ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

কৃষি

মিষ্টি কুমড়া চাষে দারিদ্র্য জয়

আবু খালিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৭ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
মিষ্টি কুমড়া চাষে দারিদ্র্য জয় ছবি: কাশেম হারুন- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

তিস্তা নদীর পাড় (রংপুর থেকে): তিস্তার কোল ঘেঁষে মাছ ধরার নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন ৬৫ বছর বয়সী প্রফুল্ল চন্দ্র বর্মণ। জৈষ্ঠ্যের খরতাপকে তোয়াক্কা না করে খালি গায়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত তিনি।

ক’দিন আগে এই তিস্তার বুকে জেগে উঠা চরে মিষ্টি কুমড়া চাষ করে বর্ষা মৌসুমের খোরাকের পুঁজি ঘরে তুলেছেন তিনি। এখন এক-দুইটা মিষ্টি কুমড়া হাঁটে তুললেই ব্যাগ ভর্তি আসে বাজার। বাড়তি মূলধন হিসেবে রয়েছে গত বছরের মিষ্টি-কুমড়া বিক্রির টাকায় কেনা গরু।

সব মিলিয়ে অভাব বা দারিদ্র্যকে বিদায় দিয়েছেন প্রফুল্ল। তার প্রমাণও পাওয়া গেলো হাসিখুশি ও নির্ভার প্রফুল্ল বর্মণের অভিব্যক্তি আর ভাষায়। স্বল্প আয়ের এই মানুষটিকে এক সময়ে অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে অন্যের দুয়ারে হাত পাততে হয়েছিলো। এখন সেদিন বদলে গেছে।

আলাপকালে কৃষক প্রফুল্ল জানালেন, গত বছরের মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন। এখন ৪০ হাজার টাকা দাম বলছে। ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করবেন। এভাবেই প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নতুন ঘরও তুলেছেন বসতভিটায়।

মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করে এতো সফলতা কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্ন ছুড়তেই কিছুটা জোর করেই প্রমাণ দেখাতে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। ভিটার একটি ঘর দেখিয়ে প্রফুল্ল বললেন, ‘আগোত একঘরে নামোত (নিচে) থাকুছু (থাকতাম), তিন বছরে আরও দুইখান ঘরও দিছু। ’ এমন কথা বলতেই তৃপ্তির হাসিও ফুটে উঠলো তার চোখে-মুখে।

রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষে তালকুশাহবাজ গ্রামসহ আশেপাশের এলাকায় ভূমিহীন মানুষদের মিষ্টি কুমড়া চাষের সফলতা না দেখলে বুঝে উঠা বেশ কঠিন। সামান্য সহযোগিতা পেলে ভূমিহীন ও নদী ভাঙনের শিকার মানুষেরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন তার চিত্র এখন তিস্তার পাড়ে গেলেই বোঝা যাবে।

স্থানীয় অপর এক কৃষক মো. মুক্তার আলী জানালেন, নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সহায় সম্বল সবই হারিয়েছেন। মূলধন বলতে শরীরটাই। ধু- ধু বালুচরে যেখানে কোনো দিন ফসল ফলেনি, সেখানে সফলতার সঙ্গে মিষ্টি কুমড়া চাষ করছেন তিনি।

তারা একটু সহযোগিতা পেলে অনেক কিছু করতে পারেন বলেও জানান তিনি।

মিষ্টি কুমড়া চাষে দারিদ্র্য জয়ের গল্প আরও বিস্তৃত হলো এলাকার ২০ জনের মতো ভূমিহীনদের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, তিস্তার বালুচরে মিষ্টি কুমড়ার পাশাপাশি পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী ফসলের চাষ করে তারা প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটান।
 

রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার পূর্বদিকে কয়েক কিলোমিটার হাঁটা দিলেই তিস্তার পাড়ে এসব কৃষকের চিত্র দেখা যাবে। সরেজিমনে গিয়ে দেখা যায়, ভালো দামের আশায় ঘরের কোণে চাষিরা সাজিয়ে রেখেছেন অসংখ্য মিষ্টি কুমড়া। ঘরের এক কোণে মিষ্টি কুমড়া আরেক কোণে গরু। আবার কোনো বাড়িতে দেখা যায়, এক কোণে মিষ্টি কুমড়া অন্য পাশে নিজেদের থাকার জায়গা। এভাবেই মিষ্টি কুমড়ার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে তাদের।  

ভূমিহীন কৃষক ভোলা রাম জানালেন, যখনই টাকার প্রয়োজন হয়, তখনই বাজারে গিয়ে মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করেন। এতে সংসারের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়। বর্ষা মৌসুমে তাদের কাজের সুযোগ কম থাকে। আগে এই সময়ে অভাব আর অনটনের সঙ্গে লড়াই করে সময় পার করতে হতো। এখন বর্গা নেওয়া জমিতে মিষ্টি কুমড়া চাষ করে পাল্টে গেছে দিন।

অধিকাংশ চাষিই মিষ্টি কুমড়া বিক্রি করে একটি গরু কিনেন। এরপর বছর শেষে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেন। এভাবে গত তিন চার বছর ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিস্তা পাড়ের কৃষকেরা। খেয়ে-দেয়ে দিন পার হলেই তারা খুশি। এটাই যেন ভালো থাকা-সুখে থাকা।

খুব বেশি চাহিদা নেই ভূমিহীন এসব মানুষের। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধে এদের একটাই চাওয়া অন্যের কাছে যেন হাত পাততে না হয়। সেই পূর্ণতা পাওয়াতেই তারা খুশি।

গঙ্গচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামের সামছুল ইসলাম জানান, শুষ্ক মৌসুম এলেই দলভিত্তিক তারা তিস্তার চরে নেমে যান এই মিষ্টি কুমড়া চাষে। পরিবারের সবাই মিলে যত্ন নেন ফলটির। এতে কাজও তাদের জন্য অনেক সহজ হয়।

এসব চাষিরা জানান, চরের বুকে এভাবে মিষ্টি কুমড়া চাষের সব ধরনের সহযোগিতা করছে বেসরকারি উন্নয়নমূলক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিকেল অ্যাকশন। চাষের যাবতীয় কলাকৌশল শেখানো হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে।

সংস্থাটির এক্সট্রিম পোভার্টি প্রোগ্রামের টেকনিক্যাল অফিসার (কৃষি) মো. মিজানুর রহমান জানান, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বীজসহ থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের উপকরণ দিয়ে সহযোগিতার ফলে ভূমিহীন এসব কৃষকেরা দ্রুত সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে পেরেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানালেন, কৃষকদের অর্ধেক আর বেসরকারি ওই সংস্থার অর্ধেক এই দুই মিলে শতভাগ বিনিয়োগেই অনাবাদী চরে ফসল ফলিয়ে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি মেলেছে ভূমিহীন শত শত পরিবারের।

২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের নদী ভাঙন কবলিত এলাকার এক হাজার চাষির জীবন মান উন্নয়নে সিকিউরিং ওয়াটার ফর ফুড প্রোজেক্ট অব ইউএসএআইডি বাজারভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে একটি বাণিজ্যিক মডেল তৈরিতে কাজ করছে। এতে টেকসই ফসল উৎপাদনও সম্ভব হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০২৩৭ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৬
একে/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।