ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

এখনও প্রস্তুত নয় হাসপাতালগুলো

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২০
এখনও প্রস্তুত নয় হাসপাতালগুলো

ঢাকা: বাংলাদেশে শুধু আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের স্বল্পতাই নয়, সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি, জনবল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামেরও (পিপিই) ঘাটতি রয়েছে। এমনকি প্রস্তুত হয়নি হাসপাতালগুলো। 

বিশেষজ্ঞদের দাবি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হাসপাতাল প্রস্তুত, সংক্রমণ শনাক্তরণ পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি প্রস্তুত, চিকিৎসক, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা সময়ের ব্যাপার।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভাইরাস (কভিড-১৯) ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে এটি মোকাবেলা করার সক্ষমতা বাংলাদেশের থাকবে না।

সার্বিকভাবে হাসপাতালগুলো এখনো করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়নি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), টেস্ট কিট এখনও পর্যাপ্ত নয়।  প্রয়োজন মতো আইসিইউ নেই, ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও আমাদের নেই। ’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিমাণ রোগী আছে, সেই রোগীদেরই কোনো রকমে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ মানুষ যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে এই সংখ্যা কত বড় হবে। এটা চিন্তা করলেই বোঝা যায়। তবে বিশাল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে বাংলাদেশের হাসপাতালে জায়গা দেওয়ার অবস্থা থাকবে না। এর সমস্ত দায়িত্ব আইইডিসিআরকে নিতে হবে। পাশাপাশি সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘করোনা ভাইরাসে (কভিড-১৯) আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসায় নেয় এমন ৬০ বছরের অধিক বয়সীদের মধ্যে যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকেন তাদের ক্ষেত্রে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) ও ভেন্টিলেশন সাপোর্টের দরকার হয়। ’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। এর বাইরেও শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুর মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে রিজেন্ট হাসপাতাল উত্তরা ও মিরপুর, যাত্রাবাড়ীর সাজেদা ফাউন্ডেশন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ১০টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ৮টি, উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি, মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে ৩টি এবং যাত্রাবাড়ীর সাজিদা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ৫টি শয্যা। তাছাড়া, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে অতিরিক্ত ১৬টি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ৮টি ভেন্টিলেটর মেশিন বসানোর কাজ চলছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর বাইরে ঢাকা মেডিকেল, মুগদা জেনারেল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী ও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতালেও শয্যা রাখতে বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি ৬৫৪টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যা আছে ৪৩২টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩২২টি এবং বাকি ১১০টি সারাদেশে। এ ছাড়া রেজিস্টার্ড প্রাইভেট হাসপাতাল আছে ৫ হাজার ৫৫টি। এগুলোয় আইসিইউ বেড আছে ৭৩৭টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৪৯৪টি এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বাকি ২৪৩টি শয্যা রয়েছে।

কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের আট বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৪ হাজার ৫১৫টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে এগুলোয় আইসিইউ সুবিধা নেই। এমনকি এখন পর্যন্ত আইসিইউ সুবিধা প্রস্তুত হয়নি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক আইইডিসিআরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বড় বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ আছে। যে প্রতিষ্ঠানে ১০টি আইসিইউ আছে, সেখানে আমরা তিনটি করোনা রোগের জন্য বরাদ্দ রাখতে বলেছি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ৫০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে। আরো সাড়ে ৩০০ আসছে। প্রাইভেট সেক্টরে ৭০০ ভেন্টিলেটর মেশিন আছে। ’

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যে যদি করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর অল্প সংখ্যক আইসিইউতে রোগী ভর্তি নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। এই সংকটপূর্ণ মুহূর্ত কাটিয়ে ওঠার জন্য ঢাকাসহ দেশের সরকারি হাসপাতালোতে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল। করোনা মোকাবিলায় আড়াই মাস সময় পেলেও হাসপাতালগুলো এখনও প্রস্তুত নয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আইইডিসিআরের পাশাপাশি আইপিএইচ, চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস হাসপাতালে পরীক্ষা করা হচ্ছে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা শিশু হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করা শুরু হবে।  

এছাড়া শিগগিরই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ, আর্ম ফোর্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে এই টেস্ট করা যাবে।  

৩১ মার্চের মধ্যে ১ লাখ কিট এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ১০ লাখ সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ পর্যন্ত ৫ লাখ পিপিই সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিনিয়তই দাতা প্রতিষ্ঠান থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩ লাখের অধিক বিতরণ করা হয়েছে। গত ২৭ মার্চ ৩০ হাজার টেস্ট কিট ও ২৯ মার্চ ৩ লাখ মাস্ক জেএসি এমএ ফাউন্ডেশন (আলি বাবা) থেকে পাওয়া গেছে।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৬৪ জেলার ২৬৪টি ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক ৭১০ জন চিকিৎসক ও ৪৩ জন নার্সকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যেকটি হাসপাতালে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় যেখানে কভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে রোগী পাবেন, তাদের বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবেন। পরে যেসব প্রতিষ্ঠানে নমুনা পরীক্ষা করা হয় সেখানে পাঠাবেন। ’

করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘প্রথমে আইসোলেশন রাখলেই হয়। অবস্থা যদি ক্রিটিক্যাল হয়, রোগী যদি ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুস জনিত নানান রোগে আক্রান্ত থাকেন, তখন ওই রোগীকে আইসিইউতে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়। এমন রোগীর সংখ্যা খুবই অল্প। ’

তিনি বলেন, ‘যাদের বয়স বেশি তাদের ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটর প্রয়োজন। সাধারণত যাদের বয়স কম, অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত নন, তাদের আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনে রাখার প্রয়োজন হয় না। ’

উল্লেখ্য, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ জন। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। এর মধ্যে ১৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আইইডিসিআরের হিসাবে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১ হাজার ৩৩৮ জনের।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০২০
পিএস/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।