ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

এইডস সম্পর্কে জানা-অজানা

ডা. মালিহা শিফা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১২
এইডস সম্পর্কে জানা-অজানা

AIDS বা Aids এর পূর্ণ অভিব্যক্তি হলো Acquired immunodeficiency syndrome বা acquired immune deficiency syndrome । এইডস হলো এক ধরণের ব্যধি, যাকে মরণব্যধিও বলা হয়।



Human immunodeficiency virus বা HIV নামক ভাইরাস এই রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। HIV এমনই ভয়ংকর জাতের ভাইরাস যে এ ভাইরাস মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করার পর তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। ফলে HIV আক্রান্ত রোগী যে কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং যা তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।

এইডস একটি মরণব্যাধি হওয়ায় এ সম্পর্কে মানুষের রয়েছে ব্যাপক ভীতি। এর বিপরীতে তেমনি রয়েছে ব্যাপক অজ্ঞতাও। আর এ অজ্ঞতার ফলে এইচআইভি বহণকারী ব্যক্তি বা এইডস আক্রান্ত রোগীকে একইসঙ্গে সামাজিকভাবেও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ হয়। এইডস সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে এবং অযৌক্তিক ঘৃণার কারণে দুঃখজনক আর অমানবিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবন দিতে হয়েছে অনেক এইডস রোগীকে।

কিন্তু বাস্তব হল, এইচআইভি ছোঁয়াচে নয় এবং শুধুমাত্র স্পর্শের মাধ্যমেই এইচআইভি এক শরীর থেকে অন্য শরীরে স্থানান্তরিত হতে পারে না। এ বিচারে, এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তি অন্য সাধারণ ব্যক্তিদের মতোই স্বাভাবিক আচরণ প্রত্যাশা করতে পারেন।
 
HIV যেভাবে ছড়ায়
HIV বহনকারী কোনো ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য কোনো ব্যক্তির শরীরে HIV প্রবেশ করালেই কেবল HIV ছড়াতে পারে। HIV বহনকারী ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য স্বাভাবিক কোনো ব্যক্তির শরীরে HIV প্রবেশের কয়েকটি মাধ্যম রয়েছে:

১। HIV বহণকারী ব্যক্তির সঙ্গে অরক্ষিত অবস্থায় স্ত্রী যোনী বা মলদ্বার বা মুখে যৌন সম্ভোগ করলে।

২। HIV বহনকারী ব্যক্তির শরীরের রক্ত অন্য কোনো শরীরে প্রবেশ করালে।

৩। HIV বহনকারী ব্যক্তির ইনজেকশনের সিরিঞ্জ যা এইচআইভি বহণ করছে তা ব্যবহার করলে।

৪। HIV বহনকারী মা যখন সন্তান সম্ভবা হন অথবা সন্তান জন্মদানের সময়ে অথবা সন্তানকে দুধ পান করানোর মাধ্যমে শিশুর শরীরে HIV অনুপ্রবেশ করতে পারে।

৫। HIV বহনকারী কোনো ব্যক্তির ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্রে যদি সংক্রামক রক্ত লেগে থাকে এবং তা ব্যবহারের ফলে যদি শরীরের উন্মুক্ত বা কাটাছেড়া ত্বকের সংস্পর্শে আসে।

কি কি উপায়ে এইডস ছড়ায় না
এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তির সঙ্গে যে সকল সম্পর্ক করলে এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে না তা হলো:

১। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তি কারো শরীরের উপর হাঁচি, কাশি দিলে, চোখের জল, থুথু বা ঘাম ফেললে, নাক ঝাড়লে

২। হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি, স্পর্শ, চুমু কিংবা কথা বললে
৩। একই পুকুর, গোছলখানা, পায়খানা, তোয়ালে, লুঙ্গি, গামছা ব্যবহার করলে
৪। একই থালা-বাসন, কাপ-পিরিচ, তৈজসপত্র ব্যবহার করলে
৫। একই আসবাবপত্র ব্যবহার করলে
৬। এইচআইভি বহনকারী ব্যক্তির রান্না করা খাবার খেলে
৭। মশা,মাছি বা পোকামাকড় কিংবা পশুর কামড়ে
৮। একই বিছানা ব্যবহার করলে, একই বাড়িতে অবস্থান করলে
৯। একই টেলিফোন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ব্যবহার করলে
১০। এইচআইভি মুক্ত সিরিঞ্জ ব্যবহার করে রক্তদান করলে

চুমু দিলে কি এইচআইভি ছড়ায়?

