ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মনোকথা

আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়!

প্রফেসর ডা. সানজিদা শাহরিয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৫
আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়!

ঢাকা: আমাদের জীবনে এমন অনেক সময় আসে যখন আমরা বুঝে উঠতে পারি না, কী করবো বা কী করা দরকার। চিন্তার জায়গায় আমরা ব্লক ফিল করি।

এ সময়গুলোকে কাউন্সেলিংয়ের ভাষায় আমরা বলি, ব্লক ফিল করা। জীবনের মোড় সর্বনাশা অন্ধ কানাগলির বাঁকে আটকে গেলে এর চরম পরিণতি আত্মহত্যা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মতে, সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর এক মিলিয়ন মানুষ আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যায় একজন মানুষ তখনই প্ররোচিত হন বা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, যখন তিনি নিরাশার চরম আবর্তে নিক্ষিপ্ত হন।

তখন হয়তো তিনি এতটাই নিরাশার অতলে নিমজ্জিত থাকেন যে, অন্যের সাহায্য চাওয়ার অবস্থায়ও থাকেন না। কিন্তু আশার কথা হলো, যত লোক আত্মহত্যা প্রবণতায় তাড়িত থাকে, তারা কিন্তু কেউই প্রকৃতপক্ষে মরতে চান না। আসলে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তাকে আত্মহত্যার মঞ্চে নিয়ে যায়। এটি সত্যিই বলা কঠিন বা এক প্রকার রহস্যের ঘেরটোপে বন্দি।

তবে এটি সহজেই বোঝা যায়, ওই ব্যক্তির কাছে আর অন্য কোনো বিকল্প থাকে না। অবশ্যই সেটি তার দৃষ্টিতে। আত্মহত্যা একটি নেতিবাচক প্রচেষ্টা অসহ্য যন্ত্রণা থেকে বের হওয়ার।

মানুষ আসলে যন্ত্রণা, ক্ষোভ, লজ্জা থেকে মুক্তি পেতেই বিকল্প হিসেবে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আদৌ সেটি মুক্তির পথ নয়। বরং আরেকটি যন্ত্রণার পথে পথ চলা।

ওয়ার্নিং সাইন
আত্মহত্যার কথা যদি কেউ বলে বা আত্মাহত্যার প্রচেষ্টা করে তবে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে, হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, এটি শুধু সতর্কবার্তা নয়, তিনি যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তার সাহায্যের প্রয়োজন- সেই আর্তনাদ।

আত্মহত্যার কথা বলা
•    আমার যদি জন্মই না হতো।
•    যদি আর কখনও দেখা না হয়।
•    হয়তো আর দেখা হবে না।
•    আমার মরে গেলেই ভালো হতো।

প্রাণঘাতী সামগ্রী
ওষুধ, ব্লেড, ছুরি, বন্দুক ইত্যাদি যেকোনো বস্তু খোঁজা। যা দিয়ে আত্মহত্যা করা যায়।

মৃত্যু চিন্তা
•    অতিরিক্ত মৃত্যু চিন্তা, হিংস্রতা।
•    মৃত্যু নিয়ে লেখাপড়া করা।

ভবিষ্যত সর্ম্পকে নিরাশা
•    অসহায়, আশাহত ও নিজেকে খাঁচায় বন্দি (যেখান থেকে বের হবার পথ নেই) ভাবা।
•    ভালো কিছু আর কখনোই ঘটবে না, ভাবা।

আত্মগ্লানি, নিজেকে ঘৃণা করা
•    নিজেকে অযোগ্য, দোষী, লজ্জিত, অপদার্থ ভাবা।
•    নিজেকে বোঝা ভাবা (সবাই আমার থেকে ভালো)।

বিদায় সম্ভাষণ
•    অপ্রত্যাশিত দেখা করা বা ফোন করা পরিবার-পরিজনকে বা বন্ধুদের।
•    এমনভাবে বিদায় জানানো যেন আর দেখা হবে না।

নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলা
•    নিজেকে বন্ধু বা পরিবার সবার থেকে আলাদা করে ফেলা।
•    একা একা থাকার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া।
•    নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

আত্মধবংসাত্মক আচরণ
•    মদ ও মাদকের চর্চা।
•    অসাবধান ও ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল।
•    অনর্থক ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা।

হঠাৎ করে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া
•    প্রচণ্ড বিষণ্ণ থাকার পর যদি হঠাৎ করে দেখা যায়, যে কেউ শান্ত হয়ে গেছে ও খুশিখুশি দেখাচ্ছে। বুঝতে হবে, হয়তো ওই ব্যক্তি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ টিপস্
কারও মধ্যে ওয়ার্নিং সাইন দেখলে খোলাখুলি কথা বলুন।

যেভাবে শুরু করবেন
•    আমি আসলে কিছুটা দেরি করে ফেলেছি তোমার দিকে মনোযোগ দিতে।
•    ইদানিং তোমার মধ্যে কিছুটা অন্যরকম ভাব দেখছি। কোনো চিন্তা থেকে এমন হচ্ছে?
•    তুমি আসলে তোমার মধ্যে আজকাল নেই, তাই আমি এই কথাগুলো জিজ্ঞাসা করছি।

যে প্রশ্ন করবেন
•    কখন থেকে এমন অনুভূতি শুরু হলো।
•    কী হয়েছে যে কারণে এমন অনুভূতি শুরু হলো।
•    এখন আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?
•    তুমি কি কারও সাহায্য নেওয়ার কথা কিছু ভাবছো?

যা বললে উপকার হবে
•    তুমি একা নও, আমি তোমার সঙ্গে আছি।
•    তুমি হয়তো এখন বিশ্বাস করতে পারবে না, কিন্তু একসময় তোমার অনুভূতি পরিবর্তন হবে।
•    আমি হয়তো তোমার সব কষ্ট-অনুভূতি ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।
•    যখন তুমি আর পারবে না, আমাকে ডেকো আমি তোমাকে ধরে রাখবো।

যা করা যেতে পারে
•    বুঝতে দেওয়া আপনি তাকে গুরুত্ব দেন, তিনি একা নন।
•    তাকে কথা বলতে দিন। যত কথা বলবেন, তত তার অবদমিত অনুভূতিগুলো প্রকাশ পাবে।
•    তার প্রতি সহানুভূতিশীল হোন।
•    তাকে আশার বাণী শোনান।
•    তার মধ্যে সাহস সঞ্চার করুন।
•    খোলাখুলি প্রশ্ন করুন, তিনি কী আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?

যা করবেন না
•    তর্ক করবেন না।
•    তাকে সঠিক-বেঠিক বোঝাবেন না।
•    তার আত্মহত্যা ভাবনা থেকে আপনি যে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন, সেটি বুঝতে দেবেন না।
•    আপনি কথাটি গোপন রাখবার প্রতিশ্রুতি দেবেন না। আবশ্যই এই চিন্তাটি তার কাছের মানুষদের জানান।

ফিরে আসি আবার সেই লেখাগুলোতে
সত্য যে ‘………জীবনে মাঝে মাঝে বৈঠা উঠিয়ে নিতে হয় আর সঠিক বাতাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আরও বুঝলাম যে, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকলে বাঁচা যায় না, নির্ভয়ে বাঁচার নামই বাঁচা। ’

আর তাইতো আত্মহত্যা কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না। জীবনে হতাশা থাকবে, কিন্তু একে জয় করতে হবে। কেননা, লাইফ ইজ বিউটিফুল। জয়তু জীবন।

প্রফেসর ডা. সানজিদা শাহরিয়া
কাউন্সিলর, বিসিআর পেইন অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৫
এটি/এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।