো এই ফুলের মধ্যে ভাষা খুঁজে পায়। আফ্রোদিতি এখন সরাসরি রাজনীতি করে না। কিন্তু মানুষের প্রতি ভালবাসার যে রাজনীতি রাজু তাকে শিখিয়ে গেছে তার প্রতি সে বিশ্বাস হারায়নি। হাওড় করাইয়ার কৃষকদের প্রতি তাই সে দরদ অনুভব করে। গল্পের বাকি অংশ এক রাতেই শেষ করার জন্য সে বড় চাচার প্রতি দাবি জানায়।

সারা দুপুর ঘুমিয়ে রাত জেগে গল্প শোনানোর জন্য বড় চাচা তৈরি হয়েই ছিলেন। রাত গভীর হলে গত রাতের মতোই আফ্রোদিতির চোখে দৃশ্যকল্প তৈরি হতে থাকে।

৩.
ফজরের আজান কানে যেতেই ধরমড় করে উঠে বসলো আফ্রোদিতি। তারপর মুখ ধুয়ে নাস্তা করার পরও গল্পের ঘোর কাটে না। কিন্তু বড় চাচা একেবারেই স্বাভাবিক। তাকে দেখে কে বলবে এই লোকটা সারা রাত জেগে গল্প বলেছে। তিনি একটা মাইক্রোবাস নিয়ে আসেন। ওই গাড়িতে চড়ে আফ্রোদিতি গ্রামের বাড়িতে যাবে। তার মানে গ্রামের রাস্তা এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল। মাইক্রোবাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে সে আবার গল্পের জগতে ফিরে যেতে চাইলো, তারপর কি হলো বড় চাচা?
কেন, কার আবার কি হলো?

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012April/0020120403182849.jpgবড় চাচার বিস্ময়ের জবাবে আফ্রোদিতি বললো, হাওড় করাইয়ার কৃষক বিপ্লবের।
আবার স্মৃতির গহনে ডুব দিলেন বড় চাচা, কি আর হবে। বিপ্লব-টিপ্লব কিছু হয়নি। একাত্তরে কয়েকজন কৃষক শহীদ হলেন। কয়েকটি পরিবার ধ্বংস হলো। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়েছিল সমন্বয় কমিটির যেসন নেতা, সেই রায়হান আর সুনীলের সম্পৃক্ততা শেষ হয়ে গেল একাত্তরেই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরকালে সমন্বয় কমিটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই কৃষক আন্দোলনটিকে অর্থনীতিবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা সমন্বয় কমিটি বাদ দিয়ে প্রকাশ্য সংগঠন গড়ে তোলে। রায়হান দল পাল্টায়। যোগ দেয় আফাজউদ্দিনের দলে। হাওড় করাইয়ার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছাত্রনেতারাও যার-যার ব্যক্তিগত ধান্ধায় বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোন কোন কৃষক নেতা পরবর্তীকালে সমাজে টাউট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর ককটু মিয়া? দিতির এ প্রশ্নের জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন বড় চাচা— ওর কথা বলে আর কি লাভ? ছিল ভূ’মিপুত্র। অসহায় কৃষকদের মধ্যে নেতা গোছের লোক। সমন্বয় কমিটি তার ভেতরের আগুন উস্কে দিয়েছে। মওলানা ভাসানী তাকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত করে তুলেছেন। সাধারণ এক কৃষক কটু হয়ে গেছে বীর কটু মিয়া। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই কটুও পাল্টে গেল। হাওড় করাইয়ার দূরন্ত সাহসী লোকটা আর দিকনির্দেশনা পেল না কারও কাছে। রাজনৈতিক নেতারা তখন হাওড়ের দিক থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কৃষকের দখল করা জমি আবার চলে গেল কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতে। একটা ট্রাজেডি লক্ষ্য করেছিস?