এইচআইভিতে স্নেহ পদার্থের আবরণ (envelop) থাকায় এইচআইভি অত্যন্ত ভঙ্গুর। ফলে এরা শরীরের বাইরে বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে না। শরীরের অধিকাংশ ক্ষরিত তরলেই এইচআইভি থাকে। কিন্তু এর আয়ুষ্কাল কম হওয়ায় রক্ত বা যৌন মিলনের মাধ্যমে সরাসরি শরীরে প্রবেশ করতে না পারলে সংক্রমনের তেমন আশংকা নেই। তাই এইচআইভি বহনকারী রোগীকে চুমুও দেয়া যায়।

তবে চুমু দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ কিস বা Deep Kissing পরিহার করা উচিত।

যদিও ফ্রেঞ্চ কিসিংয়ের মাধ্যমে এইচআইভি ছড়ানোর তেমন রেকর্ড নেই। তার পরও যেহেতু শরীরের অধিকাংশ তরল ক্ষরণেই এইচআইভি থাকে তাই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে যদি কোনো কাটা-ছেড়া, ঘা বা ক্ষত থাকে তবে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে।

আর উভয়েরই যদি মুখে কাটা-ছেড়া, ঘা বা ক্ষত থাকে তবে বিপদের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। তাই এইচআইভি বহণকারী ব্যক্তিকে যদিও চুমু দেয়া যায় তবুও ফ্রেঞ্চ কিস দেয়া থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।

কারও নিজের শরীরে এ ভাইরাস পাওয়া গেলে

●মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে সহজভাবে এর মোকাবেলা করতে হবে

●দুশ্চিন্তা এড়িয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে
●এসময় ভালো থাকার জন্য ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে
●পুষ্টিকর ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে
● নিজের টুথব্রাশ, রেজার, ব্লেড, ক্ষুর অন্যকে ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না
● স্বাভাবিক কাজকর্ম, বিশ্রাম ও প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে।
● যৌন মিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করতে হবে
● মহিলাদের ক্ষেত্রে বাচ্চা নিতে চাইলে বা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে চাইলে সন্তান আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে চিকিত্সকের পরামর্শমত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

এইডস প্রতিরোধে করণীয়

● ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এইডস প্রতিরোধের অন্যতম উপায়। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে। শুধু বিশ্বস্ত একজন স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখতে হবে। একাধিক যৌনসঙ্গী পরিহার করতে হবে।
● যৌনসঙ্গীর এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে যৌন মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে, অথবা নিয়মিত ও সঠিকভাবে কনডম ব্যবহার করতে হবে।
● শরীরে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহণের প্রয়োজন হলে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে, সে রক্ত বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এইচআইভি নেই।
● একবার ব্যবহার করা যায় এমন জীবাণুমুক্ত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করতে হবে।
● পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সুচ, সিরিঞ্জ বা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের আগে নিশ্চিত জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
● দেখা গেছে, যৌনরোগ বা প্রজণনতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কারও যৌনরোগ বা প্রজণনতন্ত্রের সংক্রমণ থাকলে দ্রুত চিকিত্সা করাতে হবে।
● জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রতিরোধমূলক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

এইডসের কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। এর যে চিকিত্সা বের হয়েছে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাছাড়া এ চিকিত্সা শুধু এইডস ‌আক্রান্তের সময়কে বিলম্বিত করে। এইডস পুরোপুরি নিরাময় করে না।

তাই, এখন পর্যন্ত এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো- এইডস সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা এবং সে অনুযায়ী সচেতন হয়ে নিরাপদ জীবনযাপন করা। এক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স অফিসার, প্রধান কার্য্যালয়, মেরিস্টোপস ক্লিনিক

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, ১৪ জানুয়ারি, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।