ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য

সরকারি হাসপাতালে যেভাবে প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন

মাসুদ আজীম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯
সরকারি হাসপাতালে যেভাবে প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন ফাইল ফটো

ঢাকা: সিরাজুল ইসলাম নামে ২০ বছর বয়সী এক যুবক গত ৫ বছর ধরে পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন। হঠাৎ একদিন তার পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হলে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন তার রক্ত বমি ও পায়খানায় রক্তসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয় এবং তার জন্ডিস ধরা পড়ে। পরে সিরাজুলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক পর্যায়ে ২০১৭ সালে তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। তবে তার লিভার আক্রান্ত হওয়ার প্রকৃত কারণ জানা যায়নি।

সিরাজুলের বাবা পেশায় একজন পেশকার। তিনি আর্থিকভাবে ততোটা স্বচ্ছল নন।

২০১৭ সালে ছেলের লিভার সিরোসিস ধরা পড়লে ছেলেকে নিয়ে তিনি ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দেন। ছেলের লিভার প্রতিস্থাপন করাতে তার প্রয়োজন প্রায় দুই কোটি টাকা। এতে তিনি হতাশা হয়ে পড়েন। আশাহত হয়ে তিনি ছেলের চিকিৎসা না করেই দেশে ফিরে আসেন।
 
দেশে ফিরে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। পরে তিনি জানতে পারেন চলতি বছরেই বিএসএমএমইউ হাসপাতালে হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি হাসপাতালের বর্তমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে লিভার প্রতিস্থাপন করারও প্রস্তুতি নেওয়া হয়।
 
ঠিক এমন সময় আবার সিরাজুলের ৪৭ বছর বয়সী মা তার ছেলেকে আংশিক লিভার দানে সম্মত হন। পরে গত ১৫ জুন সিরাজুলকে হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. জুলফিকার রহমান খানের অধীনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর সোমবার (২৪ জুন) রোগীর মায়ের কাছ থেকে আংশিক লিভার সংগ্রহ করে তার ছেলের লিভার প্রতিস্থাপনের দিন ধার্য করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সোমবার  ভোর ৬টা থেকে লিভার প্রতিস্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়। এভাবেই দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বিএসএমএমইউতে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়। এর আগে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ল্যাবএইড হাসপাতালে দু’জন ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালে দু’জনেরসহ মোট চারজন রোগীর লিভার প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

জানা গেছে, প্রথমে ল্যাব এইড হাসপাতালে লিভার ডোনেট করার দুই মাস পর ডোনার মারা যান এবং একই হাসপাতালের দ্বিতীয় কেসে ডোনার রোগীর সঙ্গে রিলেটেড (রক্তের সম্পর্ক বাঞ্চনীয়) ছিল না। তাই পরবর্তীতে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। এছাড়া বারডেম হাসপাতালে সংঘটিত লিভার প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও বেশ জটিলতা ছিল।  

সব মিলিয়ে হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান জুলফিকারের মতে, এর আগের লিভার প্রতিস্থাপনের কেসগুলো প্রায় ৫০ শতাংশ সফল। তবে বর্তমানে বিএসএমএমইউতে যে লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়েছে তার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত জটিলতা নেই এবং হওয়ার সম্ভাবনাও খুব কম বলে জানান এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।   
 
চিকিৎসার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্রিপ্টোজেনিক লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত সিরাজুলকে প্রথমে এ্যানেসথেসিওলজিস্ট দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। এরপর রোগীর লিভার অপসারণ করা হয় এবং অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করা হয়। ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া লিভার প্রতিস্থাপন কার্যক্রম সম্পন্ন হয় রাত ১২টা। অর্থাৎ এক টানা ১৮ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় এ লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়। প্রায় ৫০ সদস্যের চিকিৎসক দল এ কার্যক্রমে অংশ নেয়। এর মধ্যে ভারতের প্রতিথযশা লিভার প্রতিস্থাপন সার্জন ডা. পি বালাচন্দ্র মেনন ও তার চিকিৎসক দলও ছিল।
 
জুলফিকার আরো বলেন, লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হওয়ার পর বর্তমানে লিভার দাতা রোগীর মা এবং রোগী আশানুরূপ সুস্থ আছেন। আপনারা সবাই দোয়া করবেন। চিকিৎসা পরবর্তী প্রথম সাতদিন নিবিড় পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার প্রয়োজন। আশাকরি রোগী ও তার মা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, স্বপ্ন, বাস্তবতা ও বাস্তবায়নের মেলবন্ধন ঘটাতে প্রধান সৈনিকের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসেন হেপাটোবিলিয়ারি, প্যানক্রিয়েটিক ও লিভার ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান জুলফিকার। অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে জটিল এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি বিনামূল্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।  

এর মধ্যে দিয়ে দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো লিভার প্রতিস্থাপন চিকিৎসাসেবা চালু হলো। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল আধুনিক, উন্নত, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে আরো একধাপ এগিয়ে গেলো। এটা আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক অর্জন ও শুভ সূচনা।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯
এমএএম/আরআইএস/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।