কী? বর্ণনার ভঙ্গিতে বললেন বড় চাচা— সারাদেশে কৃষকেরা যখন জমিদারের শাসনে নিষ্পেষিত ছিল, করাইয়ার কৃষকরা তখন মুক্ত। আর যখন সারাদেশ মুক্ত হলো জমিদারি ব্যবস্থার উচ্ছেদে তখনি করাইয়ার কৃষকরা বাধা পড়লো ওয়াকফের শৃঙ্খলে। আবার যখন পাকিস্তানিদের ঔপনিবেশিক শাসনে অবরুদ্ধ ছিল দেশ তখন হাওড় ছিল কৃষকের দখলে। আরি এক নদী রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা লাভের পর কৃষকরা হারালো হাওড়ের অধিকার।

তো যা বলছিলাম, লোকমুখে শুনেছি এরপর কটু মিয়া গ্রাম্য টাউটে পরিণত হয়ে গেছে। গোষ্ঠীগত বিরোধের জের ধরে একদিন রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যায় সে।
 
অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারে না আফ্রোদিতি। কেন যেন বারবার আজ চোখের সামনে রাজুর চেহারা ভেসে উঠছে। রাজু বলেছিল বছরের পর বছর এ দেশের মাটি আর মানুষ আগুন চাইছে। বিপ্লবের আগুন। আন্দোলনে, অভ্যুত্থানে মাঝে মধ্যে তা জ্বলেও উঠছে। কিন্তু আগুনের পিপাসা কারও মিটছে না। বিশেষ করে এ দেশের ভুখানাঙা কৃষকেরা বহুদিন ধরে আগুনের জন্য পিপাসার্ত। তুমি যদি কৃষকের এই সংগ্রাম নিয়ে কোন ছবি বানাতে পারো তবে তার নাম রেখো ‘আগুন পিপাসা’। ওকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বড় চাচা বললেন— কিরে, কথা বলছিস না যে, ঘোরের মধ্যে আফ্রোদিতি জিজ্ঞেস করলো, হাওড় করাইয়া কতদূর চাচা? বড় চাচা বললেন, খুব দূরে নয়। বাড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে। তবে অন্যপথে কিছু দূরে যেতে হয়।

আফ্রোদিতি সরজমিন হাওড় দেখতে চাইলো। কিন্তু বড় চাচার হাতে এত সময় নেই। তিনি অন্য কোন দিন হাওড় ঘুরে দেখাবেন বলে জানালেন। শেষপর্যন্ত স্থির হলো হাওড়ে কৃষক আন্দোলনের হেড কোয়ার্টার বৃন্দাবনপুরের নলিনী দেবের বাড়ি ঘুরে যাবে তারা। সেখানেই আফ্রোদিতি দেখে যাবে তার টেলিফিল্মের সম্ভাব্য লোকেশন ও শুটিং স্পট। তবে বৃন্দাবনপুর গ্রামে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। বড় চাচার কাছে শোনা গল্পে জেনেছিল বৃন্দাবনপুর গ্রামটি হাওড়ের কাছাকাছি। সে কারণে বেশ দুর্গম ছিল। কিন্তু এখন সেখানে নাগরিক আবহ। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাড়িঘরে পর্যন্ত আধুনিকতার ছোঁয়া। এ ব্যাপারে বললেন বড় চাচা, স্বাধীনতার পরে এই এলাকায় রাস্তাঘাটের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। হাওড় এলাকারও পুরনো মানুষদের বংশধররা কেউ মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে টাকা কামিয়েছে না হলে শহরে গিয়ে ভিক্ষা করছে। এ দেশের প্রতিটি ব্যর্থ কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে হাওড় করাইয়ার কৃষক আন্দোলনের মিল আছে। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা নেতারা সরে পড়ার পর আন্দোলনের মূল শক্তি যে ভূমিহীন কৃষক সমাজ তারা এক টুকরা জমিরও মালিক হতে পারেনি। এবারের মুখ খুললো আফ্রোদিতি স্বাধীনতার পর কৃষকের পক্ষে কি কারও কিছু করার ছিল না?

হ্যাঁ, করেছে। বললেন বড় চাচা, মস্কোপন্থিরা ক্ষেতমজুর সমিতির নামে আবার কৃষকদের সংগঠিত করেছে। আশির দশকে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি এক শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে। একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে আমিও ওদের সঙ্গে যুক্ত হই। হাওড়ের পথে পথে হেঁটে আবার কৃষকদের জমি দখলে উদ্বুদ্ধ করি। শুধু জমিদারের ওয়াকফ করা ভূমি নয়। সেখানে প্রচুর খাসজমিও আছে। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকারের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প আমাদের আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়। এ সময় আবার পার্টির ভেতরে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশেও কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে যায় এবং বাম শিবিরে হতাশা দেখা দেয়।

কথা বলতে-বলতেই তাদের গাড়ি নলিনী দেবের বাড়িতে প্রবেশ করে। বড় চাচা বলে চলেন, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখার কারণে নলিনী দেবের এই বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বেশ অভাবগ্রস্ত হয়েই মারা গেছেন নলিনী বাবু। তবে তার ছেলে অনেক কষ্ট করে আবার দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু অর্থবিত্তও করেছে। কমরেড সুনীল বিয়ে করেছিল নলিনী বাবুর মেয়ে জলিকে। আরেক মেয়ে ডলির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে রায়হানের। বিপ্লব করতে না পারলেও বিপ্লবী দুই নেতা নলিনী বাবুর পরিবারকে সামাজিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বড় চাচার কথা শুনে শুনে বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল আফ্রোদিতি। টিনের চাল দেয়া পাকা ঘর। বেশ বড় উঠোন। কিন্তু বাড়িতে খুব লোকজন আছে বলে মনে হলো না। ভেতর থেকে কিশোরী কণ্ঠে রিনরিনে গলায় কেউ কথা বলে উঠলো। হয়তো গাড়ির আওয়াজ পেয়েছে। গলা উঁচিয়ে বড় চাচা ডাক দিলেন, কে রে মা, শিউলি নি। দরজা খুলে বেরুলো একটি মেয়ে। বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে। রুগ্ণ। হাতে লাঠিভর দিয়ে হাঁটছে।

রফিক কাকু আইছইন নি? কতদিন বাদে আইলা। বড় চাচা পরিচয় করিয়ে দিলেন ওকে আফ্রোদিতির সঙ্গে। সে জানলো ওই কিশোরী সুনীল লোহ আর জলির মেয়ে। নাম শিউলি। প্রতিবন্ধী এই মেয়েটি হাওড় করাইয়ার সেই কৃষক আন্দোলনেরই ফসল। সুনীল লোহ মারা গেছেন অনেক দিন হয়। মেয়েটি জন্ম থেকে মামাবাড়িতেই বড় হয়েছে। মেধাবী ছাত্রী হলেও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় বেশিদূর এগোতে পারেনি। তবে কবিতা লেখার চেষ্টা করে। বৃন্দাবনপুরে নলিনী দেবের বাড়ি থেকে ফেরার পথে ভাবে আফ্রোদিতি, বিপ্লবটা আসলে কি? নলিনী দেবের মতো স্বপ্ন, নাকি শিউলি লোহর মতো বাস্তবতা! সেটা কি আগুন পিপাসা? রাজু বলেছিল, তার টেলিফিল্মের নাম যেন রাখা হয়— ‘আগুন পিপাসা। ’ এদেশের বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষরা আগুনের জন্য পিপাসার্ত। তাদের সেই পিপাসার ছবি সে কি পারবে তার টেলিফিল্মে তুলে ধরতে। আফ্রোদিতি জানে, সেন্সর বোর্ড অনেক সময় যৌনউত্তেজক ভালগার ছবিকে মুক্তি দেয় কিন্তু সত্য কথার ওপরে চালায় কাঁচি। সে হাওড় করাইয়ার উপাখ্যানে আগুন পিপাসার মতো নিগূঢ় সত্য তার টেলিফিল্মে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। হয়তো পারবে। হয়তো পারবে না। পারা-আর না পারার মধ্য দিয়েই তো বহমান মানুষের জীবন।

বাংলাদেশ সময় ১৬৪৫, এপ্রিল ৩, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।